#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
৬.
তন্দ্রা বারবার ঘড়ি দেখছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের পথে মহাসড়ক,অথচ সাদাফের খবর নেই! আজকে সাদাফের আসার কথা ছিল মেয়েকে নিয়ে। তন্দ্রা আর সাদাফের ডিভোর্স হয়নি কিন্তু দু’জনেই আলাদা থাকে। যেকোনো মুহূর্তে তাদের মধ্যকার এই বন্ধনটুকুও শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হচ্ছে না একমাত্র মেয়ে জারিফার জন্য। জারিফা যেন তাদের দু’জনকে পুনরায় মিলিয়ে দেওয়ার সেতুবন্ধন। প্রচন্ড রাগী এবং গম্ভীর সাদাফের প্রতি ত্যক্তবিরক্ত হয়েই ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে চলে এসেছিল তন্দ্রা। তন্দ্রার বড়বোন পরামর্শ দিলো, জারিফার কথা ভেবে মানিয়ে নে। নইলে কয়েক মাস আলাদা থাক দু’জন দু’জনের থেকে। দেখবি,এতে একে অপরের গুরুত্ব ও মর্মার্থ কিছুটা হলেও বুঝতে পারবি। আবার একত্র হওয়ার জন্য মনটা আকুপাকু করবে। তন্দ্রা দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিলো। দুইজন দূরত্ব বাড়িয়ে একে অপরকে সময় বের করে দিলো। জারিফাকে তন্দ্রা তার নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু বাবার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা তা হতে দেয়নি। বাবা’কে ছেড়ে এক মিনিট ও দূরে থাকতে রাজী নয় সে। তাই বাধ্য হয়ে তন্দ্রাকেই নিজের বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল মেয়ে ছাড়া। মাঝে মাঝে সে ফোন দেয় সাদাফকে,মেয়ের সাথে কথা বলে। মনটা খুব ছুটে গেলে মেয়েকে নিয়ে আসতে বলে কাছের কোনো রেস্টুরেন্টে, যেখানে বসে পলকহীন চোখে মেয়েকে দেখে সে! আজকেও তার মনটা ভীষণ ভাবে ছুটে গিয়েছে জারিফাকে এক নজর দেখার আশায়! তাই তো সকালে ফোন করে বিকেলে আসতে বলেছে এই জায়গায়। সাদাফ প্রত্যুত্তরে বলেছিল, আসবে। অথচ দেখো! এতক্ষণ হয়ে গেল আসার নামগন্ধও নেই! তন্দ্রা ঠোঁট বাকিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সাদাফের নাম্বারে কল দিলো। তিনবার রিং হওয়ার পর সাদাফ ফোনটা কেটে দিলো। তন্দ্রা দ্রুত আশেপাশে তাকালো। কাছাকাছি থাকলে সাদাফ এই কাজটা করে। ফোন কেটে দেয়, পুরোনো অভ্যাস ওর, তন্দ্রা জানে। সেকেন্ড কতকের মাথায়ই সাদাফকে আসতে দেখা গেল। সাদা শার্ট পরা নরম সরম বোকা বোকা চেহারার মানুষটা যে কী পরিমাণ রাগী- তা তন্দ্রা ছাড়া আর কেউ জানে না বোধহয়! তন্দ্রার হুট করে কী যে হলো। ভীষণ কান্না পেল, ভীষণ… পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হলেও আট বছরের বিবাহিত জীবন কম নয়! আট দিন একই ঘরে একটি মানুষের সাথে থাকলে তার প্রতি মায়া হয়ে যায়, আর এ তো আট বছর! কতগুলো দিন,সপ্তাহ,মাস! তন্দ্রা নিচু হয়ে চোখের জল লুকোয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, সাদাফকে বলবে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। অনেক তো হলো আলাদা থাকা! আর দরকার নেই। মেয়েটাও মা ছাড়া বড় হচ্ছে বিনা কারণে!
যেন চোখে কিছু পড়েছে,এমন ভণিতায় আঙুলের ডগা দিয়ে চোখ মোছে তন্দ্রা। মাথা তুলে তাকাতে তাকাতে দেখে সাদাফ সামনের চেয়ারটা টেনে বসেছে। তন্দ্রা অবাক হয়, জারিফা তো আসেনি সঙ্গে! সে কোথায়?
