জলপদ্ম পর্ব -১৩

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|১৩|
মাথা ব্যথায় টনটন করছে।চোখ খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে।মাথায় ব্যান্ডেজ,হাতে ক্যানেলা দেওয়া।এমনকি হাত টাও ব্যথাও চিনচিন করছে।ব্যথার তাড়নায় আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।আমি চোখ খুলতেই মা ডুকরে কেঁদে উঠলো।আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে।আমি চোখ খুলতেই তাদের মুখে যেনো আনন্দের ধারা বয়ে যাচ্ছে।তবে,সবাই থাকলেও রক্তিম ভাইয়ের কোনো দেখা পায় নি।রেস্টুরেন্টের ঘটনা টা মনে পড়ে যেতেই আমার ভিতর টা হাঁসফাঁস করতে শুরু করে দিলো।রক্তিম ভাইয়ের উপর খুব অভিমান ঝেঁকে বসেছে।মনে মনে পণ করে নিয়েছি রক্তিম ভাই কথা বলতে আসলেও আমি উনার দিকে ফিরেও তাকাবো না।মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

‘রিমঝিম!কেমন লাগছে এখন তোর?ব্যথা কি কমেছে?’

আমি অসহায় চোখে তাকালাম মা’র চোখের দিকে।কেঁদে কেটে ফর্সা গোল মুখ টা একদম লাল হয়ে আছে।আমি মা’র একটা হাত আঁকড়ে ধরলাম।কোনোমতে মাথাটা তোলে মিনমিনে কণ্ঠে বললাম,

‘আমি ঠিক আছি মা।ব্যথাও করছে না।তুমি একদম কাঁদবে না।’

মা পুনরায় শব্দ করে কেঁদে উঠলো।আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।কপালে,মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বললো,

‘একটু সাবধানে চলবি তো রিমঝিম।এর থেকে যদি আরো বেশি কিছু হয়ে যেতো তাহলে কি হতো আমার আর তোর বাবার।তোর বাবা সিলেট থেকে আজই আসছে বাসায়।তোর কথা জানাতে চায় নি।কিন্তু,না জানিয়েও পারি নি।মানুষ টা শুনে খুব ভেঙে পড়েছে।যতই হোক!তুই আমাদের একমাত্র সন্তান।তোকে ছাড়া তো আমাদের কেউ নেই রিমঝিম।’

মা’র বুকের সাথে আমি চুপটি মেরে লেপ্টে আছি।কষ্ট টা কিছুটা কমে এসেছে।কিছুক্ষণ পর ডক্টর আসলেন রুমে।আমাকে চেকাপ করে বললেন,আমি এখন ঠিক আছি।কয়েকদিন বিশ্রামের উপর থাকতে হবে।ডক্টরের কথা শুনে সবাই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।এতো কিছুর মাঝেও আমি রক্তিম ভাইয়ের কোনো দেখা পেলাম না।মা,বড়মা,মেজোমা,সেজোমা চলে যেতেই তনায়া আপু আর রিমি আমার কাছে এসে বসলো।তাদের মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখা যাচ্ছে।আমি চোখ উঁচু করে বললাম,

‘কি হয়েছে তোমাদের?মুখটাকে এইভাবে করে রেখেছো কেনো?’

তনায়া আপু আর রিমি দু’জনেই একসাথে কেঁদে উঠলো।রিমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘তোকে নিয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রিমঝিম।মনে হচ্ছিলো এই বুঝি খারাপ কিছু একটা হয়ে গেলো।’

আমি শান্ত চোখে তাকালাম রিমির দিকে।রিমিও আমার দিকে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছে।মনে হচ্ছে এই কেঁদে দিবে।রিমি বরাবরই এইরকম।আমার কিছু হলেই বেচারি একদম ফুঁস হয়ে যায়।আসলে সম্পর্কটাই তো মধুরের।কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারি না।আমি আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলাম রিমির হাতজোড়।চোখ দিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে বললাম,আমি ঠিক আছি রিমি।একদম কাঁদবি না।তনায়া আপুও আমার পাশে এসে বসেছে।চোখ দুটো কেমন ফোলা ফোলা লাগছে।হয়তোবা কেঁদেছে খুব!

