জলপদ্ম পর্ব -৩২

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৩১|
বাহিরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।রক্তিমের বুকে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে রিমঝিম।মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে।রাত বারোটার উপর বাজে।অথচ,রিমঝিম সেই বিকেল বেলা থেকে এখন পর্যন্ত কেঁদেই যাচ্ছে।রক্তিম হেলান দিয়ে বিছানার সাথে মাথাটা এলিয়ে রেখেছে।আলতো ছোঁয়ায় রিমঝিমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’রিমঝিম!আর কতো কান্না করবে।দেখো আমি ঠিক আছি।সেই বিকেল থেকে কান্না করেই যাচ্ছো।এখন!তোমার মাথা ব্যথা শুরু হবে।অতিরিক্ত কান্না করলে তো তোমার তাই হয়।আর,আমি এখন দিব্বি আছি।তোমার সামনেই তো আছি।মরে-টরে তো আর যাই নি।’রিমঝিম চট করে মাথা টা তোলে ছলছল চোখে রক্তিমের দিকে তাকালো।এতোক্ষণ চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু,এখন আবার গাল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে।রক্তিম রিমঝিমের এরূপ পাগলামি দেখে মুচকি হাসলো।চোখ দুটো মুছিয়ে দিতে গেলেই রিমঝিম অভিমানে দূরে সরে আসলো।শাড়ির আঁচল টা খাঁমচে ধরে আছে।রক্তিম হতাশার সুর টেনে বললো,’বুঝি না আমি!তোমরা মেয়েরা কি দিয়ে তৈরি।মুখে ঠিকই বলো আপনাকে আমি সহ্য করতে পারি না,আমার সামনে আসবেন না,আমাকে আপনার মুখ দেখাবেন না,আরো কতো কি!!কিন্তু,সামান্য একটু মাথা ব্যথা হয়েছিলো বলে একদম উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছো।কেঁদেকেটে নিজের চেহারার কি হাল করেছো।’
রিমঝিম নাক টেনে টেনে বললো,’আমি এতো কিছু বুঝি না আর জানিও না রক্তিম ভাই।আপনি এখনেই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন।এইটা আপনার সামান্য মাথা ব্যথা হতেই পারে না।এইরকম হলে কি আর ব্যথায় ছটফট করতেন।আমি নিজের চোখে দেখেছি,আপনার কষ্ট রক্তিম ভাই।’রক্তিম মাথার নিচে হাত দুটো আস্তে করে রাখলো।মাথাব্যথা আগের থেকে কম থাকলেও বেশ ভারী ভারী মনে হচ্ছে।শুধু তাই নয়,মনে হচ্ছে!মাথায় কেউ ইটের স্তুপ দিয়ে রেখেছে।কিন্তু,রিমঝিমের সামনে আর তা বহিঃপ্রকাশ করতে চায় না।এতোক্ষণ প্যাঁচপ্যাঁচ করে কেঁদেছে।এখন আর চায় না,আগের মতো কাঁদুক।রক্তিম কতক্ষণ চেয়ে রইলো রিমিঝিমের মুখ পানে।দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘এতো চিন্তার কারণ নেই রিমঝিম।আমি ঠিক আছি।তোমার সামনেই তো আছি।তাহলে!আর চিন্তা কিসের।’

রিমঝিম পাল্টা জবাবে বললো,
‘আপনি ঠিক নেই রক্তিম ভাই।আপনাকে আমি এখনেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।’

‘এতো রাতের বেলা তোমার জন্য কোনো ডাক্তার বসে নেই রিমঝিম।শুধু শুধু পাগলামি করছো তুমি।’

‘না!আমি এখনেই নিয়ে যাবো।আপনি শার্ট টা পড়ে নিন।আমি চুল গুলো পরিপাটি কিরে আসছি।’

‘উফফ!রিমিঝিম!তুই কি আমার কথা শুনতে পাস না।আমি ঠিক আছি তো।আর,এখন কোনো ডাক্তার পাবি না।’

রক্তিমের ধমকানোর আওয়াজ শুনে রিমিঝিম শব্দ করে কেঁদে উঠলো।আজকের দিনটাই তার কান্নময়।ক্রন্দনরত গলায় বললো,
‘আপনি আমাকে তুই বলছেন কেনো।তুমিই বলুন না!কি সুন্দর শোনা যায়।মনে হয়,আমি আপনার আসলেই বউ।আর,তুই বললে মনে হয় আমি আপনার বউ না বোন।’

রক্তিম কপাল চাপড়িয়ে রিমঝিমকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আগের ন্যায় বুকের মাঝে শুইয়ে দিয়ে বললো,
‘ঠিক আছে তুমিই করে বললো।আমার বোনের দরকার নেই,,বউয়ের খুব দরকার।এতোগুলো দিন অনেক কষ্টে কাটিয়েছি।আর না!’

