#বাগান_বিলাস
#লেখিকাঃতামান্না
[পর্বঃএক ও পর্বঃদুই]
“প্রেম কি শরীরের টানে হয়? না মনের টানে হয় গো শৌখিন ভাই?”
শৌখিন বারান্দায় বসে ছিল, হঠাৎ করে সুপ্তির মুখ থেকে এই কথা শুনে শৌখিন যেন আকাশ থেকে পরেছে, এই টুকুনি মেয়ের মুখে এমন কথা। শৌখিন সুপ্তির কাছে এসে দাড়ালো, তারপর বলল –
–” এগুলো কেমন প্রশ্ন সুপ্তি? এত এত প্রশ্ন থাকতে এইসব কেন তোর মনে আসলো?”
–” শৌখিন ভাই বলো না, কেন প্রেম হয়? কেন কারোর মায়ায় পরতে হয়? কেন একজনের প্রেমে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায় হৃদয়? কেন এমন হয়?কেন তুমি সেই আগের মত হাসতে জানোনা? কেন আগের মত গান গেয়ে হাসি মাখা মুখে আমাদের সঙ্গে কথা বলো না?”
–” তোর এখন এগুলো ভাববার সময় নয়! ঘরে যা মন দিয়ে পড়তে বস!”
–” তুমি বলবে না শৌখিন ভাই?”
–” সুপ্তি কি বলেছি তোকে এখন? যা এখান থেকে!
যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলতে আসিস কেন?
নাক টিপলে দুধ বের হয় এত কথা তোর জানতে হবে কেন? পড়ার সময় এখন,প্রেম ভালোবাসা নিয়ে আগ্রহ কমা। আর আমার কাছে কখনোই আসবি না! আমার জীবনটা আর পাচঁটা মানুষের মত স্বাভাবিক নয়। অভাগাদের জীবনে সুখ কম দুঃখ থাকে বেশি! জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবি সারাটা জীবন! বিড়বিড় করে কথাটা বলল সে।”
সুপ্তির চোখ ছলছল হয়ে আছে, শৌখিনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে সে শৌখিনের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
দু-ঝুটি ঝুলিয়ে কাধের ঝুলানো ব্যাগটাকে টেনে দৌড়ে চলে যাওয়া এই কিশোরীটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
শৌখিন বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। বারন্দায় দাড়ানো অবস্থায় অনুভব করতে লাগল তার চোখের পাতায় বৃষ্টির পানিগুলো ঝরে ঝরে পরছে। পাশেই গোলাপি বর্ণের অদ্ভুত সুন্দর কিছু ফুল ফুটে আছে। দেখলে আসল না মনে হলেও এই ফুলের প্রাণ আছে। ফুলগুলো ও ঝরে ঝরে পরছে, শৌখিন ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল –
—” যে ফুলের সূচনায় ছিলে তুমি,
সে ফুল আজও আছে,
শুধু তুমি নেই!
যে প্রেমের বর্ষণে তুমি ছিলে,
সেই বর্ষণ আজও হয়,
কিন্তু তুমি নেই!
তুমি নেই, তুমি নেই!
সবাই আছে আগের মত,
আমার শুধু তুমি নেই!”
-[তামান্না]
__________________________
খোলা আকাশ,এই আকাশের সীমানাটা খুব বড়! কত পাখি, কত প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় এই নীল আকাশ জুড়ে!
আকাশ ও নির্দ্বিধায় তার বিশালাকার বক্ষে এই ক্ষুদ্রকায় প্রাণীগুলোকে নিজের কাছে টেনে নেয়। কখনোই দূরে ঠেলে দেয়না সে।
স্মৃতি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আমায় যদি একটু ঠাই দিতে তোমার এই বিশাল বক্ষে তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? কেন আমায় একা করলে ? এত এত মানুষ,আপন মানুষের ভীড়ে কেন আমি নিঃস্ব? সব থেকেও কেন আমি নিঃস্ব?
