#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৭
#লেখিক-মেহরুমা নূর
★ঋতুর পালাবদলে এভাবেই প্রহর খুশির খুনসটিময় সুখকর জীবনের আরও ছয়টা মাস পার হয়ে গেছে। ওদের প্রেমকাব্যের ভেলা চলছে আপন গতিতে। সময় তখন কার্তিক মাস। হেমন্তের আগমণ ঘটেছে। গরমের প্রভাব কমে গিয়ে পরিবেশে শীতল বাতাসের আবির্ভাব হচ্ছে।এর মাঝে প্রহরের স্টাডি কমপ্লিট হয়ে গেছে।তাই সে অফিস জয়েন করেছে। তবে রোজ খুশিকে কলেজে দিয়ে আসা আর নিয়ে আসার দায়িত্ব টা ঠিকই পালন করে। হাজার ব্যাস্ততার মাঝেও সে চলে আসবে খুশিকে ড্রপ করে দিতে। তাছাড়া যে সে শান্তি পায়না। খুশিকে নিয়ে কোন রকম রিস্ক নিতে রাজিনা প্রহর। খুশি যে ওর কাছে অমূল্য রতন।
ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে এলো খুশি। প্রহর হয়তো ওর জন্য অপেক্ষা করছে তাই দ্রুত সেদিকে এগুলো। মাঠের দিকে আসতেই কেমন ভীড় দেখতে পেল খুশি। আর ভীড়ের অধিকাংশ দর্শকই মেয়েরা। খুশিও কৌতুহল বশত সেদিকে এগিয়ে গেল। ভীড় ঢেলে সামনে তাকাতেই কপাল কুঁচকে এলো ওর। সামনে কলেজের ছেলেদের সাথে বাস্কেট বল খেলছে প্রহর। গায়ের শার্ট খুলে কোমড়ে বেঁধে নিয়েছে। বর্তমানে শুধু হাতা কাটা বক্সার গায়ে আছে। যার দরুন প্রহরের সুঠাম বডি দৃশ্যমান হয়ে গেছে। খেলতে খেলতে শরীর দিয়ে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। যা প্রহরের সুদর্শনীয়তা আরও পরিস্ফুটিত করছে। আর এই দৃশ্য দেখার জন্যই বিনা টিকেটে সব মেয়েরা এখানে ভীড় জমিয়েছে। প্রহরের এই প্রদর্শন দেখে রাগে শরীর কিড়মিড় করছে খুশির ।মন চাচ্ছে এই বাস্কেট বল দিয়েই প্রহরের মাথা ফাটাতে।
খেলতে খেলতে প্রহরের নজর পড়লো খুশির দিকে। খুশিকে দেখে প্রহর খেলা বন্ধ করে বল বাকিদের দিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিল। খুশির দিকে আসতে নিলেই খুশি তার আগেই রাগে হনহন করে হাঁটা ধরলো। প্রহর ভ্রু কুঁচকে খুশির পিছে পিছে আসতে আসতে বললো।
–খুশি ওয়েট। এতো দ্রুত হাটছ কেন?
খুশি কোন প্রতিত্তোর না দিয়ে আরও জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো। গেটের বাইরে এসে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। প্রহর এবার দৌড়ে এসে খুশির হাত ধরে বললো।
–আরে আরে কোথায় যাচ্ছো? গাড়ি তো ওইদিকে।
খুশি রাগী কন্ঠে বললো।
–তোমার ওই গরুর গাড়িতে তুমি একাই যাও। আমি যাবোনা তোমার সাথে। ছাড়ো আমাকে।
–আরে বাবা হয়েছে টা কি? এমন বিহেব করছো কেন? আচ্ছা ঠিক আছে আগে গাড়িতে এসে বসো তারপর যা বলার বলো। দেখ লোকজন তাকিয়ে আছে। প্লিজ গাড়িতে উঠে বসো।
খুশি হাত ঝটকা মেরে রাগে গটগট করে হেঁটে গাড়িতে এসে বসলো। প্রহরও কোমড় থেকে শার্ট খুলে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে বলে উঠলো।
–এখন বলো কি হয়েছে? হঠাৎ তোমার অগ্নিগিরি ভোলকে উঠলো কেন?
খুশি রাগী মুডে বললো।
–আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমার ভক্তদের গিয়ে বলোনা।
–হোয়াট ভক্ত? কি বলছ এসব?
এবার বিস্ফোরক হয়ে ফেটে পড়লো। দুই হাতে প্রহরের কলার টেনে ধরে ক্ষিপ্ত সুরে বললো।
–ন্যাকা সাজা হচ্ছে আমার সামনে তাইনা? ওখানে কি করছিলে তুমি হ্যাঁ? এমনিতে তো আমার সামনে ভদ্র সদ্র লেজ বিশিষ্ট সেজে বসে থাকো। আর ওখানে সব মেয়েদের সামনে নিজের শরীরের প্রদর্শনী করিয়ে বেড়াচ্ছিলে তাইনা? সানি লিওনির মেল ভার্সন হওয়ার শখ জেগেছে?
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট রাবিশ? কি আবোল তাবোল বলছ? আরে ছেলেগুলো আমাকে রিকুয়েষ্ট করেছিল খেলার জন্য। তাই একটু খেলছিলাম। শার্ট পড়ে খেললে ঘামে ভিজে যেত তাই খুলে নিয়েছিলাম। এখানে প্রদর্শনীর কি হলো?
–এসব শুধু লেইম বাহানা। আসল কথা হলো তোমার ওইসব মেয়েদের আকর্ষণ করাই উদ্দেশ্য। ওদের হায়হুতাশ দেখতে তোমার খুব ভালো লাগে তাইনা?
–দেখ এখন কিন্তু বেশি বলে ফেলছ। আরে এই স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে এমন ওভার রিয়্যাক্ট করার কি আছে?
–এটা স্বাভাবিক বিষয় তাইনা? ওকে ফাইন। আমিও কাল শর্ট স্কাট আর শর্ট হাতা কাটা টিশার্ট পড়ে আসবো? আর সব ছেলেদের দেখিয়ে বেড়াবো কেমন?
এবার প্রহরের রাগ উঠে গেল। প্রহর চোয়াল শক্ত করে বললো।
–খুশি!! এনাফ ইজ এনাফ। ইউ গোয়িং টু ফার নাও।
–কেন? এখন তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন? এটাতো স্বাভাবিক বিষয় তাইনা? তাহলে আমার বেলায় রাগছ কেন?
প্রহর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ওকে ফাইন অ্যাম সরি। আর এমন হবে না কেমন?
