জলপদ্ম পর্ব -২৯

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|২৯|
বারবার চোখাচোখি হচ্ছে রক্তিম আর রিমঝিমের।রক্তিমের পলক যেনো পড়ছেই না।আর,এদিকে রিমঝিমের খুব অস্বস্তি হচ্ছে।একটা মানুষ কীভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে পারে তা রক্তিমকে না দেখলে টেরই পেতো না।শাড়ির আঁচল টা টেনে সামনে নিয়ে আনলো।বিয়েতেও শাড়ি পড়ে এসেছে।খয়েরী রঙা।হলুদের প্রোগ্রামের মতো হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি।সামনেই মণ্ডপ টা বেশ জাঁকজমক ভাবে সাজানো।রঞ্জন আর সুস্মিতার মালা বদল হচ্ছে।রক্তিম কে এখনো তাকিয়ে থাকতে দেখে রিমঝিম মুখ ভেঙচি কেটে সরে আসলো।রিমির আঁড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো রক্তিমের চোখে না পড়ে।রক্তিমও কম কিসে!হেলেদুলে রিমঝিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,’অমায়িক লাগছে।’রিমঝিম উত্তর দিলো না।চুপচাপ সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রক্তিম কাঁধ দিয়ে রিমঝিমের কাঁধে একের পরে এক বাড়ি দিয়েই যাচ্ছে।রিমঝিম রেগে উঠলো।রক্তিমের দিকে ফিরে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’সমস্যা কি আপনার হ্যাঁ!এতো জ্বালাচ্ছেন কেনো?চুপচাপ গিয়ে একটা জায়গায় দাঁড়ান!তা না করে পোনা মাছের মতো এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছেন।’

‘আমি ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এমনকি ঠিক মানুষের সাথেই আছি।আমার তো এখানেই থাকার কথা।’

‘শুনোন!তখন আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম বলে ভাববেন না আমার রাগ কমে গিয়েছে।এইটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে।আপনাকে আমার সহ্য হয় না।দেখলেই,অতীতের কষ্ট গুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।আপনি প্লিজ দূরে দূরে থাকবেন আমার।’

‘আমি মরে গেলে তুই শান্তি পাবি তাই না রিমঝিম।আচ্ছা!মনে কর,তুই খবর পেলি আমি নেই,তাহলে ওইদিনটা হবে তোর কাছে শ্রেষ্ঠতম দিন তাই তো।তোর মনের আশা যেনো খুব তাড়াতাড়িই পূরণ হয়।’

রিমঝিম সটান করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো রক্তিমের দিকে।কিছু বলতে গিয়েও পারলো না।দৌড়ে এখান থেকে চলে আসলো।বাগানের একটা নিস্তব্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে কেঁদে উঠলো।শাড়ির আঁচল টা খামচে ধরে বলতে লাগলো,’মানুষ টা কেনো এইসব কথা বলে আমাকে পোঁড়ায়।বুঝে না নাকি!আমার যে কষ্ট হয়।মুখে যা আসে তাই বলে যায়।অথচ,তার বিপরীতে থাকা আরো একটি মানুষ যে কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে সেদিকের কোনো খেয়াল নেই।আমি কীভাবে কষ্ট পাবো তার দিকেই শুধু খেয়াল আছে।’রক্তিম রিমঝিমের যাওয়ার পানে আলতো হেঁসে তাকিয়ে বলতে লাগলো,’নিজেও কষ্ট পাচ্ছে আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে।এইভাবে আমি আর নিতে পারছি না।সব হয়েছে ওই দু’জনের জন্য।একজন আমার জন্মদাতা বাবা আরেকজন আমার বন্ধু।বাহ্!দু’জনেই আমার কাছের মানুষ ছিলো।আচ্ছা!মানুষকে কেনোই বা কাছের মানুষ দ্বারা প্রতারিত হতে হয়।বিশ্বাস,মর্যাদা সব যেনো নিমিষেই হারিয়ে যায়।তবে,যাই হোক!বাবাকে এর উত্তর দিতেই হবে।কেনো এতো বড় খেলা খেলে গেলেন আমার আর রিমঝিমের সাথে সবকিছু জানার পরেও!!

