#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন
|২৮|
কাঁচা হলদে রঙের সিল্কের শাড়ি পড়ে,মাথায় ঢিলেঢালা একটা খোঁপা করে নিলো রিমঝিম।খোঁপায় বাহারী ফুলের বেশ বড় একটি গাঁজরা।কানের দুল পড়ে হাতে একগাদা কাঁচের হলুদ রঙের চুড়ি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।রঞ্জনের আজকে গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম।এইখান থেকে হলুদ নিয়ে তারপর সুস্মিতার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।রঞ্জনদের বাসার সামনেই কিছুটা ফাঁকা জায়গা আছে।সেখানেই গা’য়ে হলুদের প্রোগ্রাম টা করা হচ্ছে।রিমঝিম হাতে চুড়ি গুলো পড়তে পড়তে বাহিরে বেরিয়ে আসলো।বড়রা নিয়মকানুন পালন করছে।আর,সেসব ছবিতে আবদ্ধ করে নিচ্ছে আবির।গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে নিয়ে ক্যাচক্যাচ শব্দে হাজারো খানেক ছবি কালো রঙের ক্যামেরা টায় বন্দী করে নিলো।রিমঝিম সেদিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় চুড়ি পড়ায় মনোযোগ দিলো।কাঁচের চুড়ি বলে সাবধানে পড়ছে।তারউপর চুড়ি গুলো সাইজে একটু ছোট হয়ে গিয়েছে।হাঁটার ফলে শাড়ির নিচের জায়গা টা এপাশ ওপাশ হয়ে দুলছে।আবির রিমঝিমকে নামতে দেখে জোরালো গলায় রিমঝিমের নাম ধরে ডেকে বললো,’রিমঝিম একটা পোজ দে!ভালোসময়ে এসেছিস।’রিমঝিম চুড়ি পড়া অবস্থাতেই সামনে তাকালো।ব্যাস!আবিরও সেই সময়টাকে ক্যামেরায় ক্যাপচার করে নিলো।আবির ছবিটা দেখেই রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো, ‘ছবিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।’রিমঝিম ইশারা বুঝতে পেরে আলতো হাসলো।গুটিগুটি পা’য়ে রিমির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।রক্তিম অদূরে দাঁড়িয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে ফোনে।অফিসের কিছু মিটিং নিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে।আবির কিছু একটা ভেবে রক্তিমের দিকে এগিয়ে গেলো।রক্তিমের পিছনে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলো,’না দেখলেই মিস।’রক্তিম পিছু ফিরলো।আবিরকে নিজের অতি নিকটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাত্তাই দিলো না।পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফোনে।আবিরও কম না।ক্যামেরায় চোখ রেখে কিছুটা সুর টেনে বললো,’না দেখলেই মিস।অনেক কিছু মিস হয়ে যাবে।’
রক্তিম ফোনের অপাশে গম্ভীর মুখ করে বললো,’বুঝেছেন সবকিছু!ফাইল গুলো একটু চেক করে নিবেন।দায়িত্ব টা কিন্তু আপনার উপর দিয়েছি আমি।’ফোনের অপাশে কি বললো তা বুঝা গেলো না। তবে,রক্তিম মাথা দুলিয়ে ফোন টা পাঞ্জাবীর পকেটে রেখে দিলো।আবিরকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুঁজোড়া ইশারা করে’কি’বুঝালো।আবিরও চোখ দুটো ক্যামেরায় ইশারা করে বললো,’না দেখলেই কিন্তু মিস।’চোখে,মুখে বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো রক্তিমের।দাঁত খিঁচিয়ে বললো,’বারবার শালিক পাখির মতো পটপট করে এক কথা বলছিস কেনো।কি না দেখলেই একদম মিস হয়ে যাবে।’আবির দাঁত কেলালো।ক্যামেরা টা একপলক রক্তিমের দিকে ঘুরিয়ে পুনরায় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো।চোখের পলকেই ঘুরিয়ে ফেলায় রক্তিম কিছুই বুঝলো না।বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