রিমঝিম নিজের থুঁতনীটা রক্তিমের বুকের উপর ঠেস দিয়ে রেখে রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘চলুন না ডাক্তারের কাছে।’

‘আমি কথা দিচ্ছি যাবো।দু’একদিনের মধ্যেই যাবো।’

রিমঝিম কিছু বললো না।মাথাটা নুইয়ে ফেললো।তার খুব ভয় হচ্ছে!হারানোর ভয়।রিমঝিম নিজের মনকে নিজেই আস্বস্ত করে বললো,মুখে যাই বলি না কেনো রক্তিম ভাই!আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না।আপনার কিছু হলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।আমার জন্য হলেও,আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে!!

রাতে একদন্ডও ঘুমোতে পারে নি রিমঝিম।রক্তিম ভুস ভুস করে ঘুমালেও রিমঝিম পারে নি।একটু পর পর,রক্তিমকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখেছে।মাঝেমধ্যে আলতো হাত দিয়ে রক্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে।কপালে,চোখে,মুখে চুমু খেয়েছে বারংবার।এখনো তার ব্যতিক্রম হয় নি।রিমঝিম একমনে তাকিয়ে আছে রক্তিমের মুখের দিকে।রক্তিমের মুখ টা অন্যদিনের তুলনায় বেশখানিকটা শুকনো লাগছে।ঠোঁট দুটো শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে।রক্তিমের শুকনো মুখটা দেখে রিমিঝিমের মনটা আবারো খারাপ হয়ে গেলো।সাইড বক্সের উপরে রাখা পানির বোতল টা হাতে তোলে নিলো।বোতলের ছিপি টা খোলে তাতে একটু পানি নিয়ে বোতল টা পুনরায় আগের জায়গায় রেখে দিলো।আঙুলের ডগায় একটু একটু করে পানি লাগিয়ে রক্তিমের ঠোঁটে ভেসলিনের মতো দিয়ে দিতে লাগলো।এভাবে পুরো টা পানিই দিয়েছে।ততক্ষণে রক্তিমের ঘুমও ভেঙে গিয়েছে।পিটপিট করে চোখ খোলে তাকালো।চোখের সামনে রিমঝিমকে দেখে মুচকি হাসলো।রিমঝিম মুখটা ভোঁতা করে বললো,
‘রক্তিম ভাই!আপনার মুখটা কেমন শুকনো লাগছে।কাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি আপনার।চলুন না সামনের কলাপাতার রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসি।’

রক্তিম শোয়া থেকে উঠে বসলো।মাথা ব্যথা একটু অনুভব করছে।তবে,এখন আগের তুলনায় বেশ আছে।চুল গুলোকে কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে রিমঝিমের কথার পিঠে বললো,
‘যেভাবে জাপটে জড়িয়ে ছিলি বাপরে!খাবো কি করে।তোর চোখের পানিতেই তো আমার বুক ভেসে গিয়েছে।এতো ভালোবাসিস আমাকে।’

‘রক্তিম ভাই!আবার আপনি আমাকে তুই বলছেন।’

‘ইশশ!রে!পুরনো দিনের অভ্যাস।মুখ ফঁসকে বেরিয়ে পড়লো।’

রিমঝিম কিছু বললো না।মুখ ভেঙচি কেটে পাশের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেলো।জানালার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বাহিরের মনোরম পরিবেশে বার কয়েক চোখ বুলিয়ে নিলো।রক্তিম ওয়াশরুম যেতে যেতে বললো,
‘রেডি হয়ে নাও!মান-অভিমান খাওয়ার পরও দেখানো যাবে।’

রিমঝিম উল্টো ঘুরে থাকলেও রক্তিমের কথায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।আয়নার সামনে এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচল টা ঠিক করতে লাগলো।ততক্ষণে রক্তিমও বের হয়ে এসেছে।একপলক রিমঝিমকে দেখে নিজেও শার্ট টা পড়ে নিলো।

