#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩০তম_পর্ব
“মানে টা খুব সোজা, তোমার জন্য অনল কতটা যোগ্য সেটার পরীক্ষা করতে চাই আমি। বলা তো যায় না সে আমার মতোই একজন অযোগ্য স্বামী প্রমাণিত হলো!”
সেলিমের কথাটা শুনতেই ধারার হৃদয়ের অন্তস্থলে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেনো উত্তপ্ত লাভা ছাড়তে লাগলো। রাগ, আক্রোশে গা রি রি করে উঠলো। তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো,
“সবাইকে নিজের পাল্লায় মাপেন নাকি! আপনি অপদার্থ বলে সকলে সেই কাতারে পরবে? শুনে রাখুন, ওই মানুষটার পায়ের যোগ্য ও আপনি নন”
ধারার চঞ্চল আঁখিজোড়া তীব্র ক্রোধাগ্নি বর্ষন করছে। দৃষ্টির তেজ এবং কন্ঠের তীব্রতায় ম্লান নিস্প্রভ হাসি হাসলেন সেলিম সাহেব। তারপর বিদ্রুপের কন্ঠে বললেন,
“বড্ড বিশ্বাস করো বুঝি! ভালো, বিশ্বাস করা। সুরাইয়াও আমাকে বিশ্বাস করতো। কিন্তু কি বলোতো, পুরুষ মানুষেরা এমন ই হয়৷ আমি তার বিশ্বাসের মান কি রাখতে পারলাম? তাই আমি চাই না তোমার পরিণতিও তোমার মায়ের মতো হোক”
ধারার কিছুসময় চুপ হইলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটির দিকে। মানুষটিকে ঠিক দিয়ে উপরওয়ালা বানিয়েছেন ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করছে ধারার। এই মানুষটাকে তার মা ভালোবাসতো। এই মানুষটার জন্য সে অপেক্ষা করতো। মৃ’ত্যু’র আগ অবধি পর্যন্ত হয়তো এই আশা করতো যে মানুষটা তার পাশে বসবে, তার সাথে কথা বলবে! কি বোকাটাই ছিলো! ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“আপনার যা খুশি তাই করুন। আসলে কি, যে যেমন সবাইকে তাই ভাবে। কিন্তু আমি তো আমার মানুষটাকে চিনি। যে মানুষটা আমার জন্য উ’ম্মা’দ সে আপনাকে জিততে দিবে না। তাই আমিও দেখতে চাই আপনার ঝা’মা ঘ’ষা মুখখানা৷ আমি আপনাকে হারতে দেখতে চাই”
বলেই হনহন করে ধারা ভেতরে চলে গেলো। অপেক্ষা করলো না সেলিম সাহেবের উত্তরের। সেলিম সাহেব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখজোড়া তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। স্মিত হাসি ফুটলো ঠোঁটের৷ কোনে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
“আমিও তাই চাই”
ধারাকে দেখা যাচ্ছে না। সে বাড়তে ঢুকে গেছে। সেলিম সাহেব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। নীলাম্বরের পানে মাথা তুলে চাইলেন। তপ্ত সূর্যটি মাথার উপর। দক্ষিণ কোনে শুভ্র মেঘেরা জড়ো হয়েছে। হয়তো কোনো ফন্দি আটছে। কি ফন্দি আটছে! কে জানে! তার হাসিটা প্রসারিত হলো। এর মাঝেই দীপ্ত ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“আংকেল ভেতরে চলুন। এখানে অনেক রোদ”
“হু, যাবো। কাজ কতদূর!”
“বিকেল হবে, ওরা এতো আলসে বলবেন না। এখন টি ব্রেক নিচ্ছে”
“এটাই বাংলাদেশ। হাজার দুয়েক বেশি দিয়ে দিও”
“সে ঠিক আছে, আপনি ভেতরে চলুন৷ নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবেন”
সেলিম সাহেব দাঁড়ালেন না। তিনি পা বাড়ালেন নিজ গন্তব্যে।
ধারা হনহন করে বাসায় ঢুকলো। তার সারা শরীর কাঁপছে অসহনীত ক্রোধে। লোকটি নিজেকে কি ভাবে! নিজে একজন অযোগ্য স্বামী বিধায় সবাই কি তাই! অনল আত্মদাম্ভিক, নিরস, খা’টা’স, জেদী, রাগী একজন মানুষ কিন্তু প্রিন্স উইলিয়াম স্বামী হিসেবে দশ এ একশ। ধারা সেটা বিশ্বাস করে। অযাচিত মানুষের মতো শান্ত জীবনকে অশান্ত করে সে কি প্রমাণ করতে চাইছে! পরমূহুর্তেই ভাবলো ধারা এতোটা কেনো ভাবছে, সে জানে তার সর্বগুনী প্রিন্স উইলিয়ামকে কখনোই হারবেই না। হারতেই পারে না। এসব ভাবতে ভাবতেই বেখেয়ালী ধারা হাটছিলো। এর মাঝেই ধাক্কা খেয়ে বসলো জমজদের সাথে। সাথে সাথেই চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো। ধারা সামনে থাকাতেই দেখলো। জমজদ্বয় খালি হাতে কিছু ছোট পোকার মতো কিছু একটি ছোট পুটলিতে ভরছে। তাদের চোখে মুখে ধরা পড়ার আতঙ্ক। ধারা চোখ কুচকে বললো,
“এই ওগুলো কি রে”
সাথে সাথেই তারা একত্রে বলে উঠলো,
“কিছু না”
“দেখি, লুকাচ্ছিস কেনো? আমি দেখবো সামনে আন”
আশা রীতিমতো কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাদের সন্দেহ করছো?”
