প্রিয়কাহন পর্ব -২০+২১

#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |২০|

প্রিয়তা অভীর হাত চেপে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বন্ধন আরও দৃঢ় হলো। অভী হাসলো ওর বোকামো দেখে। দুষ্টু হেসে বললো,
‘ এবার? পারলে ছাড়িয়ে নাও নিজেকে আমার কাছ থেকে?’

ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো প্রিয়তা। নিজেকে বুঝ দিলো এটা কি সেই অভী যে ফ্লার্ট এর ‘ফ’ ও জানতো না? এখন তো মনে হচ্ছে এতদিনের পুষে রাখা অভী সম্পর্কে সব ধারনাই ওর ভুল। এ শুধু ফ্লার্ট পারে বললে ভুল হবে, ভালোই ফ্লার্ট পারে। শুধু সুযোগের অভাবে এই নিপুন গুণটা প্রকাশ করতে পারেনি৷ প্রিয়তা পুনরায় নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াস চালালো, ব্যার্থ প্রয়াস। অভী তা দেখে বললো,

‘ খামোখা নড়াচড়া করো না। অন্যথায় তুমি নিজেই কিন্তু ক্লোজ হচ্ছো আমার!’

কথাটা স্নায়ু ধারন করতেই প্রিয়তা দম ফেলে হাল ছাড়লো। আসলেই বেশি কাছাকাছি চলে এসেছিলো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে। রিনরিনে স্বরে বললো,

‘ এখানে কেন আনলেন আমায়?’

অভী দম ফেলে বললো,

‘ এমনেই!’

ভ্রু কুঁচকালো প্রিয়তা। কথাটা ঠাওর করতে পারলো না৷ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সে। বললো,

‘ এটা আবার কেমন কথা? এমনিতেই কেনো আনবেন আমায়?

‘ কেনো এভাবেই তোমায় আনতে পারবো না?’

‘ মোটেও না।’

অভী ভ্রু নাচিয়ে খানিকাটা জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘ তাহলে তোমাকে এখানে আনার কারন এখন বানিয়ে নেই?’

কথাটি বলে অভী কোমড় চেপে টেনে আনলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো এবার। খেয়াল করলো শরীর মৃদুমাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপছে। অসাড় হয়ে আসছে শরীর। অভী প্রিয়তার ভয়ার্ত মুখ দেখে হাসলো। সে এতকিছু ভেবে প্রিয়তাকে এভাবে নিজের কাছে টানেনি৷ না ছেলেটার মনে অশ্লীল কোনো চিন্তা ছিলো। তবে কেন যেন মেয়েটার ভয়ার্ত মুখ দেখতে ভালোলাগে অভীর। ভীষণ ভালোলাগে। পাত্রীদৃষ্টির প্রথম সাক্ষাৎ এ প্রিয়তা যখন জ্ঞান হারিয়েছিলো তখন সেটা বিরক্তির মনে হলেও পরপর তার কাজে সেটা অজান্তেই ভালোলাগার জায়গা করে নিয়েছিলো। অভী প্রিয়তার মুখে পড়া খুচরো চুল ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিলো৷ বললো,

‘ রিল্যাক্স, কাছে টেনে প্রেম ট্রেম করবো না৷ এমনিতেও এসব ব্যাপারে রুদ্র বা অদ্রির মতো আমার পিএইচডি করা নেই। তাই তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারো। আমি শুধু দেখতে চেয়েছি তুমি আমার কতটুকু ডোজে সজ্ঞানে থাকতে পারবে। নাহলে দেখা যাবে বিয়ের প্রথম রাতেও তুমি জ্ঞান হারাবে।’

স্পষ্ট খোঁচা মারার ইঙ্গিত। প্রিয়তার মুখ হয়ে গেলো বারবিডলের মতে চুপসানো। তারপর সেও দ্বিরুক্তি নিয়ে বললো,

‘ আমায় বিয়ে করা নিয়ে এত কনফিডেন্স? ‘

অভী হেসে উঠলো এ কথা শুনে। প্রতিউত্তরে বললো,

‘ ইয়েস ম্যাম!’

