মেঘের উল্টোপিঠ পর্ব -১২

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
[পর্ব-১২]

নিশিরাতের অন্তিমভাগ! চারপাশ আঁধারের মাঝে বিলীন। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শুভ্র ফালি আলোর আগমন ঘটবে খানিকবাদে। তপ্তশ্বাস ফেলে কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে পায়চারিতে যখন আমি বিভোর তখন ফোনের রিংটোনের কর্কশ ধ্বনি একগাদা বিরক্তি তৈরি করে অন্তরালে। ফোন রিসিভ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকতেও ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাই সেদিকে। এতোরাতে ফোন? কোনো বিপদ হলোনা তো?

মেরুন রঙের বেডশিট হতে মুঠোফোন হাতে তুলতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা ‘ Purbo ‘ নামটা নিভৃতে আমারে কিয়ৎ পরিমাণ ধুকধুকানির সৃষ্টি করলো। পূর্বের কল! তাও এতো রাতে? চট করে রিসিভ করে ফোন কানে লাগাতেই পূর্ব ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ ঘুম বাদ দিয়ে বেলকনিতে পায়চারি করছো কেনো? ঘুমাও জলদি! মাথা ব্যাথা করবে নয়তো। ‘

চমকে গিয়ে থতমত খেয়ে যাই আমি। এই লোক জানলো কি করে আমি ঘুম বাদ দিয়ে বেলকনিতে হাটাহাটি করছি? অন্তরালে ধাতস্থ হয়ে নিমগ্ন হয়ে বললাম,

‘ আপনি জানলেন কি করে আমি ঘুম বাদ দিয়ে বেলকনিতে পায়চারি করছি?’

‘ একবার বেলকনিতে এসে নিচে তাকাও তো! ‘

চটজলদি হেঁটে বেলকনিতে পৌঁছে নিচে দৃষ্টি দেয়ার পর দৃশ্যমান হয় পূর্বের মুখশ্রী। তিনি তার ধূসর রঙের গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। এক পা তার মাটি স্পর্শ! অন্য পা গাড়িতে লাগিয়ে রেখেছে উঁচু করে। বলা চলে একটু ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার গভীর দৃষ্টিপাত ঠিক আমাতে নিবদ্ধ। সরু ভাবে! আমি হতভম্ব হয়ে বলে উঠলাম,

‘ আপনি এতো রাতে আমার বাসার নিচে কি করছেন?’

‘ নান অফ ইউর বিজনেস। নিচে আসো ফাস্ট! ‘

‘ মাথা খারাপ নাকি? এতো রাতে নিচে আসতে যাবো কেনো? লোকে দেখলে কি বলবে?কয়জনই বা জানে বলুনতো আমার, আপনার আকদের কথা?’

কন্ঠে আমার উদ্বিগ্নতা! একটু সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা যাতে আমার মুখভাব, কন্ঠস্বর পর্যবেক্ষণ করে পূর্ব কেটে পড়ে এখান থেকে। এতো রাতে তাকে এভাবে কেও দেখে ফেললে মানুষ নিশ্চয়ই চুপ থাকবে না! ভোরের আলো ফুটতেই পাড়া – পরশী, পাশের বাসার আন্টিদের মতো সাংবাদিক দ্বারা রটে যাবে অযৌক্তিকমূলক কথাবার্তা। পূর্ব আমার প্রতিত্তুরে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলেন। এটা আমি পাঁচ তলার বেলকনি হতে তার চেহারার হাবভাবে ঢের বুঝতে পারলাম। কন্ঠে গম্ভীর’তা এনে তিনি বললেন,

‘ তুমি কি আসবে নাকি আমি ওপরে এসে সবার সামনে তোমায় কোলে তুলে নিয়ে আসবো? আমি আমার কথার অবাধ্যতা মানতে পারিনা। এটা নিশ্চয়ই তুমি ভালো করে জানো। আমার কথার অবাধ্য হলে আমি ঠিক কি, কি করতে পারি তো নিশ্চিত ভালো করেই জানো। যেটা বলেছি সেটা করাও আমার জন্য তেমন কঠিন কাজ না। ‘