“না করার একটা কারণ দে”
আশা বুঝলো কাজ হবে না। ধারাপু তাদের চালাকি ঠিক ই ধরে ফেলবে। এর মাঝেই এশা ধারা সামনে পুটলিটা এগিয়ে দিলো। নির্ভীক কন্ঠে বললো,
“তেলাপোকা জোগাড় করছিলাম, আমাদের বায়োলজি প্রাকটিক্যালের জন্য। তুমি আর মা না বেশি করো। দিলে তো তেলপোকা গুলো ছেড়ে”
ধারা সাথে সাথেই সিড়ির উপর উঠে দাঁড়ালো। এই ক্ষুদ্র প্রাণীটিকে প্রচন্ড ভয় পায় সে। তার ওজনের শতভাগের এক ভাগ ও নয় এই তেলাপোকা৷ অথচ তার ভয়ে ধারা শিটিয়ে যায় সে। দেখলেই তার গা ঘিনঘিন করে। ধারার এখনো মনে আছে একবার এক উড়ন্ত তেলাপোকা উড়ে এসে ধারা কাঁধে বসেছিলো। চিৎকার করে সারাঘর মাথায় তুলেছিলো সে। চোখ মুখ কুচকে বললো,
“এখন ওই তেলাপোকা নিয়ে চোখের সামনে থেকে সরে যা। এখন ই”
“ঠিক আছে”
বলেই মাথা নত করে জমজেরা চলে গেলো। ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো৷ এদের বিশ্বাস নেই। একবার ওই পুটলি ছেড়ে দিলেই ধারাকে কে পায়। দেখা যাবে, ভয়ে সেখানেই সে কুপোকাত। বাহিরে যেতে যেতে আশা এশাকে বললো,
“তুই যে ধারাপুকে মিথ্যে বললি, ধরা খেলে”
“ওই ভীতু মহিলা জীবনেও চেক করতো না। দেখলি না তেলাপোকার নাম শুনেই সিড়িতে উঠে গেছে। বুদ্ধি খাটা, মাথায় তো গোবর ভরা”
“আর তোমার মাথায় তো আলিবাবার খাজানা আছে”
“ঝগড়া কর তুই, আর ওখানে ঘুঘু উড়ে যাক”
আশা থামলো। সে বুঝলো এখানে ঝগড়া করাটা এখন জরুরি নয়। আপাতত তাদের তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। পুটলির ছোট ইঁদুরছানা গুলোও বেশিক্ষণ পুটলিতে থাকবে না। কেঁটে ঠিক বেঁড়িয়ে যাবে। এশা, আশা চুপিসারে পাশের বাসার নিচে দাঁড়ালো। এখনো সেলিম সাহেবদের মালামাল তোলার কাজ শেষ হয় নি। কারণ চা খাবার নামে শ্রমিক দুজন কোথায় গেছে জানা নেই। দীপ্ত বা সেলিম সাহেব কাউকেই দেখা গেলো না। তারা হয়তো ভেতরে। এশা আশা সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো তখন ই তাদের চোখে পড়ে এই ট্রাকটি। ট্রাকের পেছনে অস্ট্রেলিয়ান ফুপার গাড়িটি দেখেই তাদের বুঝতে বাকি থাকে না ফুপা তাদের পাশেই ভাড়া নিয়েছে। তখন ই বুদ্ধি আটে “মিশন অস্ট্রেলিয়ান ফুপা” চালাবে। তাদের ঘরের সদ্য জন্মানো ৭টি ইঁদুরের বাচ্চাকে বেশ আদরের সাথে পালছিলো তারা। সেই ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকেই এই পুটলিতে ভরেছে। এখন তাদের প্লাণের পরিণতির পালা৷ এশা আশার খুব একটা কষ্ট হলো না। গেটের ভেতরেই তিনজনের সিল মারা তিনটি কার্টুন দেখতে পেলো তারা। সাথে আনা এন্টিকাটার দিয়ে খুব নিপুনভাবে তারা তিনটে বক্সে ইঁদুরগুলো পুড়ে দিবে। এখন কাজগুলো ইঁদুর ছানার উপর। গোলবাঁধলো অন্য জায়গায়, যখন পুরুষ কন্ঠ কানে এলো। সটান হয়ে দাঁড়ালো তারা৷ সামনে তাকাতেই দীপ্তকে দেখতে পেলো তারা৷ দীপ্ত এগিয়ে এলো তাদের দিকে। তার চোখের ভাষা বুঝতে পারলো না এশা আশা। ভাবলো এবার বুঝি ধরা খেলো। কিন্তু তাদের অবাক করে দীপ্ত হাসি হাসি মুখে বলে উঠলো,
“এ কি টুইন্স এখানে? তোমাদের মিস করেছি”
“আমরাও আপনাকে অনেক মিস করেছি দীপ্ত ভাই। আপনাকে এখানে দেখবো কল্পনাও করি নি”
“হ্যা, সাডেন প্লান। কি করছিলে ঝুকে”
“বক্স দেখছিলাম, আসলে আপনি তো যেভাবে আমাদের বাসায় এসেছিলেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না আপনার এতো কাপড় চোপড়। এখন বিশ্বাস হয়ে গেছে। আসি তাহলে?”
বলেই দেরি না করেই ছুট লাগালো এশা আশা৷ দীপ্ত বিস্মিত নজরে দেখলো তাদের যাওয়া। মেয়ে দুটো সত্যি অদ্ভুত, কি বলে, কি করে মাথার উপর দিয়ে যায়।
******
ধারা ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার মাথায় এখনো সেলিম সাহেবের কথা ঘুরঘুর করছে। নানাভাই হয়তো জানেন না, সেলিম সাহেবের পাশের বাসায় ভাড়া নেবার কথা, জানলে উনিও ঘর মাথায় করতেন। এদিকে অনল এখনো তার জায়গায় বসা। মাথা তুলেই শুধালো,
“এতো দেরি হলো যে? বলেছিলাম না গল্প জুড়বি না।”
“গল্প জুড়ি নি, চ্যালেঞ্জ করে এসেছি”
ধারার কথাটা মস্তিষ্কে অনুধাবন হতে সময় নিলো। তড়াক করে মাথা তুললো অনল। অবাক কন্ঠে বললো,
“কি?”
“সেলিম আহমেদের সাথে দেখা হয়েছে”
খাতা ছেড়ে উঠে আসলো অনল। ধারার পাশে বসে বললো,
“খুলে বলতো, কি হয়েছে?”
ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর সিলিং এর দিকে তাকিয়ে সবটুকু খুলে বললো অনলকে। অনল শান্ত চিত্তে সবটুকু শুনলো। কিঞ্চিত অবাক ও হলো, অবাক হলো সেলিম সাহেবের নিচু চিন্তায় নয়। অবাক হলো ধারার আত্মবিশ্বাসে। কথাটি ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসির উদয় হলো। ধারার চুলে আলতো হাতে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
“আমার বউ যখন চ্যালেঞ্জ করেই এসেছে, পরীক্ষা তো দিতেই হবে! দেখি শ্বশুরমশাই কি পরীক্ষার আয়োজন করছে”
“ফাজলামি করছো?”
“একেবারেই না, আমি একদম লোহার মতো সিরিয়াস”
“সেটা কিভাবে হয়?”
“দেখ লোহা যেমন সব কিছুর মাঝেও অভঙ্গুর থাকে, আমিও তেমন শ্বশুরমশাই এর ব্যাপারেও আমার সিরিয়াসনেস অভঙ্গুর। দরকার হলে আমিও নায়কদের মতো গলা তুলে বলবো, চৌধুরী সাহেব টাকা দিয়ে আপনি সব কিনতে পারলেও আমার ভালোবাসাকে কিনতে পারবেন না, পারবেন না। এখন তুই চৌধুরী সাহেবের জায়গায় আহমেদ সাহেব বসিয়ে নে”
অনলের কথাটি শুনতেই হো হো করে হেসে উঠলো ধারা। এতো সময়ের ক্রোধ, রাগ, বিষাদ, চিন্তাগুলো যেনো বাস্পায়িত হয়ে গেলো। মনের আঙ্গিনায় জমে থাকা ধুলো উড়ানো নিকষকালো মেঘগুলো নিমেষেই যেনো সরে গিয়ে এক উজ্জ্বলিত কুসুমপ্রভা বিস্তার করলো। ধারাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে অনল নরম গলায় বললো,
“এভাবে হাসবি, প্যাঁচামুখো বউ আমার ভালো লাগে না”
“কি করবে, খুঁজে খুঁজে এই পেঁ”চি’মু’খী’কে’ই বিয়ে করেছো!”
