#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবন্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৮
কুহেলী বিছানা থেকে নেমে নামাজ পড়ে আবারও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। পাশের ভদ্রলোক ঘুমে অচেতন। ওর মেজাজ চরম খারাপ হয়েছে লোকটার উপরে। মানুষ এতো ঘুমাই কিভাবে কুহেলীর জানা নেই। এই লোকটার মাথায় বড়সড় কোনো সমস্যা আছে। কুহেলী ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। বেশ বেলাকরে ওর ঘুম ভাঙলো। বাইরে হৈচৈ হচ্ছে। এই বাড়িতে হৈচৈ হছে বিষয়টা ওর বৈধগম্য হচ্ছে না। ও দ্রুত নিচে এগিয়ে গেলো। ডাইনিং রুমে বেশকিছু বাচ্চা দৌঁড়াদৌড়ি করছে। কুহেলী অবাক হলো কারণ এই বাড়িতে কোনো বাচ্চা ছিল না। কি হচ্ছে এখানে কিছুই বুঝতে পারলো না তাই কৌতূহলী হয়ে ওর চাচি শাশুড়িকে জিঞ্জাসা করলো,
> ছোট আম্মা এই বাচ্চাগুলো হঠাৎ এই বাড়িতে ঠিক বুঝলাম না। ওরা কারা?
উনি বাচ্চাদের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে বললেন,
> এগুলো জুবায়েরের ভাইবোন। লাল ড্রেসের মেয়েটা আমার ছোট মেয়ে। আর হলুদ ড্রেস পড়া ওটা তোমার বড় ফুপির মেয়ে।আর কমলা রঙের সার্ট পড়া ছেলেটা তোমার ছোট ফুপির ছেলে। বাকিগুলো পাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে। সব এক সঙ্গে খেলাধুলা করে। তুমি যাও ওদের সঙ্গে পরিচিত হও ভালো লাগবে। বাচ্চাগুলোকে জুবায়ের খুব পছন্দ করে
কথাগুলো বলে উনি চলে গেলেন। কুহেলীর কানটা গরম হয়ে উঠেছে কারণ দুদিন আগেই শুনেছিল এই বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই।তাহলে কি ওকে মিথ্যা বলা হয়েছিল, কিন্তু কেনো? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কুহেলী বাচ্চাদের কাছে চলে আসলো। বাচ্চাগুলো ওকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করলো। কুহেলীর হঠাৎ একটা বাচ্চার দিকে নজর গেলো। এই পিচ্চিটাই সেদিন ওর রুমে গিয়েছিল আর কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছিল। কুহেলী তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে ডেকে পাশে নিয়ে গেলো,
> শুনো গতকাল তুমি আমার রুমে গিয়েছিলে তাইনা? কি নাম তোমার?
> আমার নাম জুরাসিক জুবায়ের সবাই আমাকে জুরু বলে ডাকে। তুমিও ডাকতে পারো। কিন্তু আমি তো বাড়িতে ছিলাম না কিছুক্ষণ আগেই এসেছি।মামা বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
পিচ্চিটা বেশ চিকুন কন্ঠে একদমে কথাগুলো বলে থামলো।
>আচ্ছা কতদিন পরে তুমি বাড়িতে ফিরেছো?