কয়েকদিনের মতো কেটে গিয়েছে!হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছি।এই কয়েকদিনেও রক্তিম ভাইয়ের কোনো খোঁজ পায় নি।মানুষ টা গেলো কোথায় তাও জানি না।ভিতর টা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।না চাইতেও চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে রেখেছি।মাথা ব্যথা খানিকটা রয়ে গেছে।দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজ পেয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে চোখের কোণে থাকা পানিটা মুছে নিলাম।সামনে তাকিয়ে দেখি মা হাতে একটা স্যুপের বাটি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।সাইড বক্সের উপর স্যুপের বাটি টা রেখে দিয়ে আমার পাশে বসে খালি জায়গা টা দখল করে নিলো।আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘সম্পূর্ণ স্যুপ টা তোকে শেষ করতে হবে রিমঝিম।আজকে তোর কোনো বাহানা শুনবো না।’

স্যুপ দেখেই আমার নাক মুখ সিটকে এলো।মুখটা ফিরিয়ে নিতেই মা আরেক ধমক দিয়ে বললো,

‘রিমঝিম!ছোটবেলার মতো চিল্লাপাল্লার শক্তি এখন আমার আর নেই।চুলে পাঁক ধরেছে সেই সাথে বয়সের তাড়নায় চামড়া কুঁচকেও যাচ্ছে।কখন মরে যাই তারও কোনো ঠিক নেই।’

মা’র কথা শুনে আমার চোখ ভিঁজে উঠলো।ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে আছি মা’র মুখপানে।কান্নার বেগের কারণে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছি না।মা মুখের সামনে এক চামচ স্যুপ ধরতেই আমি শান্ত মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম।মা আমার চোখ দুটো পরম আবেশে মুছিয়ে দিলো।নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো,

‘এইভাবে কান্না করছিস কেনো রিমঝিম।বাস্তবতা মানতে হবে তো।বয়স হচ্ছে তো আমার যেকোনো সময় মরে যেতে পারি।’

আমি মা’কে জাপটে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।দুনিয়াতে মা থাকবে না কথাটা ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে।এখন আমার পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে।মা’কে ছাড়তে একদন্ডও ইচ্ছে করছে না।
————————–
রিমি যখন মুখ ফঁসকে বলে ফেলেছিলো,রক্তিম ভাই স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন তখনি আমার হাত পা অসাড় হয়ে এসেছিলো।ব্যাপার টা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না।দলা পাঁকিয়ে কান্না আসছিলো।কয়েকদিন আগেই শিলা আপুর কাছ থেকে শুনেছি,প্রায় এক সপ্তাহর মতো আমি অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে ছিলাম।নিঃস্তব্ধতা যেনো আমাকে জেঁকে বসেছে।চারপাশের আনন্দ গুলোও আমার কাছে পানসে লাগছে।প্রতিটি মুহূর্ত আমি রক্তিম ভাইকে অনুভব করি।রক্তিম ভাইয়ের স্মৃতি গুলো ভুলতে গিয়েও যেনো ভুলতে পারি না।

সময় প্রবাহমান।দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো।আমিও এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি।তবে,মানসিক দিক দিয়ে আমি খুবই দূর্বল।প্রতিনিয়ত রক্তিম ভাইয়ের অনুপস্থিতি আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতা যেনো আমাকে বিষিয়ে তোলে।এমন কোনো রাত নেই আমি রক্তিম ভাইয়ের জন্য কেঁদে ভাসায় নি।আমার আহাজারিতে রুমটাও তখন ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠে।মাথার চারপাশ টা ব্যথায় টনটন করছে।ঠিকমতো ঘুমও হয় নি বলে চোখ দুটো কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বিনুনির শেষ অংশ করে ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম।করিডোরের সামনে যেতেই রিমিকে দেখতে পেয়েছি।রিমি হাই তোলতে তোলতে আমার কাছে এসে হাত ধরে দিলো এক দৌড়।রিমির এরূপ আচরণে আমি কিছুটা চমকে উঠি।

‘এই রিমি তোর কি হলো!এইভাবে গরুর মতো টানছিস কেনো আমাকে।আমি কি গরু নাকি?’