স্মৃতি দোলনায় বসে বসে দুলছে, আর তার পুরোনো স্মৃতিগুলো ভাবছে। এমন বসন্তেই এসেছিল তার জীবনে একজন! খুব কাছের একজন! যার ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়েছিল সে। এমন বসন্ত হয়তো স্মৃতির জীবনে বারবার আসবে। বারবার তার জীবনের মোড় ঘুরবে,কিন্তু সেই ভালোবাসার মানুষটি হয়তো তার হবে না!
হয়নি ও সে তার, তারপর বসন্তের সেই প্রথম প্রেমের মানুষটির দূরে চলে যাওয়ার আগেই তাকে সরে যেতে হয়।তার জীবনে আবার এসেছিল আরও একজন ব্যাক্তি ! হ্যা একজন ব্যক্তি হয়তো সাধারণ ভাবে ব্যক্তি হিসেবে ফুটিয়ে তুললেও সে হয়ে যায় অনন্ত ভালোবাসার মানুষ, মানুষের জীবনে ভালোবাসার মানুষগুলো বেশ কাছের হয়। এরা আসতে দেরী করলেও এদের চলে যাওয়ার সময়টা খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসে। এরা সেই প্রকৃতির মানুষ যারা শুধু ভালোবাসা দিয়ে যায়। নিজেদের পাওনা টা মিটিয়ে নিতে পারে না। খুব করে কাছে টেনে আগলে রাখে তো ঠিক, কিন্তু তাদের ভালোবাসার মানুষটি কখনো মূল্য দেয় না।
যেমন সেই ব্যক্তিটি! স্মৃতির জীবনে প্রথম ভালোবাসাটা ছিল সম্পূর্ণ তার দিক থেকে, এরপর যে এসেছে তাকে সে মন থেকে কাছে না টানলেও ঐ ব্যক্তি তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে।
স্মৃতির ভাবনার মাঝেই দুটো নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পেলো সে । স্মৃতির মুখে হাসি ফুটে উঠল, মাথাটা নিচু করতেই দেখল। ছোট ছোট ঝুটিগুলো নাচিয়ে, কোমল হাত জোড়া দিয়ে পরম স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিল তার হাতে। স্মৃতি ছোট্ট পরিটার দিকে তাকিয়ে হেসেদিল। তার কলিজা! তার বেচেঁ থাকার শেষ সম্বল এই ছোট্ট মেয়েটা।স্মৃতি হেসে দিলেও তার মুখে কেমন ভয়ের ছাপ দেখা দিল। এতটুকু বাচ্চা ছাদে আসল কিভাবে?
মুক্তাই বা কোথায়? বর্ষাকে এভাবে ছেড়ে দিল কিভাবে সে?
স্মৃতি সব ভাবনা ফেলে বলল-
–” কি হয়েছে মা? তুমি একা একা ছাদে এসেছো? কেউ আসেনি তোমার সঙ্গে?”
মুখ ফুলিয়ে ছোট্ট মেয়েটি ছাদের দরজার পাশে দাড়ানো মেয়েটিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। স্মৃতি বর্ষার হাতের ইশারায় নজর দিয়ে দেখল ছাদের দরজার পাশে মুক্তা দাড়িয়ে আছে।স্মৃতি ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে, গালে, কপালে, অজস্র চুমু দিল।
–” আমার মা টাকে একা ঘুমের ঘোরে রেখে এসেছি বলেই রাগ করেছে মা?”
ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে বর্ষা। বর্ষা, স্মৃতির স্বামীর শেষ স্মৃতি বর্ষা! বর্ষণ কন্যার নাম বর্ষা! মিষ্টি মুখের মেয়েটি অনেকটা বাবার মত দেখতে হয়েছে। বর্ষা এবার ঠোট ভেঙ্গে কাদঁতে শুরু করল।
স্মৃতি পরম আদরে বুকে টেনে নিল তার বুকের মানিককে।
বর্ষা যেন আরও বেশি ফুলে ফেপে উঠল।
স্মৃতির চুলগুলো টেনে তার গলার কাছে জড়িয়ে ধরে আছে। মুক্তা দূর থেকে দৌড়ে কাছে এসে কোল থেকে নিতে চাইলে বর্ষা চিৎকার করে উঠল। স্মৃতি খানিকটা অবাক লাগল, বর্ষা হঠাৎ কাদঁছে কেন? স্মৃতি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল –
–” কেন কাদঁছে মা? মার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? আমার মায়ের অভিমান হয়েছে তার মায়ের উপর?”
—” বলো না মা!”
ছোট্ট বর্ষা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারলো না। স্মৃতি মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল
-” বর্ষা এমন করছে কেন? ওকে কেউ বকেছে? ওতো এরকম শুধু বকুনি দিলে করে।
–” চাচি আম্মা ওরে প্রতিবন্ধি কইছে! কইছে ও নাকি বাপ খাইছে! ও সবাইরে ধংস করবো!”
স্মৃতি মুক্তার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ দিল। এই জন্যই তো বর্ষা কাদঁছিল! ছোট্ট একটা মেয়েকে নিয়ে ও কত কথা!মেয়েটা আজকাল বুঝে যায় কেউ তাকে বকছে, আড়াই বছরের বর্ষা সবকিছু না বুঝলেও কারোর মুখ ভেংচি, কারোর বকুনি সে ঠিকই বুঝে যায়। বর্ষা তখন রেগে গিয়ে কাদঁতে শুরু করে। আর স্মৃতির চুলগুলো টেনে ছিড়ে ফেলতে চায়। বর্ষার রাগ দেখানোর মত একজনই তো আছে তার,
আর সে হলো তার মা!স্মৃতি বুকে টেনে নিয়ে মেয়েকে শান্ত করতে লাগল।
___________________________
–“তুই আজকে ও শৌখিনের বাসায় গিয়েছিস? কেন গিয়েছিস? এতবার করে বলি শৌখিন তোর থেকে কত বড়! এত বড় ছেলের ঘরে তুই কোন আক্কেলে যাস বলতো?”
–” গেলে কি সমস্যা, মা?”
–” কত সমস্যা তোকে বুঝাতে হবে আর আমাকে? তুই বুঝিস না? এইভাবে একটা ছেলের ঘরে যাওয়া উচিৎ না!
কত বলব তোকে আমি এই কথাগুলো?
–” শৌখিন ভাইকে তোমরা যে চোখেই দেখো না কেন, আমি তাকে সব সময় শ্রদ্ধা করি। ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে!”
–” বোকা মেয়ে, ড্যাং ড্যাং করে এত বড় পুরুষ মানুষের ঘরে যাস মানুষ দেখলে কত কিছু বলে জানিস তুই?
তোর লজ্জা নেই? এতটা নির্লজ্জ কি করে হতে পারিস তুই?”
–” মা এমন করে বলছো কেন?”
–“কিভাবে বলবো আর? নির্লজ্জকে নির্লজ্জ বললাম!
লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বসে আছিস তুই!”
–” মা শৌখিন ভাইকে নিয়ে তোমরা আর একটা কথা ও বলবে না! শৌখিন ভাই আমার কাছে একজন মানুষ, একজন প্রিয় মানুষ! কেন বারবার তোমরা আমাকে নিষেধ করো?”
–” ঐ ছেলে তোকে খারাপ করেছে, ঐ ছেলের জন্য তোর এত দরদ কেন? ঐ ছেলেকে কিছু বললে তুই এমন করিস কেন?”
–“কারন আমি শৌখিন ভাইকে ভালোবাসি! শুনেছো তুমি?আমি শৌখিন ভাইকে ভালোবাসি! উনাকে না পেলে আমার মরা মুখ দেখবে তোমরা!”
