রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৪০+৪১

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪০
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“মানুষ তার জীবনে একবার হলেও কারও প্রেমে পড়ে। আমিও একজনের প্রেমে পড়ে ছিলাম। তবে সেটা শুধুমাত্র প্রেমে পড়া পর্যন্তই ছিল। মানুষ সুন্দর,পরিপাটি চেহারা দেখে প্রেমে পড়ে তবে আমি প্রেমে পড়েছিলাম একজনের অগোছালো চেহারা দেখে। কান্নার ফলে চোখমুখ ফুলে ছিল। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে পুরো মুখে লেপ্টে থাকা সেই অগোছালো মুখ। চোখের বিশুদ্ধ পানিতে গাল গুলো ভিজে লেপ্টে ছিল। কারও কান্না দেখলে তো মায়া বা কষ্ট হওয়ার কথা কিন্তু আমার এই নির্দয় মনে ছিল মুগ্ধতা। দুচোখে এক রাশ মুগ্ধতা নিয়েই প্রথম দেখেছিলাম কান্নারত অবস্থায় থাকা সেই বিশুদ্ধময়ি মেয়েটাকে। এক মুহূর্তের জন্যই প্রেমে পড়েছিলাম তার উপর। এর পর তার দেখা মেলেনি আর আমিও খোঁজার চেষ্টা করিনি।”

রৌদ্র হাল্কা হাসলো। ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপালের চুল গুলো পেছনে ঢেলে দিল। আরশির দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই আরশি চোখ নামিয়ে নেয়। আরশির বুঝতে বাকি নেই রৌদ্র কার কথা বলছে। আরশির বন্ধুরা সবাই কৌতুহলী চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। নির্বান রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে বলল-

“ভাই পরে কিভাবে কি হলো! তাড়াতাড়ি বলো।”

রৌদ্রর নির্বানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বলতে শুরু করল-

“তার ঠিক বছর দুয়েক পর একদিন বাইক নষ্ট হওয়ায় বাধ্য হয়েই লোকাল বাসে উঠেছিলাম। ওইদিনই আরুকে দেখেছিলাম। তবে এবার প্রেমে নয় ভালোবাসায় পড়েছিলাম। ভুলবশত এক অচেনা রমনীকে নিজের ছোয়া দিয়ে ভুলবশত ভাবেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এবার ভালোবেসেছি তার অস্বস্তিতে ঘেরা মুখ দেখে। একনজরই দেখেছিলাম তাকে। সে তো চলে গেছে তবে রেখে গিয়েছিল তার নখের ছাপ। তখন তার স্পর্শ পেয়ে ভেবেছিলাম কখনো মেয়েদের সংস্পর্শে না আসায় এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু না আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই অদ্ভুত অনুভূতির কারন বুঝে গিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই কাকতালীয় ভাবে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হলো। একদিন পর আবারও আরুর দেখা পেয়েছিলাম আর সেদিনই জেনেছি আরুই ছিল আমার প্রথম প্রেম। আর তার কয়েকঘন্টা পরেই আরুকে পাশের বারান্দায় চিঠির মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছি। একই মানুষের সাথে বার বার ঘটে যাওয়া এই ঘটনা গুলো নিশ্চয়ই কোনো কাকতালীয় নায়। এটাই হয়তো আমাদের নিয়তি ছিল। তাই বার বার আমরা ঘুরে ফিরে একে অপরের কাছেই এসে পরেছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র এই একজনের ভালোবাসাতেই পড়তে চাই।”

রৌদ্রর কথা শেষ হতেই সবাই হাততালি দিল। পুরো ছাদ কাপিয়ে উঠেছে তাদের সিটি বাজানো আর হাততালির শব্দে। সকলের সামনে এসব বলায় আরশি লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। বাতাসের তালের সাথে তাল মিলিয়ে আরশির চুল গুলো দুলছে। চাঁদের আলোয় আরশির আবছা মুখে লজ্জার আভা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এক জোড়া তৃপ্ত চোখ। জলজল এই চোখ দুটো শুধুমাত্র আরশিতেই নিবদ্ধ।

“আচ্ছা সবই তো বুঝলাম কিন্তু ভালোবাসায় পরেছেন একথাটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। প্রেমে পড়া আর ভালোবাসায় পড়ার মধ্যে তফাত কোথায়!”