প্রহরের সরিতে স্যাটিসফাই হলোনা খুশি। সে প্রহরের শার্ট সরিয়ে ওর বুকের ওপর সজোরে কামড় বসিয়ে দিল। রাগের বসে সবগুলো দাঁত বসিয়ে দিল প্রহরের বুকে। দাঁতের ধার মাংস ভেদ করে গেল।এমন মারাত্মক কামোড়ে প্রহরের সব লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। প্রহর হাত শক্ত করে মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে সব সহ্য করে নিচ্ছে। প্রিয়তমার শাস্তিও যে মধুর। তাকে কষ্ট দিয়েও যদি তার প্রিয়তমা শান্তি পায় তবে এতেও প্রশান্তি প্রহরের। কামোড় শেষে খুশি প্রহরকে ছেড়ে দিয়ে এসে সোজা হয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রহর মুচকি হেসে বললো।
–এখন তো শাস্তিও দিয়ে দিলে। তবুও রাগ করে আছ কেন? সরি তো বাবা। এখন মুড ঠিক করোনা প্লিজ।
খুশি জানালার দিকে মুখ রেখেই অভিমানী সুরে বললো।
–আমাকে রাগালে আমি একসময় অনেক দূরে চলে যাবো। তখন বুঝবে কেমন লাগে।
প্রহরের হৃদপিন্ডে কিছু কামোড় দিয়ে ধরলো।প্রহর খুশির হাত ধরে এক ঝটকায় নিজের কাছে এনে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বললো।
–হোয়াট ডিড ইউ সে? সে ইট এগেইন।
প্রহরের অগ্নি চোখ দেখে খুশি এবার একটু দমে গেল। বুঝতে পারলো প্রহর ভয়ংকর রেগে গেছে। প্রহর বলে উঠলো।
–আজ প্রথম আর শেষ বার যা বলার বললে। আর কখনো যদি এই কথা মুখ দিয়ে বের করার দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছ, তাহলে সেদিন তুমি আমার এক অন্য রুপ দেখবে। অ্যাম শিওর যা তোমার মোটেও পছন্দ হবে না। তাই আমার সেই ভয়ংকর রুপটা কখনো বাইরে এনোনা। ইটস নট গুড ফর ইউ।
কথাটা বলে প্রহর খুশিকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। চুপ করে শুধু গাড়ি চালাতে লাগলো। খুশি বুঝতে পারলো প্রহর ওর কথায় রাগ করেছে। তাই প্রহরের বাম হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বললো।
–সরি ভুল হয়ে গেছে। আসলে তখন সব মেয়েগুলো তোমাকে ওভাবে হা করে গিলে খাচ্ছিল। তাই আমার অনেক রাগ উঠে গিয়েছিল। সরি, কামোড় বেশি জোরে দিয়ে ফেলেছি তাইনা? ব্যথা হচ্ছে বুঝি?
প্রহর বাম হাতে খুশিকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–উহুম একটুও না। এটাতো আমার দুষ্টুপরির দেওয়া প্রথম চিহ্ন। এটা অনেক স্পেশাল আমার কাছে।
খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–তাহলে আরও কয়েক টা দিয়ে দেই কেমন?
প্রহর হেঁসে দিল। এই পাগলী আর ভালো হবার না।
__
আজ খুশি কলেজ বাংক করে দিয়া আর শাহিনের সাথে নতুন একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে আড্ডা দিতে। প্রহর খুশিকে কলেজে ড্রপ করে দিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই ওরা বেরিয়েছে। যাতে প্রহর নিতে আসার আগেই আবার কলেজে এসে থাকতে পারে। খুশি রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো।
–আজ তোদের লটারি লেগেছে মনে কর। যা মন চায় অর্ডার করে বাপের নাম ভুলে খাওয়া শুরু কর। এমন অফার রোজ রোজ পাবিনা।
দিয়া বলে উঠলো।
–আমারতো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তোর মতো কিপ্টার নানী শাশুড়ী আমাদের ট্রিট দিতে এনেছিস। তোর আর জিজুর সম্পর্কের প্রায় বছর হয়ে আসলো। অথচ আজপর্যন্ত পাঁচ টাকার বাদামও খাওইলি না। এতো রিচ জিজু হওয়ার কি লাভ পেলাম আমরা?
–হইচে আর কান্দিস না। আজকে আনছিতো কব্জি ডুবাইয়া খা।
ওরা রেস্টুরেন্টের তিনতলায় একটা টেবিলে বসে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল। নানান আড্ডার মাঝেই খাবার শেষ করে ওরা আবারও বেড় হওয়ার জন্য এগুলো। সেকেন্ড ফ্লোরে আসতেই হঠাৎ খুশির নজর গেল কাচের দেয়ালের ওপাশে একটা টেবিলে। যেখানে প্রহরকে কোন মেয়ের সাথে বসে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।খুশি ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, প্রহর এখানে? আর মেয়েটা কে? খুশি দিয়া আর শাহিনকে বাইরের দিকে এগুতে বলে ও ধীরে ধীরে প্রহরের টেবিলের দিকে এগুলো। কিছুটা এগুতেই খুশি দেখতে পেল এটা সেই মেয়ে যে ওকে একবার বলেছিল সেও প্রহরকে ভালোবাসতো। তবে প্রহর ওকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ এখানে কি করছে ওরা? কৌতুহল বশত খুশি নিজেকে আড়ালে রেখে ওদের আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। কাছাকাছি যেতেই প্রহরের কিছু কথা কানে এলো ওর। প্রহর বলছে,
–দেখ তুমি রুপে গুনে অবশ্যই খুশির থেকে হাজার গুন বেশি। তোমার সামনে খুশি কিছুই না। শুধু খুশি কেন, ভার্সিটির সব মেয়েদের চেয়ে তুমি সুন্দরী আর মেধাবী। যেকোনো ছেলে তোমাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে।
প্রহরের এতটুকু বাণি শুনেই খুশি থমকে গেল। চোখের কোনে নোনাজল জমে গেল ওর। আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল ওখান থেকে।
__
কলেজ ছুটির যথাসময়ে প্রহর খুশির কলেজের সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। গাড়িতে বসে খুশির জন্য ওয়েট করতে লাগলো। কলেজ ছুটে হয়ে সব স্টুডেন্ট রা বের হচ্ছে। প্রহর গেটের দিকে তাকিয়ে খুশির আসার অপেক্ষায়। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন খুশি এলোনা তখন প্রহর গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে লাগলো খুশি আসছে কিনা। সব স্টুডেন্ট রা তো প্রায় বেড়িয়ে আসলো তাহলে খুশি এখনো কি করছে? প্রহর কলেজের ভেতর ঢুকে এদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো খুশি কোথাও আছে কিনা। খুশিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে প্রহর এবার খুশির নাম্বারে ফোন দিল। কিন্তু খুশির নাম্বার বন্ধ আসছে। প্রহর ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলো, খুশির নাম্বার বন্ধ কেন? এতক্ষণ হয়ে যাচ্ছে বাইরে আসছে না কেন? কোন সমস্যা হলো নাতো মেয়েটার। কথাটা ভেবে প্রহর এবার খুশির ক্লাসরুমে গিয়ে চেক করলো। কিন্তু সেখানেও পেলনা খুশিকে। প্রহরের এবার চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল মেয়েটা? ফোনও বন্ধ আসছে। এখন কিভাবে খোঁজ নিবো?