মাঝারি সাইজের কলাপাতার রেস্টুরেন্টের একদম ভিতরে গিয়ে বসেছে রক্তিম আর রিমঝিম।তারা দু’জন বাদে আর কেউ নেই।রক্তিম খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে পড়লো আরেক বিপদে।ডাল আর ছোট মাছ ছাড়া আর কিছুই নেই।তাও আবার ঠান্ডা ভাত।রক্তিম হাত ঘড়িতে সময় দেখে কিছুটা হতাশ হলো।সবেমাত্র সকাল আট টা বাজছে।এইসময় যে এই খাবার টুকু পেয়েছে এতেই অনেক।আর একটু পর আসলে অত্যন্ত গরম খাবার পেতো।রিমঝিম রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমার ঠান্ডা ভাতে কোনো সমস্যা হবে না।আমি খেতে পারবো।’

রক্তিম অসহায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে বললো,
‘কি এক কপাল দেখ!খাবার গরম করে আনার কোনো উপায়ই নেই।তাদের দোকানের সিলিন্ডারও নাকি শেষ হয়ে গিয়েছে।’

‘আমি খেতে পারবো রক্তিম ভাই।আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না।’

‘আশেপাশে আর কোনো রেস্টুরেন্টও নেই।জলপদ্ম বাড়িটা এখানে বানানো উচিত হয় নি আমার।শহরের দিকে বানালে ভালো হতো।’

‘মোটেও না রক্তিম ভাই।এখানে আমি গ্রাম গ্রাম একটা ফিল পাই।মনে হয়,সামনেই আঁকাবাঁকা নদী!আর দূরের মাঠ থেকে সেই নদীটিকে ডিঙিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে আসছে,যা ভাবলেই আমার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠে।সেই সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্য তো রয়েছেই।’

রক্তিম কিছু বললো না।তবে মাথা নাড়ালো।রিমঝিমের কথার সাথে সে একমত।জায়গা টা বেশ মনকরা।অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে।তাই তো,খুঁজে খুঁজে এইরকম একটা জায়গাই বের করেছে।রক্তিম জানতো রিমঝিমের খুব পছন্দ হবে।এখনো মনে পড়ে তার,রিমঝিমের বলা ওইদিনের ছোট্ট আবদার টা।পদ্ম বিলের মাঝখানে একটা বাড়ির শখ!!কথাটা মনে করেই রক্তিম মিটিমিটি হাসতে লাগলো।রক্তিমকে মিটিমিটি হাসতে দেখে রিমঝিম চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
‘এইভাবে একা একা হাসছেন কেনো??’

রক্তিম মুখে হাসি রেখেই জবাবে বললো,
‘ইচ্ছে হচ্ছে তাই।’

‘আপনি ভারী অদ্ভুত রক্তিম ভাই।’

‘তুইও কিন্তু,সেই অদ্ভুত ছেলেটার বউ রিমঝিম।’

রিমঝিম আরো কিছু বলতে নিবে তার আগেই টেবিলে খাবার চলে আসায় চুপ হয়ে গেলো।রক্তিমের দিকে নাক ফুলিয়ে তাকালো।রক্তিমের ঠোঁটে এখনো হাসি লেগেই আছি।এমতাবস্থায় খাবারের দিকে ইশারা করে বললো,খেয়ে নিতে।রিমঝিমও আর কথা বাড়ায় নি।চুপচাপ খেতে লাগলো।ঠান্ডা হোক!আর যাই হোক,খেতে বেশ লাগছে তার।মনে হচ্ছে সে কতদিনের অভ্যুক্ত এক প্রানী।

রেস্টুরেন্টে সিফাতের পাশে শাড়ি পরিহিতা এক রমনীকে দেখে আঁতকে উঠলো রিমি।ভালো করে তাকিয়ে বুঝে নিলো এটা আসলেই সিফাত।কিন্তু,মেয়েটাকে দেখে তার খুব হিংসা লাগলো।বিশেষ করে মেয়েটার সাজ দেখে।ফোন টা হাতে নিয়ে অনলাইনে গিয়ে সিফাতের উদ্দেশ্যে লিখতে লাগলো,
‘এতো সাজ দিয়েছে মেয়েটা বাপরে!আসল চেহারা বুঝাই যাচ্ছে না।আপনি ধোঁকা খাবেন আমি সিউর হয়ে বলছি।এই মেয়ে মুখ ধুলেই আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।আর শুনোন,আমি কিন্তু ঈর্ষা বোধ করছি না।আপনাকে শুধু বাঁচানোর জন্যই বললাম।এইটা কিন্তু এই মেয়ের আসল চেহারা না!!’
ম্যাসেজ টা পাঠিয়ে সটান করে উঠে পড়লো।ব্যাগটাকে খামচি মেরে ধরে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো।এইরকম একটা দৃশ্য দেখার পর রিমি কোনোমতেই আর সেখানে বসে থাকতে পারবে না।খালি একটা রিকশা পেয়ে উঠে পড়লো।রিকশাওয়ালা রিমিকে’কোথায় যাবে’তা জিজ্ঞেস করতেই রিমি খ্যাঁক করে উঠলো।খড়খড়ে গলায় বললো,
‘যেখানে মন চায় সেদিকেই নিয়ে যান মামা।আমার আজকে নাম না জানা এক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে।’