রঞ্জন আর সুস্মিতার বিয়ের পর্ব কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে।নিয়মমাফিক আজকে রঞ্জনকে সুস্মিতাদের বাসায় থাকতে হবে এবং সেই সাথে বাসর জাগবে।তাদের সামনে বরাবর বসে আছে বাকিরা।এককোনায় রিমঝিম ঘাপটি মেরে বসে আছে।তার ঠিক বরাবর রক্তিম।আবির সবার দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ভিডিও করে নিলো।শিলার কাছে আসতেই ক্যামেরা টাকে আস্তে ঘুরাতে নিলেই,রিমি চেঁচিয়ে বললো,’এইটা কি হলো আবির ভাই।তুমি ভিডিও করছো খুব ভালো কথা,কিন্তু আমাদের সামনে দিয়ে ক্যামেরা টা ঝড়ের গতিতে ঘুরিয়ে নিয়েছো কিন্তু,শিলা আপুর বেলায় এর উল্টো টা করছো কেনো?’আবির গরম চোখে তাকালো রিমির দিকে।আবিরের তাকানো দেখে রিমি মিটিমিটি হাসছে।শিলা উঠে চলে গেলো রক্তিমের পাশে।নাক ফুলিয়ে চশমা টা ঠিক করে অন্যদিকে ঘুরে তাকালো।আবির আর কিছু করলো না।রিমির দিকে শুধু একটু পর পর কটমটে চাহনি নিক্ষেপ করছে।রিমঝিম ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।রিমির কানের কাছে গিয়ে বললো,’কি দরকার ছিলো আবির ভাইকে এইভাবে ক্ষেপানোর।দেখলি তো শিলা আপু উঠে চলে গেলেন।’
রিমি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বললো,’আমি বুঝতে পারি নি রে রিমঝিম!আমার এই কথার ভিত্তিতে শিলা আপু এখান থেকে উঠে চলে যাবেন।আমি তো মজার সুরেই বলেছিলাম।’
রিমিকে ধাতস্থ করে রিমঝিম পুনরায় বললো,’ব্যাপার না,আবির ভাই একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।তবে,আমি ভাবছি শিলা আপু কি আবির ভাইয়ের মনের কথা কোনোদিনও বুঝবেন না।মাঝেমধ্যে তো আমার খুব কষ্ট হয় আবির ভাইয়ের জন্য।’

‘তোর কথার সাথে আমিও একমত রিমঝিম।আমার তো মনে হয়,আবির ভাই শিলা আপুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় বুড়া হয়ে যাবে।শিলা আপু যে হারে আবির ভাইকে ঘুরাচ্ছেন!আর,আবির ভাইও শিলা আপুর অপেক্ষায় অপেক্ষারত।’
রিমঝিম মুখে শাড়ির আঁচল চেপে হাসলো খানিকটা সময় নিয়ে।অন্যদিকে রক্তিম আশেপাশের ধ্যান-ধারণা ভুলে গিয়ে একমনে রিমঝিমকে খেয়াল করে যাচ্ছে।পাশে বসা শিলা রক্তিমের হাতে চিমটি কেটে বললো,
‘কি মরে গেলি নাকি!চোখের পলক পড়ছে না কেনো?’

‘উফফ!শিলা ডিস্টার্ব করবি না তো।দেখতে দে।’

‘বাপরে!কি ভালোবাসা তোর।চোখের পলকেই ফেলছিস না।আবার যখন রাশিয়ায় চলে যাবে তখন কি করবি।’

‘যেতেই দিবো না।পাঞ্জাবীর কোণার সাথে তার শাড়ির আঁচল বেঁধে রাখবো।’

‘ঢং!তাহলে কষ্ট দিয়েছিলিস কেনো রিমঝিমকে।খুব তো আমাকে বলতিস,রিমঝিমের কথা।কিন্তু,তুই মাঝপথে এসে রিমঝিমকে কি কষ্ট টাই না দিলি।’

‘সুন্দর মুহূর্ত গুলো কি তোর এইভাবেই ভেস্তে দিতে মন চায় শিলা।তোর সব শয়তানি আমার সাথেই করতে হয়।সেই,ভার্সিটির শুরু থেকেই তোর জন্য আমাকে কম বিপদে পড়তে হয় নি।আর,এখনো তাই করছিস।আমার তো মনে হয় তোর অস্থি,হাড়,কোষ সব জায়গা জুঁড়ে শয়তানির খেলানেলা।’