> ভাইয়ার বিয়ের পরদিন গিয়েছিলাম। মামা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
> আচ্ছা যাও তুমি।
কুহেলীর অনুমতির সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটা দৌঁড়ে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কানামাছি খেলতে যোগদিল। বাচ্চা মানুষ, মিথ্যা বলছে না কিন্তু ওর চোখের দেখা কিভাবে ভুল হলো?। যা দেখেছে তার কিছুই মিলছে না। এই বাড়িটা এতদিন ও যেমনটা দেখেছিল আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ভাবতে ভাবতে ও ধীরগতিতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ফুফি চাচি আম্মারা রান্না করছেন। ওকে দেখে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বাড়িতে কাজের লোক নেই অথচ এতগুলো মানুষের রান্না থালাবাসন পরিস্কার এগুলো খুব যত্ন করে করা হয়। যৌথ পরিবার বুঝি একেই বলে। কুহেলী কিছু একটা করার জন্য প্রস্তাব দিলো কিন্তু কেউ রাজি হলো না। উনাদের উক্তি নতুন বউ তাই কয়েকদিন সেবাযত্ন গ্রহণ করুক তারপর ক্রমশ কাজের পাহাড়ে চাপা পড়তে পারবে। আপাতত সবাই কে চিনে নেওয়াই ওর প্রধান কাজ। কুহেলী বাধ্য হয়ে উপরে চলে আসলো। রুমে জুবায়ের এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এটা দেখে ওর শরীর জ্বলে উঠলো। লোকটার কাজকর্ম কিছু নেই শুধু ঘুমাই। কথাটা ভেবে ও পাশের গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ওর মুখের উপরে ঢেলে দিলো। হঠাৎ পানি গায়ে পড়াই জুবায়ের লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। কুহেলীর ভীষন মজা লাগলো এরকম করে। লোকটা জব্দ হয়েছে ভেবে কিন্তু জুবায়ের ওর দিকে লাল লাল চোখ নিয়ে তাঁকিয়ে আছে। ও কেমন হিংস্র হয়ে উঠছে। এই চোখ দুটোকে কুহেলী ভীষণ ভয় পাই। জুবায়ের কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে ওর দিকে উঠে আসলো।। কুহেলী পিছিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু ততক্ষণে জুবায়ের ওর একদম কাছে চলে আসেছে। কুহু পিছিয়ে আসছে আর জুবায়ের ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এভাবে কিছুক্ষণ পিছিয়ে কুহুর পিঠ দেওয়ালে গিয়ে বাঁধলো। ও ভয়ে চোখমুখ কুচকে দরজায় পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের হাতটা ওর দিকে উঠাতেই কুহু চোখ বন্ধ করে ফেললো। লোকটা ওকে সত্যিই মারবে ভেবে ওর প্রচণ্ড ভয় করছে। কিন্তু বেশ সময় অতিবাহিত হবার পরেও যখন দেখলো লোকটা ওকে কিছুই বলছে তখন ওর মনে কৌতূহল জাগলো। আশেপাশে সাড়া শব্দ নেই। মনে হচ্ছে রুমেও ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় ব্যাক্তির প্রবেশ ঘটেনি। কুহেলী ভয়ে ভয়ে এক চোখ খুলে তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো কারণ লোকটা ওর দিকে চোখ লাল করে ভয়ানক দৃষ্টিতে দেখছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ঠিক কুহুর মুখের সামনে। ও মনে প্রাণে আল্লাহকে স্মরণ করছে। ঘুষিটা যদি ওর মুখ বরাবর এসে আঘাত করে তাহলে ও শেষ। কিন্তু লোকটা হঠাৎ এভাবে রেগে কেনো গেলো কুহু বুঝতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। সুযোগ পেলে এই বাড়ি ছাড়তে পারলে আর কখনও এখানে পা রাখবে না বলে মনে মনে পণ করলো। কুহেলী ভয়ে চিৎকার করতে ভুলে গেছে ঠিক তখন বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসলো। কুহেলী যেনো জীবন ফিরে পেলো। ও তাড়াতাড়ি চোখ খুঁলে অবাক, রুমে কেউ নেই। দরজা বন্ধ আছে বাইরে থেকে অনবরত দরজায় আঘাত করছে দেখে ওর আর সময় নষ্ট করলো না। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে ওর হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেলো।জুবায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু ফলমূল আর প্যাকেট নিয়ে। কুহেলীর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ওকে এভাবে চুপচাপ দেখে জুবায়ের মুখ খুলল,
> আরে ভেতরে যেতে দিবা না? তোমাকে টাটকা ফল খাওয়াইতে গিয়ে আমার অবস্থা বেহাল। ভোরবেলায় নামাজ পড়ে বেরিয়েছি। অনেক দূরে গ্রামের একটা হাটে গিয়েছিলাম এগুলো কিনতে। খেয়ে দেখো খুব সুস্বাদু।
জুবায়ের ওর ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে কথাগুলো বলে থামলো। ওর কথা শুনে কুহেলী ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি না এতক্ষণ রুমে ছিলেন? আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য আমাকে মারতে আসলেন?