অনল উত্তর ই দিবে তার পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠলো। প্রথমে না ধরতে চাইলেও শেষে বাধ্য হয়ে ফোনটি ধরে অনল। কথা শেষে যখন শুধালো, “কে ফোন করেছে?” তখন উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে অনল বলে,
“আমাদের ব্যাঁচের রিইউনিয়ন হচ্ছে যাবি?”
“তোমাদের বন্ধুমহলে আমি যেয়ে কি করবো?”
“স্মৃতিও যাচ্ছে। রবিন ও তার নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসছে। চল ভালো লাগবে।”
“কবে সেটা?”
“এইতো সামনের রবিবার। চল, একটু বউকে দেখিয়ে শো অফ করতে চাই। নয়তো সব ফুটেজ প্লাবণ ই নিয়ে যাবে। চল প্লিজ। তোর ভালো লাগবে”
অনলের আবদারে মানা করতে পারলো না ধারা। কিন্তু মূহুর্তটাও ছাড়লো না, ঠেস মেরে বললো,
“শুধু শো অফ করতেই নিয়ে যাবে আমাকে! ছি ছি, এই আমার বরভাগ্য!”
“অবশ্যই সবাইকে দেখাবো না, আমার একটা পুতুল বউ আছে। মাঝে মাঝে নিজের সৌভাগ্য দেখাতেও শান্তি লাগে। তুই বুঝবি না”
ধারার নাক টেনে কথাটা বললো অনল। ধারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটির দিকে। এতো দেখলেও কেনো যেনো মন ভরে না। মন চায় আরোও দেখি, শুধু দেখতেই থাকি। এই প্রিন্স উইলিয়ামটি যে শুধু তার________
রবিবার,
একটা বিশাল হোটেলের কনফারেন্স রুম ভাড়া করা হয়েছে। ভার্সিটির ১৩ ব্যাচের সবাই একত্র হয়েছে সেখানে। যে যার পরিবার নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি। কত বছর পর মতে হচ্ছে সেই যৌবন যেনো ফিরে এসেছে। ধারাও অনলের সাথে এসেছে এখানে। প্লাবণ এবং স্মৃতির সাথে তাদের আগেই দেখা হয়েছে। রবিন ও তার নতুন বান্ধবীকে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাদের নাকি বিয়ের কথা চলছে। রবিনটির ও যে একটা হিল্লে হলো এটাই বেশ অদ্ভুত। ইকরাম এলো একা, তার বউটি এখন বাপের বাড়ি। তাই তাকে একাই আসতে হলো। আড্ডা হলো জম্পেস। ধারার সাথে পরিচিত হলো অনেকে। সকলের একটাই কথা,
“শেষমেশ বাচ্চার কাছেই হৃদয় হারালি?”
অনল তখন গর্বের সাথে বললো,
“তাহলে বুঝে দেখ আমার বউটি কতো গুণী, আমার হৃদয় চুরি করা যার তার কাজ নয়।”
ধারা তো লজ্জায় পারলে মিশে যায়৷ না চাইতেও এতোবড় অনুষ্ঠানের মধ্যমনি সে৷ এর মাঝেই একজন বলে উঠে,
“অনন্যা দেশে ফিরেছে, জানিস?”…………
চলবে#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩১তম_পর্ব
সকলের একটাই কথা,
“শেষমেশ বাচ্চার কাছেই হৃদয় হারালি?”
অনল তখন গর্বের সাথে বললো,
“তাহলে বুঝে দেখ আমার বউটি কতো গুণী, আমার হৃদয় চুরি করা যার তার কাজ নয়।”
ধারা তো লজ্জায় পারলে মিশে যায়৷ না চাইতেও এতোবড় অনুষ্ঠানের মধ্যমনি সে৷ এর মাঝেই একজন বলে উঠে,
“অনন্যা দেশে ফিরেছে, জানিস?”
অনন্যার কথাটা কর্ণপাত হতেই অনলের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। হাসিখুশি মুখখানা হয়ে উঠলো গম্ভীর। নামটিকে যেনো সহ্য হয় না তার। এতোটা বিরক্তিও কোনো মানুষের প্রতি আসতে পারে জানা ছিলো না। ঈষৎ বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“তা আমি কি করবো?”
যে ব্যাক্তিটি কথাটা বললো সে অনলের প্রত্যুত্তোরে খানিকটা ভড়কালো, ঘাবড়ালো। রয়ে সয়ে বললো,
“ও এখানে আসছে তো তাই বললাম। আসলে পরশু ওর সাথে ফোনে কথা হলো। সপ্তাহ খানেক হয়েছে দেশে এসেছে। রি-ইউনিয়নের কথা উঠতেই উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো। আমিও বললাম চলে আয়। ও এখন অন দ্যা ওয়ে”
কথাটা শেষ হতে হতেই ব্যাক্তিটি বললো,
“নাম নিলাম আর অনন্যা হাজির”
বলেই রুমের গেটের দিকে তাকালো। কালো শাড়ি পরিহিত নারীর আগমন ঘটলো। সৌন্দর্য জিনিসটা চোখের ধাঁধা। কিন্তু মেয়েটির সৌন্দর্যটি চোখের ধাঁধা নয়। হলুদ ফর্সা বর্ণের নারীটির টানা টানা চোখের প্রেমে অনেক পুরুষই তার হৃদয় দিয়েছিলো। পাতলা ঠোঁটের টোল পড়া হাসির কাতর অনুভূতিতে মগ্ন ছিলো অনেকেই। ঘন কালো চুলগুলো খোঁপায় আটকে রেখেছে। এখনো মনে হচ্ছে নারীটি তার যৌবনের শীর্ষে আছে। নারীটি ই অনন্যা। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুন্দরী নারী। তার ক্রাশ লিস্ট গুনে শেষ করা যায় না। ধারা অপলক নজরে তাকিয়ে রইলো নারীটির দিকে। আভিজাত্য তার চলনে। সত্যি ই যেনো কেট মিডেল্টন। ধারা আড়চোখে তাকালো অনলের দিকে। তার ভ্রু কুঞ্চিত৷ মুখশ্রী কঠিন। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। কি চলছে তার মনে! তখন ই স্মৃতি তার হাত ধরে বললো,
“এখানে এদের মাঝে বোর হবে ধারা। এদিকে আসো”
তার সাথে রবিনের বান্ধবী তানিও ছিলো। ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর তাদের সাথে প্রস্থান করলো। তবে অনন্যার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা রয়েই গেলো।
অনল এখনো চেয়ে রয়েছে অনন্যার দিকে। মেয়েটিকে বহুবছর দেখছে সে। কিন্তু অন্তস্থলে জড়ো অসীম ক্রোধগুলো যেনো এখনো জীবন্ত৷ স্মৃতিগুলো এখনো তপ্ত। বাহ্যিক সৌন্দর্য্যে মানুষ মোহিত হয় কিন্তু ভেতরের কুৎসিত হৃদয়টা এড়িয়ে যায়। অনন্যার ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়ে যখ রবিন তার ঘাড়ে হাত রেখে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“তাহলে অনন্যার সাথে দেখাটা হবেই। ভাই তুই তো গেছিস! এক দিকে বউ অন্য দিকে প্রাক্তন!”