শিলা মুখ ভেঙচি কেটে বললো,
‘উচিত কথা বললেই দোষ হয়ে যায় আমার।যত্তসব!!দূরে গিয়ে বস।’

রক্তিম শিলার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বললো না।এটাই শিলার অভ্যাস।মতের বিরুদ্ধে গেলে বা তার বিরুদ্ধে কিছু বললেই হয়েছে।রাগ তখন নাক ছুঁইছুঁই করে।তাই,রক্তিম চুপ করে আছে।অযথা,শিলাকে রাগাতে চায় না।পাশেই একটা বালিশ পেয়ে সেখানে হাত টা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো।বাসরের হৈ,হুল্লোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।হাসি,ঠাট্টার আওয়াজ টা বেশ জোরালোভাবেই শোনা যাচ্ছে।রক্তিম সময় কাটানোর জন্য ফোনটা বের করে ফেইসবুকে ঢুকলো।কিছুক্ষণ স্ক্রোল করলে ভালো লাগবে এইটা ভেবে।কিন্তু,ফেইসবুকের নিউজফিডে গিয়ে রক্তিম যা দেখলো তার জন্য নিতান্তই প্রস্তুত ছিলো না।চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার আর রিমঝিমের ছবি।তাও,আবার রঞ্জনের গা’য়ে হলুদের।তখন,রিমঝিমের হাতটা টেনে ধরে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলো।আবির এই পিকটা আপলোড করে তাকে আর রিমঝিমকে ট্যাগ করে দিয়ে ক্যাপশনে,স্টাইল করে লিখেছে,ভাই আমার বউ নিয়ে ভাগছে।রক্তিম পুনরায় ক্যাপশন টা পড়ে ফোনটা নিচে নামিয়ে ফেললো।কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে।মনে হচ্ছে,কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিবে।

রিমঝিমের ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে।হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজে শুনতে অনেকটা দেরি হয়েছে।এহসানের ফোন দেখে আসর থেকে উঠে কিছুটা দূরে চলে গেলো।কানে ফোনটা চেপে ধরার সাথে সাথেই এহসান বলতে লাগলো,
‘তোর কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে রিমঝিম।সত্যি বলবি!’
রিমঝিম কিছুটা চমকালো।তার বিয়ের খবর রাশিয়ার কেউ জানে না।শুধুমাত্র মা জানে!!তাও!এটা জানে রক্তিমের সাথে তার সম্পর্কের কথা।এর বেশি কিছু না।যার ফলস্বরূপ,মার জোরাজোরিতেই তো রাশিয়ায় যেতে হয়েছে।সেদিক থেকে এহসান কীভাবে জানলো তা নিয়ে বেশ জানতে ইচ্ছে করছে রিমঝিমের।তাই নিজেকে ঠিক করে বললো,’মানে!কি আবোলতাবোল বকছিস।নিশ্চয় ড্রিংকস করেছিস তাই না এহসান।’

‘আমি একদম সজ্ঞানে আছি রিমঝিম।’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না!আমি একদম সিউর ড্রিংকস করে তুই মাতাল হয়ে আছিস।’

‘বিদেশে বড় হয়েছি আমি।তাই,ড্রিংকস টা কমন ব্যাপার আমার কাছে।আর,তুইও ভালো করে জানিস আমি ড্রিংকস করলেও ঠিক থাকি।এবার,আমার আগের কথা উত্তর দে রিমঝিম।’

‘কি উত্তর দিবো আমি তোর কথার।কি জানতে চাস?’

‘এই যে!তোর কি বিয়ে হয়েছে সেটা ক্লিয়ারলি জানতে চাই।ছবিটার ছেলেটা কে রিমঝিম!তোর হাত ধরে আছে কেনো?’