‘ভালো করে না দেখালে আমি দেখবো কি করে।দে তো ক্যামেরা টা।’আবির হাই তোলে বললো,’দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবি না।’রক্তিম টান মেরে ক্যামেরা টা নিয়ে নিলো।কিছুটা দূরে গিয়ে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ক্যামেরায় বন্দী ছবিটার দিকে।সাথে সাথেই উল্টো ঘুরে কাঁধ বাঁকা করে রিমির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিমঝিমের দিকে তাকালো।তাকিয়েই তার মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে।প্রথম দেখাতেই চোখ পড়লো উন্মুক্ত কোমরের দিকে।ফর্সা কোমরের ভাঁজটায় চিকন চেইনের বিছা টা আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে।কি আকর্ষণীয় লাগছে সেই জায়গা টা।রক্তিম বারকয়েক ঢোক গিললো।চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলো।আবির এতো কিছু খেয়াল না করে রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে বললো,এইজন্যই বলেছিলাম,’না দেখলেই মিস।কিন্তু,তুই ওপাশে কি তাকিয়ে দেখছিস।ক্যামেরায় না তাকিয়ে।’রক্তিমের চোখ অনুসরণ করে আবির সেদিকে তাকাতে নিলেই রক্তিম সাথেসাথেই আবিরের মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।হাতে ক্যামেরা টা দিয়ে বললো,’ছবি তোলার দায়িত্ব নিয়েছিস তাই ওদিকে গিয়ে ছবি তোল।মেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সবাইকে একটা একটা ছবি তোলে দিবি আর ওদের নাম্বার টাও জোগাড় করে নিবি।’আবির মুখ বেঁকিয়ে বললো,
‘তোর কানী বান্ধবী হলেই এনাফ।আর কাউকে দরকার নেই।আমি কিন্তু খুব ভালো ছেলে।হাতেগোনা এক পিসেই।’
রক্তিম চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে বললো,
‘ঠিক এক পিসেই তুই।শয়তানের সব লীলাখেলাই তোর মধ্যে বিদ্যমান।যাই হোক!রিমঝিমের এই ছবিটা যেনো আমার ফোনে পেয়ে যাই।’
‘সেই পোজ দিয়েছে রিমঝিম তাই না রে।’
‘জানি না!তবে এই ছবি কেনো রিমঝিমের যত ছবি তোলা হবে ততগুলোই আমার ফোনে চাই।সময়মত এক প্যাকেট গোল্ডলিফ পেয়ে যাবি।’
রক্তিম কথা বলেই হাঁটা ধরলো।উদ্দেশ্য রিমঝিমকে কিছুক্ষণ শাঁসাবে।পাতলা শাড়ি,পিঠ খালি ব্লাউজ পড়ে এই বিয়েতে কাকে দেখাতে চায়।এইসব পড়ার মানে কি!রক্তিম তখন রাগ টাকে ধরে রাখলেও এখন পারছে না।পাঞ্জাবীর হাতাটাকে গুটিয়ে এদিকেই আসছে।আবির রক্তিমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বিরবির করে বলতে লাগলো,কয়েকটা ছবির জন্য এক্কেবারে এক প্যাকেট গোল্ড লিফ।যে কিনা একটাও শেয়ার করতো না।’
রঞ্জনকে হলুদ লাগিয়ে অন্যরাও হলুদ খেলায় মেতে উঠেছে।যে যাকে পাচ্ছে তাকেই হলুদ লাগাচ্ছে।রিমি,শিলাও যোগ দিয়েছে।তবে,রিমঝিম কিছুতেই লাগাচ্ছে না।সবার থেকে দূরে দূরে আছে।রিমি টানতেই হাত ছুটে পালিয়ে আসে।একটু পরেই আবার সুস্মিতাদের বাসায় যেতে হবে।হলুদ লাগিয়ে শাড়ি,সাজ মোটেও নষ্ট করতে ইচ্ছুক না।রক্তিম ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আলতো হাসলো।পাশের ডালা থেকে বেশ খানিকটা হলুদ হাতে নিয়ে রিমঝিমের পিছনে এসে দাঁড়ালো।রিমঝিম সবার আনন্দ দেখায় মত্ত হয়ে আছে।পিছনে রক্তিমের উপস্থিতি মোটেও টের পায় নি।আচমকাই কোমরের শীতল অনুভব করতেই রিমঝিম চট করে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।নিজের অতি নিকটে রক্তিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।দূরে সরে আসতেই মহিলাদের ধাক্কাধাক্কি তে পুনরায় রক্তিমের কাছে গিয়ে পড়লো।রক্তিম মিটিমিটি হাসছে।রিমঝিমের খুব রাগ হলো।ক্ষিপ্ত চোখে মহিলাদের দিকে তাকালো।এই সুযোগ টাও রক্তিম একদন্ডও হাতছাড়া করলো না।রিমঝিমের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘দূরে গিয়েও যেতে পারলে না।আমার কাছে আসতে হলো তো।তাই,ডিভোর্সের কথাটাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।আমি দিচ্ছি না ডিভোর্স।’
রিমঝিম রক্তিমকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলো।সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললো,
‘নির্লজ্জ পুরুষ একটা।এতো গুলো মানুষের সামনে কাছে আসতে লজ্জা করলো না।কি ভাবলো কে জানে।আর,আপনি ডিভোর্স দেন বা না দেন আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে আর মানি না।কবে,কি বিয়ে হয়েছিলো সেগুলো নিয়ে বসে বসে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না।আরো একটা কথা,আমাকে ছোঁয়ার একদম চেষ্টা করবেন না।’
মনোযোগ দিয়ে রিমঝিমের কথা গুলো শুনে মাথা নাড়ালো রক্তিম।রিমঝিমের আরো একটু কাছে গিয়ে বললো,’তারপর!’