‘ এবার ছাড়েন তো! আমায় এমনিতেই যেমন এখানে এনেছিলেন এমনিতেই নাহয় যেতে দিন? আই’ম শিউর আমার অদিটা চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।’

ছেড়ে দিলো অভী প্রিয়তাকে। সবিনয়ে বললো,

‘ যান ম্যাডাম, নাহলে শালী সাহেবা এখানে এসে আমায় তার বাজখাই গলা শুনিয়ে যাবে!’

____________

অদ্রির কাছে যেতেই প্রশ্ন সে জর্জরিত করে ফেললো প্রিয়তাকে। প্রশ্নগুলো এরূপ ছিলো যে,

‘ প্রিয়ু তুই ঠিকাছিস? ওই হারামখোর অভী তোকে পিস পিস করে দেয়নি তো বিয়ে করবি না বলে? নাকি এটা বলেছে আমার সাথে অন্তু ভাইয়াকে প্রেম করতে দিবে না? কি করেছে সে বলতো? চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে।’

প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তখনই পেছনে সুরসুর করে এসে পড়লো অভী। অদ্রি কড়া চোখে তাকালো মেঘের সাথে ভেসে আসা অপ্রেমিক হবু দুলাভাইয়ের দিকে। প্রিয়তার হাত চেপে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ ইনি এখানে কি করছে?’

‘ আমি কি জানি? তুই জিজ্ঞেস কর?’

প্রিয়তার ঠোঁটে চাপা হাসি। অভী এসে বললো,

‘ রিক্সায় উঠিয়ে দিচ্ছি চলো।’

আকাশের মেঘ পাতলা হচ্ছে ভীষণ। বাতাসে মুখরিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক। মাত্র ৪০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় প্রিয়তাকে রিক্সা তার বাসায় পৌঁছে দিতে রাজি হলো। প্রিয়তা রিক্সায় উঠলো নির্দ্বিধায়৷ তবে ক্ষোভ জমেছে অদ্রির। অভী রিক্সাওয়ালাকে মানিব্যাগ থেকে ৪০ টাকা বের করে দিয়ে বললো,

‘ এই নিন। ‘

এবার ক্ষেপে গেলো অদ্রি। চেঁচিয়ে বললো,

‘ আপনি কেন ভাড়া দিচ্ছেন রিক্সার? আমরা গরীব নাকি? নাকি উড়ে এসে অধিকার জমাতে এসেছেন আমার প্রিয়ুর উপর?’

এটা সত্যি মনে মনে অদ্রি অভীকে ভয় পায়। একটু না- অনেকটা বেশিই ভয় পায়। তবুও একথা অদ্রি এত সাহস করে কিভাবে বললো কে জানে? তাজ্জবের বিষয় হলেও অভী তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না অদ্রি বোম্বাই মরিচ টাইপ ব্যাবহারে। শান্ত, নীরব শীতল চোখে অদ্রির দিকে তাকিয়ে সে মানিব্যাগটা পকেটে গুজলো। এতে আরও একবার কাবু হয়ে গেলো অদ্রি। অভী বললো,

‘ রিক্সা ভাড়াটা প্রিয়তার হয়ে মিটিয়েছি, তোমার না৷ তোমার যদি এতই আপত্তি- সময় আছে, চুপচাপ নেমে আরেকটা রিক্সা ভাড়া করে চলে যাও কেমন?’

রাগে আর অপমানে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো অদ্রির মুখ৷ তবুও কিছু বললো না। অভী তাকালো প্রিয়তার দিকে। ইশারায় বলে দিলো নিজের যত্ন নিতে। ওর পরীক্ষা চলছে কিছুদিন হয়তো ব্যাস্ত থাকবে। মাঝে মাঝে না কথা বলেও অজস্র অনুভুতি ব্যক্ত করা যায়, সেগুলো সবই এক-একটি সুন্দর চিরকুটের প্রেমকথন হিসেবে লুকায়িত।