রিমঝিম অবাক হয়ে বললো,’কিসের ছবির কথার বলছিস!আর,কোন ছেলে।’

ফোনের অপাশে এহসানের মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে।রিমঝিমকে ট্যাগ করে দেওয়া পোস্ট টা দেখেই মাথা তার তালগোল পাঁকিয়ে গিয়েছে।বুকে চলছে অসহনীয় তীব্র ব্যথা।তাই তো,তাড়াতাড়ি করে রিমঝিমকে ফোন করলো।কিন্তু,রিমঝিমের কথা শুনে মেজাজ তার আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে।সামনে থাকলে,কি করতো তা নিজের কাছেও অজানা।রিমঝিম আছে চিন্তায়।ছবির কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না।পুনরায় বললো,
‘চুপ করে আছিস কেনো এহসান।বল আমাকে কিসের ছবির কথা বলছিস।’
এহসান রাগ নিয়ে বলে উঠলো,
‘ফেইসবুকে গিয়ে দেখ।তাহলেই বুঝতে পারবি।’
এহসান ফোন কেটে দিয়েছে।ফোন কাটতেই রিমিঝিম তাড়াতাড়ি করে ফেইসবুকে ঢুকে ছবিটা দেখে বড়সড় একটা টাসকি খেলো।পরক্ষণেই ভাবে,আমার ফোন তো রিমির কাছে ছিলো।তাহলে,এইসব আগে থেকে প্ল্যান করা ছিলো আবির ভাই আর রিমির।একজন ট্যাগ করেছে আর আরেকজন আমার আইডিতে গিয়ে সেটা এক্সেপ্টও করেছে।তাই তো,এহসান দেখতে পেয়েছে।রিমঝিম ফোঁসফোঁস করে এগিয়ে গেলো রিমির দিকে।রিমঝিমের হাতে ফোন দেখে রিমি বললো,’দেখিছিস তাহলে!’

‘কাজ টা তোর আর আবির ভাইয়ের তাই না।এইসব তোদের ছাড়া আর কারোর না।’
কথাটা বলেই পাশ কাটিয়ে চলে আসলো রিমঝিম।ব্যাপার টায় খুবই অস্বস্তি অনুভব করছে।এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও দুষ্কর।রক্তিমের সাথে আপাতত চোখাচোখি করতে চায় না।