‘তারপর আর কি হবে।ঘুরেফিরে এগুলোই হবে।আমার এক কথা আপনি আমার থেকে দূরে দূরে থাকবেন।’
‘কেনো তোমার বুঝি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যায়।আমি তো সবসময় রেডি থাকি।লজ্জা পেয়ে বুঝি কাছে আসো না।’
‘এই আপনার কি একটু লজ্জা-শরম নেই।কি যা-তা বলছেন।পাগল-টাগল হয়ে গেলেন না তো।’
‘এতোক্ষণ পাগল হই নি।তবে,তোমাকে এইভাবে দেখার পর হয়েছি।’
রিমঝিম দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো রক্তিমের দিকে।কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্তিম হাত ধরে রঞ্জনদের বাসার পিছনে নিয়ে গেলো।সেখানে একটা চিলেকোঠার ঘর আছে।রক্তিম আসলেই রঞ্জনের সাথে এখানে বসেই সময় কাটাতো।কোলাহলবিহীন এক মনোমুগ্ধকর জায়গা।আবির এককোনায় দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ ধরে রক্তিম আর রিমঝিমের ছবি তুলছিলো,পাশে শিলার দিকে চোখ পড়তেই তার দিকেও ক্যামেরা ঘুরিয়ে ফটাফট কয়েক ছবি তোলে নিলো।শিলার এই ছবিগুলো দিয়ে ছোটখাটো একটা এলবাম বানাবে।যেদিন নিজের মনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করবে সেদিন এই এলবাম টা সাক্ষী হিসেবে শিলার হাতে তোলে দিবো।
—
চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতেই রিমঝিম চেঁচিয়ে বললো,
‘এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন আমাকে।আমি বাহিরে যাবো।’
রক্তিম উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে একপলক তাকালো রিমঝিমের দিকে।এমতাবস্থায় বললো,
‘এই পাতলা শাড়ি পড়ে যাওয়ার দরকার নেই।এইটা পড়ার সাহস হলো কীভাবে তোমার সবকিছুই তো দৃশ্যমান।’
রিমঝিমের মনে পড়ে গেলো তনুর বিয়ের দিনের ঘটনা টা।মনে মনে আওড়িয়ে বললো,সেদিন লেহেঙ্গার ব্লাউজের উপর ফুফার ফতুয়া পড়ালেও আজকে আমি এভাবেই যাবো।আর খারাপ টা কি আছে এই শাড়ির।বাঙালী নিয়মে শাড়ি পড়লে তো একটু আধটু কোমর দেখাই যাবে!!