–” সুপ্তি! ঠাস, করে একটা চড় পরেগেল সুপ্তির গালে।
ভিষণ জোরে চড়টা পরেছে গালে। হলুদআভা গালটা একদম লালরঙ্গা ধারণ করেছে। তার সঙ্গে আরও দুটো চড় পরেগেল সুপ্তির গালে।
–” তুই যে শৌখিন ভাই, শৌখিন ভাই করিস কখনো দেখেছিস শৌখিনকে তোর জন্য চিন্তা করতে? কখনো তো দেখেনি শৌখিনের মধ্যে তোকে নিয়ে চিন্তা করতে। যার জন্য আবেগে ভেসে যাচ্ছিস আজ, যাকে নিয়ে একটা কথা বললে সহ্য করতে পারিস না। এমন না আবার হয়, সেই মানুষটাই কখনো তোকে বুঝল না! বলেই চোখের জল মুছে, দরজাটা বন্ধ করে চলেগেলেন সুপ্তির মা।
মেয়েটা তার একদম অবুঝ, শৌখিন করে করে একদম পাগল হয়ে যায়। অথচ শৌখিনের মনে তারই কোন জায়গা নেই।
মেঝেতে বসে কাদঁছে সুপ্তি, একি জ্বালায় জলছে সে! এর নামই কি ভালোবাসা? ভালোবাসা তাহলে এমন কেন?
কেন এত জ্বালা! কেন এত কষ্ট!
সুপ্তি যখন নিরবে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যাস্ত ঠিক সেই সময় একটি পুরুষালি কন্ঠে শুনতে পেল গান।
পাশের বারান্দা থেকে আবার সুর ভেসে আসছে শৌখিনের…. হয়তো আবারও গানের রেওয়াজ করতে বসেছে সে। প্রবল চিত্তে সেই কন্ঠে ভেসে আসছে সেই গানের সুর গুলো….
“বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে
হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
একি তব হরি খেলা
তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন
তুমি যে রসেরও ধারা
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা
করে মোরে দিশাহার
মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে
তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু
তুমিই শুধু তুমি
প্রেমের অনলে জ্বালি যে প্রদীপ
সে দীপেরও শিখা তুমি
জোনাকি পাখায় ঝিকিমিকি নেচে
এ হৃদি নাচালে তুমি
আপনও হারায়ে উদাসি প্রানের
লহ গো প্রেমাঞ্জলি
তোমারে রচিয়া ভরেছি আমার
বাউল গানের ঝুলি
মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে
তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু
তুমিই শুধু তুমি
সুপ্তির মুখে ও উচ্চারিত হলো সেই সুর,
“আমার পরানে প্রেমের বিন্দু”
“তুমিই শুধু তুমি!”
সুপ্তি ডুবেগেল শৌখিনের গাওয়া গানে। এত মধুর কন্ঠে ও কেও গায়? এতটা গভীর কষ্ট ও কেউ গানের মাঝে প্রকাশ করতে পারে? ইশশ, সে ও যদি এভাবে নিজের কষ্টগুলোকে গানের মধ্যে প্রকাশ করতে পারতো?
ছলছল চোখ জোড়ায় কমে আসা চোখের পানি স্রোত যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।
অপরপাশে রেওয়াজ করে, শৌখিন কিছুটা থেমেগেল। সুপ্তি জানে হয়তো কোন গভীর ক্ষতের কারনে শৌখিন ভাই আবার রেওয়াজে বসেছেন।
চলবে?
#বাগান_বিলাস
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ২[বোনাস]
–” আমি বারবার বলেছি এই মেয়েকে ঘরে তুলো না!
