#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৫(অন্তিম পর্ব)
এক সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। মুনের একটা অভ্যাস হলো, সে তার জীবনের সব কিছুই ডাইরি’তে লিখে রাখে।
সেদিন আদ্রিন মুনের রুম পেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা খোলা দেখে উঁকি দিয়ে দেখতে পেল, কেউ নেই। দরজার পাশেই একটা গাঢ় নীল মলাটের ডাইরি দেখে সেটা হাতে তুলে নিলো। অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিতে আদ্রিনের গায়ে লাগছে কিন্তু মুনের ডাইরি ভেবে সে নিয়ে নিলো। হোক না একটু অন্যায়। মুনের জীবন সম্পর্কে জানার তার প্রবল আগ্রহ জমিয়েছে ডাইরিটা দেখে। যে মানুষগুলোর ডাইরি লেখার অভ্যাস, তারা তাদের ব্যক্তিগত সবকিছু ওই ডাইরিতেই লিখে রাখে। ডাইরিটা তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
আদ্রিন ডাইরিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
আদ্রিনের একটা স্বভাব হলো – মানুষ ডাইরি প্রথম দিক থেকে পড়ে কিন্তু সে ডাইরি পেছন দিক থেকেই পড়ে আসবে।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আদ্রিন ডাইরির শেষের দিকে উল্টাতেই গুটি গুটি অক্ষরে ভেসে উঠল কিছু মুগ্ধময়ী লেখা।
‘তোমাকে মন ভরে দেখার অতৃপ্তি থেকেই ভালোবাসা’র সৃষ্টি।’
আদ্রিন ডাইরি’র পৃষ্ঠাটা একে একে উল্টিয়ে পড়তে লেগে গেল।
———
এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকদিন। মুন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে নামতে নামতে বাসায় ডেকোরেশনের অনেক মানুষ দেখতে পেল। সে বুঝতে পারলো না কিছুই। ড্রয়ইং’য়ে গিয়ে সোফায় বসতেই দেখলো সব কাজিনরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে আর পাশেই সবার মাঝখানে একটি বৃদ্ধা বসা। বৃদ্ধাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ইনি এখানকার নন। দেখতে দেখতে খ্রিস্টান খ্রিস্টান লাগছে। মুন ওখানে যেতেই বৃদ্ধাটি ওকে কাছে ডাকলে মুন গিয়ে বসলো উনার পাশে। বৃদ্ধা ইংরেজিতে জানতে চাইলো মুন কেমন আছে। মুন প্রতিউত্তর দিতেই বৃদ্ধাটি মুনের দু’গাল ধরে কপালে চুমু এঁকে দিল এরপর নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুল থেকে একটি ডায়মন্ডের আন্টি খুলে মুনকে পড়িয়ে দিল। মুন কিছুই বুঝতে পারলো না। বাকি সবাই হাসি হাসি মুখে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। সবাইকেই আজ খুশি খুশি লাগছে। কিছুসময় পরে বড়ো মা আর মা বৃদ্ধার কাছে এসে রেস্ট করতে বলতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মুনকে সহ সবাইকে বিদায় জানিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে সিঁড়িতে পা বাড়ালো।
মুন বৃদ্ধার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাকু কাজিনদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,’উনি কে?’
-‘আদ্রিন ভাইয়ার নানীমা।’ কাজিনের থেকে কেউ একজন বলে উঠল।
-‘উনাকে দেখতে খ্রিস্টান খ্রিস্টান লাগছে। তার মানে কী ওই মানুষটাও খ্রিস্টান!’ মুনের কথায় অবাক হওয়ার রেশ।
-‘নানীমা খ্রিস্টান কিন্তু আদ্রিন ভাইয়া নন।’ কাজিনদের থেকে কেউ একজন বলে উঠল।
মুন তাদের কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মুনের চাহনি দেখে ওরা বুঝিয়ে দিল।
আফজাল শেখের একমাত্র ভালো কাছের বন্ধু ছিল আদ্রিনের বাবা সোয়েব আহমেদ। সোয়েব আহমেদ উচ্চ-মাধ্যমিকের সময় ম্যারিল্যান্ডে পাড়ি জমায়। ওখানেই একজন খ্রিস্টান মেয়ের সাথে সোয়েবের প্রণয়। যিনি হচ্ছেন আদ্রিনের মা রিদি। এরপর মেয়েটি খ্রিস্টান ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে সোয়েবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রিদির এমন ধর্ম পরিবর্তনে তার মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওদের বিবাহিত জীবন সুখেই চলছিল কিন্তু দুইবছরের মাথায় সোয়েবের যখন পাঁচ মাস তখন এক এক্সিডেন্টে দুইজনেই না ফেরার দেশে চলে যায়। তখনই নাতিকে নিতে ছুটে আসে আদ্রিনের খ্রিস্টান নানীমা। এরপর থেকে ওই বৃদ্ধাই আদ্রিনকে লালন-পালন করে।
সব শোনার পর মুনের মায়া হলো ওই মানুষটার প্রতি। মা-বাবার ভালোবাসা কত ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলল!