_____________________

নাকে মুখে জল খেয়ে প্রিয়তাদের সেমিস্টারের পূর্ব প্রস্তুতি চললো, রুদ্র অদ্রির মতো ভয়াবহ ইমোশনাল ফিলোসফাররাও পড়াশোনা করছে কাদা জল খেয়ে। এদিকে অভীদের টা চলমান। সবমিলিয়ে কারওই কারও সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ নেই৷

প্রিয়তা বিষন্ন মনে ভাবতে থাকলো এসব কিছু৷ চাঁদ উঠেছে আকাশে। জানান দিচ্ছে পূর্নিমার। প্রিয়তা খেয়ে দেয়ে নিজের ডায়েরী নিয়ে বসলো। লিখার চেষ্টা করলো কিছু। বহুদিন ধরে কিছু লেখা হয়না৷ আজ সে লিখবে। লিখবে তার অগোছালো অনুভূতিগুলোর কথা। অদ্রি পাশের রুমে ল্যাপটপে এসাইমেন্টের কাজ করছে। রুদ্র ঘুমাচ্ছে তার নিজের রুমে৷ তুশি রুশিকে একটু আগেই চড় থাপ্পড় মেরে ফুপি নিয়ে গেলো৷ ওরা কিছুতেই আজ ঘুমাবে না বলে পণ করেছিলো। তবে তা সফল হলো না৷ গান চলছে রেডিওতে। অর্নবের সুন্দর একটি গান।

নিজের পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে মগ্ন প্রিয়তার ধ্যান ভাঙলো মোবাইলের আওয়াজে। সেটা বেজে চলছে৷ বেজে চলছে বিরামহীনভাবে। প্রিয়তাকে আলসেমি ধরলো। এত রাতে কারও কল ধরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না৷ বাবা- মা সবাই ঘুমাচ্ছে এতক্ষণে। গভীর ঘুম। তাদেরও হয়তো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এই শব্দ। অগত্যাই সে উঠলো। অপরিচিত নম্বর দেখে বিস্মিত হলেও না জানি কেন রিসিভ করলো। তখনই অপরপাশ থেকে অভী ঝাঁঝালো গলায় বললো,