প্রহর আরও কিছুক্ষণ কলেজের সবজায়গায় খুঁজলো খুশিকে। খুশিকে না পেয়ে প্রহরের মনে ভয়ের উৎপত্তি হচ্ছে। মেয়েটার কিছু হলো নাতো? নাকি ও বাসায় চলে গেছে? কিন্তু বাসায় গেলে ওতো ফোন করে জানাতো আমাকে। ফোনটাও বন্ধ আসছে। কি করবো এখন আমি? প্রহরের হঠাৎ দিয়ার কথা মনে হলো। দিয়ার নাম্বারে ফোন দিল প্রহর। ফোন রিসিভ হলে খুশির কথা জানতে চাইলো সে। দিয়া বললো।
–ভাইয়া আমিতো আজকে কলেজে যাইনি। শাহিনের সাথে বেড়িয়ে বাসায় চলে এসেছি।
প্রহরের এবার মাথা ঘুরছে। খুশির কোন বিপদ হলো নাকি সেই ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে প্রহরের। বারবার খুশির নাম্বারে ফোন দিচ্ছে আর বারবারই বন্ধ পাচ্ছে। অস্থির হয়ে যাচ্ছে ও। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কলেজ থেকে বেড়িয়ে এলো ও।
সময়ের সাথে অস্থিরতা আরও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দিন গড়িয়ে রাতে নেমেছে। এখন পর্যন্ত খুশির নাম্বার বন্ধ আসছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে প্রহরের। বারবার ফোন বন্ধ পাওয়ায় রাগে এপর্যন্ত তিনটা ফোন ভেঙে ফেলেছে প্রহর।খুশির চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। খুশির সাথে কথা না হওয়া পর্যন্ত ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রহরের এই অস্থিরতা দেখে জিদান সাহেব চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে প্রহর? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোকে?
প্রহর অস্থির কন্ঠে বললো।
–বাবা আজ খুশিকে আনতে গেলে খুশিকে কলেজে পাইনি। আর তখন থেকেই ওর নাম্বার বন্ধ আসছে। আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে বাবা। ওর কিছু হলো নাতো? ওর সাথে কথা না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।
–আরে চিন্তা করিস না। খুশি মার কিছু হবে না। তুই তো জানিসই ও একটু বাচ্চা স্বভাবের। হয়তো ও বাসায় চলে গেছে কিন্তু তোকে বলার কথা মনে নেই। আর ফোনের হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে।
–আই রিয়েলি হোপ এন্ড প্রে তুমি যা বলছো তাই যেন হয়। কিন্তু ওর সাথে কথা না হওয়া আমি কিছুতেই শান্তি পাবোনা বাবা। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
প্রহর উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বললো।
–বাবা আমি আসছি।
কথাটা বলেই প্রহর বেড়িয়ে গেল। জিদান সাহেব আর কিনা বললেন না। ছেলেটা যে খুশির প্রতি এতো দূর্বল তা আজকে বুঝতে পারলেন উনি। আল্লাহ না করুক কোন কারণে মেয়েটাকে না পেলে ছেলেটা যে কি করবে তার আভাস পাচ্ছেন উনি। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ছেলেটা যেন ওমন দিন কখনো না দেখে।
__
রাত ১১টা
খুশির বাসার সামনে গাড়ি থামিয়ে বসে আছে প্রহর। মনে মনে আশা করছে একবার শুধু খুশিকে বেলকনিতে দেখতে পেলে হয়। তাহলেই শান্তি পাবে ও। তবে ঘন্টাখানিক বসে থাকার পরও খুশির কোন দর্শন পেল না। আর থাকতে পারছে না প্রহর। খুশিকে না দেখতে পেলে এবার হয়তো ওর দম সত্যি সত্যিই বন্ধ হয়ে যাবে। রাত অনেক হয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয় বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই প্রহর এবার গাড়ি থেকে বের হয়ে দেয়াল টপকে খুশিদের বাসার গেটের ভেতর ঢুকলো। খুশির ব্যালকনির নিচ বরাবর এসে পাইপ বেয়ে দোতালায় খুশির ব্যালকনিতে উঠা শুরু করলো। প্রহর মনে মনে বলতে লাগলো, কি দিন এসে গেল তোর।দ্যা প্রহর মেহরাবকে শেষমেশ কিনা টিনএজারদের মতো পাইপ বেয়ে উঠতে হচ্ছে। লোকে ঠিকই বলে প্রেম মানেই কপালে দুর্ভোগ।
অনেক কষ্টে হাত পা ছিলে নিয়ে খুশির ব্যালকনিতে উঠতে সক্ষম হলো প্রহর। ব্যালকনির আস্তে করে খুলে ভেতরে তাকালো সে। বিছানার উপর খুশিকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আটকে থাকা নিঃশ্বাস টা বেড় হলো প্রহরের। তবে রাগও হচ্ছে প্রচুর। আমাকে অশান্তিতে ফেলে দিয়ে কি সুন্দর আরামে ঘুমাচ্ছে ম্যাডাম। প্রহর এগিয়ে গিয়ে খুশির কাছে বেডের ওপর বসলো। ডিম লাইটের আলোয় ঘুমন্ত খুশির মায়াবী মুখট দেখে প্রহরের রাগ মুহূর্তেই পানি হয়ে গেল। মন জুড়ে ছুঁয়ে গেল প্রশান্তির সুখছায়া। প্রহর খুশির মুখের ওপর ঝুঁকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো। কপালের চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে গালে হাত বোলাতে লাগলো। এই মুখটায় কি এমন আছে? কেন এমন পাগল করে দেয় আমাকে? আমাকে পাগল করে নিজে কি সুন্দর দিব্বি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
খুশি হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকালো। চোখের সামনে প্রহরকে দেখে ঘুমের ঘোরে মুচকি হেসে বললো।
–তুমি আবার এসেছ স্বপ্নে?
প্রহর বলে উঠলো।
–হ্যাঁ এসেছি। তবে স্বপ্নে না। বাস্তবে।
–ওওও বাস্তবে..
হঠাৎ খুশির চেতনা এলো। খুশি চোখ বড়বড় করে ঠাস করে উঠে বসলো। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
–প প্রহর?? তুমি সত্যি এখানে??
প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–না আমি না। আমার ভুত। ইডিয়ট একটা।
খুশি হাসিমুখে বললো।
–তুমি সত্যি আমার জন্য এখানে এসেছ?
–নাহ তোমার নানীমার জন্য এসেছি। ইডিয়ট একটা। তুমি আগে বলো তোমার ফোন বন্ধ কেন? আর তুমি কলেজ থেকে একা চলে এসেছ তা আমাকে জানাও নি কেন?
প্রহরের কথায় খুশির এবার তখনকার কথা মনে পড়ে গেল। খুশি অন্য দিকে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বললো।
–আমার খবর জানার তোমার কি দরকার? তুমি এখানেই বা কেন এসেছ? চলে যাও এখান থেকে।
প্রহর দুই হাতে খুশির দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললো।
–মজা করছ আমার সাথে? তুমি জানোনা আমি কেন এসেছি? একেতো তোমার কোন খবর না পেয়ে টেনশনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর তুমি বলছ তোমার খবর জেনে কি হবে? হয়েছে টা কি তোমার?
–কেন? কেন হচ্ছে এতো টেনশন? আমি কি হই তোমার? তুমি গিয়ে তোমার ওই সুন্দরীর টেনশন করো। আমার টেনশনের দরকার নেই।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–সুন্দরী? কে সুন্দরী?