-‘কিন্তু ম্যারিল্যান্ড থেকে! উনি এখানে!’ মুন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলে কাজিনরা তার উত্তর এড়িয়ে গিয়ে আবার গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুন মনে করলো, হয়ত বাংলাদেশ ঘুরতে এসেছে তাই সে এর ব্যাপারে আর কোনো কথা বাড়ালো না। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,’বাসায় কী হচ্ছে!’
-‘ভাবো।’ সবাই সমস্বরে মুনের প্রতিউত্তর করলে মুন কিছুক্ষন তুটনি’তে হাত রেখে ভাবুক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে আবারো বলল,
-‘আজ তো তোদের মধ্যে কারো বার্থডে না, আর না কারো ইউনিভার্সিরী! তবুও বাসা সাজোনোর উদ্দেশ্য কী? কী হচ্ছে, বল তো। ইদানিং সবাই আমার কাছ থেকে কথা লুকোয়।’
-‘আজকেরটা সারপ্রাইস, বিশেষ করে তোমার জন্য। সন্ধ্যা পর্যন্ত ধৈর্য ধরো।’ সবাই আবারো সমস্বরে বলে উঠল। ইরাও ওদের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে মুনকে কিছুই বলল না।
মুন কিছুসময় সবার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর উঠে পড়ল। সে মায়ের রুমে গিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পেল না।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসলো। বাসা-ভর্তি মেহমান আসছে। মুন রুমে দরজা আটকে বসে রইল।
মুনের হঠাৎ করে আদ্রিনের কথা মনে পড়ল। মানুষটাকে আজ এক পলকের জন্যও দেখা যায়নি। মুহূর্তের মধ্যে মন পাল্টে ফেলল মুন। ওই মানুষটার কথা কেন সে ভাবছে!
হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে মুন উঠে দরজা খুলতেই দেখলো তার মা হাতে লেহেঙ্গার মতো কিছু কাপড় আর সাজ-সজ্জার জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে দুইটা মেয়ে। মুনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে রাশিদা ইসলাম বলে উঠল,
-‘এরা পার্লার থেকে এসেছে তোকে সাজানোর জন্য। নেয়, এগুলো পড়ে রুমে বস। ওরা সাজিয়ে দিবে।’ বলেই রাশিদা ইসলাম চলে যেতে নিলে মুন উনার হাত ধরে বলে উঠে,
-‘আজ কী মা? এগুলো কীসের জন্য?তোমরা কেউই কিছু বলছো না আমাকে!’
রাশিদা ইসলাম মুনের দিকে এগিয়ে এসে তার দুহাত মুনের মুখে আলতো ভাবে রেখে মুচকি হাসলো।
-‘আজ তোর ইনগেজ।’ বলেই তিনি চলে গেলেন। হয়ত চোখের কোনে পানিগুলো আড়ালে ঢাকার বৃথা চেষ্টা।
মুন অবাক দৃষ্টিতে তার মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে সে কী শুনেছে! সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না মুন। তার ইনগেজ! অথচ কেউ কিছু জানালোও না! কার সাথে! এসব ভাবতেই মুনের চোখ গড়িয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তার ইনগেজ -এটা শোনার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে হঠাৎ করে চোখের সামনে আদ্রিনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠায়। মানুষটার মুখটা কেন জানি বারবার ভেসে উঠছে।
মুন পুতুলের মতো বসে রইল। তার এদিকে আর কোনো হেলদোল নেই। কার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেটাও শোনার আর প্রয়োজনবোধ মনে করলো না।
সাজানো শেষেও মুন একইভাবে পুতুলের মতোই বসে রইল। তার হাল্কা আকাশি রঙ ভীষণ পছন্দের। আজকে তার পরনের লেহেঙ্গাটাও তার পছন্দের রঙের। হাল্কা আকাশি রঙের উপর সাদা পাথর বসানো। সবমিলিয়ে অনেক সুন্দর জামা কিন্তু তার মুখে কোনো হাসির রেশ নেই। কেন জানি, তার কিছুই ভালো লাগছে না।
কিছুসময় পরে ইরা আর বাকি কাজিনরা এসেই মুনকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,’তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে, একদম নীল পরীর মতো একটা পুতুল।’
মুনের এসব কিছুই ভালো লাগছে না। তার আর কিছু জানার আগ্রহ নেই তাই চুপ করে রইল। দরজার বাইরে থেকে বড়ো মা’র আওয়াজ শুনে ইরা মুনকে নিয়ে নিচে নামল। আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ড্রয়ইং রুমটা মেহমান’ভর্তী হয়ে গেল। মুনকে দেখে অনেকে এগিয়ে এল। রাশিদা ইসলাম আর রোকসানা বেগম এসে মুনের দু’গাল ধরে বলে উঠল,
-‘বাহ্! মাশ’আল্লাহ! অনেক সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।’
আদ্রিনের নানীমা এসে মুনের পাশে দাঁড়িয়ে কপালে চুমু এঁকে দিল।
মুন মুচকি হেসে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে কেন জানি মানুষটাকে খুঁজল। এমন সময় কেউ একজন এসে মুনের হাত ধরে লাইটিং করা মেইন জায়গায় নিয়ে গেল। হঠাৎ করেই মাঝখানের মূল লাইট’য়ের জায়গায় আদ্রিন হাঁটুমুড়ে বসে মুনের দিকে রিং এগিয়ে দিল। মুন তার চোখের ভ্রম ভেবে ভালোভাবে কচলে আবারো তাকিয়ে বুঝতে পারলো, এটা তার ভ্রম নই। তার মানে মানুষটাও মুনকে ভালোবেসেছিল!