রক্তিম দেয়ালে হেলান দিয়ে আয়েসি ভঙিমা করে দাঁড়িয়ে বললো,
‘নিজের সাথে কথা বলতে বলি নি।আমার সাথে কথা বলতে বলেছি।উত্তর চাই আগের প্রশ্নের।’
‘উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি।আর,এই শাড়ি শুধু আমি একা পড়ি নি।বাকিরাও পড়েছে।’
‘বাকিরা পড়লে কি তোমারও পড়তে হবে।’
‘পিরিতির আলাপ করে লাভ নেই রক্তিম ভাই।আমাকে বের হতে দিন।আপনাকে দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘দরজা খোলে চলে যাও।ধরে তো আর রাখি নি।’
রিমঝিম নাচতে নাচতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।দরজার ছিটকিনি খুলতেই রক্তিম পিছন দিক থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলো।আকস্মিক ঘটনায় রিমঝিম চমকে উঠলো।দরজার ছিটকিনি থেকে হাতটা আপনাআপনি নেমে আসলো।পিঠে খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শ পেতেই রিমঝিম সোজা ঘুরে দাঁড়ালো রক্তিমের মুখ বরাবর।কলার টা চেপে ধরে বললো,
‘কাপুরুষ কোথাকার।’
রক্তিম আলতো হাসলো।তবে,কিছুই বলে নি।রিমঝিমের শরীর জ্বলে উঠলো রক্তিমের হাসি দেখে।পুনরায় বললো,
‘আমাকে যেতে দিন।’
‘না করেছে কে!যাও।’
‘মজা করছেন আমার সাথে।এইভাবে চিপকে থাকলে আমি যেতে পারবো নাকি!তাই তো ছাড়তে বলছি।’
‘লাস্ট একটা সুযোগ চাই।ভুলগুলো শুধরে নিতে চাই।’
রিমঝিম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।চোখে পানি চিকচিক করছে।মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
‘কখনোই না।’
‘ভিতরে ভিতরে তো ঠিকই জখম হচ্ছো।সেই সাথে আমাকেও করছো!’
‘হচ্ছি না।আমি দিব্যি আছি।’
‘তাহলে কাঁদছো কেনো?’
‘ইচ্ছে হয়েছে তাই কাঁদছি।’
ঠোঁট চেপে হাসলো রক্তিম।হাতে থাকা হলুদ টা ধীর গতিতে রিমঝিমের গালে গলায় ছুঁইয়ে দিতে লাগলো।রিমঝিম যেনো জমে গিয়েছে।ছলছল চোখে তাকালো রক্তিমের দিকে।রক্তিমের নেশাযুক্ত চাহনি দেখে চোখ দুটো নামিয়ে ফেললো।ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি যেনো ক্রমশই বেড়ে চলেছে।সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।আর কোনো ভুল করতে চায় না রিমঝিম।মরিচিকার পিছনে আর দৌড়তে ইচ্ছুক না।রক্তিমের ভালোবাসা তাকে সেটাই মনে করিয়ে দেয়।রক্তিম রিমঝিমের হাতজোড় আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
‘মরিচিকা নয়!ভালোবাসাটা সত্যিই।ভালোবাসার খাতায় তোমার নামটাই বরাদ্দ হয়ে আছে।সেখানে কারোর নাম এসে যুক্ত হয় নি,এমনকি আর হবেও না।মানছি,আমি খুব অপরাধ করেছি।অনেক অন্যায় করেছি।ক্ষমারও অযোগ্য আমি।আমি এটাও এখন উপলব্ধি করতে পারছি,আমার উপর রাগ করেই তুমি সেদিন আমাকে রিজেক্ট করেছিলে।আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে।’
‘বাহ্ বাহ্!নিজের মনের মতো মনগড়া কতো কথা বলে দিলেন।স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে রিজেক্ট কথাটা কখনো আসে না রক্তিম ভাই।এতোকিছু করার পরও সেগুলো আপনার কাছে সামান্য ব্যাপার মনে হলেও আমার কাছে অনেক কিছু।যে মানুষ টা নিজের বউকে ঠকিয়ে অন্য নারীতে মত্ত হয়ে থাকতে পারে তাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।আপনার তো আরো খুশি হওয়ার কথা ছিলো।তবে,কি রক্তিম ভাই!আপনাকে আমি রিজেক্ট না মুক্ত করে দিয়েছিলাম।আপনি যাতে আপনার ভালোবাসার মানুষের কাছে যেতে পারেন।তাকে নিয়ে সুখী হতে পারেন।’
রিমঝিমের কথায় রক্তিমের কোনোকিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।পরনারীর কথা তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।এমনকি,রিমঝিমের শেষ কথাটার মানেও ঠাহর করতে পারলো না।কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
‘পরনারী মানে?আর কিসের ভালোবাসার মানুষ।’
‘সাধু সেজে আর কি হবে রক্তিম ভাই।আমি কিছুই ভুলি নি।আমার সব মনে আছে।’কথাটা বলতে বলতেই রিমঝিম ফ্লোরে বসে পড়লো।মুখে হাত গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।অতীতের ঘা গুলো জেগে উঠছে যেনো।তাছাড়াও,অতীতের ঘা কি কখনো শুকিয়ে যায় নাকি!রিমঝিম হাউমাউ করে কাঁদছে।চোখের পানিতে কাজল টা লেপ্টে গিয়েছে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।রক্তিম দৌড়ে রিমঝিমের কাছে যেতে নিলেই রিমঝিম কিছুটা দূরে আসলো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘একদম আমার কাছে আসবেন না।পুরোনো ঘা ঘেটে আর কষ্ট দিতে হবে না।’
‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না তোমার কথা রিমঝিম।কি আবোলতাবোল বলছো।’
রিমঝিম বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তেড়ে গেলো রক্তিমের দিকে।চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
‘এতো কিছু করে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আপনার।পরনারীতে মেতে থাকার কথাও কি ভুলে গেলেন।বেইমান পুরুষ একটা।’
রক্তিম ধমকে উঠলো।এমতাবস্থায় বললো,
‘বারবার পরনারীর কথার আসছে কেনো।আমি শুধু তোকেই ভালোবেসেছি রিমঝিম।আর কারোর সাথে কিছুই ছিলো না আমার।’
রক্তিমের তুমি থেকে তুই বলায় রিমঝিম বিরবির করে বললো,’আগের রূপে ফিরে আসছে আবার।’
‘কি হলো বল!বারবার পরনারীর কথা আসছে কেনো?’
‘যা করেছেন তাই বলেছি আমি।আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলি নি সেসব দিনগুলো।অভিনয় করেছেন আমার সাথে আপনি,ভালোবাসার অভিনয়!ঠকিয়েছেন আমাকে।আর,আমি শুধু আপনাকে বিশ্বাস করে গিয়েছি।পাগলের মতো ভালোবেসে গিয়েছি।’
‘আমার ভালোবাসা তোর কাছে অভিনয় মনে হয়েছে রিমঝিম।তোকে ছাড়া আমি কেমন ছিলাম তা কি একবারো ভেবেছিস।প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয়েছে আমি মরণযন্ত্রনায় ভুগছি।সবকিছু আমার বিঁষিয়ে উঠেছিলো।’
রিমঝিম চোখ দুটো মুছে বললো,
‘এইজন্যই তো বড়বাবাকে চিল্লিয়ে বলেছিলেন,রিমঝিমকে আমি ভালোবাসি নি।কোনোদিনও ভালোবাসি নি।ওর সাথে জাস্ট অভিনয় করে গিয়েছি!এটাই হলো আপনার ভালোবাসার নমুনা তাই তো!শুধু তাই নয়,তারিন আপুর উন্মুক্ত বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে আপনি এখনো সাধু রয়ে গেছেন।এটাকে পরনারীতে মত্ত বলে না!এটাকে আপনার ভাষায় কি বলে তাহলে!’
রক্তিম মাথাটা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়লো।মনে পড়ে গেলো ওইদিন রাতের কথা।যেদিন,সিদ্দিক আহমেদ রক্তিমকে জোর করেছিলো রিমঝিমকে ভুলে যাওয়ার জন্য।এইনিয়ে তো কম অশান্তি হয় নি বাপ ছেলের মাঝে।লাস্টে তো রাগ করেই চলে গিয়েছিলো বাসা থেকে।একদিন পর এসেছিলো।এই একটা দিন রঞ্জনের সাথে এখানে ছিলো।এমনকি তার জন্য,তনায়ার বৌভাতেও যাওয়া হয় নি।এইসব ঝামেলা নিয়ে নিজের মধ্যে অনেকটাই অশান্তিতে ভুগছিলো।যারফলে,রিমঝিমের সাথে ওইদিন খারাপ আচরণও করে ফেলে।ভেবেছিলো পরে গিয়ে সরি বলে নিবে।কিন্তু,তার আগেই সিদ্দিক আহমেদ উনার নতুন খেলা টা খেলে দিলেন।রক্তিমের আর বুঝতে বাকি রইলো না,রিমঝিম যে তার বাধ্য হয়ে বলা,সেদিনের কথাগুলো শুনে নিয়েছে।আলতো আওয়াজে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো,’বাবা যদি আমাকে মা’র কসম না দিতো তাহলে এইসব কথা আমি কখনোই মুখ দিয়ে বের হতে দিতাম না।কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।তবে,মুখ দিয়ে যাই বলি না কেনো,আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি রিমঝিম।’রক্তিম মাথাটা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হচ্ছে।রিমঝিমও যে এই কারণেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেটা এখন বোধগম্য হয়েছে।তবে,এর মাঝেও আরো কিছু আছে।যা তার আর রিমঝিমের অজান্তেই হয়েছে।এর মধ্যে যে,তারিন আর তার বাবা যুক্ত আছে তাও বুঝতে পেরেছে।চোয়াল শক্ত করে পুনরায় আওড়াতে লাগলো,’সবকিছুর উত্তর তোমাদের দিতেই হবে।কি কারণে তোমরা এতো বড় খেলা খেলে গেলে।’
অদূরে বসেই রিমঝিম এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।রক্তিম রিমঝিমের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো।সটান করে রিমঝিমকে কোলে তোলে নিলো।রিমঝিম হাত-পা নাড়াচাড়া করছে।রক্তিম ধমকে বললো,’আরেকবার নড়লে কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দিবো নিচে।কোমর ভাঙলে আমার দোষ নেই।’
‘কোন সাহসে আমাকে কোলে নিয়েছেন।ইতরামি করার জায়গা পান না তাই না!!’