খুশি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–হয়েছে আর সাধু সাজতে হবে না। আমি সব দেখেছি আজকে।
–আচ্ছা? আমাকেও বলোতো শুনি কি এমন দেখেছ তুমি?
–আজ তোমাকে ওই মেয়েটার সাথে রেস্টুরেন্টে কথা বলতে দেখেছি আমি। আর তুমি ওকে বলছিলে ওই মেয়ে আমার চাইতে হাজার গুন ভালো। ওকে পেলে তুমি সৌভাগ্যবান হয়ে যাবে।
–বাচ এতটুকুই শুনে চলে এসেছ? আরও কিছুক্ষণ থাকলে আমাদের বাকি প্রেমালাপও শুনে আসতে পারতে।
খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে?
–মানে তোমার মাথা ইডিয়ট। পুরো কথা না শুনেই উনি কাহিনি করে বসে আছে। আরে আমিতো ওখানে একটা মিটিং এর জন্য গিয়েছিলাম। মিটিং শেষে আমার ক্লাইন্ট চলে যেতেই কোথাথেকে যেন মেয়েটা এসে হাজির হলো। আমার সাথে কিছু কথা বলার রিকুয়েষ্ট করলো। আমিও ভদ্রতার খাতিরে রাজি হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমাকে বলেছিল।
–আচ্ছা আমিতো দেখতে শুনতে বা গুনের দিক দিয়ে সবদিক থেকেই খুশির চেয়ে ভালো। তাহলে তুমি আমাকে পছন্দ করলেনা। অথচ খুশিকে ঠিকই ভালোবাসলে। কেন? ওর মাঝে কি এমন আছে?
তখন আমি ওকে বুঝানোর জন্য বললাম।
–দেখ হ্যাঁ তুমি রুপে গুনে সবদিক থেকেই খুশির চেয়ে ভালো। তোমাকে পেলে যেকোনো ছেলেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে। তবে খুশি খুশিই। আর এটাই ওর সবচেয়ে বড়ো গুন। খুশি নিজের মাঝে অতুলনীয়। ওর মাঝে কি গুণ আছে তা হয়তো আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। শুধু বলবো খুশির মাঝে এমন নূর আছে যা আমার জীবনের সব অন্ধকার ঘুচিয়ে, সর্বত্র আলোকিত করে দিয়েছে। আমার কাছে খুশি পৃথিবীর সবচেয়ে স্পেশাল মেয়ে। না ওর মতো কেউ আছে। না কখনো হবে বলে মনে করি।
এভাবে বুঝানোর পর মেয়েটা বুঝতে পারে। এরপর ও চলে যায়। বাচ এতটুকুই। আর এই বিষয় টা নিয়ে তুমি মাথার উল্টো পাল্টা ঢুকিয়ে নিয়ে বসে আছ তাইনা? এমনিতে তো কিছু হলে ঝগড়া করে আমার মাথা খেয়ে ফেলো। তো আজকে আমার কাছে সরাসরি কিছু না বলে এভাবে ফোন বন্ধ করে বসে ছিলে কেন?
খুশি মাথা নিচু করে মলিন সুরে বললো।
–তো কি করবো? আমি মনে করি যে আমার সাথে থাকতে ইচ্ছুক না তাকে জোর করে বেঁধে না রাখাই ভালো। আমি কারোর জীবনে বাঁধা হয়ে থাকতে চাইনা।
প্রহর আবারও খুশির দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট। একেতো সারাদিন ফোন বন্ধ করে আমার পাগল প্রায় অবস্থা করে দিয়েছ। আর এখন বসে ফালতু ফিলোসোফি ঝাড়া হচ্ছে? মন তো চাচ্ছে উঠিয়ে একটা আছাড় মারি। তাহলে সব ফিলোসোফি বের হয়ে যাবে।
খুশি হঠাৎ নেকি কান্না শুরু করে দিলো।ঠোঁট উল্টে কেঁদে নাক টেনে টেনে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ মারবেই তো। মারো মারো। জানো আজ সারাদিন বসে বসে কতো কেঁদেছি। খাবারও খাইনি। ওই দেখ মা খাবার দিয়ে গিয়েছিল ওমনিই পড়ে আছে।
খুশির ইশারা অনুযায়ী প্রহর তাকিয়ে দেখলো টেবিলের ওপর খাবার ঢাকা রয়েছে। এবার প্রহরের খারাপ লাগছে। প্রহর দুই হাতে খুশির মুখটা আগলে ধরে আদুরে গলায় বললো।
–ইশশ আমার দুষ্টুপরি টা অনেক কেঁদেছে বুঝি? খাবারও খায়নি?
খুশি মাথা নাড়ালো। মানে না। প্রহর বলে উঠলো।
–আচ্ছা আমি খাইয়ে দিবো? তোমার টেনশনে আমিও ডিনার করিনি। চলো দুজন একসাথেই খাই।
–আচ্ছা।
প্রহর মুচকি হেসে খাবারের প্লেট এনে খুশিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। আর খুশিও নিজের হাতে প্রহরকে খাইয়ে দিলো। খাইয়ে দিতে দিতে প্রহর বলে উঠলো।
–আচ্ছা বাইদা ওয়ে তুমি ওই সময় রেস্টুরেন্টে কি করছিলে? তখন তো তোমার কলেজের ক্লাসের সময় তাইনা? তাহলে ওই সময় কলেজ ফাকি দিয়ে ওখানে কি করছিলে?
খুশি এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো
–আ আসলে দিয়া আর শাহিনের সাথে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।
–সামনে না তোমার এক্সাম? পড়াশোনা বাদ দিয়ে তুমি আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছ? তোমাকে না বলেছি তুমি এখন বেশি বেশি তোমার বইয়ে মনোযোগ দিবে?
–কেন? বইয়ের কি বাচ্চা হবে নাকি যে এতো মনোযোগ দিতে হবে? আর এতো পড়ে কি হবে? জামাই তো পেয়েই গেছি।
খাওয়া দাওয়া শেষে খুশি বললো।
–এখন কি তুমি চলে যাবে?
–নাহ সারাদিন অনেক টেনশন গেছে। আর পাইপ বেয়ে এখানে উঠতে অনেক ধকল গেছে। অ্যাম টায়ার্ড নাও। আমি আজ এখানেই থাকবো।
খুশি উৎসাহী কন্ঠে বললো।
–সত্যিই?? তারমানে তুমি আমার সাথে এখানে থাকবে? হাও রোমান্টিক।
প্রহর বলে উঠলো।
–বেশি এক্সাইটেড হওয়ার দরকার নেই। আমি শুধুই ঘুমাবো এখানে।
খুশি হতাশার সুরে বললো।
–ধ্যাৎ, তাহলে আর কি হলো।
প্রহর বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই মহান। আই মিন যে ডায়লগ গুলো আমার বলা উচিত সেগুলো তুমি বলছ? লজ্জা শরম সব হোল সেলে বেঁচে দিয়েছ তাইনা?