‘ নিচে আসো প্রিয়তা। আমি তোমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি।’
.
.#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |২১|
গহীন রাত। আর এত রাতে অভী প্রিয়তাদের বাসার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এটা শুনেই প্রিয়তার শরীর হিম হয়ে গেলো। কানে এখনও ফোন চেপে রয়েছে প্রিয়তা। অপরপাশে টের পাওয়া যাচ্ছে অভীর উত্যপ্ত নিঃশ্বাস। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। অস্পষ্ট গলায় বললো,
‘ আপনি…আপনি মজা করছেন তাইনা?’
অপরপাশে অভী কি প্রতিক্রিয়া দেখালো তা বোঝা গেলো না৷ শুধু নীরব হয়ে রইলো সে। অতঃপর সেটা কাটিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
‘ আমায় মজা করার মানুষ মনে হয় তোমার?’
প্রিয়তা কথা ভুলে গেলো। অভী যেহেতু এধরনের মানুষ না তার মানে ছেলেটা সত্যি সত্যিই এসেছে নিচে। বসা থেকে চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। অস্থির কন্ঠে বললো,
‘ এখানে কি করছেন আপনি? মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে? বাসায় বাবা আছে, বড় আব্বু আছে, চাচ্চুও আছে- আর আপনি ড্যাং ড্যাং করে এসে কল দিয়ে বলছেন নিচে এসে দেখা করতে। আমি পারবো না। আপনি ফিরে যান।’
অভী নিশ্চুপ রইলো প্রিয়তার এমন কথায়। যেন খানিকটা হলেও ধারনা ছিলো সে এমন করবে। প্রিয়তা দম নিয়ে বললো,
‘ চুপ হয়ে আছেন কেন?’
অভী চনমনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিজের হাতঘড়ির দিকে। সময় বেশি নেই। প্রিয়তার সাথে দেখা না হলে তার ঘুম হবে না এটা নিশ্চিত। নিজের চুলে হাত নাড়িয়ে তাই সে কপট ভারি কন্ঠে বললো,
‘ তুমি আসবে না তো…. তাইনা?
‘ না আসবো না।’
‘ তাহলে আমিই আসি তোমার রুমে। এতরাতে এই বাড়ির সীমানায় যখন পাড়ি দিতে পেরেছি- তোমার বেডরুম পর্যন্ত যাওয়া আমার কাছে অসাধ্য কিছু না!’
স্পষ্ট হুমকির মুখোমুখি হওয়াতে প্রিয়তা যেন কথা বলাই ভুলে গেলো। এ ছেলেকে হয়তো ভূতে ধরেছে, নাহলে শিউর স্বপ্নের জগত থেকে উড়ে এসে পেছনের বাগানে জুড়ে বসেছে। প্রিয়তা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
‘ এই না!’
ডানপিটে হাসি ফুটলো অভীর চোখেমুখে। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘ তুমি আসবে নাকি আমি তোমার কাছে আসবো?’
‘ আ..আসছি নিচে।’
___________
পূর্ণিমায় অপূর্ব লাগছে আকাশ। চারিদিকে চাঁদের ম্লান আলোর ছড়াছড়ি। এসময় এই শহরকে বলা হয় মায়ার শহর। পথে ঘাটে অজস্র মায়া এসময় ঘুরে বেড়ায়। প্রিয়তার থমকে যাওয়া মনেও এখন মায়া আর ভালোলাগার অনুভূতির লীলাখেলা চলতে লাগলো। সেও যুবতী- আর অভীও একজন যুবক। তার গরম রক্তের বৈশিষ্ট্যে তাই তো প্রকাশ পায়। আর যাই হোক- এতরাতে তার আসা, একঝলক এক অপার সুন্দরী রমনীকে দেখা সমাজের চোখে কটু। তবুও দুজনেই সেই তিক্ততা এড়িয়ে গেলো। বুঝ দিলো নিজেদের সদ্য প্রেমে পড়া কিশোর কিশোরীদের মতো।
