কারো ঠোঁটের মিষ্টি স্পর্শ কপালে অনুভব করছে শুভ্রা। কিন্তু অতিরিক্ত ঘুমের কারণে সে তার চোখ খুলতে পারছে না। কেউ তার কপালে গভীর ভালোবাসার পরশ দিয়েছে। সে অনুভব করতে পারছে। সে কষ্টে চোখ পিটপিট করে খুলে চারিদিকে কেউ নেই। সে বেডের পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিল। সেভেবেই নিল এটা তার স্বপ্ন ছিল। সে আর এগুলো চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পরল।
চরম বিরক্তি সঙ্গে নিয়ে ভারসির্টির দিকে যাচ্ছে শুভ্রা। আজ কোনমতেই সে ভারসির্টি যেতে চাচ্ছিল না। রাতের ঘটনাটি কেন জানি ভুলতে পারছে না ও। ইদানিং কিছু দিন যাবত এই রকম হচ্ছৈ তার সঙ্গে। ওর মা জোর করে পাঠিয়েছে ওকে ভারসির্টি । রাতে ঘটনাটি নিয়ে ভাবছিল আর মুখ গোমড়া করে হাটছিল।
হঠাৎ একটা কুকুরের দিকে চোখ পরল তার। তার মুখে একটা দুষ্টামি হাসি ফুটে উঠল। রাস্তা থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে দিল কুকুরের গায়ে। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল আর দৌড়ানি দিতে লাগল। আর শুভ্রা সে তো জান প্রাণ দিয়ে দৌড়ে একবারে ভারসির্টিতে চলে আসল। শুভ্রা কুকুরটাকে এমন ঘুরিয়েছে যে কুকুরটাও হাপিয়ে গিয়েছে।
এখন আসুন শুভ্রা সম্পর্কে কিছু জেনে নেই। শুভ্রার পুরো নাম শুভ্রতা শুভ্রা চৌধুরী। শুভ্রা আরিফুল চৌধুরী আর আলিয়া চৌধুরীর মেয়ে শুভ্রার একটা বড় ভাইও আছে নাম অভ্র চৌধুরী। সে বছর দুইয়েক হলো ডাক্তারি করছে। অভ্র অনেকটা শান্ত প্রকৃতির। কথা প্রয়োজন ছাড়া বলেনা বলেই চলে।আর শুভ্রা এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। আর হয় তো এতোক্ষনে বুঝেছেন শুভ্রা একটু দুষ্টু প্রকৃতির আর শুভ্রা একটু বাচল টাইপের ও। একবার কথা বলা শুরু করলে আর থামানো যায় না।
যাইহোক…..,এবার গল্পে, ফিরি শুভ্রা হাপাতে হাপাতে কেন্টিনে গিয়ে ওর ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বসল। লুভা আর নুসরাত স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে কারণ তারা জানে শুভ্রার বেপারে ভালো করেই । ওরা তিনজন ছোট থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করে আসছে। শুভ্রা টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিল।
লুভা স্বাভাবিক ও শান্ত গলায় শুভ্রাকে জিঙ্গাসা করল.., “কি রে আবার কি করে এতো হাপাতে হাপাতে আসলি শুনি তো একটু।”
শুভ্রা একটু লুভার দিকে তাকালো লুভা ফোন টিপছে আর শুভ্রার উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে।
শুভ্রা কিছু বলার আগেই নুসরাত বলল ” কি রে শুভ্রা তুই না আজকে ভারসির্টিতে আসবি কাল রাতে যে আমাদের বললি।” তাহলে!!!?…
শুভ্রা মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বলল আম্মু জোর করে পাঠাল। বলল আমি বাসায় থাকলে ফাজলামি করে সারাদিন কাটাবো তার থেকে ভারসির্টিতে আসলে একটু হলেও কিছুটা বাদরামী কম হবে। আর রাস্তায় একটা কুকুরকে ঢিল দিছিলাম। সেই কুকুর আমাকে দৌড়ানি দিছে।
শুভ্রার কথা শুনে লুভা ফোন রেখে শুভ্রার দিকে তাকাল নুসরাত ও তাকালো আবার দুইজন একে অপরের দিকে তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসিতে ফেটে পরল দুইজন। এইদিকে ওদের হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে শুভ্রার।
-“লুভা ”