খুশি দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হেসে বললো।
–লজ্জা, শরম এগুলো সব মনের ভ্রম । এগুলো সব মোহ ময়া বালক । বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো সব কুসংস্কার। এসবে বিশ্বাস করতে নেই। আর তাছাড়া শরম করলে গরম ভাত পাওয়া যায় না।
প্রহর হেঁসে দিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই একটা পাগলী।
প্রহর খুশিকে নিয়ে বালিশে শুয়ে পড়লো। খুশির কপালে চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। খুশি বিড়বিড় করে বললো।
–খালি কপালে চুমু খায়। কেনরে ভাই আমার ঠোঁটে কি করোনা ভাইরাস হয়েছে?
বিড়বিড় করে বললেও প্রহরের কানে ঠিকই পৌঁছালো। প্রহর চোখ বন্ধ রেখেই বললো।
–বিড়বিড় না করে ঘুমিয়ে পড়ো।
এতক্ষণে খুশির মনোদেবি এসে হাজির হলো। উপর থেকে বলতে লাগলো।
–এই এতো সুবর্ণ সুযোগ তুই হাত ছাড়া করবি? এতো হট চিজ সামনে রেখে ঘুম কিভাবে আসবে তোর?
প্রহর আবারও চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বলে উঠলো।
–তোমার মনোদেবি কেউ বলো ঘুমিয়ে পড়তে।
খুশি একটু চমকে গেল। প্রহরও কি আমার মনোদেবির কথা শুনতে পায়? খুশি মুখটা একটু উঁচু করে দেখলো প্রহর ঘুমিয়ে আছে। খুশি মনে মনে বললো, বললেই হলো নাকি? এতো হট চকলেট সামনে থাকতে একটু ফায়দা নিবো না তাকি হয় নাকি? খুশি আস্তে করে ধীরে ধীরে প্রহরের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। উপরের তিনটা বোতাম খুলে শার্ট দুই দিকে সরিয়ে দিল।হ্যাঁ এখন ঠিক আছে। ঠোঁট চোখা করে প্রহরের বুকে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে, প্রহরের খোলা বুকের উঞ্চতায় নিজের মুখ লুকালো। বুকে মুখ ঘষে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল খুশি। প্রহরও চোখ বন্ধ অবস্থায় মুচকি হেসে খুশিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল। দুজনে প্রশন্তিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো।
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূূর
★বর্তমান,
ফাহিম প্রহরের রুমে ঢুকতেই হা হয়ে গেল। প্রহর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। প্রহরের লুক একদম চেঞ্জ করে ফেলেছে। চুলদাড়ি কেটে একদম মাচো ম্যান হয়ে গেছে। ফাহিম প্রহরের সামনে এসে শিস বাজিয়ে বলে উঠলো।
–ও মাই গড, লুক হু ইজ হিয়ার। দ্যা মাচো ম্যান ইন দ্যা হাউজ। আওয়ার স্টাইলিশ হিরো ইজ ব্যাক। ইউ আর কিলিং ব্রো।
প্রহর নিজের চুল সেট করতে করতে বললো।
–থ্যাংকস। ইটস নেসেসারি। খুশির দৃষ্টি আকর্ষন করতে হলে নিজেকে একটু প্রেজেন্টেবল করাটা জরুরি।খুশির সামনে সেই পুরানো প্রহরকে আনা দরকার। এখন দেখি আমাকে কিভাবে ইগনোর করতে পারে।
কথাটা বলে প্রহর চোখে সানগ্লাস পড়তে পড়তে বেরিয়ে গেল। ফাহিম পেছন থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতে লাগলো নাজানি ওর বন্ধুর কপালে কি আছে। ভাবনার মাঝেই ফাহিমের হঠাৎ তিশার কথা মনে হলো। ওই মেয়েটাকে শিক্ষা দেওয়া বাকি আছে ওর। আজকে তো হেব্বি মজা হবে। লেটস হ্যাভ সাম ফান। বাঁকা হেসে ফাহিমও বেড়িয়ে গেল ওর উদ্দেশ্যে।
তিশা ওর রুমে রেডি হচ্ছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। তখনই হঠাৎ রুমের কারেন্ট চলে গেল। পুরো রুম অন্ধকার হয়ে গেল। তখনই আয়নায় কারোর মুখচ্ছবি ভেসে উঠল। তিশা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সামনের ব্যাক্তি তখন তিশার মুখ চেপে ধরলো। তিশা আরও ভয় পেয়ে পেল। ভয়ে আত্মা শুঁকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। তিশা চোখ খুলে ফাহিমকে দেখতে পেল। ফাহিমকে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড়ই হয়ে গেল ওর। ফাহিম বাঁকা হেসে বললো।
–কি মিস তিশা চিনতে পারছেন তো? নাকি চশমা লাগবে?
ফাহিম ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিল। তিশা অবাক সুরে বললো।
–আ আপনি? এখানে?
–ইয়েস মিস তিশা আমি। এখন এটা আপনার দূর্ভাগ্য বা আমার সৌভাগ্য বলতে পারেন যে এখানে আপনাকে দেখে ফেলেছি আমি। আর আপনার ষড়যন্ত্র গুলোও জেনে গেছি। আমাকে বোকা বানিয়ে ছিলেন না ? এখন আমার পালা।
তিশা ভীতু স্বরে বললো।
–মানে? কি করবেন আপনি?
ফাহিম বেডের ওপর আরাম করে বসে বললো।
–তেমন কিছুই না। জাস্ট মাকে ফোন করে বলবো যে আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে। আর বাকিটা তুমি নিজেই বুঝতে পারছ।
তিশা এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। সে ফাহিমের সামনে এসে বিনয়ী সুরে বললো।
–দেখুন প্লিজ এমন করবেন না। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি বলুন?
–ক্ষতি করেছ মানে, আলবাত করেছ। আমার সাথে ধোঁকা ধারি করে আমাকে রীতিমতো বোকা বানিয়েছ। আর তোমাকে মানা করার কারনে সবার সামনে আমাকে ভিলেন বানিয়েছ।আর নিজে ভুক্তভোগী সেজে সবার সিমপ্যাথি লুফে নিচ্ছ। এটা কি তোমার কাছে কম মনে হচ্ছে?
–দেখুন আমি কোনভাবে শুধু বিয়েটা ভাঙতে চাচ্ছিলাম। আসলে আমি এখুনি বিয়ে করতে চাইনা। বিয়ে মানে স্বাধীনতা শেষ হয়ে যাওয়া। যেটা আমি মোটেও চাইনা।মা বাবাকে বললে ওনারা মানতো না। তাই ওমন করেছিলাম। প্লিজ ভুলে যান না ওসব।
–আ হাহা নিজে ভালো থেকে অন্যকে ভিলেন সাজানো তাইনা। বিয়ে করবে না সেটা নিজে বলে দিতে। তানা করে তুমি আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করেছ। এখন এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। আমি এখুনি মাকে ফোন করে বলে দিবো যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি। তারপর বুঝবে মজা।
–দেখুন প্লিজ দয়া করে এমন করবেন না। এতে আপনার কি লাভ বলুন? আপনিও তো এতে ফেঁসে যাবেন তাই না?
–দ্যাটস নট ম্যাটার। এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ, ওয়ার এন্ড রিভেঞ্জ । তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যদি আপনাকে বিয়ে করতে হয় তাতেও সমস্যা নেই। এমনিতেও চেহারা সুরত মোটামুটি ভালোই আছে। আমি কাজ চালিয়ে নিতে পারবো।
তিশার রাগে শরীর রি রি করছে। ইচ্ছে তো করছে লোকটাকে এখানেই বালিশ চাপা দিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেই।
হঠাৎ ফাহিম বলে উঠলো।
–ফ্লপ প্ল্যান।
তিশা চমকে উঠে বললো।
–মানে?