> দূর মারবো কেনো শুনি ? বউয়ের মন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল আমি।আর সেই আমি কিনা তাকে মারবো। কয়টা মাথা আছে আমার ঘাড়ে?
> আপনি বাইরে ছিলেন তাহলে ঘরে কে ছিল?
কুহেলী হতাশ হয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। সত্যিই ডাক্তার দেখানো একান্ত জরুরী হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে যা ঘটছে তার কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে না। আজ যা দেখছে কাল তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অজানা রহস্যের সমাধান করলেই আবিরকে পাওয়া যাবে। ওকে এভাবে ভাবতে দেখে জুবায়ের ফলগুলো টেবিলের উপরে রেখে কুহেলীর পাশে গিয়ে বসলো,
> কি হয়েছে না বললে বুঝবো কিভাবে?
> আমি আপনার মতো কাউকে এইরুমে দেখেছি। ভয়ানক তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। আমি হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছি নয়তো এমন কিছু আছে যে আমাকে তার বশবর্তী করতে চাইছে। জানিনা তার উদ্দেশ্য কি।
> এক মিনিট আমাদের রুমে আমার মতো কেউ মানে?
> জ্বী ছিল।
> অপেক্ষা করো।
জুবায়ের তাড়াতাড়ি উঠে ফুলদানীর ভেতর থেকে একটা ক্যামেরা বের করলো তারপর এটার মেমোরি ল্যাপটপে বসিয়ে দিয়ে দুজনে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলো। এরকম কিছু একটার আশঙ্কা করেই জুবায়ের ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিল। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে কুহেলী রুমে এসে কিছুক্ষণ শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে পাশের গ্লাস থেকে পানি তুলে বিছানার দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ কুহেলীকে মনে হলো সামনে থেকে কেউ ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। রুমে কুহেলী ছাড়া কেউ নেই কিন্তু তবুও অদৃশ্য একটা মানুষের উপস্থিতি উপলব্দি করা যাচ্ছে। কুহু অবাক হচ্ছে না, চোখ মুখে শুধু আতঙ্কের ছাপ। জুবায়ের ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা নিজের মুষ্টিমেয় করে বলল,
> ভয় পাইলে সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে? কিছু হবে না আমি সব ঠিক করে দিবো। আর তোমার মাথা একদম ঠিক আছে। কেউ তোমাকে ভুলভাল দেখাচ্ছে। জানিনা তার উদ্দেশ্যে কি তবে সে সফল হতে পারবে না।
> আপনি বিশ্বাস করছেন আমাকে?
> অবিশ্বাস করছিনা বলেই আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
কথাগুলো বলেই ও দ্রুত বাইরে চলে গেলো। কুহেলী হতাশ হয়ে বসে আছে। বাড়ি থেকে আসার পরে আর কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। বাবা মা এমন কখনও করেনা। আর ভাইয়া কিভাবে পারছে ওর খবর না নিয়ে থাকতে। মেয়ে বিয়ে হয়ে গেলে কি পর হয়ে যায় নাকি তার খোঁজখবর রাখা মানা। এসব ভেবে ওর প্রচণ্ড অভিমান হলো সবার উপরে। ঠিক তখনই টেবিলের উপরে রাখা মুঠোফোনটা বেজে উঠলো।
চলবে