রিমি দৌড়েই বাসার মেইন দরজা পেরিয়ে আসলো।আমাকে আগের ন্যায় টানতে টানতে বললো,

‘আপাতত তুই একটা গরু রিমঝিম।উঁহুহু!গাভী।’

‘কি এমন হলো বল তো।এইভাবে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস।’

‘রাস্তায় গেলেই বুঝতে পারবি।লুচ্চাকে দেখলাম হঠাৎ বুঝলি।আমাদের বাসার সামনে বাইক নিয়ে টইটই করছে।ভাইয়া তো নেই তাহলে,লুচ্চা এখানে কি করছে তাই ভাবছি।’

‘বলিস কিরে!!সিফাত ভাইয়া এইখানে কি করছেন?তোর জন্য এসেছেন নাকি।নির্ঘাত তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে এসেছেন।’

‘লুচ্চার এমন শখকে আমি বস্তায় ভরে সামনের বড় নর্দমায় ফেলে দিয়ে আসবো।’

‘তুই কি আসলেই এইটা করবি রিমি?’

‘তোর কি সন্দেহ আছে রিমঝিম!’

আমি সাথে সাথে মাথা নাড়ালাম।রিমি তেড়ে এসে বললো,

‘তো!আবার বলছিস কেনো তুই এইসব?’

আমি এবার চুপ মেরে যাই।রিমির সাথে হেঁটে বাসার সামনের চৌরাস্তার মোড় টায় এসে দাঁড়িয়েছি।এখান থেকে রিকশায় উঠে দশ টাকা ভাড়া দিলেই আমাদের কলেজ।রিমিকে দাঁড় করিয়ে রিকশা ঠিক করতে নিলেই সিফাত ভাইয়া এসে সজোরে ব্রেক কষলেন।এমন হওয়ায় আমি কিছুটা পিছিয়ে পড়ি।সিফাত ভাইয়া মাথার হেলমেট টা খোলে বাঁকা হেসে রিমির দিকে তাকালেন।রিমিও কটমটে চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।সিফাত ভাইয়া এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘হাই ভাব–ইয়ে মানে রিমঝিম!কেমন আছো এখন?শরীর ভালো আছে।’

আমি মুখে সৌজন্যমূলক হাসি বজায় রেখে বললাম,

‘জ্বি ভাইয়া!আমি এখন ভালো আছি।’

‘ঠিকমতো,মেডিসিন নিবে রিমঝিম!উপর থেকে অর্ডার আছে কিন্তু।’

‘মানে!কি বলতে চাইছেন সিফাত ভাইয়া।’

আমার কথা বলা শেষ হতে না হতেই রিমি দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।সিফাত ভাইয়ার দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বললো,

‘রিমঝিম!তুই উনার কথা বিশ্বাস করবি না তো।উনার মুখের কথার কোনো ঠিক নেই।’

সিফাত ভাইয়া তেড়ে আসলেন রিমির দিকে।রিমিও এগিয়ে গেলো সিফাত ভাইয়ার দিকে।সিফাত ভাইয়া সটান করে রিমির গলায় একটা মালা পড়িয়ে দিলেন।রিমি সাথে সাথে মালা টা খোলে সিফাত ভাইয়ার দিকে আঙুল তোলে বললো,

‘আমাকে অন্যের বিয়ের মালা পড়িয়ে লাভ নেই মিষ্টার লুচ্চা।’

‘ওকে!তাহলে আমার বিয়ের মালাটা আমার বউ হিসেবে তোমাকেই পড়িয়ে দিবো মিস রিমঝিম।’

দু’জনের কথোপকথন শুনে আমি বেশ অবাক হলাম।তার উপর বিয়ে নিয়ে কথা বলছে।সিফাত ভাইয়ার হাতে এবার লক্ষ্য করে দেখলাম দুটো ফুলের মালা।সাথে আরো অনেক ফুলও রয়েছে।খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে,কার বিয়ে।মনের ভিতর না দমিয়ে রেখে দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘কার বিয়ে??’

আমার কথা শুনে রিমি আর সিফাত ভাইয়া দু’জনেই থতমত খেয়ে গিয়েছে।আমতাআমতা করছে ঠিকই কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর টা বলছে না।আমি কিছু বলতে নিলেই সিফাত ভাইয়া তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,

‘আমার এখনেই যেতে হবে।খুব জরুরী ভিত্তিতে একটা কাজ পড়েছে।তোমরা সাবধানে যেও কলেজে।’