বাসরের আড্ডা শেষ করে সবাই সেখানে ঘুমিয়ে পড়লো ছড়িয়ে ছিটিয়ে।রিমঝিম এক্কেবারে দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে।মাথাটা রিমির পেটের উপর।যার ফলে,মাথাটা উঁচু হয়ে আছে।তীব্র ঘাড় ব্যাথায় রিমঝিমের ঘুমটা হালকা হয়ে যায়।আবছা চাহনি নিজেকে এখানে পরোক্ষ করে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।জড়োসড়ো ভাবে উঠে দাঁড়ালো।এলোমেলো পা’য়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই শিলার পা’য়ের সাথে দুড়ুমদুড়ুম করে একটা বাড়ি খেলো।ঘুমের মধ্যেই শিলার কপাল কুঁচকে গেলো।রিমঝিম ঘুমের নেশায় থাকায় কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না কার সাথে বাড়ি খেয়েছে।বরং,এলোমেলো পা’য়ে সামনে আগাতে লাগলো।রক্তিম করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো।সুখ,দুঃখের হিসেব করছিলো,সেই সাথে চোখে ফুটে উঠেছিলো একরাশ অসহায়ত্ব।আজকে!যদি এমন ঘটনা গুলো না ঘটতো তাহলে,তার আর রিমঝিমের পথচলা অন্যরকম হতো।সুখে,শান্তিতে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে বাকি দিন গুলো পার করতো!ছোট ছোট আবদার গুলো পূরণ করা হতো!শুধু তাই নয়,আদর করে রাগ ভাঙিয়েও দিতো।অথচ,এখন সবকিছু উলোটপালোট হয়ে তারা দু’জন একে অপরের থেকে অনেকটা দূরে আছে।এই দূরত্ব কবে ঘুঁচবে তা ভেবে ভেবে রক্তিম ক্লান্ত।তবে,সে শান্তি চায়,ভালোবাসার সঙ্গ চায়।সিগারেট টা দূরের অন্ধকারে ফেলে দিয়ে রক্তিম,বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালো।চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার আলাপন।হঠাৎ করে কিছু একটার শব্দ হওয়ায় রক্তিম কিছুটা চমকে উঠলো।নিস্তব্ধ পরিবেশে এমন হলে চমকানোরই কথা।উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু আলোয় রিমঝিমকে দেখতে পেলো।পাশের এরিকা পামের গাছ টা ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করছে।রক্তিমের রিমঝিমকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা খটকা লাগলো।ভ্রুজোঁড়া কুঁচকে সেদিকেই পা বাড়ালো!!রিমঝিম ঘুমের তালে বেসামাল হয়ে একদম বেগতিক অবস্থা।তবে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।হয়তোবা,ঘুমের জন্য।রক্তিম এসে রিমঝিমের সামনে দাঁড়ালো।আবছা আলোয় সামনে রক্তিমকে দেখে মৃদু হাসলো রিমঝিম।এগিয়ে গিয়ে বললো,’আপনি কি সত্যিই রক্তিম ভাই।নাকি আমি ঘুমের ঘোরে উল্টো পাল্টা দেখছি।একটু সিউর হওয়ার জন্য কি করা উচিত আমার এখন তাই ভাবতে হবে।’
রক্তিমের কিছুটা খঁটকা লাগলো রিমঝিমের আচরণ দেখে।রক্তিমের জানামতে মানুষ ঘুমের ঘোরে কখনো এইসব বলবে না।তবে,রিমঝিমের আচরণ বলে দিচ্ছে রিমঝিম ড্রাংক অবস্থায় আছে।তা সিউর হওয়ার জন্য মুখটা এগিয়ে নিতেই রক্তিমের আন্দাজ হুবুহু ঠিক হয়ে গেলো।চোয়াল শক্ত করে তাকালো রিমঝিমের দিকে।রিমঝিম ক্যাবলা হেসে তাকিয়ে আছে রক্তিমের পানে।রক্তিম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,’কি খেয়েছিস তুই রিমঝিম?’
রিমঝিমের হাসি মুখখানা নিমিষেই চুপসে গেলো।মনে করার চেষ্টা চালালো,পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো সে আর রিমি মিলে কি একটার শরবত খেয়েছিলো।খেতে অন্যরকম টেস্ট।প্রথমে বিদঘুটে লাগলেও পরে হেবি টেস্ট।যার ফলে,রিমঝিম কয়েক গ্লাস খেয়ে নিয়েছিলো।রিমি তেমন একটা খায় নি।খাওয়ার পর থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে।রক্তিমের রিমঝিমের মতিগতি দেখে ভীষণ রাগ হলো।কাছে গিয়ে কনুই টা চেপে ধরে বললো,
‘কি হলো কি খেয়েছিস।এইসব কোথায় পেলি তুই?’
রিমঝিম জোরালো কণ্ঠে বললো,
‘শরবত রক্তিম ভাই!হেবি টেস্টি।খাবেন আপনি!খেতে দারুন মজা।নিয়ে আসবো নাকি!একটু দাঁড়ান নিয়ে আসি।যাবেন না কিন্তু!রিমঝিম যাবে আর আসবে।’
রক্তিম রাগে দু’হাতে কপাল ঘঁষলো।এই কাজ টা যে একমাত্র আবিরের বুদ্ধিতে তা রক্তিমের নিতান্তই জানা।আবির ছাড়া এই কাজ কারো দ্বারা সম্ভব না।তাছাড়াও,আবির একবার এই প্ল্যানের কথা মুখ ফঁসকে বলে ফেলেছিলো তার সামনে।সকাল হলে কাল আবিরকে দেখে নিবে।এখন অত্যন্ত রিমঝিমকে সামলাতে হবে।রিমঝিম উল্টো ঘুরে দৌড় দিতেই রক্তিম খপ করে ধরে ফেললো রিমঝিমের হাতের কব্জি টা।নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাতেই রিমঝিম গাল ফুলিয়ে বললো,