ভীষণ বিরক্তিতে ওষ্ঠাধর ‘ চ’ আকৃতির করতে গিয়েই থেমে গেলাম। পূর্ব ফোন কেটে দিয়েছেন। ইশারার মাধ্যমে তাড়া দিচ্ছেন দ্রুত নিচে আসতে। লোকটা ত্যাড়া! বড্ড অসভ্য ধরনের। যতসব উল্টো কর্ম করার রেকর্ড তা বুঝি তার দ্বারাই সম্ভব! পরনের পোশাক পাল্টে পরিপাটি হয়ে শুভ্র রঙের ওড়না দ্বারা নিজেকে আবেষ্ঠীত করে নেমে পড়ি! বাসায় সবাই ঘুমে। মেইন ডোর ওয়ার্ড লক সিস্টেমে লক করে লিফট দিয়ে নিচে এসে পড়ি। পূর্ব তখনও একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। হাতের ইশারায় তিনি বললেন তার কাছে আসতে!

নিঃশব্দে পা ফেলে পূর্বের নিকট পৌঁছে চোখমুখ বিরক্তিতে কুঁচকে বলে উঠি,

‘ কি সমস্যা? এতো রাতে নিচে কেনো ডাকলেন? ‘

পূর্ব নিরুত্তর! সে তার ডান হাত এগিয়ে আমার ডান হাত বেশ জোরেসোরে চেপে ধরলেন। এতোটা জোরে ধরেছে একটা হাড্ডিও আস্ত থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা। ব্যাথায় কুকরে চোখে পানি আসার জোগান! কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললাম,

‘ ক..কি করছেন? ব্যাথা পাচ্ছি আমি। ‘

হাতের বাঁধন কোমল করলেন পূর্ব তবুও হাত ছাড়লেন না। তাকে এ মূর্হতে আমার কাছে অচেনা ঠেকলো! রাশভারী মুখশ্রী! চোখে ঘৃনাতুর দৃষ্টি। ক্ষোভে পুষে রাখা যেনো অন্তরালে। থমথমে কন্ঠে তিনি বললেন,

‘ খেয়াল করিনি। সরি! ডেকেছি কাজ আছে তাই। আসো আমার সাথে। ‘

হাত আঁকড়ে নিয়েই পূর্ব সামনে এগোচ্ছেন। নিশুতি রাত! এই রাশভারী মানুষটার সাথে হাঁটতে মন্দ লাগছে না কিন্তু নিভৃতে যে কিয়ৎ ভয়! পূর্ব অমন ঘৃনাতুর দৃষ্টি কেনো দিলেন?পূর্বের দৃষ্টি সামনে। নিকষ কালো আঁধারির মাঝে তার আঁখিজোড়া এঁটে সেঁটে আছে। শেষে আমি কৃত্রিম ভীতি নিয়ে বললাম,

‘ আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বলুনতো? এই নিস্তব্ধ, জনমানবহীন রোডে আমার সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করবেন না তো? আই মিন, মেরে ফেলা টাইপ? ছুরিকাঘাত করে সোজা ওপরে পাঠানোর ফন্দি আঁটছেন বুঝি?’

পূর্ব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। তেতে উঠে বললেন,

‘ সর্বদা উদ্ভট ভাবনা! এমন মনে হওয়ার কারণ?তাও হুট করে? অলওয়েজ তো তোমার উদ্ভট ভাবনা একটা রিজনকে ঘিরেই হয়ে থাকে। তো বলো! এবারকার রিজনটা কি?’

‘ আপনার ঘৃণ্যমান দৃষ্টি! ‘

পূর্ব তার ওষ্ঠাধর গোল গোল করে বলল, ‘ হোয়াট?’