–মানে, আমাকে খুন করার যে প্ল্যান করছেন সেটা টোটালি ফ্লপ আইডিয়া। কারণ এই রিসোর্টের কোনায় কোনায় সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে।আর এটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের রিসোর্ট।তাই আমি কবরে যাওয়ার আগেই তুমি ফাঁসির দড়িতে লটকে থাকবে। তাই বলছি ফ্লপ আইডিয়া।
তিশা অবাক হয়ে ভাবলো এ আমার মনের কথা কিভাবে শুনলো? যাইহোক এখন রাগলে চলবে না। আপাতত এর সামনে নত হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তিশা নিজের রাগ গিলে নিয়ে বললো।
–দেখুন কি চান আপনি? আপনি আমাকে অন্য যা শাস্তি চাইলে দিতে পারেন। তবুও প্লিজ বিয়ের কথা বলবেন না।
ফাহিম বাঁকা হেসে বললো।
–আর ইউ শিওর? যা বলবো তাই করবেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।
–ওকে ফাইন। আপনি যখন এতো আকুতি মিনুতি করছেন তখন আপনাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। আপনিও কি মনে রাখবেন কোন দয়াবান লোকের সাথে পালা পড়েছিল। যাইহোক আসল কথায় আসি। তো এখন থেকে আমি যে কয়দিন এখানে আছি। আমি আপনাকে যা যা করতে বলবো আপনাকে তাই তাই করতে হবে। যখন যেখানে ডাকবো সেখানেই যেতে হবে।
তিশা একটু ভীতু স্বরে বললো।
–যা খুশি তাই মানে? দেখুন খবরদার আমার সাথে উল্টো পাল্টা করার কথা ভাববেন না। আমি মোটেও সে ধরনের মেয়ে না।
ফাহিম তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–তোমাদের মেয়েদের চিন্তাধারা সবসময় ওয়ান ওয়ে ট্রাকেই চলে তাইনা? যত্তসব চিপ চিন্তাভাবনা। আমার এতো খারাপ দিনও আসেনি যে তোমার সাথে ওসব করতে যাবো। আই হ্যাভ এ ক্লাস।
ফাহিমের কথায় রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তিশার। তবে কিছু করার নেই। মাইনকার চিপায় ফাইস্যা গেছে যে। এখন এই হাঁদারাম কেই গুরুঠাকুর মানতে হবে। ফাহিম বলে উঠলো।
–আর হ্যাঁ একদম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আমাকে না বলে চলে গেলে আমি সাথে সাথেই মাকে ফোন করে বিয়ের কথা বলে দিবো।
তিশা দ্রুত বলে উঠলো।
–আরে না না আমি কোন চালাকি করবোনা। আপনি যা বলবেন তাই হবে। তবে আপনিও প্রমিজ করুন। এরপর আপনি আর বিয়ের কথা বলবেন না।
–ওকে প্রমিজ। তো এখন চলো কাজ শুরু করো।
–কি কাজ?
ফাহিম বেডের ওপর আরামে শুয়ে পড়ে বললো।
–আপাতত আমার পা অনেক ব্যাথা করছে। একটু আপনার কোমল হাতে আমার পা টিপে দিন।
তিশা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো।
–হোয়াট? আমি পা টিপে দিবো?
–হ্যাঁ এখানে কি আমি তুমি ছাড়া অন্য কেউ আছে? জলদি জলদি শুরু করো। নাহলে দ্বিতীয় বার চর বলবোনা। সোজা মাকে ফোন লাগিয়ে দিবো।
–না না আমি করছি তো।
–গুড। লেটস স্টার্ট।
তিশা দাঁতে দাঁত চেপে ফাহিমের পা টিপে দিতে লাগলো। ফাহিম বিশ্ব জয়ের হাসি হাসছে।
__
খুশি সমুদ্র কিনারে ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে হাঁটু ভাজ করে, হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। সামনের অথই সমুদ্রের পানির উত্তাল ঢেউকে অবলোকন করছে। যদি পারতো তাহলে নিজেকেও এই অথই সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতো। এই বোঝতুল্য এই জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যেত ও। হঠাৎ খুশি পাশে তাকাতেই ওর নজর আটকে গেল। প্রহরের এই পরিবর্তীত রুপে খুশির হৃদয়ের তার বেজে উঠলো। না চাইতেও প্রহরের আবহে ডুবে গেল ও। চোখের সামনে ভেসে উঠছে পুরান দিনের প্রতিচ্ছবি। এই সুদর্শন যুবক যে বরাবরই ওকে ঘায়েল করে দেয়। এমন কেন করছে সে? এমনিতেই এতো কঠিন সবকিছু। তারওপর এখন এভাবে আমার সামনে এসে আমার জন্য সবকিছু আরও কঠিনতর করে দিচ্ছে।
খুশিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রহর বাঁকা হাসলো। সে জানতো আজ খুশি ওর থেকে নজর সরাতেই পারবেনা। প্রহর আকর্ষণ থেকে খুশির বাঁচা মুশকিল।
তবে প্রহরের এই আকর্ষণ শুধু খুশি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইলো না। আশেপাশের মেয়েগুলোও প্রহরের আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে পড়লো। সবাই লোলুভ দৃষ্টির তীর নিক্ষেপ করছে প্রহরের দিকে। কয়েকজন তো এগিয়েও এলো প্রহরের সাথে পরিচিত হতে। একপ্রকার ক্লোজ হওয়ার চেষ্টায় নিয়জিত তারা। আর এসবকিছুই খুশির চক্ষুশূল হয়ে উঠছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। বুকে জ্বলে উঠছে হিংসুক অগ্নির শিখা। খুশি দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে বেহায়া চোখের অবাধ্য নজর ঘুরেফিরে সেদিকেই যাচ্ছে । মেয়েগুলো যেন প্রহরের গায়ে ঢলে পড়তে চাইছে। খুশির হাত পায়ের মাঝে নিসপিস করছে। মেয়েগুলোকে এই বালির মাঝে পুতে ফেলার অদম্য ইচ্ছেও জাগছে মনে।
খুশির এই জ্বলন প্রহরের চোখ এড়ালো না। বাঁকা হাসলো প্রহর। খুশির মনের অবস্থা আচ করতে পারছে সে। প্রহরের মনে আছে কোন মেয়ে ওর ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করলে খুশি কতটা ক্ষেপে যায়। ওর করা সেই পাগলামি গুলো প্রহর কখনোই ভুলতে পারে না। এসব কথা মনে পড়তেই প্রহর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এখন এই জ্বলনই খুশিকে ওর কাছে নিয়ে আসবে। আমাকে অন্য মেয়ের ক্লোজ হতে দেখলে খুশি সহ্য করতে পারবেনা। ও নিশ্চয় কোনো না কোন রিয়্যাক্ট করবে। আর নিজের মনের কথাও বলে দিবে। এসব পরিকল্পনা করে প্রহর সেই মোতাবেক একটা মেয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে লাগলো। মেয়েটার হাত ধরে সমুদ্রের পানিতে হাঁটতে শুরু করলো। খুশিকে দেখিয়ে দেখিয়ে মেয়েটার সাথে নানান অঙ্গভঙ্গী করে হাসিঠাট্টা করতে লাগলো । আর আরচোখে তাকিয়ে খুশির রিয়্যাকশন দেখছে। মেয়েটা একসময় ইচ্ছেগত ভাবেই প্রহরের গায়ের ওপর ঢলে পড়লো। প্রহরের ভেতরে ভেতরে চরম বিরক্ত লাগলেও আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না।