‘আঁটকে দিলেন কেনো রক্তিম ভাই।নিয়ে আসি ওই শরবত টা।আপনি খেয়ে মজা পাবেন।
‘দরকার নেই।আমি এসব খাবো না।চল তোকে রুম অব্দি দিয়ে আসি।’
‘উঁহুহু!আমি রুমে যাবো না।’
‘তাহলে কোথায় যাবি।তোর ঘুম দরকার রিমঝিম।’
রিমঝিম ঠোঁট উল্টে বললো,
‘আমার আপনাকে দরকার রক্তিম ভাই।আপনার সাথে থাকবো।চলুন তো ওই রুমে!’
‘একদমই না রিমঝিম।তুই রিমির কাছে যাবি এখনি।’
‘এতোক্ষণ তো ওর কাছেই ছিলাম।দেখুন না,ওর পেটের উপর শুয়ে আমার ঘাড় টা ব্যাথা করছে।চলুন না ওই রুমে।’
‘আমি যাবো না!তবে,তোকে রুম অব্দি দিয়ে আসছি।’
রিমঝিম বিরক্তিতে চোখ,মুখ কুঁচকে নিলো।ধ্যাত!বলে,রক্তিমের হাত টা চেপে এলোমেলো পা’য়ে করিডোরের কোণার দিকের রুমটায় নিয়ে গেলো।দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে পাশের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে বললো,
‘রক্তিম ভাই আমি ঘুমোচ্ছি!আমাকে একদম ডিস্টার্ব করবেন না।’
রক্তিম মাথায় হাত দিয়ে রাগটাকে সংবরণ করার চেষ্টা করছে।রিমঝিমকে ধরে বললো,
‘এইটা ঘুমানোর জায়গা না রিমঝিম।ঘুমোতে হলে বিছানায় চল।’
রিমঝিম আলতো করে চেয়ে বললো,
‘আমি তো বিছানাতেই আছি রক্তিম ভাই।এইযে,বালিশে শুয়ে আছি।কি উল্টা পাল্টা বকছেন আপনি।চোখে,মনে হয় কম দেখছেন তাই না।’
রক্তিম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ওইটা বিছানা না রিমঝিম।ওইটা দেয়াল।একদম জ্বালাবি না।ভালো মেয়ের মতো বিছানায় যা বলছি।’
রিমঝিম নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
‘বিছানা কই রক্তিম ভাই।’
রক্তিম চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
‘আমার সাথে ফাইজলামি করা হচ্ছে ফাজিল কোথাকার।চুপচাপ সামনে যা।’
রিমঝিম ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলো।গোলগাল চোখে,তাকালো রক্তিমের দিকে।রক্তিমের রাগে যেনো মাথা ফেটে যাচ্ছে।কাল আবির কে শায়েস্তা করবে আচ্ছামত।আপাতত,এদিকটা সামলাতে হবে।ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো রক্তিম।রিমঝিমকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললো,
‘এটাই বিছানা।এবার চুপচাপ ঘুমা।আমি বাহিরে যাচ্ছি।যাওয়ার আগে বাহির থেকে দরজাটা আমিই বন্ধ করে দিবো।’
রক্তিম উঠতে নিবে তার আগেই রিমঝিম রক্তিমের গলা টা জড়িয়ে ধরলো।রক্তিম টাল সামলাতে না পেরে রিমঝিমের উপর গিয়ে পড়লো।রিমঝিম খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।রিমঝিমের হাসিটা রক্তিমের কানের কাছে ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো।রিমঝিমের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ঠোঁটে সেই হাসি।রিমঝিম রক্তিমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।রক্তিমের ঠোঁট টায় চাপ দিয়ে বললো,
‘আগে তো এমন ছিলো না আপনার ঠোঁট টা রক্তিম ভাই।কি সুন্দর পিংকি পিংকি কালার ছিলো।এখন কেমন হয়ে গিয়েছে।আপনি আর স্মোক করবেন না রক্তিম ভাই।’
‘ঠিক আছে!করবো না।এবার অত্যন্ত আমাকে যেতে দে।’
যাওয়ার কথা শুনতেই রিমঝিম রক্তিমকে আরো চেপে ধরলো।বাচ্চামো ফেস করে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুট করেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে উঠলো।রিমঝিমের কান্না দেখে রক্তিম চমকে উঠে,অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।রিমঝিম ক্রন্দনরত গলায় বলতে লাগলো,
‘আপনি কেনো এমন করলেন রক্তিম ভাই।কেনো আমাকে কষ্ট দিলেন।আমি প্রতিনিয়ত আপনার দহনে পুঁড়েছি।তারিন আপু যখন আপনার আর উনার ক্লোজ ছবিটা পাঠিয়েছিলো তখন মনে হয়েছিলো আমি যেনো মরে যাই।আপনি খুব খারাপ রক্তিম ভাই।’