‘ জি! নিচে আসার পর আপনি আমায় ঘৃণা টাইপ দৃষ্টি দিয়েছিলেন। রেগে ছিলেন অনেকটা। যেনো এখনি তুলে আছাড় দিবেন। সেই হিসেবেই এটা বলেছি। ‘

‘ ফালতু লজিক! এই চাহনি তোমার জন্য নয় বরং অন্য কারো জন্য বরাদ্দ ছিলো ষ্টুপিড! ‘

পূর্ব আমার হাত ছেড়ে সামনের দিকে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। তার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গিয়ে দুই হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে শুরু করলাম। এই মানব এতো দ্রুত হাঁটে? মাবুদ! তাল মেলানো বেশ কষ্টকর! সামনের দিকে ঠিক মতো খেয়াল না করে হাঁটা ইটের ক্ষুদ্র কোণায় পা আঁটকে পড়তে নিলেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত বেশ পরিপক্ক রূপে আমায় আগলে নেয়। মাথা তুলে তাকাতে দৃশ্যমান হলো পূর্বকে। সে বিড়বিড় করে বলল,

‘ ডাফার গার্ল! কবে যে বড় হবে এই মেয়ে। ‘

হাতদুটো আমার ছেড়ে সামনে চললেন তিনি। তবে এবার পুনরায় তিনি আমার একহাত কোমলভাবে আঁকড়ে নিয়েছেন।

দমকা হাওয়া! নির্জন, নিঃশব্দহীন রাত। পূর্ণিমার স্নিগ্ধ আলো। সব মিলিয়ে পূর্বের সাথে এই রাতে, এই পরিবেশে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। ফিরে যাওয়ার কোনো তাড়া মস্তিষ্ক দিলো না। বরং সে শান্ত! অনুভব করতে বলছে যেনো এই চমৎকার প্রহরটাকে।

_______

দরজার ভারী কড়াঘাতে চটপট আঁখি জোড়া খুলে চারপাশে তাকাই। আঁখি জোড়া হতে ঘুম যায়নি এখনো। কাল একদম ভোরের আগ দিয়ে বাসায় ফিরেছি। আর পূর্বের সাথে যাওয়ার আগে তো ঘুমই আসেনি। আপুর রেষ্টুরেন্টে বলা ফিসফিসিয়ে কথা গুলো ঘুমোতে দেয়নি।

উঠে বসে দরজা খুলতেই ফের আপির দেখা মিললো। তাকে দেখে অন্তরালে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও বাহ্যিক দিক দিয়ে কৃত্রিম হেঁসে বলি,

‘ কিছু বলবে আপি?’

আপি আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেও খানিক হাসলেন। ঢের দৃশ্যমান হলো সে জোরপূর্বক হাসছে, মিষ্টি কন্ঠে বলল,

‘ আজ থেকে তোর ক্লাস শুরু। মনে আছে?জলদি রেডি হ! মা টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়েছে। ‘

আপিকে প্রতিত্তুরে ‘ আসছি ‘ বলে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেই। দিবা আপু নিশ্চিত মনে মনে নতুন কোনো ফন্দি আঁটছে। তার কালকের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু কথা বলছিলো কার সাথে? অদ্ভুত লাগে সবকিছু! যেকোনো উপায়ে হোক সবকিছু জানা দরকার। অতি শীগ্রই!

_______

ক্যাম্পাসে আজ স্টুডেন্টদের আনাগোনা ভুড়ি ভুড়ি! সাদা এপ্রোন ছেড়ে আজ সকলের দেহে শোভা পেয়েছে শাড়ী, পান্জাবি! মেডিকেলে আজ বসন্তের উৎসব! ক্ষনিকের জন্য সাদা এপ্রোন ছেড়ে সবাই নিজেদের পছন্দের রঙে সজ্জিত হয়েছে। সবার রঙিন বেশভূষায় ক্যাম্পাস যেনো জ্বলজ্বল করছে নব্য হাসির সুবাদে।

শাড়ীর আঁচলে পিন আঁটকে নিয়ে শেষবারের মতোন নিজেকে একবার পরোখ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। কিছুক্ষণ হেঁটে সামনে যেতেই অরিন’রা দৌড়ে আসে। অরিন এসেই প্রফুল্লতা নিয়ে বলল,

‘ দোস্ত আজকে ভার্সিটির সবাইকে হার্ট অ্যাটাক করানোর ইচ্ছে আছে নাকি?’

চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে বলে উঠলাম, ‘ মানে? কি বলিস আবোল – তাবোল?’

