#বেলা_শেষে – ২
[০১]
আমার দু-হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আমার সামনে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে অভি ভাইয়া। চোখ মুখে তার ক্রোধ উপছে পরছে। অতিমাত্রায় আক্রোশের কারনে তার ব্রাউন কালারের চক্ষুদ্বয় রক্তিম আকার ধারন করেছে। অভি ভাইয়ার এমন ক্রোধান্বিত রুপ দেখে ভয়ে আমার প্রান যায় যায় অবস্থা। এখন নিজের উপরই বেশ রাগ লাগছে আমার। এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতাম। ভীতু চোখে রুমের চারিপাশটাতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। যদি মামনি আসে তাহলে ভাইয়ার হাত থেকে রেহাই পাবো। নাহলে আজ আমি শেষ। নাহ রুমে কেও নেই। এই সময় মামনি আমার রুমে আসবে বলেও মনে হয় না। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বললাম,
-আ-আমার লাগছে, আমাকে ছাড়ো ভাইয়া।
আমার কথা ভাইয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই সে আরো জোড়ে আমার হাত চেঁপে ধরলো। এতে আমি ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠলাম। তাতেও ভাইয়া আমার প্রতি কোন সহানুভূতি হলো না। সে আমাকে দেয়ালের সাথে আরো জোড়ে চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলল,
– হাও ডেয়ার ইউ। তোর সাহস হয় কি করে আমার সাথে এমনটা করার।
-এবারের মতো আমাকে ছেড়ে দাও ভাইয়া। আমি আর কখনো এমনটা করবো না। নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম আমি। আমার কথা শুনে ভাইয়া দু-চোখ বন্ধকরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় বড় করে শ্বাস নিলো কয়েকবার। তারপর বলল,
-এই মিথ্যে প্রতিঞ্জা তুই রোজ-ই করিস।
-এবার আর প্রমিস ব্রেক করবো না। আমাকে ছেড়ে দাও। করুন চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। ভাইয়ার সাথে আমার দৃষ্টির সংযোগ হতেই ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এবার যেন আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। বুকের উপর হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নিলাম কয়েকবার। তারপর অধরে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– থ্যাংকু, থ্যাংকু ভাইয়া। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালাম চলে আসার জন্যে। আর তখন ভাইয়া আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে বলল,
– তোর সাহস দিনদিন বেড়েই চলেছে মিষ্টি। আর এই সব হয়েছে শুধু মাত্র আমার আম্মুর জন্যে। আম্মু তোকে এতটাই আদর দিয়েছে যে তুই আস্ত একটা বাদুড় তৈরী হয়েছিস। নে এবার কান ধর। কি হলো ধর কানে। ধমকের সুরে বলল ভাইয়া। আমি শুকনো ঢোক গিলে মিটমিট করে ভাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ভাইয়া আমার চাহনি উপেক্ষা করে বলে উঠল,
– তোকে কানে ধরতে বলেছি মিষ্টি। কান ধরবি নাকি অন্য কোন শাস্তির ব্যবস্থা করব।
-না। তড়িৎগতিতে জবাব দিলাম আমি। তারপর দুহাতে কান ধরে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। এবার ভাইয়া আমাকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বলল,
-পা উঁচু করে দাঁড়া। কানে ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবি এক ঘন্টা। অভি ভাইয়া আমার বিছানায় গিয়ে বসলো।তারপর সে দেয়ালে সাঁটানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
-ইউর টাইম স্টার্ট ফ্রম নাও। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল এদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? পা উঁচু করে দাঁড়া। শেষ কথাটা ধমকের সুরে বললো সে।
