#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন
|৩০|
“আকাশ এতো মেঘলা
যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে
নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ-হারাবার”
মৃদু আওয়াজে গান টা ভেসে আসছে উত্তর দিকের রুমটা থেকে।জানালার গ্রিল ধরে এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে।থুঁতনী টা ঠেকিয়ে রেখেছে গ্রিলের মধ্যে।সারা পিঠ ময় খোলা চুলের ছড়াছড়ি।একমনে তাকিয়ে আছে মেঘে ঢাকা আকাশটার দিকে।দূরের গাছগুলো বাতাসের তাড়নায় হেলছে আর দুলছে।আচমকাই বাতাসের তীব্র হানায় চোখে মুখে বালি ঢুকে যাওয়ায় রিমঝিম তাড়াতাড়ি জানালার ধার থেকে সরে আসলো।দু’হাত দিয়ে চোখ ধরে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।পানির ঝাপটা অতিরিক্ত দেওয়ায় জামার অর্ধেকাংশ এমনেই ভিঁজে গিয়েছে।একরাশ বিরক্তি নিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো।আলমারি খুলতেই চোখে পড়লো মা’র সাদা রঙের শিপন শাড়িটার দিকে।মিনিট খানেক সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আলমারির তাঁকে জায়গায় করে নেওয়া সেই শাড়িটার দিকে।শাড়িটা হাতে নিয়ে উলোটপালোট করে দেখে দ্রুত গতিতে হাঁটা ধরলো মিনি ওয়ারড্রবের দিকে।সেখানে অনেক খুঁজে খুঁজে আলতার দেখা পেলো।মুহুর্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।বাহিরে তুমুল বেগে বাতাস চলছে।এইরকম একটা আবহাওয়ায় রিমঝিমের খুব শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে।নিজের ইচ্ছে টাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যই এতোক্ষণ ধরে আলতার খোঁজ করেছে।আর,দু’সপ্তাহের মতো বাংলাদেশে আছে।রাশিয়ায় গিয়ে শাড়ি পড়ার ইচ্ছা থাকবে না।আগের বোরিং জীবনে চলতে হবে।খোলা চুল গুলো কে হাত খোঁপা করে নিলো।এরিমধ্যে ফোনটা খড়খড় ভাবে বেজে উঠায় রিমঝিম কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো।অনিচ্ছাকৃত ভাবে ফোনটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে মা’র নাম্বার টা দেখে কিছুটা খটকা লাগলো তার।কানে চেপে ধরে কিছু বলার আগেই অপরপাশে সেলিনা আহমেদ হতাশার সুর টেনে বলতে লাগলেন,
‘রিমঝিম!আজকে আমরা থাকছি তোর দাদু বাড়িতে।আমাদের দেখতে অনেকেই এসেছেন সেই দূর থেকে।আর তোর দাদিও থাকতে চাইছে সবার সাথে।তাই,আমরা আর না করতে পারি নি।আর,বাকিরাও থাকতে ইচ্ছুক।অনেকদিন পর তো এমনভাবে সবাই এক হয়েছি।সেই সুবাদে থাকা আর কি।আর,তোরাও সবাই সাবধানে থাকবি।তনায়ার খেয়াল রাখিস কিন্তু।আমি এখন ফোন রাখছি।’
রিমঝিম ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।এমন টা হবে তার জানা ছিলো না।এইজন্যই তো মা’র ফোন দেখে তার কিছুটা খটকা লাগলো।বাসায় এখন বলতে গেলে তেমন কেউ নেই।রিমি গিয়েছে ভার্সিটির এক বান্ধবীর বাসায়।আসতে আসতে বিকেল হবে।তনায়া আর বাবু নিজেদের রুমেই আছে।তনায়ার শরীর টা ইদানীং খারাপ যাচ্ছে।রিমঝিম হাতে শাড়িটা তোলে নিলো।পরিপাটি করে শাড়িটা পড়েও নিলো।চুল গুলো খোলা রেখে,হাতে আলতা টা নিয়েই দৌড়ে গেলো ছাঁদের দিকে।রুমে এখনো গানটা বেজেই চলছে।আকাশ আগের থেকে অনেকটাই মেঘলা।সেই সাথে বাতাসের তেজ।অথচ,বৃষ্টি পড়ছে না।আকাশের অবস্থা দেখলেই মনে হবে এই বুঝি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে।আলতা টা ছাঁদের মাঝখান টায় রেখে কার্ণিশের দিকে এগিয়ে গেলো।হাতদুটো কার্ণিশে ঠেস দিয়ে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে, মুখটা আকাশের দিকে করে রাখলো।শাড়ির আঁচল টা নিজের স্বাধীন মতো উড়ছে।খোলা চুল গুলোও তাদের মতো অবাধ্যতার খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে।