প্রিয়তা তুশি রুশির রুমে এসে দেখে দিলো বাড়ির পেছনের বাগানটা। সেটা নিতান্তই আঁধারে ঢাকা থাকলেও চাঁদের অস্ফুট আলোয় রহস্যময়ী লাগছে। তাকে নামলে দোতলার এই বারান্দা দিয়েই নামতে হবে। কেননা আফসোস বশত আজ মানিকের মা নিচে রান্নাঘরে ঘুমুচ্ছে। কোনোভাবে সে যদি টের পায় এ খবর তবে কেলেঙ্কারি লেগে যেতে পারে।
প্রিয়তা অভীকে দেখলো না ওপর থেকে। তবুও জানে সে নিচেই আছে। খোলা বারান্দার একপাশে কাত করে বাঁশের মই রাখা। মইটা রেখেছে রুদ্র।।রাতে বাসা থেকে কোনো কারনে পালিয়ে যেতে এই পথই সে ব্যাবহার করে। আজ প্রথম প্রিয়তা এটা ব্যবহার করবে। ভয় ও লাগছে – আবার বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা।
চোখ বুজে আশ্বস্ত করলো সে নিজেকে। বললো,
‘ পারবে প্রিয়তা, ইউ ক্যান ডু ইট!’
বিসমিল্লাহ বলে বারান্দা দিয়ে মইয়ে চড়লো সে। বুক যেন পাগলা ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ছুটে চলছে। প্রিয়তা সাবধানী চোখে নামতে লাগলো মই বেয়ে। বিড়বিড়িয়ে নিজেকে বললো,
‘ এবারের মতো রক্ষা করুন হে মাবুদ! আমি কোমড় ভাঙতে চাই না!’
শেষে নামার সময় প্রিয়তা খেয়াল করলো না যে মাঝখানে দুই ধাপ ভাঙা। সেখানে পা রাখার পর কোনো ঠাই না পাওয়াতে নিয়ন্ত্রণ হারালো সে। তবে অত উচু থেকে ঘাসের নরম গালিচায় পড়লো না। পড়ার অনতিপূর্বেই এক সুঠাম ছায়াদেহী মানব ধুপধাপ করে ধরে ফেললো তাকে। প্রিয়তা যেন জান ফিরে পেলো। আতঙ্কে বেড়ে গেলে নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাস। সে তাকালো অভীর দিকে। অভী তার শরীরের আধা ভার নিয়ে তাকিয়ে আছে নির্বিঘ্নে। ভ্রুজোড়া কুচকানো। বললো,
‘ প্রিন্সেস ফিওনার মতো এখান দিয়ে নামার বুদ্ধি কে দিয়েছে তোমাকে? বাসায় দরজা নেই?’
প্রিয়তার কোমড় থেকে দু’হাত সরিয়ে সে প্রিয়তাকে দাঁড় করলো ভালোমতো। এদিকে মুখ চোখ লজ্জায় নিষপিষ করছে প্রিয়তার। নিজেকে সংবরন করে বললো,
‘ আহাহা! শখ কত? ওদিকে দিয়ে এলে কেউ না কেউ নির্ঘাত টের পেতো৷ আমি তো আপনার মতো পাগল টাগল না যে অতি প্রেমে বুদ্ধি খেয়ে ফেলবো।’
‘ আমি অতি প্রেমে বুদ্ধি খেয়ে ফেলেছি?’
অভীর কন্ঠের বিস্ময়। প্রিয়তা প্রতিউত্তরে বললো,
‘ তা না হলে কি? আপনি আমার প্রেমে পড়েন নি?’
‘ মোটেও না। আমি কি একবারও বলেছি এমন কিছু?’
অস্বস্তিতে পড়ে গেলো প্রিয়তা। সে কপট রাগ নিয়ে তাকানোর বৃথা চেষ্টা করলো অভীর দিকে। অভীর চোখে মুখে রহস্যময়ী হাসির আভাস। এতক্ষণে অভীর দিকে ভালোমতো নজর দিলো প্রিয়তা। কিছুটা থমকালো। অভী একটা কালো ট্রাউজার আর সাদা গেন্জি পড়েই এসে পড়েছে৷ অতিরিক্ত হিসেবে পকেটে রয়েছে একটি মোবাইল আর মানিব্যাগ। চুলগুলো অন্যান্য দিনের মতো মোটেও পরিপাটি না, একটু অগোছালো। শ্যাম্পুর ঘ্রাণ হুরহুর করে এসে লাগছে নাকে। কালো ঘন চুলের নিচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি ম্লান। পড়াশোনার চাপে নাজেহাল অবস্থা ছেলেটার। প্রিয়তা অনেক সাহস নিয়ে এসেছিলো নিচে। পরিকল্পনা করে এসেছিলো নিচে এসে তাকে দু’চারটি কথা শোনাবে। অদ্রির মতো ভয়াবহ ধরনের কথা৷ কিন্তু পারলো না। এমন নির্জন রাতের আধারে পেছনের বাগানে শিউলি গাছের নিচে অভীর মতো টগবগে তরুন এর স্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখেই তার নিঃশ্বাস ভারি হলো। মনে রইলো সংকোচ। অভী কি আসলেই তার প্রেমে পড়েনি? তাহলে এগুলো কি সব? শুধুমাত্র হবু স্ত্রী বলে এত টান? সে এবার বললো,
