#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“মিস আরু”
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করেই মিস আরু ডাকটা শুনে ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসলো আরশি। বিচলিত হয়ে ফোনটা বালিশের উপর থেকে নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলো স্কিনে ইংরেজিতে খুব সুন্দর করে ডক্টর লেখাটা ভেসে উঠেছে। কিন্তু উনি এতো রাতে কল করেছে কেন?? আরশি বিস্ময় নিয়ে ফোনটা কানের কাছে ধরলো। সাথে সাথেই অপরপ্রান্ত থেকে আবারও মিস আরু নামটা শুনতে পেল আরশি। আবারও চমকে উঠলো বুকটা ধুকপুক করছে তার। এই নামটা শুনলেই কেন যেন তার হার্ট লাফাতে লাফাতে বুকের হাড়গোড় ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি অসহ্যকর এই বুকের যন্ত্রণা। আরশি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-
“জ্বি আমি শুনছি।”
অপরপ্রান্ত থেকে গম্ভীর গলায় ডক্টর সাহেব বললেন-
“আমি ফোন দিতে দ্বিধা বোধ করছিলাম কারন ভেবেছিলাম আপনি স্টুডেন্ট মানুষ হয়তো এই সময় পড়াশোনা করছেন বেশ মনযোগ দিয়ে। কিন্তু ফোন দিয়ে এখন আমার ধারনাটা পুরো মিথ্যে প্রমাণ হয়ে গেল। আপনি তো দেখছি রাত এগারোটা বাজেই ঘুমিয়ে কাতর হয়ে আছেন। মিস আরু।”
ডক্টর সাহেবের কথা গুলো শুনে আরশির ভ্রু জোড়া আপনা আপনি কুচকে গেল। পড়াশোনার কথা শুনে কপালে বিরক্তির ভাজ ফুটে উঠেছে। আরশি নিজের বিরক্তি ভাব প্রকাশ না করে ভদ্রতার সাথে জিজ্ঞেস করলো-
“আপনি এতো রাতে কল করেছেন যে!! না মানে কোনো দরকার ছিল??”
অপর পাশের মানুষটা সব সময়ের মতো গম্ভীরমুখে বললেন-
“কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখলাম একটা বাচ্চার পা ভেঙে গেছে তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটাকে দেখেই আপনার পায়ের কথা মনে পরলো তাই জানার জন্য ফোন দিয়েছি আপনার পা ঠিক আছে কি না।”
আরশি শান্ত গলায় বললো-
“হ্যাঁ আমার পা এখন একদম ঠিক আছে।”
“বেশ ভালো। যাইহোক আপনি বাচ্চাদের মতো বিছানায় পরে পরে না ঘুমিয়ে একটু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করুন মিস আরু। রাখছি এখন। নিজের খেয়াল রাখবেন।”
আরশি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল। আরশি হতবাক হয়ে বসে আছে। রাত এগারোটায় ফোন দিয়ে এসব বলার কি মানে!! এটা কি জ্ঞান দেওয়ার সময় না-কি!! আরশি মাথা থেকে সকল চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলে আবারও শুয়ে পরলো।
——————————
রৌদ্র ফোন কেটেই বুকে হাত দিয়ে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো। সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করতে করতে একটা পর্যায়ে বেশ অধৈর্য্য হয়েই আরশিকে কল করে ফেলে। কিন্তু আরশির এমন ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনেও গম্ভীর গলায় কথা বলা যেন তার জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তাই তাড়াতাড়ি করেই ফোন রেখে দিল। রৌদ্র মনে মনে নিজেকেই গালি দিচ্ছে তার এমন অধৈর্য্যে জন্য। না জানি মেয়েটা তাকে নিয়ে কি ভাবছে!! রাত-বিরেতে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলার জন্য নিশ্চয়ই এখন তাকে পাগল মনে করছে মেয়েটা।
“ভাই তুমি ঠিক আছো তো!! তোমার কি বুকে ব্যথা করছে না-কি!! এভাবে বুকে হাত দিয়ে হাঁপাচ্ছো কেন??”