‘নিজের বউয়ের সাথে ইতরামি করবো না তো কার সাথে করবো।’
রিমিঝিম ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো,
‘কেনো তারিন আছে না আপনার।ওর সাথে করবেন।’
রক্তিম দাঁত চেপে রিমঝিমকে বিছানায় ফেলে দিলো।জাপটে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘একটু সময় চাই আমি।সবকিছু ঠিক করে দিবো।কিন্তু,একটু সময় দরকার।’
‘পারবো না দিতে আপনাকে সময়।’
‘ঠিকাছে!আপাতত একটু জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে চাই।’
‘বালিশ আছে!সেখানে গিয়ে ঘুমান।অত্যন্ত আমাকে ছেড়ে দিন।মুক্তি চাইছি আপনার থেকে।’
রক্তিম মায়াভরা চাহনি নিয়ে তাকালো রিমঝিমের দিকে।এমতাবস্থায় বলতে লাগলো,
‘কিন্তু,আমি তো তা পারবো না।কেনো জানি বারবার মনে হয় আমার কাছে সময় অনেক কম।একদিন আমি অনেক দূরে হারিয়ে যাবো।’
রিমঝিম চমকে তাকালো।সেই সাথে বুকটাও কেঁপে উঠলো।চোখের কার্ণিশ ভিঁজে উঠছে।রক্তিমের এই কথাটায় তার কান্নার বেগ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।অভিমানে উল্টো মুখ ঘুরিয়ে নিলো।তাকাবে না এই লোকটার দিকে।কষ্ট দিতে মনে হয় খুব ভালোবাসেন।রক্তিম মুচকি হেসে মাথাটা এলিয়ে দিলো রিমঝিমের বুকে।তারও চোখে পানি।রিমঝিমের বুক ভিঁজে উঠছে।রিমঝিম হাত দুটো দিয়ে রক্তিমকে আঁকড়ে ধরে নিলো।
—
রিমির সারা শরীর হলুদে মাখামাখি হয়ে আছে।সুস্মিতাদের বাসায় হলুদ নিয়ে যেতে হবে দেখে তাড়াতাড়ি ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে।হাত মুখ ধুয়েই চলে যাবে।কিছু দূর যাওয়ার আগেই বাঁধলো এক বিপত্তি।সিফাত রিমিকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনলো।সেই সাথে,মুখে আরো একগাদা হলুদও মাখিয়ে দিয়েছে।রাগে,দুঃখে রিমির কান্না চলে আসার উপক্রম।সিফাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিমিকে দেখে হাসছে।রিমি রাগ দেখিয়ে সিফাতের কাছে এগিয়ে গেলো।সিফাতের সাদা পাঞ্জাবী টা দিয়ে মুখভর্তি হলুদ মুছে নিলো।সিফাত শুধু অবাক হয়ে রিমির কান্ডকারখানা দেখছে।লাস্টে,সিফাতের বুকে কয়েকটা কিল দিয়ে দৌড়ে সামনে এগিয়ে গেলো।কিছুদূর এগিয়ে পুনরায় পিছনে ফিরে,সিফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘শখ কতো!হলুদ লাগাতে এসেছে!’
চলবে..