‘ আপনি কি ধরনের মানুষ?’
‘ মানে?’
‘ আমি আপনাকে চিনতে পারছি না৷ আমি একজন মেয়ে। মেয়েগুণে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে ভালোমতোই টের পাই আপনার অনুভূতি। তাহলে আপনার চোখে আর ঠোঁট দু’ধরনের কথা কেন বলছে বলেন তো!’
অভী এবারও হাসলো। হাসলো বিনয়ী হাসি। প্রিয়তার এই তৃষ্ণার্ত চোখে নেশা আছে কেমন যেন। তাকালে তাকিয়েই থাকতে মন চায়। অভী প্রিয়তার কথার উত্তর দিলো না। হেলে দাঁড়ালো শিউলি গাছের সাথে। হাত ভাঁজ করলো। রাতের মায়া আলোয় প্রিয়তার অবনত মুখে দৃষ্টি স্থাপন করে প্রগাঢ় কন্ঠে বললো,
‘ এইযে তুমি এখন সাদা সুতির সালোয়ার কামিজ পড়েছে না? এতে জানো কেমন লাগছে তোমায়?’
‘…….’
‘ পূর্নিমার মায়ারাণী।’
প্রিয়তা আর এক দফা স্তব্ধ হলো। মনে হলো যে পার্থিব এ জগতে নেই। চলে গিয়েছে পূর্নিমার এক অন্য দুনিয়ায়। বাতাস বইছে। সেই সাথে নড়ে উঠছে ঝাঁকড়া শিউলি গাছের ডালপালা। দু তিনেক শিউলি চুপিসারে টুপ করে ঝড়ে পড়ছে কালো চুলে। অপষ্টস্বরে সে বললো,
‘ আ…আপনি?’
‘ আমি ঠিকাছি প্রিয়তা। আমায় নিয়ে তোমার সকল ভাবনাই ঠিক। তবে এই অনুভূতি, তোমার প্রতি এই দুর্বলতা কবে মনে বাসা বাঁধলো আমি জানিনা। সত্যিই জানিনা। এইযে পরীক্ষার পড়া আর সেমিস্টারের চাপে আধমরা আমি কেন হুট করে তোমায় দেখার জন্য এখানে এলাম তাও জানিনা৷ শুধু জানি তোমাকে এই মুহূর্তে দেখা আমার প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন। তাছাড়া আর কোনো কিছুই না।’
প্রিয়তা এগোলো অভীর দিকে। তাকালো গভীর দৃষ্টিতে। মাঝরাতে এমন একটা সুন্দর দৃশ্য প্রিয়তার মন কেড়ে নিয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে একসময় হয়তো এই ছেলেটাকে প্রতিরাতে এইভাবে দেখবে সে। সেদিনটা কবে আসবে? কবে শেষ হবে তার পড়ালেখা? তারপর ক্যারিয়ার? মাঝে মাঝে এসব কিছুকে প্রিয়তার উটকো ঝামেলা মনে হয়। কেন যে পরিবারের ময়-মুরুব্বিরা এমন সিদ্ধান্ত নিলো? প্রিয়তা হাত রাখলো অভীর গালে। উচু হলো। তপ্ত কন্ঠে বললো,
‘ এটা সত্যি যে আপনি কখনো বলেননি আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন কি না। কিন্তু না বলা সত্বেও তা আমি জানি। আপনার ব্যাবহার, আচরণে আমূল পরিবর্তন, চোখের ভাষা সবটাতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান যে আপনি কতটা দুর্বল। নারীমন তো। ছেলেদের ধারনার আগেই তারা চট করে সব বুঝে ফেলতে পারে। এবার আমায় দেখা হয়েছে না? ফিরে যান। একটা শান্তির ঘুম দিয়ে সব স্ট্রেস ঝেড়ে ফেলে দিন। আমি তো আছিই।’