‘ তোকে আজ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। আমি তো মেয়ে হয়েই নিজে ক্রাশ খেয়েছি। ছেলে হলে এতক্ষণে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম! আর চারপাশ তাকা একটু। ভার্সিটির সব ছেলের মূল কেন্দ্রবিন্দু তুই-ই! ‘

অরিনের বর্তমান বক্তব্য মিথ্যে নয়! আশপাশ অবলোকন করে তার স্পষ্টত অনুমান করতে পারলাম। সকলের চাহনি অস্বস্তিতে ফেলে দিলো আমায়। ইতস্তত বোধ করে নতজানু হতেই ফোনের টুং – টাং ম্যাসেজ আনায় বিব্রতিতে ফেললো। ফোন বের করে চক্ষু সম্মুখে আনতেই দৃশ্যমান হলো পূর্বের ফোন নাম্বার হতে আগত ম্যাসেজ। ম্যাসেজে তিনি লিখেছেন,

‘ ক্যাম্পাসের পিছনে বটতলায় আসো! ‘

অরিনকে বলে তৎক্ষনাৎ বটতলার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ওখানে থাকতে নিজেরেই কেমন তুমুল অস্বস্তি হচ্ছিলো। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছুতেই দেখা মিললো কালো পাঞ্জাবি পরিহিত এক মানবের। উল্টোপিঠ ছিলো সে! সামনের দিকে ঘুরতেই বোধগম্য হলো তিনি ছিলেন পূর্ব। ত্রস্ত পায়ে এসে তিনি বললেন,

‘ পুরো ফাংশনে তুমি আমার সাথে থাকবে। এদিক ওদিক যাওয়া চলবে না। ‘

‘ কিন্তু কেনো?’

‘ আমি বলেছি তাই। আমার সাথে এসো।’

পূর্বের পিছু পিছু টিচার্স রুমে আসতে হলো।তখন সকল টিচার’রা একে অপরের সাথে কুশল আদান – প্রদান করছিলেন। আমায় দেখে ম্লান হেঁসে কিছু সময় কথা বলে একে একে সবাই চলে গেলেন। পূর্ব নির্দিষ্ট এক স্থানে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ইশারায় আমায় তিনি তার নিকট যাওয়ার জন্য ডাকতেই বিনাবাক্য অপচয় করে তার নিকট গেলাম।

পূর্ব কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেশ কিছু ফুলের গহনা বের করলেন। নিরুত্তর থেকে একে একে সব গহনা নির্দিষ্ট স্থানে আমাকে বিনা স্পর্শে পড়িয়ে দিয়ে দুই কদম পিছিয়ে বললেন,

‘ স্নিগ্ধ ফুলে স্নিগ্ধপরী! পার্ফেক্ট কম্বিনেশন। ‘

পূর্ব দরজার দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি পিছন হতে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,

‘ স্নিগ্ধপরী কি আপনি আমায় বললেন?’

পূর্ব জবাব না দিয়ে ‘ ধাম ‘ করে দরজা লাগিয়ে চলে গেলেন। আমি হাল ছাড়ার পাত্রী নই! আজ তাকে করা আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাই পাই করে নিবো।হুহ্! ছুটে তার পিছু নিতেই মাঝপথে বেশ বিকট এক শব্দ হলো। সামনে তাকিয়ে লক্ষ্য করি পূর্ব মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছেন। তার কাঁধ হতে অনবরত রক্ত গলগল করে বের হচ্ছে। কাঁপা হাত উঁচু করে তিনি আমায় সরে যেতে বললেন বারবার। আমি স্তব্ধ! দ্বিতীয় ক্ষণে ঠিক একই শব্দ কর্ণপাত হলো।

আমার কাঁধ এবং হাতে তীব্র ব্যাথা। পূর্বের মতো একই ধাঁচে গুলি করেছে ফের আমাকেও। অনুভূতিহীন হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে যেতেই দৃশ্যমান হলো পূর্ব তার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান চেপে ধরে উঠে আমার দিকে আসার চেষ্টা করছেন। আসতে পারলেন না! বাকিটাও আর আমার দেখা হলো না।আঁখি জোড়া টেনে খোলার প্রয়াসে আমি ব্যার্থ। লম্বা শ্বাস ফেলে চক্ষু যুগল বদ্ধ রূপে রূপান্তর হলো!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here