সকলের হাসিঠাট্টার মাঝেই নীলা ভাবুকতার সাথে প্রশ্ন ছুড়ে দিল রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র নীলার দিকে তাকালো। নীলার চোখে মুখে কৌতুহল। অবুঝ বাচ্চাদের মতো ফ্যালফ্যাল করে রৌদ্রর দিকে কৌতূহল মেটানোর আশায় তাকিয়ে আছে। নীলার সাথে সাথে বাকি সবাই উত্তরের অপেক্ষা করছে।

“প্রেমে পড়া মানে একটা নির্দিষ্ট জিনিসের মায়ায় অথবা কারও মোহে জড়িয়ে যাওয়া। এই মায়া বা মোহ একটা সময় পর কেটে যায়। ঠিক যেমনটা আমিও অল্পদিনে ভুলে গিয়েছিলাম সেই কান্নারত বিশুদ্ধময়িকে মেয়েটাকে। আর ভালোবাসায় পড়া হলো একটা মানুষের নামে নিজের মনকে বিলিয়ে দেওয়া। যত কিছুই হয়ে যাক না কেন মাথা আর মন থেকে সেই নির্দিষ্ট মানুষকে বের করা সম্ভব হয়না। মানুষটার ভালো-মন্দ, ব্যর্থতা সব কিছুই তখন মুগ্ধকর মনে হয়। তার সব কিছুতেই ভালো লাগা কাজ করে। মানুষটার তুচ্ছ থেকেও তুচ্ছ জিনিস গুলোতেও ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়। একবার কারও ভালোবাসায় পড়ে গেলে তাকে নিজের মন থেকে বের করা অসম্ভব। সব শেষে বলবো প্রেম একটা সময় কেটে যায় তবে ভালোবাসা সারাজীবন থেকে যায়। আর ভালোবাসলে নিজের মনে মনেই তাকে নিয়ে সারাজীবন ভালো থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যায়।”

নীলা বিজ্ঞ মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে হুম বলল। আরশি মুগ্ধ হয়ে রৌদ্রর কথা গুলো শুনছিল। নিচ থেকে ডাক আসায় আরশির ঘোর ভাঙলো। একেক করে সবাই নিচে চলে যাচ্ছে। আরশি যেতে নিলেই রৌদ্র শক্ত করে তার হাত ধরে ফেলে।

———————

“হঠাৎ করে বাঘিনী থেকে কিউট শান্তশিষ্ট বিড়াল হয়ে গেলে কিভাবে?”

সিড়ি দিয়ে নামার সময় আচমকাই পেছন থেকে নির্বানের কন্ঠ শুনতে পেয় নীলা। নির্বানের কথায় থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে নম্রমুখে বলল-

“আমার আগের ব্যবহারের জন্য আমি আসলেই খুব লজ্জিত। তখন মেজাজ খারাপ ছিল কিন্তু এখন একদম ঠিক আছে তাই নিজের ভুল বুঝতে পারছি।”

নির্বান নীলাকে পাশ কেটে নিচে যেতে যেতে বলল-

“লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। আমি কিন্তু বাঘিনী খুব ভয় পাই তবে বিড়াল খুব ভালো লাগে আমার।”

নীলা নির্বানের পেছন পেছন সিড়ি দিয়ে নামিছে। কিছুটা বিনয়ের স্বরে বলল-

“আচ্ছা তাহলে আমি আপনাকে একটা বিড়াল কিনে দিব।”

নির্বান নীলার দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

“বিড়ালটা যেন তোমার মতো হয়।”

কাসফিয়ার ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। কপালে ভাজ পরেছে। নির্বানকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই নির্বান শব্দ করে হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুমে চলে গেল। নীলা এখনো ভ্রু কুচকে নির্বানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। এই লোককে বিড়াল না বরং একটা মানসিক ডাক্তারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। ওনার মাথায় নিশ্চিত কোনো প্রব্লেম আছে। সব সময় কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলে অদ্ভুত লোক। নীলা মনে মনে নির্বানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