‘এইডা কেমন কথা কইলেন আপা।’

‘কেনো?ভুল কি বলেছি।আপনি কি পারবেন না,আমাকে অজানা এক জায়গায় নিয়ে যেতে।’

‘আপা!ভাড়া কিন্তু বেশি লাগবো।আপনারে নিয়া আমার হুদাই গাঁধার খাটুনি হইবো।কারণ,আপনে কইছেন অজানা এক জায়গায় নিয়া যাইতাম।’

ভাড়ার কথা শুনে রিমি ব্যাগ টা চেক করে দেখলো মাত্র ২০ টাকা আছে।টাকার পার্স টা রেস্টুরেন্টে রেখেই এসেছে।রাগে,দুঃখে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।ওদিকে রিকশাওয়ালা আবারও বললো,
‘আপা!!কোনদিকে যাইবেন কন।এই রাস্তায় নাকি ওই রাস্তায়।’

রিমি আমতাআমতা করে বললো,
‘মামা!আপনি আমাকে আবার রেস্টুরেন্টে দিয়ে আসুন।আমার টাকার ব্যাগ টা সেখানে ফেলে এসেছি।’

রিকশাওয়ালা পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
‘আমারে এইরম ভাবে ঘুরানোর লাইজ্ঞাও কিন্তু বেশি টাকা দেওয়ন লাগবো।আপনার লাইজ্ঞা হুদাই আমার রিকশার চার্জ টা শেষ হইয়া যাইতাছে।’

রিমি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘আমার টাকার পার্স টাই আপনার হাতে তোলে দিবো।এবার খুশি!দয়া করে রেস্টুরেন্টের দিকে চলুন।’

রিকসাওয়ালা রিকশা ঘুরিয়ে টান দিলো।রিমি নিজের মনকে হাজারো বকে রাগে হাত দুটো মুঠো করে নিলো।তবে,খুব করে চাইছে রেস্টুরেন্টে যেনো সিফাতকে আর না দেখে।মন টা তার নিমিষেই খারাপ হয়ে গিয়েছে।কেনো হলো তা তার কাছে অজানা।মনে হচ্ছে,চোখ ফেটে পানি চলে আসছে।রিমি আকাশের পানে মুখ করে তাকালো।বিরবির করে বলতে লাগলো,পড়তে থাকুক চোখের পানি!ভিজে উঠুক চোখের কার্ণিশ,আমার চোখ দুটো না হয় চুপ করেই তাদের সঙ্গী হোক।কথাটা বলেই চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।সাথে সাথেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে কয়েক ফোটা অম্বুর দানা গড়িয়ে পড়লো।

‘রক্তিম ভাই!বিকেল হতে চললো!বাসায় ফিরবেন না।’

রক্তিম জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলো।পকেটে হাত গুঁজে বাহিরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত।রিমঝিম এতোক্ষণ ধরে বিছানায় মাঝখানে গোল হয়ে বসে ছিলো।একা একা বসে কতক্ষণ নখ কাঁমড়ে সোজা নখ টাকে এঁবড়োথেঁবড়ো করে ফেলেছে।বাসায় কখন যাবে তা রক্তিমকে বলতে গিয়েও যেনো বলতে পারছিলো না।এবার সাহস করে বলেই দিয়েছে।রক্তিমের মুখের কোনো পরিবর্তন না দেখে রিমঝিম একটু কাছে এগিয়ে গেলো রক্তিমের।কোমরের পিছনে হাত রেখে নিচু হয়ে রক্তিমের মুখ দেখতে নিলেই রক্তিম খপ করে রিমঝিমকে নিজের সাথে চেপে ধরলো।আচমকাই এমন হওয়ায় রিমঝিম জোরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
‘রক্তিম ভাই!কি করছেন আপনি।আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।এইভাবে কেউ এট্যাক করে নাকি।’