খুশির আর সহ্য হচ্ছে না। বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। চোখে নোনাজল জমে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখুনি গিয়ে মেয়েটাকে পানির মাঝে চুবিয়ে মেরে ফেলতে। কিন্তু না, ওর নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে হবে। আমিতো এটাই চাই। প্রহর আমাকে ভুলে নিজের জীবনে সামনে অগ্রসর হোক এটাই তো চাই। তাহলে এখন যখন সেটাই হচ্ছে তাহলে আমার দূর্বল হয়ে পড়া চলবেনা। খুশি মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে নিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো। তবে চাইলেও মনকে শক্ত করতে পারছে না। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতর টা। মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠছে। চোখের সামনে কেমন সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। শরীরের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। পায়ের চলা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা। কিন্তু এখন যে ওকে এখান থেকে যেতেই হবে, নাহলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। খুশি অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তবে মনে হচ্ছে না বেশিক্ষণ আর টিকে থাকতে পারবে। খুশি শরীরের শক্তি হারিয়ে পড়ে যেতে লাগলো। তখনই কেউ সামনে থেকে এসে ধরে ফেললো। খুশি সামনের ব্যাক্তির বুকে গিয়ে পড়লো। খুশি সেই ব্যাক্তির কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে মাথা তুলে দেখলো এটা জারিফ। খুশি আধো আধো চোখে তাকিয়ে অতি ক্লান্ত সুরে বললো।
–আমাকে নিয়ে চলো বিবি। জলদি নিয়ে চলো। ও দেখার আগেই নিয়ে চলো আমাকে।
জারিফের বুঝতে বাকি রইলো না খুশি কি বলতে চায়ছে।সে একমুহূর্তও দেরি না করে খুশিকে দ্রুত কোলে তুলে নিল। কোলে নিয়ে যেতে যেতে বললো।
–আমি জানি তুই এসব ইচ্ছে করেই করিস। যাতে আমার কোলে উঠে ঘুরতে পারিস। সেদিনও এমন করেছিলি। ছোটবেলার অভ্যাস আর গেলনা তোর। নিজের বউকেও বোধহয় এতবার কোলে নেইনি।
খুশি জানে জারিফ ওর মন ভালো করার জন্য এসব বলছে। তাই খুশিও জারিফের কাঁধে মাথা রেখে ক্লান্তিকর হাসি দিয়ে ক্লান্ত সুরে বললো।
— তোমার বউকে কোলে নিলে তোমাকে তখন চার কাঁধে তুলতে হবে বিবি।
–চুপ বদমাশ। নিজের ভাবিকে মোটা বলছিস? তোর ভাবি শুনলে হয়। তোর মামুর বাড়ি আসা বন্ধ করে দিবে।
অথচ ওরা জানলোই না, ওদের পেছনে কেউ তিব্র ক্রোধে ধ্বংসাত্মক রুপ ধারণ করছে। তার চোখের তপ্ত লাভায় পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। খুশিকে তখন চলে আসতে দেখে প্রহরও ওর পিছু নেয়। তবে কিছুদূর আসতেই খুশিকে অন্য লোকের বাহু বন্ধনে দেখতে পায় ও। সাথে সাথেই থমকে যায় ওর কদম। লোকটার হাত যখন খুশিকে জড়িয়ে ছিল তখন প্রহরের ভেতর মনে হচ্ছিল কেউ অগ্নিগিরির লাভা ঢেলে দিয়েছে। আর লোকটা যখন খুশিকে কোলে তুলে নিয়ে গেল তখন মনে যেন হলো কেউ ওর কলিজায় ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। কষ্ট আর ক্ষোভে প্রহরের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।চোখের লালিমার পরদ গাঢ় হচ্ছে। হাতে থাকা সানগ্লাস টা হাতের মুঠোয় সজোরে চেপে ধরলো প্রহর। সানগ্লাস ভেঙে হাতের ভেতর গেধে গেল। হাত থেকে টপটপ করে নিচে রক্ত পড়তে লাগলো। তবে তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই প্রহরের। সে যে আপাতত তার হৃদহরণির দহনে জ্বলে মরছে।
___
রাতে ডিনার শেষে নিজের রুমে যাচ্ছিল খুশি। খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবে জারিফের জোরাজুরিতে না গিয়ে পারলোনা। অগত্যা অল্প কিছু খেয়ে এসেছে। করিডর দিয়ে হেঁটে যেতেই কেউ আচমকা ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে রুমের ভেতর নিয়ে গেল। খুশি চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখলো এটা প্রহর। প্রহর রুমে এসে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। খুশিকে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। খুশির দুই হাতের মাঝে হাত রেখে খুশিকে আটকে দিল। খুশির মুখের ওপর ঝুঁকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–ও কেন ছোঁয় তোমাকে? বল কেন?
খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ছোঁয় মানে? কি বলছ এসব?
–তুমি ভালো করেই জানো আমি কি বলছি। বলো ও কেন ছোঁয় তোমাকে? ওর সাহস কি করে তোমাকে ছোঁয়ার? ও কেন ছুঁবে তোমাকে?
প্রহরের মুখ থেকে মদের তীব্র দুর্গন্ধ আসছে। চোখ দুটোও ভীষণ লাল হয়ে আছে। খুশি বুঝতে পারছে প্রহর এখন সম্পূর্ণ মাতাল আর চরম পর্যায়ে রেগে আছে। এই অবস্থায় ওর হিতাহিত জ্ঞান নেই। খুশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো।
–প্রহর ছাড় আমাকে। ইউ আর ড্রাংক নাও। তোমার হুঁশ ফিরুক তারপর কথা বলবো।
প্রহর আরও ক্ষিপ্ত সুরে বললো।
–নাহ তুমি যাবে না। কোথায় যাবে তুমি হ্যাঁ? ওই রাস্কেলটার কাছে যাবে? কেন যাবে হ্যাঁ? কেন যাবে? কেন ও তোমাকে ছুঁবে? তুমি শুধু আমার। তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু আমার। ও কেন ছুঁবে? কেন ছুঁবে বলো?
প্রহর খুশির কোমড়ে হাত রেখে কিছুটা অস্বাভাবিক সুরে বললো।
–এখানে ছুঁয়েছিল তখন তাইনা? কেন ছুঁয়েছিল ও বলো?