-এক ঘন্টা বেশী হয়ে গেল না। আমি এক পা উচু করে দাড়িয়ে বললাম। আমার কথা ভাইয়ের কর্ণপাত হলো না। সে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইলে গেমস খেলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আমি দুঃখ ভরা মন নিয়ে ছলছল নয়নে তাকালাম টেবিলের উপর পড়ে থাকা কফির মগের দিকে। মগে এখনো লিপস্টিকের দাগ স্পষ্ট। শুকনো একটা ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর ভাবতে লাগলাম আজ সকালের কথা।
খন্দকার জুবায়ের হাসান অভি। নামের মতোই মানুষটা বেশ রাজকীয় চমৎকার বিলাসবহুল ও পরিপাটি। তার সবকিছুই যেন পারফেক্ট হওয়া চাই। বুয়েট কলেজে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং পড়াশুনা করার পাশাপাশি একজন ব্লগার সে। তার ফ্যান ফলোয়ার কয়েক মিলিয়ন। শহরের সকল মেয়ের ক্রাশ বয় অভি। ক্রশ তো হবেই ভাইয়া তো এখন সেলিব্রেটি।সেলিব্রেটির মতোই তার চলা ফেলা। ভাইয়াকে রাস্তায় দেখকে মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকে। আর থাকবেই না কেন? এমন সুদর্শন ছেলের দেখা মেলা বড় দায়। পাচ ফুঁট নয় ইন্চি লম্বায় উজ্জল শ্যামবর্ণের এর ছেলের ব্রাউন কলারের চোখের দিকে তাকালেই মেয়েরা ফিদা। আর অভি ভাইয়াও কম কিসে। মেয়েদের সাথে কি সুন্দর হেসে কথা বলে। আর আমার কাছে অভি একটা উটকো ঝমেলা ছাড়া আর কিছুই না। আমার দুঃখ কষ্ঠ কান্নার একমাত্র কারন এই অভি। সেই ছোট বেলা থেকে অভি ভাইয়া আমাকে সহ্য করতে পারে না। বিশেষকরে মামনি যখন আমাকে আদর করে তখন ভাইয়া এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মনে হয় আমাকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে। আব্বু আম্মু আর আমার ছোট ভাই স্পর্শ আমার নানার বাড়ি গিয়েছে। সামনেই আমার এইচএসসি এক্সাম তাই আমাকে মামনিদের বাসায় রেখে গেছে। আমি আবার পড়া শুনায় একদম ফাঁকিবাজ। এই নিয়ে দুইবার এইচএসসি দিবো। এটা নিয়ে আমাকে কম কথা শুনায় না ওই জলহস্তী অভি।
মামনি সকলের জন্যে ব্রেকফাস্ট রেডি করছে তখন আমি ড্রয়িংরুমে পা রাখি। আর আমাকে দেখেই মামনি বলে উঠে,
-ঘুম ভাংছে তোর। গিয়ে দেখতো অভির ঘুম ভাংছে কি না।
-সকাল সকাল তোমার ওই হিটলার ছেলের মুখ দেখে আমার দিনটা মাটি করার কোন ইচ্ছেই নেই মামনি। আর ভাইয়ার ঘুম ভাংলে সে নিজেই চলে আসবে। বলেই সুফায় বসে খবরের কাগজ হাতে নিলাম। আর তখনি আরাভ আংকেল নিচে আসলেন। সেও এসে আমার পাশে বসে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে মামনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-ভূমি আমার চা-টা দাও।
-হ্যাঁ আসছি। বলেই মামনি আরাভ আংকেল কে চা দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। তারপর অভি হিটলারের জন্যে কফি বানিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
-অভিকে কফিটা দিয়ে আয়।
আমি কফির মগের দিকে কিছুক্ষণ দৃষ্টি রেখে মামনির মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললাম। তারপর বললাম,
-আ- আমি কেন?? লাকিকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমার এমন জড়ানো কথা শুনে মামনি ছোট ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকায় তারপর বলেন,
-আবার কোন কান্ড করেছিস।
-না – না তো। আমি আবার কি করবো।
-তাহলে যা অভিকে কফিটা দিয়ে আয়।
আমি ইনোসেন্ট ফেস করে আরাভ আংকেলের দিকে তাকালাম। আংকেন তখন খবরের কাগজ রেখে চায়ের কাপে অধরোষ্ঠ ঠেকিয়ে চা-য়ে চুমুক দিয়ে মামনির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
-আহা ভূমি কেন মেয়েটাকে জোড় করছো বলোতো। ও যখন যেতে চাইছে না তাহলে যাবে না। তুমি বরং লাকিকে দিয়ে কফিটা পাঠিয়ে দাও। লাকি এই লাকি।
-চাচা আমি আইছি কন কি কইবেন? আরাভের সামনে দাঁড়িয়ে মাথাটা হালকা নিচের দিকে ঝুকে বলল লাকি।
-অভির কফিটা দিয়ে আয়। আর ওকে বলবি তাড়াতাড়ি নিচে আসতে।