রবিনের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো অনলের৷ কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“প্রাক্তন মানে? শুধু বান্ধবী! তাও কিছুদিনের”
“তাই নাকি! তা ওই যে রান্না করে আনতো! তোর পেছনে ঘুরতো! লাইব্রেরির মূহুর্ত!”
রবিনের কথা শেষ হতেই অনল আড়চোখে ধারার দিকে তাকায়। সে তানি এবং স্মৃতির কাছে গল্পে মশগুল। অর্থাৎ রবিনের আজগুবি কথাগুলো সে শুনে নি। অনল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তোর মতো বন্ধু থাকলে শত্রুর অভাব হয় না। চুপ করে যা! নয়তো তোমার কলস ভাঙ্গতে সময় লাগবে না। তানি জানে লেডিস হোস্টেলের নিচে দাঁড়িয়ে শশীর জন্য মেডিসিন কিনে দেওয়া? নোট পাস করা! জানে?”
এবার কেশে উঠলো রবিন৷ মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বললো,
“ছাড় না, অতীত তো!”
“ও, তোমার বেলায় অতীত। আর আমার বেলায় প্রাক্তন, তাই না? কান খুলে শুনে রাখ, অনন্যা শুধু আমার বান্ধবী ছিলো৷ ও আমাকে পছন্দ করতো এটা ওর ব্যাপার। আমার মাথা ব্যাথা নয়। শুধু শুধু আমার ছোট বউ এর মাথায় আজাইরা কিছু ঢুকাবি না। নয়তো তোর বিয়ে হবার আগেই ভেঙ্গে দিবো”
অনলের হু’ম’কি কাজে দিলো। প্লাবণ এবং ইকরাম হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা। রবিনটাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। কিন্তু প্রেমে পড়ে আজ সেও কাঠির মতো সোজা হয়ে গেছে। প্লাবণ টপিক বদলায়। কারণ সে জানে অনন্যার টপিক আরেক উঠলে অনলের মেজাজ বিগড়াবে৷ দেখা যাবে সব ছেড়ে বাড়ি চলে যাবে। অনল ও আর মাথা ঘামালো না। জীবনে এমন অনেক মূহুর্ত আসে যখন চরম অপছন্দের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। এটা তো হবার ই ছিলো। তাই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ায় বুদ্ধিমানের। এতো সুন্দর সন্ধ্যা নষ্ট করার মানে নেই।
দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গেলো। খাওয়া দাওয়া সেরে অনল ধারার হাতটি নিজের মুঠোবন্দি করে বললো,
“কেমন লাগলো?”
“ভালো”
“তাহলে যাওয়া যাক”
“হু”
অনল এবং ধারা সকলকে বিদায় দিয়ে প্রস্থান ই করবে এমন সময় একটি চিকন নারী কন্ঠ শোনা গেলো,
“অনল”
কথাটা শুনতেই পিছনে ফিরলো ধারা। অনন্যা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ধারা তার শার্ট টেনে বললো,
“আপুটা তোমাকে ডাকছে বোধ হয়”
অনল তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অনন্যার দিকে। না চাইতেও এখন ভদ্রতার খাতিরে কথাটা বলতেই হবে। অনন্যা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে স্মিত হাসলো। তারপর বললো,
“তুই চলে যাচ্ছিস? অথচ আমাদের তো কথাই হলো না।”
অনল উত্তর দিলো না। তার মেজাজ সংবরণ করা কঠিন হয়ে গিয়েছে। অনন্যা অনলকে মৌন থাকতে দেখে ধারার দিকে তাকালো। কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
“তুমি অনলের বউ?”
“জ্বী, আমি ধারা”
“আমি অনন্যা। তোমার স্বামীর খুব ভালো বন্ধু, যদিও একটু মনোমালিন্য চলছে। তোমার বর একটু রেগে আছে আমার উপর”
বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো। ধারাও তার সাথে হাত মিলালো। অনল এখন ও মৌন। অনন্যা একটু থেমে বললো,
“এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস? ব্যাপার না৷ দেশে যখন ফিরেছি তোর রাগটাও ভাঙ্গিয়ে দিবো। ভুল আমার ছিলো। আমি মানছি। কিন্তু এই পুরোনো কথাগুলো ছেড়ে দে। আমরা আবার ফ্রেন্ড হতেই পারি।”
“আমার যে স্বার্থপর মানুষ পছন্দ নয় অনন্যা। যারা আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায় তাদের থেকে আমি দূরে থাকি। চল ধারা। মাথা ব্যাথা করছে”
কাঠ কাঠ কন্ঠে কথাগুলো বললো অনল। তারপর ধারার হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো। অনন্যা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভেবেছিলো সকলের সম্মুখে অনলের সাথে কথা বললে হয়তো অনল বাধ্য হয়ে তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং উপস্থিত সবাই এর মাঝে গুঞ্জন শুরু হলো। অনল এবং অনন্যার কথাটা প্রায় সকলের ই জানা। অনলের এমন ব্যাবহারে তারা নিশ্চুত হলো তাদের মাঝে কিছু একটা তো ঘটনা আছেই। প্লাবণ এবং রবিন মুখ চাপ্যা চাওয়ি করলো। অনলের রাগ সম্পর্কে তারা বেশ ভালোভাবেই অবগত।