প্রহর খুশির কোমড়ে জোরে খামচে ধরলো। হাতের নখগুলো সব গেঁথে পড়লো কোমড়ে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো খুশি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। তবে নেশায় মাতাল প্রহরের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অতিরিক্ত রাগ আর কষ্টের সংমিশ্রণে পুরো উন্মাদ হয়ে গেছে ও। কি করছে তা নিজেও জানে না।পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–আর কোথায় কোথায় ছোঁয় ও তোমার?
প্রহর এবার খুশির গলার ওড়না টা টান দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। গলায় হাত রেখে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–এখানে ছুঁয়েছে হ্যাঁ?
কথাটা বলে এবার গলায় কামড় দিয়ে বসালো প্রহর।সবগুলো দাঁত বসিয়ে দিল চামড়ার গভীরে। ব্যাথায় খুশির নাজেহাল অবস্থা। খুশি আর সহ্য করতে না পেরে সর্বশক্তি দিয়ে প্রহরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো।
–ছাড় আমাকে। পাগল হয়ে গেছ তুমি। জুঙ্গলী জানোয়ার দের মতো আচরণ করছ। হ্যাঁ ও ছোঁয় আমাকে তো? তাতে কি হয়েছে? আমার স্বামী আমার যেখানে খুশি সেখানে ছুঁতে পারে। আমার সাথে যা খুশি তাই কর…….
কথা শেষ করতে পারলো না খুশি। ক্ষিপ্ত প্রহর খুশির কথায় আরও ক্ষিপ্র হয়ে এবার খুশির অধর আঁকড়ে ধরলো। সমস্ত রাগের প্রতিক্রিয়া ঘটালো খুশির নরম অধর কামড়ে ধরে। এটার জন্য খুশি মোটেও প্রস্তুত ছিলনা।কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ও। প্রহরের দাঁতের ধারে খুশির নিচের ঠোঁট কেঁটে রক্ত বের হতে লাগলো। খুশি এবার নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রহরের বুকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে লাগলো। তবে পাগল প্রহরের সাথে পেরে উঠছেনা কিছুতেই। খুশির অশ্রুধারা গড়ে প্রহরের ঠোঁটে এসে লাগলো। প্রহর ওই অবস্থায়ই খুশির চোখের দিকে তাকালো। খুশির চোখের পানি দেখে প্রহরের একটু হুঁশ এলো। তবে খুশির অধর ছাড়লোনা ও। এবার দাঁতের হিংস্রতার বদলে ও নিজের অধর দিয়ে খুশির অধরে মোলায়েম মিষ্টতা ঢেলে দিতে লাগলো। মেতে উঠলো অন্য এক নেশায়। যে নেশার সামনে এই অ্যালকোহলের নেশা কিছুই না।
প্রহরের এই ছোঁয়ায় খুশিও নিজেকে সামলাতে পারলোনা। ধীরে ধীরে কেমন শান্ত হয়ে এলো ও।না চাইতেও এতদিন পরে প্রিয়তমের ভালোবাসাময় ছোঁয়ায় দূর্বল হয়ে পড়ছে ও। কিছুক্ষণের জন্য সব ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে ভাসাতে ইচ্ছে করছে প্রহরের জোয়ারে। খুশিকে শান্ত হয়ে আসতে দেখে প্রহর এবার খুশির কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে আরও মিশিয়ে নিলো। আর থাকতে পারলোনা খুশি। সব ভুলে নিজেও সায় দিল প্রহরের সাথে। প্রহরের কাঁধের পেছনে হাত দিয়ে প্রহরের চুল খামচে ধরে নিজেও হারালো প্রহরের মাঝে। খুশির রেসপন্স পেয়ে প্রহরের নেশা আরও বেড়ে গেল। প্রহর এবার খুশির অধর ছেড়ে ধীরে ধীরে গলায় নেমে এলো। খুশির গলায় চুমোতে ভরিয়ে দিতে লাগলো। কোমড়ে রাখা হাতটা এবার খুশির কামিজের পেছনের চেইনে রাখলো। চেইন টা একটু খুলতেই খুশির হুঁশ এলো। চমকে গেল ও। ও কি করছে এসব? না না এটা একদম ঠিক না। এভাবে প্রহর ওর কাছে আসলে প্রহর বুঝে যাবে যে,আমি এখনো কুমারী আছি। আমার কোন বিয়ে হয়নি। আমার এতদিনের সব পরিশ্রম ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। না না আমি এটা হতে দিতে পারি না। কিছুতেই না।
খুশি এবার দুই হাতে প্রহরের বুকে সজোরে ধাক্কা দিল। আচমকা ধাক্কায় প্রহর ব্যালেন্স হারিয়ে নিচে পড়ে গেল। খুশি আর একমুহূর্তও না দাড়িয়ে নিচ থেকে ওড়না টা নিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। প্রহর শুধু আহত দৃষ্টিতে খুশির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বললো।
–খুশিইইইইইই
__
জারিফ খুশিকে দেখার জন্য ওর রুমে এসে দেখলো খুশি রুম অন্ধকার করে,নিচে ফ্লোরে বসে বেডের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে। জারিফের বুঝতে বাকি রইলো না খুশির কাঁদার কারণ কি। নিশ্চয় ওই ছেলেটার সাথেই কিছু হয়েছে। জারিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বেডের ওপর বসে খুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো।
–কেন এসব করছিস খুশি? ছেলেটাকেও কষ্ট দিচ্ছিস। আর নিজেও কষ্টে ভুগছিস। এরচেয়ে ভালো ছেলেটাকে সব সত্যি টা বলে দে।
খুশি মাথা তুলে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–কি বলবো বিবি? বলো কি বলবো? কিভাবে বলবো? কিভাবে বলবো যার সাথে ও নিজের জীবন কাটাতে তার জীবন রেখায় শেষ হয়ে গেছে? কিভাবে ওকে আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়িয়ে নিবো? যে জীবনটাকে মরণঘাতী “”ব্রেইন টিউমার”” তিলতিল শেষ করে দিচ্ছে। কিভাবে বলবো বলো? ওকি সইতে পারবে? না না কিছুতেই সইতে পারবেনা। আমি চাইনা আমার পরে ও আমার শোকে সারাটাজীবন জীবন্ত লাশ হয়ে থাকে। আমার এই মরণঘাতী অসুখের কথা ওকে কিছুতেই জানানো যাবে না। আমি চাই ও আমাকে ঘৃণা করুক। তবেই ও ওর জীবনে সামনে এগুতে পারবে।
–দেখ তোকে এখানে এনেছিলাম তোর ভালোর জন্য। যাতে প্রকৃতিতে সময় কাটিয়ে তোর একটু ভালো লাগে। কিন্তু এখানে এসে তো তুই এসব স্ট্রেসের কারণে আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিস। তুই যত যাই বলিস। আমার মনে হয় তোর ওকে সত্যি টা জানিয়ে দেওয়াই উচিত। নাহলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। ভেবে দেখিস আমার কথা।
কথাটা বলে জারিফ চলে গেল। আর খুশি মনে মনে বললো, কিভাবে বলবো ভাইয়া? ওযে সইতে পারবেনা। খুশির মনে পড়লো সেইদিনের কথা। যেদিন ও একটুখানি অসুস্থ হওয়ায় প্রহরের কি অবস্থা হয়েছিল। সেদিনের কথা ও আজও ভুলতে পারে না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই স্মৃতি।
চলবে……
/