সিফাত ভাইয়া কথাটা বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।রিমির দিকে তাকিয়ে দেখি সেও মুখটাকে কেমন করে রেখেছে।আমাকে সম্পূর্ণ এঁড়িয়ে চলছে।আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিকশায় উঠে বসলো।আমিও আর কোনো কথা বাড়ালাম না।সময় করে জেনে নিবো রিমির থেকে তা ভেবে রিকশায় উঠে বসলাম।গন্তব্য কলেজ!
—-
কলেজ এসে আমি যেনো আরেকদফা চমক গেলাম।কলেজের গেইটের সামনে রক্তিম ভাইয়ের বন্ধুমহলের সবাই দাঁড়িয়ে আছেন।শুধুমাত্র তারিন আপু নেই।আমাকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই রঞ্জন ভাইয়া দৌড়ে আসলেন।মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘কেমন আছো বোন।হসপিটালে আমি দু’দিন ছিলাম।তুমি অচেতন অবস্থায় ছিলে তো বুঝতে পারো নি।’

রঞ্জন ভাইয়ার কথার জবাবে বললাম,

‘আমি একদম ঠিক আছি ভাইয়া।কোনো চিন্তা করতে হবে না।’

একে একে শিলা আপু,সুস্মিতা আপু এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়ালেন।সুস্মিতা আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘আজকে তোমাকে ক্লাস করতে দিচ্ছি না রিমঝিম।আজকে আমাদের সাথে তোমার সময় কাটাতে হবে।’

সুস্মিতা আপু বলার পরপরই রিমি হাত তোলে বললো,

‘আমি একমত সুস্মিতা আপু।আমি আজকে মোটেও ক্লাস করবো না।’

আমি প্রথমে নাকোচ করলেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে গেলাম।গাড়িতে আমি,রিমি,শিলা আর সুস্মিতা আপু উঠে বসলাম।রঞ্জন ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে বসেছেন।কথায় কথায় শিলা আপুর থেকে জানতে পেরেছি সুস্মিতা আপুর বাসায় আজকে একটা পার্টি আছে।সেখানেই এতো ঘটা করে যাওয়া।মা’কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন রঞ্জন ভাইয়া।মাও যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিয়েছে।
——–
সুস্মিতা আপু হাতে একটা খয়েরী রঙের জামদানী শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘রিমঝিম!কলেজ ড্রেসটা পাল্টিয়ে এই শাড়িটা পড়ে নাও।দেখো আমরা সবাই শাড়ি পড়েছি।’

সুস্মিতা আপুর কথার পিঠে আমি আর কোনো কথা বললাম না।সুস্মিতা আপুর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নিয়েছি।শাড়িটা পড়ে বের হতেই শিলা আপু,সুস্মিতা আপু আর রিমি এই তিনজন মিলে আমাকে ধরে আয়নার সামনে বসিয়ে দিলো।চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা মেকাপ করিয়ে দিলো।আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি সবার কান্ডকারখানা।কিছু বলতে গেলেই ধমক দিয়ে কথা থামিয়ে দিচ্ছে।আমাকে পরিপাটি করে সাজানোর পর তারা তিনজনে মিলে একে একে চলে গেলো।যাওয়ার আগে দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে।আমার মাথায় কিছুতেই আসছে না তারা কেনো এইভাবে আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে।আয়নায় একবার পরোক্ষ করে নিজেকে দেখে নিলাম।মন্দ লাগছে না বটে!!

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি।অনেকক্ষণ হলো এইভাবে রুমে বন্দী হয়ে আছি।এশার আজানও দিয়ে দিয়েছে।শিলা আপু আর সুস্মিতা আপু আজকে কিছুতেই আমাদের যেতে দিবেন না।বরং,বাসা থেকে তনায়া আপু আর বাবু ভাইয়া কেও ফোন করে নিয়ে এসেছেন।এতোক্ষণ এইভাবে রুমে বন্দী হয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।সাথে মশাও কাঁমড়াচ্ছে আমাকে।এইভাবে আর দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানায় শুয়ে পড়ি।বিছানায় শুতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম যেনো আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো।

মুখের উপর গরম নিঃশ্বাস পড়তেই আমার ঘুমের রেশ কেটে গেলো।ধীর গতিতে চোখ খোলে মুখের সামনের ব্যক্তি টিকে দেখে আমি যেনো চমকে উঠি।তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার দিকে ঝুঁকে আছেন।আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।মানুষ টা তো কানাডায় তাহলে এইখানে কীভাবে আসবেন।মুহুর্তেই আমার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো।চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলাম,