হোটেল থেকে বের হবার পর থেকেই চুপ করে রয়েছে অনল। তার মুখে কোনো কথা নেই। কঠিন মুখে বাইক চালাচ্ছে। চোখ পিচঢালা রাস্তার দিকে। ধারার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। প্রশ্নগুলো অনন্যাকে ঘিরে। অনল এবং অনন্যার মাঝে কি এমন মহাকান্ড ঘটেছিলো যে প্রিন্স উইলিয়াম কেট মিডেল্টনের মুখ দর্শনেও বিরক্ত। তাদের বন্ধুত্বে ফাটল বাধলো কেনো! সেও কি দিগন্তের মতো কান্ড করেছে! কথাটা ভাবতেই স্নায়ুকোষে দিগন্ত নামটি উদয় হলো। ধারাদের বন্ধুমহলেও ফাটল ধরেছে। দিগন্তকে সকল জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করার সুযোগ রাখে নি। মাহির সাথে দু-তিনবার কথা হয়েছে। সে ইনিয়ে বিনিয়ে এক-দুবার দিগন্তের হয়ে আর্জি গিয়েছিলো। কারণ পাঁচজনের মধ্যে দুজনের ঝামেলা হলে বাকি তিনজন হয়ে যায় অনাথ। তারা এই পক্ষেও যেতে পারে না আবার ওই পক্ষেও যেতে পারে না। ফলে তারা চায় যেনো এই গ্যা’ঞ্জা’মে’র একটা সমাধান হোক। অভীক, নীরব এবং মাহিও চায় এই মনোমালিন্য দূর হোক। পাঁচজনের বন্ধুমহল টা অক্ষত থাকুক। অভীক এবং নীরব সুপারিশ করতে আসলে ধারা তাদের আস্তো রাখবে না। ফলে তারাই মাহিকে ওকালতি করার পরামর্শ দিয়েছে। দিগন্ত ও বেশ অনুতপ্ত তবে ধারার সাথে কথা বলার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু ধারা মাহিকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। সরাসরি মানা করে দিয়েছে সে। যে মানুষ বন্ধুত্বের মর্ম বুঝে না, তাকে বন্ধু বলে মানে না ধারা। হঠাৎ স্পিড ব্রেকারের কারণে বাইক নড়ে উঠলো। সাথে সাথেই চিন্তার ঘোর ভাঙ্গলো ধারার। টাল সামলাতে না পেরে আকড়ে ধরলো অনলের শার্ট। তখন ই অনলের গম্ভীর পুরুষালী স্বর কানে আসলো,
“ধরে বয়, একটা মোড় নিলেই তো কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়বি”
“খেয়াল করি নি”
“তা করবি কেনো? ভাবনায় তো ম্যাডাম তখন জাহাজ বানাচ্ছিলেন।”
ধারা উত্তর দিলো না। শুধু শক্ত করে অনলকে ধরে বসলো। মাথা ঠেকালো অনলের কাধে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস অনলের শার্ট ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে। মৃদু বাতাস বইছে। আকাশে নিকষকালো মেঘের আনাগোনা। চাঁদটি নেই। ফলে আঁধার যেনো আরোও ঘন। রোড লাইটের সোডিয়াম আলোটুকুই পড়ছে ধারার মুখে। আলো আধারীর মায়ায় ধারাকে ফ্রন্ট মিররে দেখতে ভীষন মায়াবতী লাগছে। যেনো মায়ানগরীর কোনো সিন্ধুপুষ্প। অনল হাসলো। মসৃণ, স্মিত হাসি। বা হাত টা ব্রেক থেকে সরিয়ে কোমড়ে থাকা ধারার হাতটি ছুলো আলতো ভাবে। অমলিন কন্ঠে বললো,
“তুমি প্রণয়ে বাধিবে
নাকি প্রহেলিকায় রাখবে?
আমি প্রণয়িনী তোমায় চাই
প্রহেলিকার দ্বার খোল
চলো হৃদয়ে হারাই” (জান্নাতুল মিতু)
ধারা আরোও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অনলকে। তার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। হাসিটি তৃপ্তির, হাসিটি সিন্ধুসমান সুখ প্রাপ্তির__________
********
পড়ন্ত বিকেল। কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত। তার নজর রক্তিম সূর্যের দিকে৷ নীল আকাশ তার শেষ প্রান্তের চাকতির ন্যায় রক্তিম অস্তগামী সূর্য। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নিজ নিজ নীড়ে৷ দীপ্ত তখন গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ধুলোউড়ানো উষ্ণ, ব্যাস্ত দিনের অবসান। ব্যাস্ত শহরের কোলাহল এখন শেষ হবে। কিন্তু তার জীবনের কোলাহলগুলো থামার নাম নেই। রোকসানা আন্টি অতীষ্ট এই ঢাকার জ্বালাময়ী উত্তাপে। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েদারে অভ্যস্ত নারী ঢাকার এই উত্তাপকে নাকোচ করছে। তারপর এতো ছোট বাসায় সে থাকতে পারছে না। তার পারি চার ভাগের এক ভাগ ও নয় এই বাসা। উপরন্তু পানির সমস্যা আলাদা৷ এসিও লাগান নি সেলিম সাহেব। তার মনে হচ্ছে অহেতুক খরচা। এখানে তো ঘর বাঁধতে আসা হয় নি৷ আর পুরোনো বাসা হওয়ায় এসি লাগাবার সিস্টেম নেই। মিস্ত্রী এনে লাইন করা, হাবিজাবি— কি দরকার! ফলে রোকসানার নাকি দমবন্ধ হয়ে আসে। উপরন্তু ইঁদুরের উৎপাত। কোথা থেকে তাদের তিনজনের কাপড়ের বক্সে ইঁদুর ছানার উপদ্রব হয়েছে কে জানে। প্রতিটি জামা কেটে ফালাফালা। ফলে আবারো জামা কিনে হয়েছে। কিন্তু ইঁদুর সমস্যার নিস্পত্তি হয় নি। প্রায় অন্ধকার রুমে তাদের আনাগোনার আভাষ পাওয়া যায়। দীপ্ত বহুবার ঔষধ ও এনেছে। কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না। মরে যেনো আবার আসে তারা৷ যেনো কেউ প্রতিনিয়িত নিয়ম করে তাদের বাড়ি ইঁদুর সাপ্লাই করছে। ব্যাপারটা সন্দেহীন। কিন্তু দীপ্তের কিছু যায় আসছে না। সে নির্বিকার। সে বরং ইঞ্জয় করছে। যখন রোকসানা ইঁদুর দেখে ছুটে সোফার উপর উঠছে তখন দীপ্তের মনে হচ্ছে সে কোনো মিউট কমেডি স্কেচ দেখছে। ভাবতেই আয়েশ করে কফির মগে চুমুক দিলো দীপ্ত। ঠিক সেই সময়েই রোকসানার আগমন ঘটলো। তার মুখশ্রী রক্তিম এবং কঠিন। তেজী স্বরে বললো,
“আমি দেশে ফিরবো। আমার এখানে আর ভালো লাগছে না”
“তাহলে কবের টিকিট কাটবো?”
“আজকের ই”
“আচ্ছা”
নির্বিকার স্বরে বললো দীপ্ত। রোকসানা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“কেনো যেতে চাচ্ছি শুনবে না?”