রক্তিম রিমঝিমের গালে চট করে একটা চুমু খেলো।রিমঝিম হাত দিয়ে রক্তিমের মুখটা সরিয়ে দিতেই গালে নখের আঁচড় পেতেই রক্তিম আহহ্ বলে শব্দ করে উঠলো।এমতাবস্থায়,গালে হাত ঘঁষে বললো,
‘এইটা নখ নাকি অন্য কিছু।’

রিমঝিম নখটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখে বললো,
‘এইটা নখ রক্তিম ভাই।’

‘তাহলে এমন আঁচড় লাগলো কেনো।’

‘আসলে,এতোক্ষণ বসে বসে এটা কাঁমড়িয়েছি তাই।কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না তো এইজন্য।’

‘ছি ছি!নখ বুঝি খাওয়ার জিনিস।খচ্চরের মতো কাজকারবার।’

রিমঝিম ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো রক্তিমকে।গাল ফুলিয়ে বললো,
‘একদম কাছে আসবেন না আমার।এই খচ্চরের কাছে আসতে হবে না।বাসায় যাবো আমি।’

‘উঁহুহু!আজকেও আমরা এখানে থাকছি।বাসায় কাল যাবো।’

‘পাগল হলেন নাকি!মা,বড়মা সবাই চলে আসবে তো।’

‘কথা হয়েছে তাদের সাথে আমার।আজকেও আসবে না।আসতে আসতে কাল সন্ধ্যা হবে।’

‘কিন্তু!তনায়া আপু তো একা আছে।’

‘বাবু,রিমি আর আবির তো আছেই।তারা সবাই তনায়া কে দেখে রাখবে।আর,তনায়ার জন্য বাবুই যথেষ্ট।তোর প্রয়োজন নেই।’

রিমঝিম আঁড়চোখে বেশখানিকটা সময় নিয়ে তাকালো রক্তিমের দিকে।জায়গা পরিত্যক্ত করতে নিলেই পুনরায় রক্তিম জাপটে ধরলো রিমঝিমকে।রিমঝিমের গলায় মুখ গুঁজে দিতেই রিমঝিম একদম চুপ হয়ে গেলো।হাত দুটো মুঠো করে রেখেছে।চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।রক্তিম মুচকি হেসে কোলে তোলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো।রিমঝিমকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জানালার পর্দা টা টেনে দিলো।
🍁🍂
কেটে গেলো কয়েকটা দিন।রিমঝিমের শরীর টা ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে।ঠিকমতো খেতেই পারে না।শরীর টা কেমন ভারী-ভারী অনুভব হয়।বিছানার এককোনায় রিমঝিম চুপটি মেরে শুয়ে আছে।উঠতে গেলেই কেমন একটা অনুভব করছে।সেলিনা আহমেদ রিমঝিমের রুমে ঢুকে রিমঝিমকে শোয়া অবস্থায় দেখে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন।রিমঝিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘শরীর খারাপ তোর!এইভাবে শুকনো মুখে শুইয়ে আছিস কেনো?’

রিমঝিম আলতো গলায় বললো,
‘একটু একটু খারাপ লাগছে মা।তবে ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘তাহলে!খেয়ে ঘুমা।আমি খাবার নিয়ে আসি।’

রিমঝিম নাক কুঁচকে বললো,
‘আমার মোটেও খিদে নেই মা।যখন লাগবে তখন খেয়ে নিবো।’

সেলিনা আহমেদ দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ঠিক আছে।এখন তাহলে একটু ঘুমিয়ে পড়।’

রিমঝিম কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।সেলিনা আহমেদ যাওয়ার আগে খুব কঠিন ভাবে পরোক্ষ করে গেলেন রিমঝিমকে।কেনো জানি!উনার কাছে রিমঝিমকে কয়েকদিন ধরে বেশ অন্যরকম লাগছে।আগের থেকে সুন্দর হয়ে গিয়েছে।শরীরের পরিবর্তন এসেছে।নাদুসনুদুস হয়েছে বেশখানিকটা।সেলিনা আহমেদ আর না দাঁড়িয়ে দরজা চাপিয়ে চলে গেলেন।