অফিসে ভালো লাগছিলো না বলে রক্তিম বাসার দিকেই রওনা হলো।মাঝপথে মা’র সাথে কথা হয়েছে।তখনি জানতে পেরেছে আজকে তারা আসতে পারবে না।মিনিট দশেকের মধ্যেই রক্তিম বাসায় চলে আসলো।গাড়ি টা কে পার্কিং লটে রেখে দিয়ে বাসার সামনের সরু রাস্তা টার দিকে পা বাড়ালো।চোখ পড়লো ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র এক পরীর দিকে।পা দুটো সেখানেই থমকে গেলো।বুঝতে আর অসুবিধা হয় নি এটা যে রিমঝিম।পলকহীন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
‘আমার শুভ্র রাঙা প্রেয়সী।’মুচকি হেসে দ্রুত গতিতে রক্তিমও ছাঁদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
বাতাসের বেগ এখনো রয়েই গেছে।ছাঁদের মাঝখানটায় বসে রিমঝিম মনের সুখে পা’য়ে আলতা দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।পাশের ছাঁদ থেকে হৈচৈ এর আওয়াজ ভেসে আসছে।রিমঝিম একপলক তাকালো সেদিকে।পাশের বাসার দিবার মা কাপড় নিচ্ছেন আর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বকছেন দিবাকে।পাশেই দিবা দাঁড়িয়ে মুখটাকে কাঁচুমাচু রেখেছে।তা দেখে রিমঝিম মুচকি হাসলো।পুনরায় আলতা পড়ায় মনোযোগ পোষণ করলো।সামনে কারোর অবয়ব দেখে মাথা তোলে সেদিকে তাকাতেই চমকে গেলো রিমঝিম।রক্তিমকে এখানে মোটেও আশা করে নি।আলতা রেখেই লজ্জায় উঠে দাঁড়ালো।রক্তিম নেশালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে আছে রিমঝিমের দিকে।ঠোঁটের কোণে হাসি বিদ্যমান।পকেটে এক হাত গুঁজে দিয়ে ধীর গতিতে রিমঝিমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।রিমঝিম রক্তিমের মতিগতি বুঝতে পেরে দৌড় দিতে গেলেই রক্তিম খপ করে রিমঝিমের হাতটা ধরে হেঁচকা টান মারলো।রিমঝিম তাল সামলাতে না পেরে রক্তিমের বুকের সাথে লেগে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।রিমঝিম দূরে সরে আসতে নিলেই রক্তিম রিমঝিমকে কোলে তোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে হাটা ধরলো।রিমঝিম গাল ফুলিয়ে বললো,
‘নামান বলছি!কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।’
রক্তিম আলতো হাসলো।মুখে হাসি রেখেই জবাবে বললো,
‘যেখানে যাওয়ার দরকার সেদিকেই যাচ্ছি।’
‘হেয়ালিপনা না করে ঠিকঠাক ভাবে বলুন রক্তিম ভাই কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।’
‘উঁহুহু!এখন কিছুই বলবো না আমি।গেলেই দেখতে পাবে।’
রিমঝিমের খুব রাগ হলো।মুখটাকে বেঁকিয়ে বললো,
‘আপনি সবসময় ভুল টাইমে এন্ট্রি নেন রক্তিম ভাই।’
‘একদমই না!আমি ঠিক টাইমেই এন্ট্রি নিয়েছি।এখন না আসলে আমি তো দেখতেই পেতাম না এই শুভ্র সাজের মেয়েটাকে।যার কারণে,আমার হৃদপিন্ড টা তুমুল বেগে ঢিপঢিপ আওয়াজ করছে।কান পেতে শুনবে কি সেই ঢিপঢিপ আওয়াজ!!!