কথাগুলো বলে রিমঝিম রক্তিমকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো।এইরকম হাজারো কথার বুলি ফুঁটিয়ে কাঁচের চুড়ি গুলো একটা একটা করে খোলে সাইড বক্সের উপর রাখতে লাগলো।অনেকক্ষণ ধরে এইগুলো খোঁচাচ্ছে তাকে।রক্তিম রিমঝিমের কথাগুলো শুনে আলতো হাসলো।কারণ,রিমঝিমের কথাতে প্রকাশ পেয়েছে,রক্তিমের প্রতি তার অভিমান।তবে,রক্তিম যা ভেবেছিলো তাই,তারিন যে কিছু একটা করেছে তা এবার পুরোপুরি সিউর হতে পেরেছে।মনে মনে পণ করে নিলো,এর শেষ দেখে ছাড়বে রক্তিম।এখন আপাতত রিমঝিমের অভিমানী কথা শুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।চুড়ি গুলো খোলে রিমঝিম শুয়ে পড়লো।তবুও শান্তি পেলো না।শাড়ির আঁচলে আঁটকে থাকা সেইফটিপিন টা অনেক জ্বালাচ্ছে।পুনরায় উঠে শাড়ির আঁচল থেকে সেইফটিপিন খোলে শুয়ে পড়লো।যার,ফলে শাড়ির আঁচল মুহুর্তেই নিচে নেমে আসলো।তার উপর সিল্কের শাড়ি।রক্তিম তা দেখে শুকনো ঢোক গিললো।চোখ গিয়ে পড়লো রিমঝিমের বুকের ভাঁজের উপর।শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে উঠানামা করছে।রক্তিম উল্টো ঘুরে বসতেই রিমঝিম রক্তিমের হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আলতো কান্নামাখা কণ্ঠে বললো,’যাবেন না প্লিজ রক্তিম ভাই আমাকে ছেড়ে।আমার খুব কষ্ট হয়।’রক্তিম নিষ্পলক চেয়ে রইলো রিমঝিমের দিকে।ভিতরে তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।এভাবে দু’জনে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো দু’জনের দিকে।তাদের চোখ যেনো হারিয়ে গেলো একে-অপরের মাঝে।শুধু তাই নয়,এমনকি তারা অনেকটা কাছেও চলে এসেছে।রক্তিম নিজেকে যংযত রাখতে গিয়েও পারলো না।মুখ গুঁজে দিলো রিমঝিমের বুকে।ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো।রিমঝিম শরীর টা আঁটসাঁট করে রাখলো বিছানায়।রক্তিম নিজের পাঞ্জাবী টা খোলে রিমঝিমের ব্লাউজের হুক গুলো একটানে খোলে দিলো।রিমঝিম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।একহাতে দিয়ে রক্তিমের চুল গুলো আঁকড়ে ধরেছে।দু’জনের নিঃশ্বাসের পাল্লা দ্রুত গতিতে চলছে।সারারুম ময় বিস্তার করছে রিমঝিমের সুখের গোঙানী!!এতোদিন পর নিজের প্রেয়সীকে কাছে পেয়ে রক্তিমও যেনো এক পাগল প্রেমিক হয়ে গিয়েছে।উন্মাদের মতো করছে!!
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রিমঝিমের ঘুম ভেঙে গেলো।উঠতে গিয়ে শরীরের ব্যথা অনুভব করলো।পাশে রক্তিমকে দেখে চমকে উঠলো।নিজের দিকে তাকিয়ে আরো চমকালো।তাড়াহুড়ো করে চাদরটা টেনে নিলো শরীরের উপর।মনে করার চেষ্টা করছে কি হয়েছে তার সাথে।আবছা আবছা যখন মনে পড়লো গতকাল রাতের কথা,তখনি,তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।নিজেই নিজেকে দোষারোপ করে বললো,’এই ভুল কাজ টা কীভাবে করতে পারলাম আমি।এখন কি হবে!!’চাদর প্যাঁচিয়েই শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।গোসল করে একদফা কেঁদে বের হলো।রক্তিমকে দেখেই তার শরীর জ্বলে উঠছে।ততক্ষণে রক্তিমের ঘুম ভেঙে গিয়েছে।রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে আছে।কাল রাতের কথা মনে করতেই ঘাড়ে হাত বুলালো।রাতে বেশ কয়েকবার রিমঝিম ঘাড়ে কাঁমড় দিয়েছে।সেও তো কম দেয় নি।রিমঝিমের সারা শরীরের লাভ বাইটের ছড়াছড়ি।কথাটা ভেবে হাসলো রক্তিম।অবশ্য,এই হাসি রিমঝিমের চোখ এড়ায় নি।তেড়ে এসে বললো,
‘কন্ট্রোল ছিলো না আপনার নিজের উপর।’
রক্তিম ঠোঁট বাঁকালো।এমতাবস্থায় বললো,
‘তুমিই তো যেতে দিচ্ছিলে না।’
‘তাই বলে,একদম ওইসব করতে হবে।’
‘নিজের বউয়ের সাথেই তো করেছি।আমি তো কোনো অপরাধ করি নি।’
‘এতো জ্ঞান দিতে হবে না আপনার।এখনি এইরুম থেকে বেরিয়ে যান।’
‘পারবো না।ঘুমাবো আমি এখন।সারারাত ঘুমোতে পারি নি।তবে,যাই বলো!রাত টা কিন্তু সেই ছিলো।প্রায় দু’বছর পর।কি অনুভূতি টাই না কাজ করছিলো!!
রিমঝিম বালিশ টা ছুঁড়ে মারলো রক্তিমের দিকে।মিহি গলায় চেঁচিয়ে বললো,
‘অসভ্য কোথাকার।’
রক্তিম বালিশ টা ক্যাচ ধরে দাঁত কেলিয়ে শুয়ে পড়লো।অনেকদিন বাদে আজকে নিজের মনে অন্যরকম এক শান্তি পাচ্ছে।
🍁🍂
মুখোমুখি বসে আছে সিদ্দিক আহমেদ আর রক্তিম।দু’জনের চোখেই ক্রোধ।রক্তিম পা’য়ের উপর পা তোলে বসলো।বাপের উদ্দেশ্যে বললো,
‘কি অপরাধ করেছিলাম আমি আর রিমঝিম।যার জন্য আমাকে বাধ্য করেছিলে রিমঝিমকে যেনো ভুলে যাই।’