“ইঁদুর, গরম বা দমবন্ধ লাগার জন্য?”
“না, তোমার আংকেলের উইল পড়েছি। জানো সে উইলে কি লিখেছে?”
“কি?”
“তার মৃত্যুর পর তার সকল সম্পত্তির চার ভাগের দু ভাগ পাবে ধারা, এক ভাগ আমি এবং এক ভাগ তুমি। এটার কোনো মানে হয়? যে মেয়ে তাকে উঠতে বসতে অপমান করছে তার জন্য সে সম্পত্তিও রাখছে। উপরন্তু আমাকে আর তোমাকে কষ্ট ও দিচ্ছে। এর বিহিত হওয়া চাই না?”
দীপ্ত চুপ করে রইলো কিছু সময়৷ তারপর চিন্তার ভাব করে বললো,
“ঠিক বলেছে আন্টি। এর তো বিহিত হওয়াই চাই। উনি শুধু শুধু আমাকে উনার উইলে কেনো জড়িয়েছেন? আমার অংশটিও তো ধারার প্রাপ্য”
“কি বলছো তুমি দীপ্ত!”
“ভুল কি বললাম। আংকেলের লিজিট ডটার তো ধারা। আই এম নোওয়ান। আমাকে কেনো ইনভলভ করা হচ্ছে! আই হ্যাভ টু স্কিপ উইথ হিম”
রোকসানা ভ্রু কুঞ্চিত করে বিস্মিত নজরে চেয়ে রইলো দীপ্তের দিকে। দীপ্ত নির্লিপ্ত। ফলে বাধ্য হয়ে বললো,
“তাহলে তুমি তার সাথেই থাকছো?”
“কাজ না হওয়া অবধি আমি এখানেই থাকছি। আপনার টিকিট করে দিচ্ছি। শুধু শুধু কেনো এই ঝঞ্জাটে থাকবেন”
“লাগবে না”
বলেই রোকসানা নিজ ঘরে চলে গেলো। ঠাস করে দরজা আটকে দিলো সে। দীপ্ত নির্লিপ্ত হাসলো। রোকসানার এই স্বভাব তার জানা। সে যাবে না, কারণ তার ভয় আমে দুধে যদি মিলে যায়________
*******
অবশেষে নিজ ভার্সিটিতে পা রাখলো ধারা। এখন সে সেকেন্ড ইয়ারে। নতুন নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে ভার্সিটির প্রাঙ্গনে। বেশ জড়ো সড়ো হয়ে কচি মুখগুলো ছুটছে নিজ নিজ ক্লাসে। স্বপ্ন পূরনের যুদ্ধে এবার নবযাত্রী এসেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটি এখন আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। সে গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে আছে ধারা। অপেক্ষা মাহির আগমনের৷ মাহি আসলেই একত্রে নতুন ক্লাসে পা রাখবে। তপ্ত রোদের নিচে কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ধারা৷ সূর্যমামার উত্তাপে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে। সাদা ওড়নাড়ি দিয়ে কপাল মুছে নিলো সে। তখন ই আগমন ঘটলো মাহির। উত্তাপে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যেই ক্রোধবানী উগরাবে তার আগেই খেয়াল করলো নীরব, অভিক এবং দিগন্ত তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। দিগন্তকে দেখতেই ধারা উলটো দিক হাটা দেবার প্রস্তুতি নিলো। শান্ত আগ্নেয়গিরির লাভা আবারোও তার প্রচন্ড রুপ নেবার আগেই সরে যাওয়া শ্রেয়। কিন্তু তার আগেই দিগন্ত অসহায় কন্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দে ধারা। আমি সেদিন সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম”…………..
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩২তম_পর্ব
দিগন্তকে দেখতেই ধারা উলটো দিক হাটা দেবার প্রস্তুতি নিলো। শান্ত আগ্নেয়গিরির লাভা আবারোও তার প্রচন্ড রুপ নেবার আগেই সরে যাওয়া শ্রেয়। কিন্তু তার আগেই দিগন্ত অসহায় কন্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দে ধারা। আমি সেদিন সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম”
দিগন্তের কথাটা স্নায়ুকোষে প্রবেশ করতেই রেষারেষি শুরু হলো। সে কি শুধু বাড়াবাড়ি করেছিলো! হয়তো শুধু বাড়াবাড়ি হলে ধারা তাকে ক্ষমা করে দিতো। কিন্তু সে রীতিমতো ধারাকে অপমান করেছে তাও ডিপার্টমেন্ট করিডোরে বহু মানুষের মাঝে। শুধু ধারাকে নয় সে অনলের সততাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বহুবার। উপস্থিত সকলের মনে না চাইতেও অনল স্যারের সততা নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। এই মানুষটাকে ক্ষমা করা যায় কি! আচ্ছা, আঘাত করে ক্ষমা চাইলেই কি আঘাতের ক্ষত দূর হয়ে যায়! ধারা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ একটা কথাও বললো না, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দিগন্তের দিকে। হ্যা! বন্ধুত্ব সত্যি অদ্ভুত একটা সম্পর্ক৷ সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পরিবারটা বেছে দেন। পরিবার, আত্নীয় বাছাই করার উপায় মানুষের থাকে না। কিন্তু এই বন্ধুর নির্বাচন মানুষ নিজে করে৷ তারা তাদের মনের সাথে মিলে এমন বন্ধু বাছাই করে। কিছু কিছু বন্ধুত্ব তো পরিবারের মতো হয়৷ ধারার বন্ধুমহল টিও ঠিক তেমন ছিলো। দিগন্তের সাথে তার বন্ধুত্বটি একটা বছরের৷ কিন্তু এই এক বছরে সুন্দর মূহুর্ত অগণিত। এই সকল সুন্দর মূহুর্তগুলো তিক্ততায় পরিণত করেছে সেদিনের উক্তিগুলো৷ চাইলেও মস্তিষ্ক সেই উক্তিগুলো ভোলাতে পারছে না। হয়লো প্রিয় বন্ধুটি এমন কটুক্তি করেছিলো বলেই আঘাতটা গভীর। ধারাকে নিশ্চুপ দেখে দিগন্ত নরম কন্ঠে বললো,