-আইচ্ছা চাচা। লাকি কফির মগ নিয়ে চলে যায় হিটলারের রুমে। মামনিও রান্নাঘরে চলে যায়। আমি আমার রুমে এসে দরজা আটকিয়ে ভেতরে জড়সড় হয়ে বসে থাকি।
এদিকে,
অভি এখনো ঘুমিয়ে আছে। লাকি এসে ওর রুমে কফির মগ রেখে অভিকে ডেকে চলে যায়। অভি কোনরকমে উঠে কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে নিজের অধরোষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয়। কয়েকবার কফির মগে চুমুক দেওয়ার পর অভির চোখ আটকে যায় কফির মগে। অভি যেখানে তার অধর ঠেকাচ্ছে ঠিক সেই খানে লিপস্টিকের দাগ বসেগেছে।কফির মগে লিপস্টিকের দাগ দেখে বড়সড় শক খায় অভি। দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর যা দেখে তাতে তার রাগ মাথায় উঠে বসে।অভির ঠোটে গাঢ় করে লিপস্টিক দেওয়া। কালিদিয়ে গোঁফ বসানো। ভ্রুতেও কালি দেওয়া মোটা করে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের হাতের শক্তমুঠি করে নেয় অভি। ওর আর বুঝতে বাকি থাকে এটা কাজ। এই বাড়িতে যে একটা উটকো ঝামেলা রয়েছে সে ছাড়া এই কাজটা কেও করবে না। অভি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সে ড্রয়িংরুমে পা রাখে কিন্ত সেখানে আমাকে দেখতে পায় না। তাই অভি ভাইয়া দ্রুত চলে আমার রুমের সামনে কিন্তু ভিতরে ডুকতে পারে না। ডুকবে কি করে আমিতো দরজা লক করে রেখেছি। ভাইয়া দরজার ওপাশ থেকে জোড়ে চিৎকার করে আমাকে ডেকে চলেছে বাট আমি কোন রিসপন্স করছি না। তাই ভাইয়া বলল,
-দেখ মিষ্টি ভালোভাবে বলছি দরজা খোল। না হলে আমি দরজা ভেঙে রুমে ডুকবো তখন কিন্ত শাস্তিটা আরো ডাবল হবে। ডাবল শাস্তির কথা শুনে আমি ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলে দেই। ভীতু চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-কি-কি হয়েছে ভাইয়া। কিসের শাস্তির দিবে তুমি আমাকে??
আমার বলার সাথে সাথেই ভাইয়া আমার দুই বাহু চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো। তারপর দাত কটমট করে বলল,
-আমাকে জোঁকার সাজিয়েছিস কেন??
-জোঁকার সেজে তোমাকে কেমন লাগে সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম। বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম আমি। আর ভাইয়া তার ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার উপর।
– এই নিয়ে কতোবার পা বদল করলি। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল অভি ভাইয়া। আমি মাত্রই পা চেঞ্জ করে দাঁড়িয়েছি। অভি ভাইয়ার কথা শুনে আমি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালাম। সে তো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গেইম খেলছে তাহলে বুঝলো কি করে আমি পা বদল করছি। আমার এমন চাহনি দেখে মহাশয় উঠে টেনেটুনে টিশার্ট ঠিক করে আমার সমনে এসে দাঁড়িয়ে ফটাফট আমার কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তারপর অধরোষ্ঠ চেপো হেসে বলল,
-এই পিকগুলো আমার পেজে আপলোড করলে কয়েক মিলিয়ন লাইক পাবো। দুই ঠোট প্রসারিত করে হাসলো ভাইয়া। তারপর সে চলে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকালো। দুই হাত পকেটে গুজে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-মাত্র বিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছিস। আরো চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবি। আমার কথা যদি অমান্য করেছিস তাহলে, তর্জনী তুলল আমার উপর। আমি এখনো হা করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সে যতক্ষণ আমার দৃষ্টির আগোচরে না হল ততক্ষণ আমি তাকিয়েই ছিলাম। তারপর ভাইয়া চলে যেতেই আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিলাম।
চলবে,,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।