সিদ্দিক আহমেদ আক্রোশে বললেন,
‘পুরোনো কথা তোলার মানে কি রক্তিম।আমি যা করেছিলাম,তোমার ভালোর জন্যই করেছিলাম।তোমার বাবা আমি,তোমার ভালোটাই তো চাইবো তাই না।’

‘আমার ভালোর জন্য নাকি নিজের ভালোর জন্য।কোম্পানির আরো নাম-ডাকের জন্য।’

সিদ্দিক আহমেদ চমকে উঠে তাকালেন রক্তিমের দিকে।আমতাআমতা করে বললেন,
‘মানে!কি বলতে চাইছো তুমি।’

‘ভুল তো কিছু বলি নি আমি বাবা।’

‘নিজের মনগড়া কথা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখো।আর,নিজেকে তৈরি করে নাও বিয়ের জন্য।তারিনের সাথে তোমার বিয়ে পাকাপোক্ত রক্তিম।কয়েকদিনের মধ্যেই তোমাদের চার হাত এক করে দিবো।’

রক্তিম রাগে চোয়াল শক্ত করে নিলো।মুখশ্রীতে লাল আভা ফুঁটে উঠেছে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘আমি তারিন কে কেনো কাউকেই বিয়ে করবো না।রিমঝিম আমার বউ।এমনকি তাকেই আমি ভালোবাসি।আগের মতো ভুল এখন আর আমি করবো না।তাই,তোমার এইসব ভাবনা তোমার কাছেই রাখো।’

রক্তিম হনহনিয়ে বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে।রাগে হাত দুটো মুঠো করে রেখেছে।সিদ্দিক আহমেদ ফোঁসফোঁস করছেন।রক্তিম এইভাবে বিগড়ে যাবে তা উনার ভাবনাতেই ছিলো না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here