“ধারা আমি সত্যি অনুতপ্ত৷ সেদিন আমি তোকে এতো বাজে কথাগুলো বলেছি, আমি নিজেই লজ্জিত। আসলে আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। প্রথমত অনল স্যারকে আমি অপছন্দ করি। দ্বিতীয়ত আমার কিছু ব্যক্তিগত কারণ ছিলো, যা তোকে বলা সম্ভব নয়। ফলে ক্রোধে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কথাগুলো তোর কাছে অযুহাত মনে হবে। ক্রোধের বশে তোকে অপমান করাটা যৌক্তিক নয়৷ কিন্তু ওই সময় আমার মানসিক অবস্থাটা তোকে বোঝাতে পারবো না। যখন তুই আমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলি, মুখ ঘুরিয়ে নিলি তখন বুঝলাম আমি কি অমূল্য জিনিস হারিয়েছি। আমি অতিরিক্ত লোভী হয়ে উঠেছিলাম। এই বন্ধুত্বটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমাদের পাঁচজনের কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত আমার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য মূহুর্ত। আমি তোর বন্ধুত্ব হারাতে চাই না ধারা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে”
“দিগন্ত, বন্ধুর দ্বারা অপমানিত হবার থেকে জঘন্য জিনিস আর কিছুই হয় না। সেই আঘাত গুলো মনে দাগ কেটে যায়। তুই আমার উপর রাগ দেখালে হয়তো আমি কিছুই মনে করতাম না৷ কিন্তু তুই শুধু আমাকে না অনল স্যারকেও অপমান করেছিস। সেদিন যে যে সেখানে উপস্থিত ছিলো তুই কি তাদের মন থেকে সব কিছু মুছিয়ে দিতে পারবি। আমার সম্পর্কে তাদের ধারণা বদলাতে পারবি? পারবি না। কাঁচ ভাঙ্গলে সেটা জোড়া ঠিক ই লাগে তবে দাগ থেকে যায়।”
ধারা শান্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো৷ দিগন্ত নত মস্তক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জার জন্য তাকাতেও পারছে না সে। বুকের ভেতর কাতর অনুভূতিগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। চিনচিনে বিষাদেরা পাথরের মতো চেপে আছে বুকের উপর। না চাইতেও বার বার হানা দিচ্ছে বন্ধুত্ব চুরমার হবার আশঙ্কা। ধারা দাঁড়ালো না। সে পা বাড়ালো ক্লাসের দিক। মাহিও তার পিছু নিলো। নীরব এবং অভিক রইলো দিগন্তের সাথে। অভিক স্বান্তনা দিলো,
“ধারার অভিমান হয়েছে। এখন এই অভিমানিটা তোর ই ভাঙ্গাতে হবে। ভুল যেহেতু করেছিস সুতরাং সেটার মাশুল ও গুনতে হবে”
“দোস্ত আমাদের বন্ধুমহলটা আমার জন্য নষ্ট হয়ে গেলো”
“যদি বন্ধুমহলের জোড় এতো ঠুঙ্কো হয় তবে আমার মনে হয় তা ভেঙ্গে যাওয়া শ্রেয়। আর আমাদের বন্ধুত্বের জোড় যদি কঠিন থাকে তবে এই ঝড় তুফানেও তা অক্ষত থাকবে। জীবনটাতো মসৃণ নয়। মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়ে থাকিস না। চল ক্লাসে”
শান্ত কন্ঠে নীরব কথাটা বললো। নীরবের কথাগুলো সর্বদাই আধ্যাত্মিক ধরণের হয়৷ তবে তার কথাগুলোর মর্ম যৌক্তিক। অভীক বলে উঠলো,
“যথাআজ্ঞা নীরব বাবা, চলেন। আপনাকে এই গাছের নিচে একটা গেরুয়া রঙ্গের লুঙ্গি পড়িয়ে বসিয়ে দিতে হবে। আপনি বাণী বকবেন আর আমি টাকা ইনকাম করবো”
“ফাজলামি কর, কিন্তু এই নীরব বাবার কথাই খাটে”
কথা বলতে বলতে পা বাড়ালো ক্লাসের দিকে। দিগন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মাথা তুলে তাকালো নীলাম্বরের দিকে। সাদা তুলোর মতো মেঘেরা এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। কেউ ঠিক বলেছিলো,
“বিশ্বাস ভাঙ্গা সহজ, গড়া বহু দুষ্কর”
*******
অবশেষে উৎসাহীত মনকে সম্পূর্ণ নাকানিচুবানি খাওয়িয়ে শেষ হলো সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাস। এখন দুপুর ১.২০। সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাসটি এতোটা ক্লান্তময়ী হবে কে জানতো! বিষয়গুলো আরোও দ্বিগুন কঠিন। উপরন্তু এই সেমিস্টারে অনলের একটি ক্লাস ও নেই। সুতরাং যা একটু ক্লাসের ফাঁকে কাতর নয়নগুলো মুগ্ধ মনের মানুষটিকে দেখবে সেই উপায়টিও নেই। ক্লান্ত ধারা বের হলো ক্লাস থেকে। মাহি উদাস কন্ঠে বললো,
“এবার ফেল নিশ্চিত”
মাহির কথাটি কর্ণপাত হলো না ধারার। কারণ তার নজর সিড়ির কাছে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে। শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে সে। ডানহাত পকেটে, বারবার বাম হাতের ঘড়িটিকে দেখে যাচ্ছে কিছুসময় পর পর। তারপর কপালে আসা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে আবারো শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে প্রণয়িনীর অপেক্ষায়। ঘামে নীল শার্টটি ভিজে চুপচুপে অবস্থা। তবুও মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই ধারার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। মাহিকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেলো সে। এখন আর লুকোচুরি নেই, সকলে জানে তার এই পা’গ’লে’টে মানুষটির কথা। ধারা আসতে দেখে স্মিত হেসে এগিয়ে গেলো অনল। বেশ সময় ধরে অপেক্ষা করছিলো তার জন্যই৷ বিকেলে ল্যাব স্যাশন আছে তার। তাই দুপুরের খাবারটি বউ এর সাথেই খাবে। নরম গলায় বললো,
“ল্যাব আছে?”
“আছে”
“আমারোও আছে, চল খেয়ে নেই”
“কোথায় যাবো?”
“আশেপাশে কোথাও”
“তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি!”
“সব জেনেও যখন অবুঝ সাজিস কেনো?”
“ভালো লাগে, অবুঝ মনের আবদারও বলতে পারো”
অনল ধারার নিষ্পাপ স্বীকারোক্তিতে হাসে শুধু। তারপর আদুরে কন্ঠে বলে,
“আমার দশটা না পাঁচটা না, একটা বউ। অপেক্ষা না করে উপায় আছে?”