এই মেয়ে আমার সব ধংস করে দিয়েছে। কেউ শুনেনি,
রুপাকে বিয়ে করালে কি ক্ষতি হতো? আমার ভাইয়ের মেয়ে তাদের পছন্দ হয় না! তারা আমার কথা না শুনে
এই অপয়া মেয়েটাকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল।
আমার ছেলেটা, আমার বর্ষণকে শেষ করে দিল।
মুখ পুড়ি! আমার ছেলেটাকে খেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে রঙ্গতামাসা করে ! মেয়ে একটা জন্ম দিয়েছে প্রতিবন্ধি!
আমার ছেলের কোন চিহ্ন এই কলঙ্কিনী রাখেনি।”
–” আহ, রোজিনা এমন করছো কেন? বর্ষণের মৃত্যর জন্য বারবার স্মৃতি মাকে দোষারোপ করছো কেন?
ছেলে কে আমার যায় নি বলো? আমি ও তো বাবা ডাকটা আজ একবছর শুনতে পারলাম না, ছেলেটা চলেগেছে রোজিনা,তার জন্য দোয়া করো! নামাজ পরো, কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছ?”
–” আমি শুধুই কষ্ট দিয়ে যাই তোমাদের সবাইকে। আমি বর্ষণকে ও শান্তি দেয়নি, আমি শুধু সবার খারাপ চাই।
ক্যাটক্যাট করা আমার স্বভাব! আমার এমন তাগড়া যুবক ছেলে আমার চোখের সামনে শেষ হয়েগেছে। তার বউ পাড়া-প্রতিবেশীর ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে, রঙ্গতামাশা করে এইগুলো সহ্য করা যায়? নাতনিটাও প্রতিবন্ধির মত ঠিক করে কথা ও বলতে পারে না। যে বয়সে আমি আমার নাতি নাতনিদের নিয়ে একটু আদর করবো। নাতি নাতনিরা আমাকে ডাকবে কোথায় কিছুই তো হলো না।আমি কি নিয়ে বাচবো? এর চেয়ে তোমরা বিষ খাইয়ে মেরে দেও! শেষ হয়ে যাই আমি!
–” রোজিনা! কি বলছো তুমি!”
রোজিনা বেগম হাতের কাছে কিছু খুজঁতে লাগলেন।
কিছু না পেয়ে রুমের দিকে ছুটেগেলেন। হাতের কাছে ডায়াবেটিসের ঔষধ গুলোকে পেয়ে। পাতা গুলো থেকে ঔষধ গুলো নিয়ে যেই মুখে দিবে স্মৃতি দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে বলল-
–” মা এমন করবেন না, এমন কেন করছেন? আপনি এমন করলে আপনার ছেলে কষ্ট পাবে মা।
রোজিনা বেগম রাগী চোখে তাকিয়ে আছে স্মৃতির দিকে।
স্মৃতি সেই নজর উপেক্ষা করে তার হাত থেকে ঔষুধগুলো ফেলে দিতেই। তিনি স্মৃতিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন –
—” খবরদার! আমাকে মা বলে ডেকে কাছে আসার চেষ্টা করবি না। নষ্টা মেয়েছেলে কোথাকার!
তোর মুখে মা ডাক শুনা ও পাপ, তুই কালনাগিনী!