তন্দ্রা বলল, ‘আমার মেয়ে কোথায়?’
‘ও আসেনি।’ চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী গম্ভীর গলায় জবাব দেয় সাদাফ।
‘আসেনি মানে! কোথায় ও?’
‘বাসাতেই। ঘুমাচ্ছে। অনেক ডেকেছি, ওঠাতে পারেনি। তাই আর জোর করিনি।’
তন্দ্রার মন খারাপ হলো। নিজেকে বোঝালো সে,কী করার আর! একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘ওহ! আম্মার কাছে রেখে এসেছো?’
‘না, রূপ আসছে তো বাসায়। রূপের সাথেই আছে।’
‘রূপ?’ ভ্রু কুঁচকালো তন্দ্রা।
সাদাফ মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হুম।’
‘ওর না বিয়ে হইছে দুইদিন আগে! জামাই নিয়ে বেড়াতে আসছে নাকী?’
সাদাফ মাথা দোলায় এদিক ওদিক। বায়ুতে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলে, ‘ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কাগজে কলমে না,মুখে মুখে।’
তন্দ্রার মনে হলো তার মাথার উপর কয়েকটি বজ্রপাত পড়লো ধিম করে। হতবাক কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল, ‘বলো কী! ডিভোর্স মানে! দুদিন আগে বিয়ে হলো, আর এরই মাঝে ডিভোর্স? কী হইছে। আমাকে খুলে বলো প্লিজ।’
সাদাফ বলতে গিয়েও বলল না। ভার গলায় বলল, ‘বাসায় ফোন করে আম্মার থেকে জেনে নিও। আমি এতকিছু বলতে পারবে না।’
‘কেন পারবে না?’
‘ইচ্ছে হচ্ছে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবো নাকী?’
‘নিজের স্ত্রীকে একটা বিষয় জানাবা,এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছার কী হলো?’
‘কে স্ত্রী? তুমি? তোমার প্রতি আগের মতো টান টা আমার আর অনুভব হয় না তন্দ্রা। তোমাকে শুধু জারিফার মা মনে হয়, আমার স্ত্রী না।’ অন্যরকম গলায় কথাটি বলে দৃষ্টি অন্যত্র সরায় সাদাফ, তন্দ্রা স্তব্ধ হয়ে তাকায়। কী বলল! তন্দ্রাকে তার স্ত্রী মনে হয় না! মাত্র কয়েক মাস সাদাফের থেকে দূরে দূরে থেকেছে, কোথায় ভেবেছিল সাদাফ তাকে মিস করবে, নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তন্দ্রা কী চায় বুঝবে। তন্দ্রাকে আপন করে ফিরিয়ে নিবে। তন্দ্রা তো এখন প্রতিটি রাত ছটফট করে সাদাফের একটু উষ্ণতার জন্য!
তন্দ্রার গলা ধরে আসে, কষ্ট হয়, বুঝতে দিলো না সাদাফকে। বলল, ‘আমার প্রতি তোমার রাগটা এখনো কমেনি, না?’