বিকেলে তীব্র হৈচৈর আওয়াজে রিমঝিমের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে।কোনোমতে চোখ খোলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।সাথে সাথেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে দরজা টা খোলে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরের কাছে এগিয়ে গেলো।লিভিং রুমে তারিন আর তারিনের পুরো পরিবার বসে আছে।সামনে বাহারী রকমের নাস্তা সাজানো।তার সামনেই বাকিরা বসে আছে।আর,রক্তিম চিল্লাফাল্লা করে বাসা একাকার করে তোলছে।সিদ্দিক আহমেদ মুখটা রাগে অন্ধকার করে রেখেছেন।তারিনকে দেখে রিমঝিম সোজা হয়ে দাঁড়ালো।মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা গুলো।বাংলাদেশে আসার পর এই প্রথম তারিনকে দেখেছে।অনেক পরিবর্তন এসেছে তারিনের মাঝে।ড্রেসআপের যেনো আরো অনেক অবনতি হয়েছে।বড়োদের সামনে হাতাকাটা একটা জামা পড়ে আছে,বগলের মাংস গুলো একদম ভেসে উঠেছে।হাঁটু অবধি জামা টা হওয়ায় ফর্সা পা গুলো চিকচিক করছে।তবে,তারিনের পুরো পরিবার কেনো এসেছে তা রিমঝিমের বোধগম্য হলো না।ব্যাপার টা বোঝার জন্য নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলো।

সিদ্দিক আহমেদ রক্তিমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘তোমাকে তারিনকেই বিয়ে করতে হবে রক্তিম।আমি সবকিছু ঠিক করে ফেলেছি।ইভেন,আমি তারিনের পুরো পরিবারকে কথাও দিয়ে দিয়েছি।’

রক্তিম ছিটকে সরে আসলো।জোর গলায় বলতে লাগলো,
‘আমি আর কোনো ভুল করবো না বাবা।তুমি যা চাইছো তা আর কোনোমতেই হবে না।’

তারিন রক্তিমের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিলেই রক্তিম হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলো।পুনরায় আগের মতো বলতে লাগলো,
‘তোকে ফ্রেন্ড বলতেও ঘৃণা হয় আমার।নিজের অপরাধ গুলো ভুলে যাস না তারিন।’

তারিন কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।সিদ্দিক আহমেদ চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলেন তারিনকে।তারিনের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রক্তিমের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললেন,
‘রক্তিম প্লিজ রাজি হয়ে যা বাবা।আমি তোর ভালো চাইছি।’

‘তুমি আমার না তোমার ভালো চাইছো।’

‘রক্তিম!আমার কথা তোকে রাখতেই হবে।তুই আমাকে কথা দিয়েছিলিস আমি যা বলবো তাই করবি।তাহলে,এখন কেনো এমন করছিস।’

‘সেখানেই তো ভুল আমার।তার জন্য নিজেকে আমার কাপুরষ মনে হয়।’

‘আমি এতো কথা শুনতে চাই না।তারিনের সাথে তোর বিয়ে হবে।আজকেই তোদের বাগদান করিয়ে দিবো আমি।’

রক্তিম রাগে দ্বিগুণ বেগে চিল্লিয়ে উঠলো।এক কথা,দু কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে সিদ্দিক আহমেদ আর রক্তিমের মাঝে বিবাদ শুরু হয়ে গেলো।তবে,এখানেই বিপত্তি বাজলো।তীব্র মাথা ব্যথায় রক্তিম সেখানেই বমি করে দেয়।একপ্রকার ছটফট করতে করতে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।রিমঝিম এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলো।যা শুনেছে বা দেখেছে,তাতে এতোটুকু স্পষ্ট হয়েছে,তার বড়বাবা অনেকটা পাল্টে গিয়েছে।তাদের বিয়ে টায় তো তার বড়বাবাই সাপোর্ট দিয়েছিলো।কিন্তু,বড়বাবার আজকের এই পরিবর্তন যেনো কিছুতেই মানতে পারছে না রিমঝিম।তবে,রক্তিমকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখে রিমিঝিম দু’হাতে মুখ চেপে ধরে’রক্তিম ভাই’বলে চিল্লিয়ে উঠলো।ঝড়ের গতিতে নামতে গিয়ে পা’য়ে বড়সড় একটা আঘাতও পেলো।কিন্তু,রক্তিমের কাছে শেষ পর্যন্ত যেতে পারলো না তার আগে নিজেও ঢলে পড়ে গেলো।

চলবে..
[যতই দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছি!ততই যেনো দেরি হচ্ছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here