তুই কি ভেবেছিস আমার ছেলের টাকা পয়সা হাতিয়ে নিবি আর সুযোগ বুঝে চলে যাবি? তোর সেই বাড়া ভাতে আমি ছাই ফেলবো! কি ভেবছিস তুই? শশুর পেয়েছিস ভালো, শাশুড়ি হাতের মুঠোয় না আসুক সবকিছুই তোর! আমি বেচে থাকতে এই সংসার তোর হাতে দিব না।”
স্মৃতি রোজিনা বেগমের পায়ে হাত দিতে গেলে তিনি সরে গেলেন দূরে।
ছোট মেয়ে বিভা এসে তাকে জড়িয়ে ধরলে, কাদঁতে লাগলেন তিনি। রোজিনা বেগম কখনোই স্মৃতিকে মেনে নেননি, বর্ষণ আর তার বাবার কথা রাখতেই বিয়েতে রাজি হয়ে যান তিনি। কিন্তু তার মন জুড়ে ছিল ভাইয়ের মেয়ে রুপাকে নিয়ে স্বপ্ন, রুপা তার ঘরের লক্ষী হয়ে ঘর সামলাবে তাই তিনি চাইতেন। হঠাৎ করে লন্ডভন্ড করে দিল এই স্মৃতি।
মেঝেতে পরে পরে কাদতে থাকা স্মৃতিকে ধরে উঠালেন শশুর মশাই বশির সাহেব। বড় স্বাদ করে ছেলের বউ করে এনেছেন এই লক্ষীমন্ত সৌন্দর্যের অধিকারী সুন্দরী মেয়েটিকে। এনেছিলেন পূত্রবধূ হিসেবে, কিন্তু তার জায়গা হলো দাসীবাদির থেকে ও নিচু স্তরে। স্মৃতির আড়াই বছরের মেয়েটা ও কি পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে!
যে বয়সের নাতি-নাতনিদের দাদা দাদির কোলে কোলে থেকে আদর পাওয়ার কথা অথচ সেই মেয়েটারই কিনা হতে হলো সবার চক্ষুশূল?
স্মৃতি টলমল পায়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। একটা মানুষের জীবন কতটা দূর্বিষহ হলে তার আপন বলতে থেকে ও কেউ থাকে না! ভালোবাসার মানুষগুলো ও থাকেনা। হাউমাউ করে স্মৃতি কাদতে লাগল। বেডসাইড টেবিলের উপর বর্ষণ আর তার শেষ ছবি, বর্ষণের কোলে এক বছরের মেয়ে বর্ষা।
বাবা-মেয়ে দুজনের মুখে হাসি। স্মৃতির চোখ ঝাপসা থেকে ঝাপসা হতে লাগল।কেন অপরাধি বানিয়ে চলেগেল মানুষটা তাকে? এত আপন করে, এত ভালোবেসে, এত আগলে রেখে মাঝ পথে তাকে ছেড়ে চলেগেল?”
_______________________________
চোখের চশমাটা হাতরে খুজছেন বিপিন বাবু, শৌখিনের গলার সুরের মায়ায় যে কেউ পরতে বাধ্য। খুব সুন্দর গলা শৌখিনের, গিন্নিকে ডেকে উঠলেন তিনি, এক কাপ চা পান করতে হবে, চায়ের তেষ্টা।
–” ডেকে ডেকে একদম কানের পোকা নড়িয়ে দিলে।
একটু সবুর করা যায় না? ডাকতে থাকলে ডাকতেই থাকো তুমি!”
–” চা চেয়েছি অন্যকিছু তো চাইনি গিন্নি এমন করছো কেন? তা গলাটা শৌখিনের মনে হচ্ছে না গো?”
–” হুম তাই তো মনে হচ্ছে,”
–” ছেলেটার জন্য খুব দুঃখ হয়, ছেলেটার জীবনের সুখের মুহূর্তগুলো খুব সংকট গো।”
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নন্দিতা সরকারের মুখ থেকে।
সত্যিই এমন কঠিন আর কষ্টের জীবন ও হয়?
নন্দিতা চা বানানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে চলেগেল।
বিপিন বাবু শৌখিনের আগেরকার দিনগুলোর স্মৃতি মনে করতে লাগলেন। ছেলেটা এক বৃষ্টির দিনে তার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে তার পায়ের কাছে বসেছিল।
হাসিখুশি থাকা ছেলেটার মুখে সেদিন কি অসহনীয় কষ্ট ভেসেছিল একমাত্র সেদিন না দেখলে বুঝতে পারতো না।
শৌখিন তার পায়ের কাছে বসে বলেছিল –
–” জীবন এমন কেন স্যার? আমার জীবনটা কি আর পাচঁটা মানুষের মত হতে পারতো না? ”
বিপিন বাবু তব্দা খেয়ে গেলেন শৌখিনের হঠাৎ তার পায়ের কাছে বসে পা আকড়ে ধরায়। তিনি শৌখিনকে তুলে উঠালেন –
–” কি হয়েছে শৌখিন?”