‘রক্তিম ভাই!আপনি খুব নিষ্ঠুর।আপনি চলে গিয়েও আমাকে শান্তি দেন নি।আমার স্বপ্নেও এসে আমাকে জ্বালিয়ে মারেন।আমি কি আপনার থেকে রেহাই পাবো না।আপনি কেনো এমন করেন রক্তিম ভাই আমার সাথে।আপনি কি বুঝেন না আমার কষ্টটা।’

কপালে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই আমি এবার কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।চোখ খোলে দেখি রক্তিম ভাই মুচকি হেসে আমার কপালে চুমু খাচ্ছেন।তার মানে রক্তিম ভাই আমার স্বপ্নে আসেন নি।উনি সত্যি সত্যিই জীবন্ত ভাবেই এসেছেন।তাহলে,রিমি যে বললো রক্তিম ভাই স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।তাহলে কি রিমি আমাকে মিথ্যে বলেছে!কিন্তু কেনো?

আমার এসব ভাবনার মাঝেই রক্তিম ভাই আমার গালে শব্দ করে চুমু খেলেন।আমি পিলে চমকে উঠি।রক্তিম ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।রক্তিম ভাই মুচকি হেসে বললেন,

‘সব প্রশ্নের উত্তর দিবো তবে সময়মতো।খুব ধকল গিয়েছে এই কয়েকদিনে আমার উপর দিয়ে।দেখো না আমার চেহারাই পাল্টিয়ে ফেলেছি।’

আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি।আনমনে রক্তিম ভাইয়ের মুখটায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,

‘কি ধকল গিয়েছে আপনার উপর দিয়ে রক্তিম ভাই?’

রক্তিম ভাই মুচকি হাসলেন।আমার উপর থেকে উঠে গিয়ে পরণের লাল-খয়েরি পাঞ্জাবী টাকে ঠিক করে নিয়ে আমাকে কোলে তোলে নিলেন।আমি ভয়ে রক্তিম ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলাম।মূহুর্তেই আমার মনে অভিমানরা উঁকিঝুঁকি বাইতে শুরু করে দিলো।কাঁদো কাঁদো মুখ করে রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।রক্তিম ভাইও আমার দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছেন।পুনরায় আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার নিকট আসতেই আমি দুড়ুম করে রক্তিম ভাইয়ের বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলাম।রক্তিম ভাই আমার হাত দুটোকে বিছানায় চেপে ধরে বললেন,

‘খুব শক্তিশালী হয়ে গেছো তুমি।আজকে রাতে দেখে নিবো কার দম কতটুকু।’

‘আমার থেকে দূরে সরুন আপনি।একদম আমার কাছে আসবেন না।আমি আপনার কেউ না রক্তিম ভাই।আপনার জন্য এখন তারিন আপু আছে।আপনার ভালোবাসার মানুষ।’

‘সব সময় একটু বেশি বুঝো তুমি।উঁহুহু!এখন কান্না করে চোখের পানি নষ্ট করে লাভ নেই।কিছু জমিয়ে রাখো বাসর রাতের জন্য।কাজে দিবে তখন।’

রক্তিম ভাইয়ের কথায় তালগোল পাঁকিয়ে গিয়েছে।অবাক হয়ে বললাম,

‘মানে কিসের বাসর রাত রক্তিম ভাই।’

‘আজকে আমাদের বিয়ে।সেহেতু,আজকে রাতেই আমাদের বাসর হবে।’

আমি চমকে উঠলাম বিয়ের কথা শুনে।কান্নার বেগ এক ছুটেই পালিয়ে গিয়েছে।এমতাবস্থায় বললাম,

‘অসম্ভব রক্তিম ভাই।’

‘সবই সম্ভব।আর আজকেই আমাদের বিয়ে প্লাস বাসর।চিন্তা নেই প্রটেকশন নিয়েই সব করবো।’

রক্তিম ভাইয়ের কথায় মুখে একরাশ লজ্জা এসে ভিড় করলো।চোখ দুটো নামিয়ে ফেললাম।রক্তিম ভাইও মুচকি হেসে আমার গলায় মুখ গুঁজে দিলেন।ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলেন।আমি ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।রক্তিম ভাই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বললেন,
‘বাকিটা গভীর রাতের জন্য তোলা রইলো।নিজেকে প্রস্তুত করে নাও।’

চলবে..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here