———————

রৌদ্র আরশির হাত ধরে টেনে ছাদের এক কোণায় নিয়ে আসলো। আরশির হাত ছাড়ানো জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। হাত ছাড়াতে না পেরে অসহায় মুখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল-

“এমন করছেন কেন! হাত ছাড়ুন আমার।”

রৌদ্রর সহজ উত্তর-

“নিজের ভালোবাসার বউয়ের হাত ধরেছি অন্য মেয়ের হাত তো আর ধরিনি।”

রৌদ্রর নির্লিপ্ত জবাব শুনে আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল-

“সবাইকে নিচে ডাকছে। আমাদের এখন যাওয়া উচিত।”

রৌদ্র আরশির একদম কাছে এগিয়ে আসলো। আরশির দু কাধে হাত রেখে শীতল কন্ঠে বললো-

“হুম যাবো কিন্তু তার আগে বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না! উত্তরটা অবশ্য তোমার ফ্রেন্ডের কাছে শুনেছি কিন্তু এখন তোমার মুখ থেকে সরাসরি শুনতে চাই।”

আরশি মাথা নিচু করে ফেলল। রৌদ্রকে এতোটা কাছে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার৷ গলায় মাঝেই যেন শ্বাস আটকে আসছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। আরশি দু’হাত কচলানো শুরু করবে তখনই রৌদ্রর আরশির হাত ধরে ফেলে। আরশির অবস্থা দেখে রৌদ্র ঠোঁট চেপে হেসে শান্ত গলায় বলল-

“তোমার নিস্তব্ধতা, লজ্জায় নুয়ে পড়া এসব কিছুতেই তোমার উত্তর প্রকাশ পায় আরু। তুমি মুখ ফুটে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে দাও।”

রৌদ্র কথা গুলো বলেই আরশির হাত ধরে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল-

“নিচে চলো ভালোবাসা বউ। সবাই হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

আরশি চুপচাপ রৌদ্রর সাথে সিড়ি দিয়ে নেচে নেমে যাচ্ছে। নিচে আসতেই রৌদ্রর আরশির হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। আরশি ড্যাবড্যাব করে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রৌদ্র ঝুঁকে আরশির মুখোমুখি হয়ে নিম্ন স্বরে বলল-

“অবশেষে রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী চিরকালের জন্য এসেই পরলো।”

রৌদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে কপালের কিছুটা উপরের চুল গুলোতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। আরশির চুল গুলো ঠিক করে দিয়েই ড্রয়িং রুমে চলে গেল। রৌদ্রর কাছে আরশি থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সব কিছু তার মাথার হাজার ফিট উপর দিয়ে যাচ্ছে। নীলের আকর্ষণ কাড়া ডাকে আরশির হুশ ফিরলো। দ্রুত ড্রয়িং রুমে চলে আসলো। সবাই সোফায় বসে আছে। আরশি আসতেই কথা বলা শুরু হলো। এতোক্ষন হয়তো আরশির জন্যই অপেক্ষা করছিল সবাই। রৌদ্র সোফায় বসে আরশির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। রৌদ্রর হাসি দেখে আরশি কাসফিয়ার আড়ালে যেয়ে দাঁড়ালো। কাসফিয়ার আব্বু গলা খেকরিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি বিয়ের অনুষ্ঠান আগামী মাসের শুরুতেই হবে। আর রৌদ্র বাসা যেহেতু এখান থেকে দূরে তাই বিয়ের অনুষ্ঠান ঢাকাতেই হবে।”

আদিব হাসান বলল-

“হুম এই কয়দিনে তোমরা নিজেদের মার্কেট আর বিয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিছু রেডি করে নিবে। আর বিয়ের তারিখ তোমরা ভেবেচিন্তে আমাদের জানিয়ে দিবে। তবে তারিখ যেন আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে-ই হয়।”

রৌদ্রর আব্বু বলল-

“বিয়ের অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত তোমরা আগে যেমন ছিলে তেমনই থাকবে। আমরা সবাই কালকেই এখন থেকে চলে যাবো। এমাস শেষ হতে আর মাত্র পনেরো দিন বাকি। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। তোমাদের কারও কোনো মতামত থাকলে আমাদের জানাতে পারো ”