‘মোটেও না।আপনার মতোই অবাধ্য আপনার হৃদপিন্ড।’
রক্তিম শব্দ করে হেসে উঠলো।রিমঝিমের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই সময় টাকে আমি আর তুমি মিলে উপভোগ করতে চাই।’
রিমঝিম মুখ ভেঙচি কেঁটে বললো,
‘ঢং!যতসব।’
রক্তিম মুখে হাসি টেনেই বাহিরে বেরিয়ে আসলো।রিমঝিমকে নামিয়ে দিয়ে পুনরায় গাড়ি টা বের করে নিলো।রিমঝিম শুধু চোখ ছোট ছোট করে রক্তিমের হাবভাব পরোক্ষ করছে।রক্তিম রিমঝিমের সামনে গাড়িটা থামিয়ে দরজা টা খোলে দিলো।চোখ দিয়ে ইশারা করে বসতে বললো।রিমঝিমও লক্ষী মেয়ের মতো বসে পড়লো।মৃদু আওয়াজে গান চালিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।বৃষ্টি এখন একটু একটু করে পড়তে শুরু করে দিয়েছে।রিমঝিম সিটে মাথায় এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়ে গান টাকে বেশ উপভোগ করছে।রক্তিমও আঁড়চোখে বারবার দেখছে রিমঝিমকে।
🍁🍂
গাড়ি থামতেই রিমঝিমও চোখ খোলে জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরের পরিবেশের দিকে তাকালো।জালানার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা বিদ্যমান।সেই ফোঁটার আঁড়ালে রিমঝিম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছনের সেই বাড়ি টা।যেখানে রক্তিম আর সে ভালোবাসার এক রাত কাটিয়েছিলো।রিমঝিমের মনে পড়ে গেলো তাদের বিয়ের রাতের কথা।চোখ দুটোতে পানি এসে জমা হচ্ছে।মস্তিষ্কে অতীতের স্মৃতি গুলো হানা দিয়ে উঠছে।রক্তিম নামার আগেই রিমঝিম গাড়ি থেকে নেমে আসলো।ছোট্ট পুকুর টায় পদ্ম ফুলের কোনো দেখা নেই।বুকে হাত গুঁজে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।এরিমধ্যে রক্তিমও এসে দাঁড়ালো রিমঝিমের পাশে।রিমঝিম সামনে তাকিয়েই বলে উঠলো,
‘জলপদ্মে আজকে পদ্মর অভাব দেখছি।’
‘আজকে না!সেই অনেক আগে থেকেই পদ্মর অভাব।’
রিমঝিম একপলক তাকালো রক্তিমের দিকে।রক্তিমও তাকিয়ে রইলো রিমঝিমের দিকে।রিমঝিম দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় সামনে তাকিয়ে রইলো।রক্তিম আলতো গলায় বলতে লাগলো,
‘যার জন্য এই জলপদ্ম বানিয়েছিলাম সেই তো ছিলো না।আমার সাথে সাথে পদ্ম গুলো বেশ অভিমান করেছে।তাই হয়তো তারাও একসাথে পণ করেছে এতো সহজে দেখা দিবে না।যেদিন মন ভালো হবে ওইদিন হয়তো দেখা দিবে।’
‘স্বার্থপর!সবাই স্বার্থপর!সবাই শুধু নিজের টাই বুঝে।আমি কেমন ছিলাম তা একজন দেখেও যেনো দেখলো না।অবহেলা করে গেলো প্রতিনিয়ত।চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষ টির কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা যে কতটা কষ্টকর তা নিতান্তই আমার জানা।সবকিছু সহ্য করতে পারলেও তার কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা টা যেনো কিছুতেই নিজের মনকে মানাতে পারছিলাম না।একটু একটু করে আমার সবকিছু যেনো বিষিয়ে উঠলো।সুন্দর মুহূর্ত গুলো কান্নায় পরিণত হলো।দোষ কি ছিলো আমার!!যার জন্য,এতোটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।জবাব আছে কোনো আপনার কাছে?’
রক্তিমের বুকটা হু হু করে উঠলো।নিজেকে আজকের মতো অপরাধী মনে হয় আগে কখনো লাগে নি।ঝাঁপসা চোখে তাকালো রিমঝিমের দিকে।রিমঝিমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।বৃষ্টিও তুমুল বেগে পড়ছে।সাদা শিপন শাড়িটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।সবকিছুই দৃশ্যমান।বৃষ্টির পানিতে আলতা গুলো ধুয়ে যাচ্ছে।সেদিকে কোনো খেয়াল নেই রিমঝিমের।অথচ,একটু আগেই কিনা এতো সুন্দর,যত্ন করে আলতা টাকে নিজের পা’য়ে ফুঁটিয়ে তুলেছিলো।
রক্তিম কয়েক পা পিছিয়ে আসলো।গায়ে সাদা শার্ট টা ভিজে একাকার অবস্থা।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।তীব্র মাথা ব্যথায় আশেপাশের সবকিছুই বিতৃষ্ণা লাগছে।তবে,চোখ আঁটকে আছে এখনো রিমঝিমের দিকে।ইচ্ছে করছে,জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু,নিজের অজান্তেই সে পিছিয়ে আসছে।পা দুটো যেনো আপনাআপনিই পিছিয়ে যাচ্ছে।গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।বিরবির করে বলতে লাগলো,এতো কেনো মাথা ব্যথা হচ্ছে আমার।শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে,এভাবে আর একদন্ডও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না!!’
চলবে..
[