কারো গম্ভীর গলায় ডাক শুনে তিনজনই পিছনে তাকালো। পিছনে তাকিয়ে সবার মুখের হাসি উড়ে গেল। কারণ ওই ব্যাক্তি এসে সবসময় লুভা তাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। পিছনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিকে লুভা প্রথম থেকে অপছন্দ করে আসছে। ছেলেটির নাম রাজিব খান। ওর পরনে কালো কালারের শার্ট সঙ্গে জিন্স,চোখে সানগ্লাস,হাতে ব্রান্ডের ঘড়ি। লুভাকে প্রথম দেখায় তার ভালো লেগে যায়। সে বড় লোক বাবার ছেলে। আর লুভা মধ্যবৃত্ত পরিবারের মেয়ে। তাতে রাজিবের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ও লুভাকে চায় মানে চায়। দীর্ঘ চার বছর যাবৎ.., লুভার পিছনে পরে আছে রাজিব। । কিন্তু লুভা এখন এই সবে জরাতে চায় না।
রাজিব এসে লুভাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আর শুভ্রা আর নুসরাত গালে হাত দিয়ে দেখলো শুধু। এই কাহিনি প্রতিদিন কার। এখনই লুভা কোনো ভাবে এনিয়ে বিনিয়ে রাজিবকে এরিয়ে ক্লাসে চলে যাবে আর রাজিব ও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চলে যাবে।
বসে বসে দূরে দাড়িয়ে থাকা ওদের ই দেখছিল শুভ্রা আর নুসরাত । তখনই একটা ছেলে তাদের চোখের সামনে এসে দাড়াল। ছেলেটিকে দেখেই শুভ্রা আর নুসরাতের মুখে বিরক্ত ফুটে উঠল। ছেলেটির নাম আবির। পরনে ঢিলেঢালা শার্ট আর ঢিলেঢালা প্যান্ট, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা আর চুল তেল দিয়ে আচরানো। যাকে বলে পুরো ভ্যাবলা মার্কা একটা ছেলে। ছেলেটি এক পলকে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রা তা দেখে বলল…….,
– “এই যে মি ভ্যাবলাইয়া চুহা,,আপনি আবার বলেই শুভ্রা নুসরাতের হাত ধরে ক্লাসের দিকে রওনা দিল। সেই ভারসির্টি প্রথম থেকে বেটা শুভ্রা আগে পিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওদের ক্লাসের দিকে যেতে দেখে আবির ও যেতে লাগল ওদের পিছু পিছু কিন্তু বেশি এগোতে পারল না। জোড়ে হাটা একটু এগতেই নিজের পায়ের সঙ্গে পা বেজে পরে গেল আবির।
শুভ্রা আর নুসরাত পিছে ঘুরে আবিরের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে ক্লাসের দিকে চলে গেল।
ওরা গিয়ে দেখল লুভা ও ইতোমধ্যে ক্লাসে এসে বসে পরেছে। ওরা দুইজন ও গিয়ে বসল। যথারীতি সময়ে ক্লাস শুরু হলো। সব গুলো ক্লাস ঠিক মতো শেষ করে তিনজন বেরিয়ে পরল ভারসির্টি থেকে। তিনজন কিছু সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলে যে যার বাসায় চলে গেল।
শুভ্রা বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকবে এমন সময় হঠাৎ পাশে বাড়ির টাকলা বুড়াকে দেখতে পেল। বেটা খুব বদ। বেটার বাড়ির পাশে একটা ফাকা জায়গা আছে সেখানে কখনো কাউকে যেতে দেয় না। জায়গাটি শুভ্রার খুব পছন্দের একটি জায়গা। যেহেতু জায়গাটার মালিক ওই বুড়ার কোন মালিকের তাই তার অনুমতি ছাড়া ও সেখানে প্রবেশ করা যায় না। সেই জায়গায় একদিন চুপিচুপি গিয়েছিল শুভ্রা। পরে বুড়ো দেখে নেয় আর আরিফুল চৌধুরীর কাছে বলেন। পরে সেটার জন্য সে বকা খায়। শুভ্রা তার ব্যাগ থেকে একটা সেন্টার ফ্রুট বের করে চিবতে লাগল।
বুড়ো আর একটু সামনে এগোতেই হঠাৎ তার জুতার সাথে কি জেনো বেজে ধরল। সে পা একটু উপরে তাকিয়ে দেখলে কি জেনো একটা তার জুতার সাথে লেগে আছে। বুড়ো ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এইদিকে শুভ্রার মুখে দুষ্টামি হাসি ফুটে উঠল। সে হাসতে হাসতে ভিতরে চলে গেল।
ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখতে পেল লিভিং রুমে তার বাবা মা বসে আছে। শুভ্রা শুকনো একটা ঢোক গিলল। সে ভাবতে লাগল। তার কোনো কথা নিয়ে বকার জন্য তার বাবা মা বসে আছে। তার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আলিয়া বেগম বললেন….,
– “কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন কাছে আয় কথা আছে। ”