অভী হাসলো প্রিয়তার এমন অধিকার খাটানো মায়াবীণী রূপ দেখে। নিয়ন্ত্রণ হারালো। সম্মোহিত হলো প্রিয়তার প্রতি। অতঃপর হাত ধরে কাছে টেনে আনলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তা হতভম্ব হলো। দৃষ্টি ফেললো অভীর উথাল-পাতাল ঢেউ খেলানো চোখের দিকে। সময় বিলম্ব না করে অভী নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরলো প্রিয়তার ওষ্ঠে । সারা পৃথিবীর থমকে গেলো প্রিয়তার। বুক দ্রিম দ্রিম করতে লাগলো। ঠোঁটেও ওপর এমন নির্লিপ্ত স্পর্শে অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠলো প্রিয়তার সারা শরীর। প্রিয়তা ছাড়িয়ে নিতে পারলো না নিজেকে। বরং সে চোখ বুজে ফেললো৷ চট করেই সরে এলো অভী। দৃষ্টি নির্লিপ্ত, হৃদয় ব্যাকুল। প্রিয়তা তাকাতে পারলো না লজ্জায়। শুধু আড়চোখে দেখলো অভীর আওড়ানো হাসি। সেটা সুন্দর। তবে প্রিয়তার মিষ্টি ছোঁয়ায় তা যেন আরও মারাত্মক লাগছে।
এই রাতটি কখনোই ভুলতে পারবে না প্রিয়তা। চাইলেও না৷ জীবনের পাতায় এটি প্রেমের প্রথম স্পর্শ হয়ে গেঁথে থাকবে৷ আর এই প্রেমের স্পর্শের সাক্ষী হয়ে থাকবে পূর্নিমার রাত আর সুবাসিত শিউলি ফুলের বাহার।
________________________
দিনগুলো পেরিয়ে গেলো পাতা ঝড়ার মতো। অভীর বার্ষিক কার্যক্রম ইতি টেনে এখন শুধু অপেক্ষা সমাবর্তনী অনুষ্ঠানের। প্রিয়তা অপলকভাবে শুধু দেখলো কর্মনিষ্ঠা এ মানুষটিকে। প্রিয়তা ভালো ছাত্রী। তবে সেটা সবসময় অভী থেকে কম। তাই অপ্রাপ্তবয়সে যখন সে সবার মুখে তার গুণগাণ শুনতো স্বাভাবিক ঈর্ষাপরায়ণ রমনীর মতো মনে জমতো হিংসা। তবে সেটা এখন আর নেই। অভী সাধারণ ছেলে, সমকালীন গল্প উপন্যাসের মতো চোখে প্রগাঢ় অনুভব নেই, অযাচিত রূপ নেই- তবুও সাধারণ ছেলে হয়েও অসাধারণ তার ব্যাক্তিত্ব। আর সেই ধারালো ব্যাক্তিত্বের মোহে পড়ে হলেও প্রিয়তা হাতছানি দিয়েছিলো।
সেদিন রাতের পর থেকেই শুরু হলো তাদের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। অদ্রিও শেষমেষ ধরে নিলো প্রিয়তা তার অপছন্দের মানুষটির প্রেমে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। গহীন রাতে চুপিসারে গল্প, বাইকে করে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, সন্ধ্যায় লয়াল স্ট্রিটে অদ্রির চক্ষুগোচরে অভীর হাত ধরে হাঁটা, ইউনিভার্সিটিতে কোনো সমস্যা হলে ইশারায় আশ্বস্ত করা সবই ছিলো অন্যরকম। প্রিয়তার মনে আছে অদ্রি যখন জেনেছিলো যে অভী কিভাবে তাদের বাসায় এসেছিলো তখন ওর প্রতিক্রিয়া কি ছিলো। মাথায় হাত দিয়ে সে বললো,
‘ কি বলিস প্রিয়তা? এত রাতে অভী ভাইয়া এমনি এমনি তো দেখতে আসেনি। প্রিয়তা রে! আমার মনে অশ্লীল সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অভী ভাইয়া তোকে চেপে লুতুপুতু প্রেম করেনি তো?’
অভী আর প্রিয়তা হেসেছিলো সেদিন। হেসেছিলো অন্তু ভাইয়ার প্রতি অদ্রির পাগলামি দেখে। বিনা সংকোচেই সে হাত জড়িয়ে ধরেলো প্রিয়তার। প্রিয়তার মাথা অবনত হলো। তাকালোর সাহস পেলো না। অদ্রি আর রুদ্রিক হেসেছিলো মিটমিটিয়ে। ওরা একটু দূরে যাওয়ার পর প্রিয়তা অভিমানি হয়ে বলেছিলো,
‘ এভাবে সবার সামনে হাত না ধরলে হয় না?’
অভী প্রিয়তার কানের কাছে ঝুঁকে এলো। লতিতে স্পর্শ করালো নিজের কোমল ঠোঁটের। গহীন কন্ঠে বললো,
‘ তোমার চোখের অনন্ত মায়ায় ডুবেছি প্রিয়তা! শুধু হাতের স্পর্শে তা কাটানো সম্ভব নয়!’
.
.
.
.
.
.
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here