নির্বানের এমন বিস্ময় ভরা কথা শুনে রৌদ্র চমকে উঠে পাশে তাকালো। নির্বানকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে রৌদ্র বুক থেকে হাত নামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ালো। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“আমার কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি।”
নির্বান রৌদ্রর কাছে এগিয়ে এসে ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
“তুমি এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেন ভাই?? অন্যের হার্টের চিকিৎসা করতে করতে কি এখন তোমারই হার্টে প্রব্লেম হয়ে গেছে না-কি??”
রৌদ্র নির্বানের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত রকমের একটা হাসি দিয়ে বললো-
“হলেও হতে পারে।”
কথাটা বলেই রৌদ্র দু হাত পকেটে গুজে বেশ ভাব নিয়ে ছাদ থেকে চলে গেল। নির্বান এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের যাওয়ার পথে। তার কাছে রৌদ্রকে একদমই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। জ্বিন ভূতে ধরেছে নাকি!! এভাবে বিনাকারণে হাসার কি মানে!! নির্বান দ্রুত তার ফুপিকে ফোন দিয়ে সব কিছু খুলে বললো। রৌদ্রের মা সব কিছু শুনে বেশ চিন্তায় পরে গেলেন।
————————
আরশি প্রতিদিনের মতো আজও সকালে বারান্দায় গেল। পাখিগুলোর সাথে বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেল। সারাদিন ব্যস্ততায় চিরকুটের কথা একটুও মনে পরেনি। বিকেলে বাসায় এসে সন্ধ্যার দিকে বারান্দায় গিয়ে তখনও চিরকুট না পেয়ে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ হয়নি৷ নিজের মতো করে পশ্চিম আকাশের সূর্যের রক্তিম আভা দেখে সময় কাটিয়ে দিল। চারপাশে অন্ধকার নেমে আসতেই পাশের বারান্দায় একপলক তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রুমে চলে আসলো। সারাদিন ব্যস্ততায় সময় কাটালেও এখন কিছু একটার অভাব বোধ করছে। নিজের অজান্তেই কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেটাকে পাত্তা দিতে চাইছে না আরশি।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরেই রৌদ্র বারান্দায় ছুটে আসলো। লাল রঙের চিরকুটটা হাতে নিয়েই স্বস্তি বোধ করলো। পাখিগুলোকে ভালো করে দেখে খাবার দিয়ে রুমে চলে আসলো। বিছানায় বসে চিরকুটটা পড়েই একটা মুচকি হাসি দিল। কিন্তু পরক্ষণেই তার হাসি মুখ মলিন মুখে পরিনত হলো। আর কিছুক্ষণ পরেই তাকে চলে যেতে হবে দু’দিনের জন্য। রৌদ্রর মা ফোন করে আজকের মধ্যেই রৌদ্রকে বাসায় যেতে বলেছেন। আর এর প্রধান কারণ হলো নির্বানের বলা কথা গুলো। রৌদ্রকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না শুনেই তিনি তার ছেলেকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আর এই কারনেই তিনি রৌদ্রকে ফোন করে বিভিন্ন তালবাহানা করে রাজি করিয়েছেন। রৌদ্র তার মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেলেও মনে মনে আরশির কথা ভেবেই তার মধ্যে প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে। যেখানে কিনা একদিনেই সে কতটা অস্থির হয়ে পরেছিল চিঠি না পেয়ে সেখানে দু’দিন কিভাবে কাটাবে!! এই বয়সে কি তার এমন স্কুলের কিশোর ছেলেদের মতো পাগলামো মানায়?? আর এমন অস্থিরতাই বা কেন? শুধুই কি এই চিঠির জন্য!! জীবনের প্রথম চিঠি আদান-প্রদান করছে তাই?? নাকি অন্য কিছু!! রৌদ্র নিজের মনে হাজারো প্রশ্ন করে তার উত্তর না পেয়ে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের চিরকুটটা রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসেই নীল রঙের কাগজ নিয়ে লিখতে বসেছে। আজ অদ্ভুত এক ইচ্ছে জাগলো নীল রঙের কাগজে চিরকুট লেখার। তাই ইচ্ছেটা আজই পূরণ করে ফেলতে চাইছে রৌদ্র।
“প্রিয় রুদ্রাণী,
অধিকার খাটাচ্ছি নাকি অনুরোধ করেছি জানিনা। তবে রৌদ্রের শহরে যেহেতু রুদ্রাণীর আগমন ঘটেছে সেহেতু রুদ্রাণীর উপর একটূ আধটু অধিকার খাটানোটা আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হচ্ছে না। রুদ্রাণীর উপর রৌদ্রের অধিকার থাকবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়!! আপনার কি মনে হয়??
বিঃদ্রঃ ময়না পাখির নাম রাখার কারনটা না হয় এখন অজানাই থাক। সব কিছু জানা হয়ে গেলে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। আমি চাচ্ছি আপনার এই ভয়ংকর কৌতুহলটা বজায় থাকুক তার সাথে কিছু জানার আগ্রহটাও থাকুক। আশা করছি অপেক্ষা করবেন রৌদ্রের রুদ্রাণী।
ইতি,
রৌদ্র”
চিরকুটটা লিখে একনজর দেখে নিল রৌদ্র। তারপর ভাজ করে বারান্দায় গিয়ে ছুড়ে মারলো পাশের বারান্দায়। কিছুটা সময় নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরশি আর কাসফিয়ার চেচামেচি শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট ভাবে। হয়তো কিছু একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে তারা দু’জন। রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে পরলো তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এই গরমে দিনের বেলা জার্নি করার থেকে রাতের সময়টাই তার কাছে স্বস্তির মনে হলো তাই আজ রাতেই বেরিয়ে পরেছে তার বাসার উদ্দেশ্যে।
—————————
বেশ কিছুক্ষন ধরে পাখির চেচামেচির শব্দে আরশির ঘুম আজ তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল। কৌতুহল নিয়ে বারান্দায় আসতেই দেখল পাখির খাঁচা গুলো নড়ছে। খাঁচায় পানি রাখার পাত্র থেকে পানি পরছে। আর পাখির খাবারগুলোও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আরশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এক একটা জিনিস। মনে হচ্ছে এই মাত্র এখানে কেউ এসে গেছে। অগোছালো ভাবেই পাখির খাবার গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েই চলে গেছে। তবে কি সে মানুষটা-ই চিঠির মানুষ ছিল?? কিন্তু এতো অগোছালো ভাবে কাজ করেছে কেন?? ব্যস্ততায় নাকি তার কাছ থেকে পালানোর জন্য?? আরশি নিজের ভাবনা গুলো বাদ দিয়ে মেঝেতে চিরকুট খুঁজতে লাগলো। খানিকটা সময় খোঁজার পর গোলাপ গাছের ডালে নীল রঙের কাগজ দেখে আরশির চোখ বিস্ময়ে গোলাকৃতি হয়ে গেল। আজ নীল চিরকুট পেয়ে খুব অবাক হলো আরশি। নীল রঙের চিরকুট দেখেই কেমন যেন উত্তেজনা কাজ করছে তার মনে। কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা নিয়ে পড়তে লাগলো। আজ চিরকুটের প্রতিটা লাইনে পড়েই মুগ্ধ হলো আরশি। একটা মানুষ এই ছোট্ট একটা চিরকুটও এতো সুন্দর করে গুছিয়ে লেখে কীভাবে?? কয়েক লাইনেই যেন হাজার হাজার কথা প্রকাশ করেছে। আরশি মুগ্ধ হয়ে চিরকুটের দিকে তাকিয়ে আছে। আচমকা পাশের বারান্দা থেকে দরজা খোলার শব্দে আরশি চমকে উঠেলো। চিরকুট থেকে চোখ তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকটার দিকে। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। গালে চাপ দাঁড়ি ডাগর ডাগর চোখ গুলোতে মেয়েদের মতো বড় বড় ঘন পাপড়ি। গায়ে নীল রঙের শার্ট জড়ানো। দেখতে তার থেকে দু এক বছরের বড় মনে হচ্ছে। আরশি তার দিকে অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে থেকেই বিস্ময় ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“আপনিই কি আমাকে চিরকুট লিখেছেন??”
আরশির কথায় নির্বান সামনের বারান্দার দিকে তাকালো। নির্বান চোখ গুলো ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আরশির দিকে। ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো-
“হ্যাঁ আমি চিরকুট লিখেছিলাম। আপনিই কি তাহলে আমার সেই চিঠির পাঠিকা??”
আরশি নির্বানকে এমন বিচলিত হতে দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।
চলবে…..