রৌদ্র ভদ্রতার সাথে বলল-

“আমাদের কোনো মতামত নেই। তোমরা যা বলবে তা-ই হবে।”

আদিব হাসান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“আচ্ছা তাহলে এখন সবাই যাও ঘুমিয়ে পড়। ছেলেরা সবাই কাসফিদের বাসায় যাও। আর আরশি তোমরা নিজেদের রুমে যাও।”

সবাই মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ নিজেদের মতো করে চলে গেল।

———————

“আচ্ছা কাসফি তোর কি মনে হয় ডক্টর রোদ সত্যি সত্যিই কখনো বাবা হতে পারবেন না?”

ঘুমের ঘোরে আচমকা আরশির প্রশ্ন শুনে কাসফিয়া ফটাফট চোখ মেলে তাকালো। সাথে সাথেই ঘুম বিদায় নিয়ে উড়ুউড়ু করে চলে গেল। আরশির প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো কাসফিয়া। ঘাড় বাকিয়ে আরশির দিকে তাকালো। আরশি এখনো অন্য পাশ ফিরে শুয়ে আছে। কাসফিয়ার অন্য পাশেই নীলা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাসফিয়া কিছুটা নেড়েচেড়ে ওঠে। নিজেকে সামলিয়ে সিরিয়াস কন্ঠে বলল-

“কেন! ভাইয়ার অক্ষমতার জন্য কি এখন ওনাকে বিয়ে করে তোর আফসোস হচ্ছে না-কি আশু!”

আরশি কাসফিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। শক্ত গলায় বললো-

“আমি কি কখনো বলেছি না-কি এসব! আফসোস হবে কেন? আমি তো কখনো ওনার অক্ষমতা বা ব্যর্থতা নিয়ে ভেবেই দেখিনি।”

কাসফিয়া সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

“তাহলে আজ হঠাৎ করে এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

আরশি আবারও অন্য পাশ হয়ে শুয়ে পরলো। নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিল-

“তেমন কিছু না। আমাদের দুজনেরই একই প্রব্লেম এই ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগছে তাই একটু কৌতুহল ছিল মনে।”

“শোন আশু এসব নিয়ে এতো ভাবিস না। তোদের ভাগ্যে হয়তো এটাই লেখা ছিল। তোরা দুজনেই নিজেদের ব্যর্থ মনে করে তোদের জীবনে কাউকে জড়াতে চাসনি তাই হয়তো আল্লাহ তোদের দুজকেই মিলিয়ে দিয়েছে একে অপরের জন্য।”

আরশি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-

“হুম.. আমাদের ভাগ্য একসাথেই লেখা ছিল। আচ্ছা এখন ঘুমা সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”

কাসফিয়া হুম বলে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু আরশির চোখে আজ ঘুম নেই। মাথায় আজ সারাদিনের ঘটনা গুলোই ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিনের মধ্যেই কি থেকে কি হয়ে গেল!! সব কিছু একটা সপ্নের মতো লাগছে। এটা যদি সপ্নই হয়ে থাকে তাহলে কখনো যেন এই সপ্ন না ভাঙে। আরশি কথা গুলো ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরে।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“এত সকালে ছাদে কি করছেন মিস আরু!”

আরশি পেছন ফিরে তাকালো। দুহাত পকেটে গুজে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েই এবাসার ছাদে চলে এসেছে। অগোছালো চুল গুলো কপালে আছড়ে পরে আছে। ভেজা ফর্সা মুখে পানির ফোটা গুলো মুক্তার মতো ঝলঝল করছে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। মুখ দেখে এই মুহূর্তে তার ভাবাবেগ বোঝা বড়ই মুশকিল। গায়ে কালো রঙের টিশার্টের মাঝখানে হলুদ রঙের একটা স্মাইলি ইমুজি। আরশি মনে মনে হাসলো। আরশির আর বুঝতে বাকি নেই এই টিশার্ট কার। আরশি উৎকন্ঠা হয়ে বলল-

“আপনি নীলের টিশার্ট পরেছেন তাই না!”