অনলের উক্তিটি শুনতেই বুকের ভেতর অনুভূতিরা ঝড় তুললো। অজস্র সুখ জেনো তার হাতের ভেতর চলে এসেছে। হ্রদস্পন্দনটা কিঞ্চিত বেড়ে গেলো৷ এ যেনো এক অদ্ভুত ভালোলাগা। সে জানে অনল এমন মোহনীয় কিছু একটা বলবে! তবুও বেহায়া হৃদয় বারবার তা শুনতে চায়। এবং এই একই রকম ভালোলাগাটা প্রতিবারেই ধারার অনুভূত হয়। প্রতিবার ই হৃদস্পন্দন বাড়ে, প্রতিবার ই ভীষন লজ্জায় দৃষ্টি নেমে যায়। তবুও শুনতে ইচ্ছে হয় কথাগুলো। এ যেনো এক অদ্ভুত অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এর মাঝে অভীক বলে উঠলো,
“আজ একটা বউ থাকলে আমরাও তাকে নিয়ে খেতে যেতাম। আহারে কষ্ট”
মাহি এবং নীরব হেসে উঠলো। ধারা লজ্জা পেলো ঠিক ই কিন্তু পরমূহুর্তেই অনলের হাতের ফাঁকে নিজের হাত গলিয়ে দিলো। অনলও শক্ত করে হাতটি ধরলো। পাছে ছুটে না যায়। রুক্ষ্ম হাতের মাঝে এই নরম হাতের স্পর্শটি মন্দ লাগে না বরং এক সাগর অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দেয়। একেই বুঝি ভালোবাসা বলে। ধারা এবং অনল চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। পিছনে দুটো কাতর নয়ন ঠিক ই চেয়ে রইলো। অনুভূতিগুলো আর্তনাদ করছে। তপ্ত হৃদয়টা বার বার বেহায়ার মতো প্রশ্ন করছে, “আমার মাঝে কি নেই! কেনো আমায় ভালোবাসা যায় না”। দিগন্ত তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। পা বাড়ালো লাইব্রেরির দিকে। কেউ সেটা খেয়াল না করলেও মাহি ঠিক ই খেয়াল করলো। কিছু একটা ভেবে সেও পিছু নিলো তার।
লাইব্রেরির শেষ ভাগে গিয়ে বসলো দিগন্ত। মাথা বেঞ্চে ঠেকিয়ে রাখলো। না চাইতেও চোখের কোন ভিজে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় চেয়ার টানার শব্দ কানে এলো। মাথা তুলে তাকালে মাহিকে দেখতে পেলো সে। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“তুই এখানে?”
“আসলাম! দুপুর পর্যন্ত রোদে ঘোরা ভালো লাগছে না”
“খাবি না?”
“তুই ও তো খাস নি”
দিগন্ত উত্তর দিলো না। সে পুনরায় মাথা নামিয়ে রাখলো। মাহিও নজর বাহিরের দিকে দিলো। লাইব্রেরির এই প্রান্তে থাই গ্লাস থেকে ভার্সিটির মাঠটা দেখা যাচ্ছে। মাহি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো মাঠটির দিকে। তারপর মলিন কন্ঠে বললো,
“অবুঝ মনটা নীল অম্বরের ফুটন্ত আতশবাজির মতো, মূহুর্তেই রঙ্গিন আবার মূহুর্তের মাঝেই বিলীন”
কথাটা কর্ণপাত হতেই মুখ তুলে চাইলো দিগন্ত। বিস্মিত চোখে তাকালো সে মাহির দিকে। মাহি নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“ভালোবাসাটা খারাপ নয়, শুধু ভালোবাসায় জোর করাটা খারাপ”
“তোকে কে বলেছে আমি কাউকে ভালোবাসি?”
“তুই ধারাকে ভালোবাসিস, কি মিথ্যে বললাম?”
দিগন্ত উত্তর দিলো না। শুধু কাঠের নির্জীব টেবিলটির দিকে চেয়ে রইলো। মাহি আবারও হাসলো। তারপর বাহিরে মাঠের দিকে রোদের মাঝে কাঠের অংশ আর রাবারের ফাঁটা বল দিয়ে খেলতে থাকা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমাদের জীবনে সবাই কাউকে না কাউকে, কোনো না কোনো সময় পছন্দ করে। সেই পছন্দের সময়সীমা থাকে, কিছু পছন্দ ক্ষণিকের আবেগ তো কিছু পছন্দ স্থায়ী। আমি তোকে ভালোবাসাকে ক্ষণিকের আবেগ কিংবা স্থায়ী কাতর অনুভূতি নামক আখ্যা দিবো না। শুধু বলবো, যতদিন এই বিষাদ আগলে রাখবি ভেতরটা বারবার তিক্ত হয়ে উঠবে৷ জানি যন্ত্রণা টা অসহনীয়। কিন্তু সহ্য করার ক্ষমতাটাও অসীম। সময়ের থেকে বড় ঔষধ আর হয় না”
“তুই এতোটা শান্ত কিভাবে? কষ্ট হয় না তোর?”
দিগন্তের প্রশ্নে মাহি আবারো হাসলো। বিচিত্র দূর্বোধ্য সেই হাসি। তারপর বললো,
“কষ্ট হয়, সবার হয়৷ মানুষ তো। শান্ত বিধায় অনুভূতি গুলো তো সজীব। জড়ো বস্তু হলে হয়তো কষ্ট হতো না। কিন্তু সেই কষ্টটা স্থায়ী নয়। কারণ যা পাবার নয় তার জন্য যা পেয়েছি তা হারাতে চাই না। যে মানুষটার হৃদয়ে আমার স্থান নেই, তার প্রতি লোভ করে নিজের এতো স্নিগ্ধ বন্ধুত্ব জ্বলাঞ্জলি দেই কি করে!”
মাহির দৃষ্টি এখনো মাঠের দিকে। আর দিগন্তের দৃষ্টি মাহির দিকে। মেয়েটি এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে জানা ছিলো না দিগন্তের। বিস্মিত নজরে সামনে থাকা চরম ঝগড়ুটে, মারকুটে, অভদ্র মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে; যার সাথে তার ছত্রিশের আখড়া। অথচ এই মেয়েটিকেই আজ মুগ্ধ হয়ে দেখছে দিগন্ত। মেয়েটি কি বরাবর ই এতোটা সরল, সুন্দর, মোহনীয়। কে জানে!________
এশা আশা হাটু গেড়ে বসে আছে সেলিম সাহেবের বাসার সদর দরজায়। দরজার পাশে ছোট একটা ছিদ্র করেছে তারা। কিভাবে করেছে সেটা একটা বিশাল কৌতুহল। কিন্তু তারা সক্ষম এই ছিদ্র করতে। তারা প্রতিদিন এই ছিদ্র দিয়ে ইঁদুরের সাপ্লাই করে। আজ অন্য কিছু সাপ্লাই করবে। কারণ ইঁদুরের সংকট দেখা গেছে। তারা তো ইঁদুর কিনে এনে সাপ্লাই করতে পারবে না। ইঁদুররা ও ভয়ে তাদের ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে এখন তেলাপোকা সঞ্চার শুরু করেছে। আপাতত আর কোনো ফর্মুলা কাজে লাগানোটি দুষ্কর। ফলে তেলাপোকা সঞ্চার করাটাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এশা যখন খুব নিপুন ভাবে শেষ তেলাপোকাটি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকাচ্ছিলো। তখন ই কানে এলো,
“তোমরা এখানে কি করছো?”………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
মুশফিকা রহমান মৈথি