–” স্যার, স্বপ্নকুমারীর বিয়ে হয়েগেছে স্যার! সে এখন অন্যকারো স্ত্রী! আমার শেষ সম্বল টাও হাত ছাড়া হয়েগেল। ভালোবাসার মানুষটাও পর হয়েগেল আমার!
আমার জীবনটা পাপ ছাড়াই পাপের পরীপূর্ণতা লাভ করতে লাগল।আমি নিঃস্ব হয়েগেছি স্যার, আমি নিঃস্ব হয়েগেছি!আমার জন্মটাই কি ভুল ছিল স্যার?
–” কি বলছো শৌখিন এগুলো! প্রত্যেকের জীবনে সুখ-দুঃখ থাকে, কারো জীবনের প্রথম মুহূর্তে সুখ থাকে পরবর্তী কালে থাকে দুঃখ! এ নিয়ে যদি এখনই ভেঙ্গে পরো তাহলে ভবিষ্যতে কি করবে তুমি?
যে তোমার ভাগ্যে নেই তার জন্য নিজেকে শেষ করো না।
যে তোমার ভাগ্যে নেই তার জন্য আফসোস করো না হ
তুমি তো চেষ্টা করেছিলে তাকে পাওয়ার ভাগ্যই সহায় হয়নি।
–” স্যার আমার জীবনটা এমন কেন হলো স্যার? বাবা-মার স্নেহ মমতা নাহয় বিসর্জন দিলাম। ছোট থেকে নাহয় আমি ঐ এক জায়গায় কাঙ্গাল হয়েই কাটালাম সারাজীবন। কিন্তু তাই বলে বিধাতা আমায় আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত গুলোকেও কেড়ে নিবে এভাবে? কি দোষ ছিল আমার? একের পর এক আঘাত আমাকেই সহ্য করতে হবে?”
সেদিন দেখেছিলেন বিপিন বাবু শৌখিনের জ্বলেপুড়ে যাওয়া অবস্থা। হৃদয়ের জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা নিয়ে কেমন মরমে মরমে মরেছিল শৌখিন। শৌখিন আর স্মৃতি দুজন ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। শৌখিন আর স্মৃতি দুজনের গলাই সুন্দর। বিপিন বাবুর বাড়িতে তখন সুরের তালে পুরো বাড়ি ভরে উঠতো।
সুপ্তি সারাটাদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিল। কারো সঙ্গে কথা বলেনি সে। সুপ্তির মা ও তাকে ডেকে খাইয়ে দেয়নি।
সুপ্তির বাবা অফিস থেকে এসে মেয়েকে কাছে না পেয়ে কিছুটা অবাক হলেন। যখনই তিনি অফিস থেকে আসেন সুপ্তি দৌড়ে এসে তার কাছ থেকে ব্যাগটা টেনে নিবে।
পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিবে বাবাকে, আজ সুপ্তি এলো না।
তবে কি সুপ্তির মন খারাপ? মন ভালো না থাকলেই তো সে একা একা রুমে বসে থাকে,কারো সঙ্গে কথা বলে না।
রুমের সামন এসে দরজায় নক করলেন তিনি। ভিতর থেকে সাড়া না পেয়ে আবার নক করলেন। এবার আর সুপ্তি দুম ধরে বসে রইল না দরজা খুলে দিয়েছে সে। সামনে বাবাকে দেখে সরে গিয়ে বসে পরল বিছানায়।
সুপ্তির বাবা মেয়ের সামনে বসে বললেন –
–” মায়ের সাথে রাগ করেছো?”
চলবে?