রৌদ্র আরশির পাশে এসে দাঁড়ালো। গায়ে জড়ানো টিশার্টে দিকে এক নজর তাকিয়ে সহজ গলায় বলল-

“হুম। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”

আরশি হাল্কা হাসলো। নিচের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। রৌদ্র আবারও জিজ্ঞেস করলো-

“সকাল সকাল ছাদে কি করছেন? আমি তো ঘুম থেকে উঠেই জানালা দিয়ে আপনাকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাই ফ্রেস হয়েই এখানে চলে আসলাম।”

“এমনি। রাতে ঘুম হয়নি তাই ছাদে একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে আসলাম।”

রৌদ্রর আরশির কানের কাছে এসে শীতল কন্ঠে বলল-

“তুমি সারারাত আমাকে নিয়ে ভাবছিলে তাই না ভালোবাসার বউ!”

আরশি রৌদ্রর দিকে তাকানোর আগেই রৌদ্রর স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। আরশি তার ভ্রু জোড়া কুচকে ফেললো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“আপনি আসলেই খুব অদ্ভুত লোক। একবার আপনি সম্মোধন করেন আবার তুমি সম্মোধন করেন। মানে এক এক সময় এক এক রকমের কথা বলার কি আছে আজব!!”

রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো-

“আমি অদ্ভুত বলেই তো আমাকে নিয়ে সারারাত চিন্তাভাবনা করো। মানুষ সব সময় অদ্ভুত জিনিসের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। যেমনটা তুমি হয়েছো।”

আরশি ভড়কে উঠলো। রৌদ্রর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“আপনি একটু বেশিই বোঝেন।”

রৌদ্র আরশির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“কেন তুমি কি আমাকে নিয়ে ভাবো না! আমাকে ভালোবাসো না?? পছন্দ হয়নি আমাকে!”

রৌদ্র এক সাথে এতো প্রশ্ন করায় আরশি তেতে উঠে। তেজি কন্ঠে ছোট্ট করে উত্তর দিল।

“জানি না।”

রৌদ্র আহত দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকালো। আসহায় কন্ঠে বলল-

“তুমি তোমার এক মাত্র হাসবেন্ডকে ভালোবাসো না আরু? তুমি সত্যিই আমাকে ঘৃণা করো? আমাদের তো কালকেই আকদ হয়েছে। আজ বলছো তুমি আমাকে ঘৃণা করো!”

রৌদ্রর কথায় আরশির মাথায় জ্বলজ্বল করে রাগের শিখা জ্বলে উঠলো। প্রচন্ড রাগে রৌদ্রর দিকে তেড়ে গেল। রৌদ্রর মুখ বরাবর আঙুল উঁচু করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“আমি কি কখনো বলেছি আমি আপনাকে ঘৃণা করি? সব সময় দশ লাইন বেশি বোঝেন কেন আপনি?”

রৌদ্র আরশির রাগ পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসলো।

“তার মানে তুমি আমাকে ঘৃণা করো না তা-ই তো!”

আরশি নাক ফুলিয়ে শক্ত গলায় বললো-

“নাহ করি না।”

রৌদ্র একটা অমায়িক হাসি দিল। আরশিকে টান দিয়ে রৌদ্র নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আরশির ঘাড়ের কাছে মুখ এনে নিম্ন স্বরে বলল-

“ঘৃণা করো না তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসো তাই না ভালোবাসার বউ!”

রৌদ্রর কথায় আরশির জ্বলন্ত রাগ নিমিষেই নিবে পানি হয়ে গেল। রৌদ্রর এতটা কাছে আসায় আরশি বরফের মতো জমে আছে। নড়াচড়া করার বোধশক্তিও যেন আরশির মধ্যে নেই।

“পাশের বারান্দা…. ও ক্রাশ ভাবি কোথায় তুমি?”

নির্বানের আকর্ষণীয় ডাকে আরশির ধ্যান ভাঙলো। এক ঝাটকায় রৌদ্রকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে দাড়ালো। হঠাৎ ধাক্কায় রৌদ্র ছিটকে কিছুটা দূরে সরে যায়। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে আরশির দিকে তাকায়। আরশি মাথা নিচু করে অনবরত হাত কচলাচ্ছে। নির্বান ছাদে এসে আরশিকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে কৌতুহল নিয়েই প্রশ্ন করল-

“কি হলো ক্রাশ ভাবি! কি হয়েছে তোমার? এভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

আরশি কোনো কথা বলছে না। এখনো আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। নির্বান এবার ভ্রু কুচকে রৌদ্রর দিকে তাকালো। সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল-

“ভাই তুমি কি ক্রাশ ভাবিকে কিছু বলেছ না-কি!”

রৌদ্র আরশির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল-

“আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম আরু আমাকে..”

রৌদ্রর কথার মাঝেই আরশি হকচকিয়ে উঠে আমতা-আমতা করে বলল-

“আসলে রাতে ঘুম হয়নি তাই মাথা ব্যথা করছে। আর কিছু না।”

রৌদ্র মুচকি হাসলো। নির্বান আরশির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করে বলল-

“তা না হয় বুঝলাম কিন্তু তোমার মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? আর হাত কচলাচ্ছো কেন?”

আরশি দ্রুত নিজের দু হাত আলাদা করে নেয়। মুখে হাত দিয়ে স্পর্শ করে জড়ানো কন্ঠে বললো-

“কই না তো। তেমন কিছু না। হয়তো রোদের জন্য এমন হয়েছে।”

রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলল-

“আমার জন্য হয়েছে! কিন্তু কিভাবে মিস আরু?”

নির্বান আর রৌদ্রর একের পর এক প্রশ্ন করায় আরশি প্রচন্ড অস্বস্তিতে পরে যায়। রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“আপনার কথা না আমি সূর্যের কথা বলেছি।”

নির্বান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল-

“কিন্তু পাশের বারান্দা সূর্য তো এখনো পুরোপুরি উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি।”

আরশি ক্ষিপ্ত হয়ে ধমকের স্বরে বলল-

“জানি না আমি কিছু। আপনারা থাকুন আমাকে নিচে ডাকছে।”

আরশি কথা গুলো বলে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে তখনই আবারও নির্বান বলল-

“কিন্তু এখনো তো তোমাকে কেউ ডাক দেয় নি পাশের বারান্দা।”

আরশি নির্বানের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই নিচে চলে গেল। সাথে সাথেই নির্বান আর রৌদ্র অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।

—————————

বিকেলে সবাই যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরলো। রৌদ্র আর নির্বান আরশিদের সাথে একই ট্রেনে এসেছে। তবে আরশি সকালের পর থেকে রৌদ্রর সাথে একটা কথাও বলেনি। রৌদ্র আড় চোখে আরশির দিকে তাকালেই আরশি গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরশির এমন অবস্থা দেখে রৌদ্র আর বাকি সবাই মিটমিটিয়ে হাসে। তাদের সবার হাসি দেখে আরশির রাগ আরও বেড়ে যায়। পুরো রাস্তা আরশি গাল ফুলিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। ঢাকা পৌঁছেই রৌদ্র হসপিটালে চলে যায় আর নির্বান নিজের বাসায়। আরশি আর তার বন্ধুরা নিজেদের বাসায় চলে আসে। ক্লান্ত থাকায় আরশি ফ্রেশ হয়েই ঘুমিয়ে পরে। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ আরশির ফোন বেজে উঠে। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আরশি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে না দেখেই ফোন রিসিভ করলো।

“আরু তুমি কি ঘুমিয়ে পরেছিলে?”

রৌদ্রর প্রশ্নে আরশি ছোট্ট করে হুম বলে। রৌদ্র আবারও বলল-

“আচ্ছা তাহলে তুমি ঘুমাও। আমি আজ হসপিটালেই থাকবো। তুমি সকালে একটু পাখি গুলি দেখে নিও।”

আরশি আবারও হুম বলে। আরশি ঘুমের ঘোরেই হুম হুম বলছে। রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে ফোন কেটে দেয়। আরশি কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আরশি সব সময়ের মতো আজও বারান্দায় যায়। পাখিগুলোর সাথে বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে রুমে এসে পরে। নাস্তা করেই কাসফিয়ার সাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। ভার্সিটিতে আসতেই আরশি আহানকে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আরশি আহনকে পাশ কেটে চলে যেতে নিলেই আহান আরশি হাত ধরে ফেলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here