সাদাফ তাকাল, কয়েক সেকেন্ডের অপলক নয়ন, তারপর হঠাৎ কঠিন গলাতে বলল, ‘আপনের উপর রাগ রাখা যায়,পরের উপর না। তোমার প্রতি আর কিছুই আসে না আমার তন্দ্রা! না রাগ, না অভিমান, আর না ভালোবাসা। তুমি কয়েক মাসের জন্য আলাদা হয়েছো কিন্তু আমার মনে হচ্ছে,এই আলাদা হওয়াই আমাদের শেষ এবং আজন্ম আলাদা হওয়া। আর কোনোদিন তোমাকে ফিরিয়ে নিবো কীনা জানি না।’
***
সবাই ভাবছে আমার বোধহয় খুব মন খারাপ। হয়তো ঘরের দরজা চাপিয়ে আমি অশ্রুপাত করছি। অথচ আমার মন একদমই খারাপ না। আমি নিজেও জানি না আমার কেমন লাগছে অথবা কেমন লাগা উচিত! আমার কী কাঁদা উচিত নাকী এরকম একটা জায়গা থেকে মুক্তি পেয়েছি- তা ভেবে খুশি হওয়া উচিত? ভীষণ টাফ ব্যাপার! তারচেয়েও টাফ হলো সবাইকে এটা বিশ্বাস করানো। আমি যখন বললাম, প্রহর সাহেবকে জেলের ভাত খাওয়াতে চাই,তারপর ভীষণ হাঙ্গামা হলো। প্রহর সাহেব আর অধরা মিলে তক্ষুনি তোলপাড় করে আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারা যদি পালাতে চায়,পালাক। খাঁচায় আঁটক থাকা পাখি আর খুঁজে খুঁজে বন থেকে ধরে আনা পাখির মাঝে মজাটাই আলাদা। আমি চাই তারা পালানোর চেষ্টা করুক এবং আমি তখনই তাদেরকে গ্রেফতার করাই। কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে যাবে ব্যস! আর কিচ্ছু চাই না আমি,কিচ্ছু না! ভার্সিটিতে পড়া হয়নি,কিন্তু এখন ভাবছি পড়াশোনা টা আবার কন্টিনিউ করব। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আজকে যে আমাকে ছুঁড়ে ফেলল একদিন যেন সে-ই আমার জন্য আফসোস করে। আমি যেন কোনো এক ব্যস্ত বিকেলের অবসরে কফি মগ হাতে আজকের এই দিনটির কথা মনে করে ঠোঁটে হাসি ফুঁটাতে পারি- এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য এখন। প্রহর সাহেব আর অধরা বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বড় ভাইয়া ও আব্বাকে নিয়ে আমি থানায় গিয়ে মামলা করে এসেছি। প্রহর সাহেবকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে,তার নাম্বার, ডিটেইলস যাবতীয় সব দিয়ে এসেছি। অধরার ব্যাপারটাও সুন্দর মতো উল্লেখ করে এসেছি। সেই সাথে আব্বা আবার কিছু ক্যাশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ অফিসার ভীষণ গদগদ কণ্ঠে বলেছেন, ‘আপনারা বাসায় যান,রাতের ভেতর আপডেট জানাবো।’
থানা থেকে বের হয়ে দেখি বড় কাকা দাদীকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে রিকশা করে। আরেক রিকশায় সাদাফ ভাই,আমাদের দেখে রিকশা থামিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে আমাকে কাকাদের বাসায় নিয়ে এলেন তারাই। আমি আসতে চাইনি, কাকা অনেক জোরাজুরি করলেন। দাদীও অনুরোধ করলেন,তাই আর ফেলতে পারলাম না। কিন্তু এখানে এসে অবাক হচ্ছি বড় কাকীর ব্যবহার দেখে। আমি যেন মানুষ না,কোনো ডাইনী অথবা পিশাচিনী! আমার সঙ্গে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছেন। এই ডিভোর্সের পেছনে নাকী আমারই দোষ আছে কোনো,নইলে কেউ বউ রেখে কেন অন্য মেয়েকে চাইবে! আমাকে ছোঁয়ারও রুচি হয়নি নিশ্চয়ই তার,এর মানে আমার ভেতরেই সমস্যা- আরও অনেক কথা বলেছেন চাচী। শেষতক দাদীর ধমকানীতে মুখ বুজেছেন। আমার এই বাড়িতে পা রাখাটা ঠিক হয়নি, এবার বুঝতে পারছি আমি। মনটা যদি খারাপ হয়েই থাকে তবে চাচীর কারণে খারাপ। প্রহর সাহেবকে নিয়ে আমি আর ভাবছি না যে তার জন্য মন খারাপ হবে! আমি বাঁচতে চাই, নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে চাই। একজনের সাথে সংসার হলো না সেই দুঃখে নিজের জীবন দিয়ে দেওয়ার মতো বোকা আমি নই। আর সারাজীবন সমাজের লাঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করার মতো অপদার্থও নই। যে যোগ্যতা আছে তাই দিয়ে নিজের পায়ে একদিন দাঁড়াবোই দাঁড়াবো,তাতে আমার পাশে কেউ থাকুক বা না থাকুক, ইনশাআল্লাহ।
আব্বার দেওয়া এক্সট্রা ক্যাশ বোধহয় ভালো কাজেই লেগেছে। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না,সন্ধ্যার পর পরই খবর হলো, প্রহর সাহেবকে তার প্রেমিকা সহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
চলবে…