‘আমি তোমার জীবনে প্রথম অধ্যায় হতে পারিনি কিন্তু শেষ অধ্যায় হয়েই আজীবন থাকতে চাই।’
মুন আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, সবাই উৎফুল্ল নজরে মুন-আদ্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার দৃষ্টি দেখে মুন বুঝতে পারলো, এই সবকিছুই অনেকদিনের প্ল্যান। হয়ত সবাই জানতো শুধুমাত্র মুন ছাড়া। মুন কাঁপা কাঁপা হাতটা আদ্রিনের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আদ্রিন রিং পড়িয়ে দিল। মুনের দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আসলেই অনেক বড়ো সারপ্রাইস এটা।
——–
আস্তে আস্তে রাত ঘনিয়ে আসল, মুন ব্যালকনির শিকলে হাত দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল আনমনে।
মুন জানে না, এই মানুষটার ভালোবাসার মূল্য সে দিতে পারবে কী না! কারণ তার যে – কাউকে ভালোবাসতে বড্ড ভয় করে। তার যে একটা বিষাক্ত অতীত আছে, সবাইকে উপর সেই অতীতটা ভুলে গিয়েছে বললেও তা কিন্তু নয়। এই মানুষটা সুদূর অতো দূর দেশ থেকে মুনের জন্য এলো, মুন কী সেই মূল্য দিতে পারবে মানুষটাকে!
মুনের ভাবনার মাঝেই আদ্রিন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে বলে উঠল,
~’তোমার যেমন ইচ্ছে, তেমনভাবেই থেকো,
শুধু হারিয়ে না গেলেই হবে।
ইচ্ছে হলে ভালোবাসো,নাহলে
থেকো ঠিক যেমন থাকে স্নিগ্ধ গাংচিল’~
————
কেটে গেল অনেকগুলো দিন। মুন-আদ্রিনের বিয়ের পর মুন নিজের দেশেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু আদ্রিনের নানীমা মারা যাওয়ায় মুন ম্যারিল্যান্ডে চলে গিয়েছিল। ইরা নিজের পড়ালেখা শেষ করে বাবার বিজনেসের দিকে নজর দিচ্ছে। রিক-সিমি’র বিয়ে হয়েই গেল শেষপর্যন্ত। রিহিও জব নিয়েছে। দেশে রিফাত আর বিয়ে করেনি, সে একটা বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। বাচ্চা আর অফিস সবমিলিয়ে রিফাতের দিন কেটে যায়। শুনেছে, প্রীতি আর না হতে পারবে না তাই তার বর্তমান স্বামী আকাশ অন্যমেয়ের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে প্রীতিকে অনেক অত্যাচার করতো। শেষপর্যন্ত প্রীতি আর সইতে না পেরে আকাশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। প্রীতি’র নিজের বাসায়ও আর ঠায় হয়নি, রিফাতের কাছে এসে মাফ চেয়েছিল কিন্তু রিফাত আর সুযোগ দেয়নি। আকাশ প্রীতির দেওয়া সেই মামলাটা বন্ধ করতে পারেনি যার ফলে কয়েক বছরের জন্য সে জেলকতৃক সাজাপ্রাপ্ত ঘোষিত হয়েছে। সব মিলিয়ে সবাই সবকিছুর শাস্তি পাচ্ছে। প্রকৃতি ছেড়ে দেয় না – এটার প্রমান এই সবকিছু। মুন আর আদ্রিনও ভালোই আছে। আদ্রিন এখনো মুনকে কোনো কিছু নিয়ে জোর করেনি। সে এখনো বলে – মুনকে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই থাকতে, স্নিগ্ধ গাংচিলের মতোই।
#সমাপ্ত।