শুভ্রা মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখল তার বাবা মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভয়ে ভয়ে গুটিগুটি পায়ে আরিফুল চৌধুরী আর আলিয়া চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাড়াল। মেয়ের এইরকম ভীতু চেহারা দেখে আরিফুল চৌধুরী হেসে দিলেন আর বললেন…,
– “ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আসলে আজকে সন্ধ্যায় আমার একটা ফ্রেন্ডের বাড়িতে পার্টি আছে। সেখানে আমাদের সবাইকে ইনভাইট করেছে। সন্ধ্যায় রেডি থেক। আমরা সাতটার দিকে যাব।”
শুভ্রা আরিফুল চৌধুরীর কথা শুনে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল।
——————————
পড়ন্ত বিকেল চারিপাশে এক মুখরিত পরিবেশ। বারান্দায় কফি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। দৃষ্টি তার বাহিরের প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। সূর্য রত্তিম আভা ধারন করেছে।
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে পিছনে ঘুরে তাকালো। তার সমবয়সী একটা ছেলেটি। ছেলেটি তারই পিএ। ছেলেটি তার কানেকানে কিছু বলে চলে গেল। ছেলেটির কথা শুনে তার মুখে একটা রহস্যময় বাকা হাসি ফুটে উঠলে। সে তার রুমে গিয়ে তার ফোন নিয়ে এসে একটা ছবি বের করে রহস্যময় হাসি দিয়ে বিরবির করে বলতে লাগল।
তুমি নিজেও জানোনা তোমার সঙ্গে কি ঘটতে চলছে বেবী। আর কিছু দিন তারপরেই……বলেই ছেলেটি অট্টহাসিতে ফেটে পরল।
——————–
শুভ্রা তার বারান্দায় বসে লুভা সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। শুভ্রা লুভাকে বলল…,
– “কি রে দুলাভাই কি খবর?”
লুভা রাগান্বিত কন্ঠে বলল..আবার শুরু হলো। তুই যদি আর একবার ওর কথা বলিস তাহলে কিন্তু,আমি কল কেটে দিব।
শুভ্রা বলল তাই নাকি বাবু। আমার বাবুটা দেখি রাগ করছে। রাগ করেনা বাবুটা। বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরল ও।
আর এইদিকে লুভা রেগে কল কেটে দিল।
শুভ্রা ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হসতে বসে পড়ল। হঠাৎ..,ফোনটা আবার বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে শুভ্রার কপাল কুচকে গেল। একটা আপরিচিত নাম্বার। শুভ্রা কল রিসিভ করল না। কিন্তু ফোন বেজেই চলছে। তাই সে বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে বলতে শুরু করল…,
কি সমস্যা অপরিচিতদের কল দিতে খুব ভালো লাগে। দেখছেন কল রিসিভ হচ্ছে না তারপর ও কেন বারবার দিচ্ছেন অভদ্রের মতো। কোন গ্রহ থেকে আপনি উদয় হয়েছে। আর আমার নাম্বারই কেন আপনার কল দিয়ে বিরক্ত করতে হবে। আর…,কে আপনি!! শুভ্রা খেয়াল করল ওপর পাশ থেকে কোনো রেসপন্স নেই। তাই সে বিরক্তি নিয়ে কল কেটে দিল।
—————–
অপরদিকে কলের অপরপাশের ব্যাক্তি বাঁকা হাসি দিয়ে বিরবির করে বলল…. “জানেমান..,তোমার নাম্বার ছাড়া আর কার নাম্বারে কল দিয়ে বিরক্ত করব।” আর আমি কে তা না হয় সময় হলেই বুঝবে…!
——————-
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। আলিয়া বেগম শুভ্রাকে সাজাতে ব্যাস্ত। ব্যাপারটা শুভ্রাকে খুব ভাবাচ্ছে। আর মা তাকে এতো সাজাচ্ছে কেন? শুভ্রা একটা নেভী ব্লু রঙের লেহেঙ্গা হোয়াইট ডায়মন্ডের নেকলেস আর ছোট দুটো দুল আর চিকন চিকন চারটা চুড়ি পরেছে। হালকা মেকআপ চোখে গারো করে কাজল আর ঠোঁটে হালকা পিংক কালারের লিপস্টিক দিয়েছে। এতেই শুভ্রাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। আলিয়া বেগম শুভ্রাকে,…………
(চলবে)
#পূর্ণতার_মাঝেও_অপূর্ণতার_ছোয়া
#পর্বঃসূচনা_পর্ব
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা