প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -৪১+শেষ

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৪১তম_পর্ব

বাসায় ফিরতেই সকলকে জড়ো করলো অনল। ধারাও বুঝে পেলো না কি হয়েছে। জামাল সাহেব, রাজ্জাক, ইলিয়াস রুবি, জমজদ্বয় বেশ অবাক। কৌতুহলের বশে সুভাসিনী বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে?”
“আমার সবাইকে কিছু বলার আছে। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি”

অনলের কথায় সকলেই বিস্মিত হলো। কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অপরদিকে ধারার হৃদয়ে জমলো একরাশ ভয়। দীপ্ত যে কোম্পানির চাকরির কথাটা বলেছিলো সেটা কি তবে গ্রহণ করেছে অনল৷ হয়তো সেটাই বলার জন্য সকলকে জড়ো করেছে। বুকচিরে তপ্ত নিঃশ্বাস বের হলো ধারার৷ অহেতুক অভিমান সে করবে না, অনল যে সিদ্ধান্তই নেক না কেনো সে তার পাশে রইবে। কারণ সে অনলকে বিশ্বাস করে। জামাল সাহেব বেশ অধৈর্য্য হলেন। একেই তার শরীরটা আজকাল খুব একটা ভালো নেই, তারপর এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এ তার অস্বস্তি বাড়ছে। সে হুংকার ছেড়ে বললেন,
“এতো ভনিতা না কইরে খোলশা করে কও কি কবা?”
“আমি ধারাকে বিয়ে করতে চাই”

অনলের কথায় আক্কেলগুড়ুম হবার উপক্রম। ধারার চোখজোড়াও বিস্ফারিত হবার যোগাড়। লোকটা বলে কি! রাজ্জাক সাহেব ভ্রু কুচকে অবাক কন্ঠে বললেন,
“বিয়ে করা বউকে আবার বিয়ে করবি?”
“হ্যা, আপত্তি আছে তোমাদের? থাকলে বলো। এজন্যই সবাইকে জড়ো করেছি”

অনলের কন্ঠে জড়তা নেই। সে মজাও করছে বলে মনে হচ্ছে না। তার ব্যক্তিত্বে অহেতুক মজাঠাট্টা করাটা নেই। থাকলেও সেটা পরিবারের কাছে গোপনীয়। পরিবারের কাছে সে এক কথার মানুষ। এশা এর মাঝে আশাকে খোঁচা দিলো, ফিসফিসিয়ে বললো,
“চেরাগআলীর ডোজে কি অনলভাই ঘাবড়ে গেছে?”
“লোকটার মনে হয় মাথামুথা আওলায়ে ফেলছে। অতিবুদ্ধিমানদের এমনটা হয়। আমি তো আগেই জানতাম ধারাপুর সাথে থাকতে থাকতে এমন হবেই”

অপরদিকে বড়দের সকলের মাঝে বেশ উত্তেজনা। ধারাকে আবার বিয়ে করার কথাটা তাদের উত্তেজনার কারণ নয় কারণটা হলো হঠাৎ এই প্রস্তাবের পেছনের উৎসটি। অনলের সকলের হতবাক মুখের দিকে একপলক চেয়ে গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে জামাল সাহেবের হাতে দিলো। তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“তোমাদের মেয়েটি এখন সাবালিকা। আমি ওর বার্থ সার্টিফিকেট ঠিক করিয়েছি। শুধু তাই নয়। ওর আইডিকার্ড ও সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চলে আসবে। সুতরাং এবার আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়েতে ঝামেলা নেই। আর বাকি রইলো আবার বিয়ের কথা। গতবার তোমরা আমার বিয়ে দিয়েছিলে তাও আমাদের অমতে। অনেকটা ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল করে। এবার বিয়েটা আমাদের সম্মতিতেই হোক। মানুষ জীবনে একবার ই বিয়ে করে। সেই দিনটা সোনালী ফ্রেমে বাধাই করে রাখে। কিন্তু তোমরা যেভাবে বিয়ে দিয়েছিলে, আমার মনে হয় না সেটা কালো ফ্রেমেও বাঁধানোর মতো। একটা ছবিও নেই। বাচ্চাকাচ্চা হলে তো দেখাতেও পারবো না। তাই আমি আবার আমার বউকেই বিয়ে করতে চাই। তাও ধুমধাম করে।”

অনলের কথাগুলো শুনে সকলের মুখে মিটিমিটি হাসি। তবে এতোদিনে ছেলের অন্তস্থলে প্রণয়ের ফুলটি ফুটলো। অন্যদিকে অনলের কথাগুলো শুনে লজ্জায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বড় বড় পা ফেলিয়ে রুমের দিকে হাটা দিলো। লোকটির কি সত্যি মুখে কিছুই বাঁধে না। মূহুর্তেই রক্তিম হয়ে উঠলো কোমল গালজোড়া। এতো লজ্জার মাঝেও এক প্রশান্তিতে হৃদয় ছেয়ে আছে। তার প্রিন্স উইলিয়াম তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। উপরন্তু সে আবার বধু বেশে সাজবে। সাজবে প্রিন্স উইলিয়ামের জন্য। কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে মনের ব্যালকনির একটুকরো কুসুম প্রভা ঠাঁয় নিলো। মুখখানা দুহাতে ডেকে নিলো ধারা। ইস! এতো লজ্জা আজ কেনো ভিড়লো! এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে অনল। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ধারার দিকে। শক্ত হাতের বেষ্টনীতে আকড়ে ধরলো ধারার কোমড়। থুতনী ঠেকালো ধারার কাঁধে। আলতো কন্ঠে বললো,
“ওখান থেকে চলে এলি যে!”
“দাঁড়িয়ে থেকে তোমার কথা শুনতাম! দেখা যেতো ওখানে বাচ্চাকাচ্চার বিয়ের প্লান ও করে ফেলতে”
“বউ বুঝি লজ্জা পেয়েছে! এখন ই লজ্জা পেলে হবে! এবার কিন্তু ঘরের বাহিরে রাত কাটাবো না আমি। তখন লজ্জা পেলেও আমি কিছু নির্লজ্জ হবো”
“ধ্যাত”

ধারা মুখ লুকালো অনলের বক্ষস্থলে। আড়ষ্টতা তাকে কাহিল করে তুলছে। অনল নিঃশব্দে হাসলো। হাতের বাধন করলো আরোও নিবিড়। ধারার কেশে বা হাতটা ডুবালো। আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
“সকালে এই সার্টিফিকেট এর কাজেই গিয়েছিলাম। তাই তোকে ভার্সিটিতে দিতে পারি নি। রাগ করিস নি তো!”
“একেবারেই না। জানো যখন বলছিলে তুমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছো, আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো অস্ট্রেলিয়ার চাকরিটার কথা বলবে”
“তুই জানতি কিভাবে? আমি তো তোকে এই কথাটা বলি নি”

অনলের কন্ঠে বিস্ময়। ধারা ধীর কন্ঠে বললো,
“দীপ্ত ভাই বললেন, আসলে এই চাকরিটা সেলিম আহমেদ ই দিয়েছিলো”

অনল কিছু সময় চুপ থাকলো, তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“ভাগ্যিস আমি অফারটা নেই নি। আরেকটু হলেই ফাঁদে পা দিতাম। ধন্যবাদ”
“কেনো?”
“আমার জীবনে আসার জন্য। আমাকে এতোটা আপন করে দেবার জন্য। আমার প্রণয়িনী হবার জন্য। গোটা তুইটা আমার হবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ”

ধারা আর কথা বললো না। শুধু চুপ লরে লেপ্টে রইলো অনলের বুকে। লোকটির হৃদস্পন্দন শুনতেও বেশ ভালো লাগে তার। যেনো কোনো মধুর ধ্বনি। এর মাঝেই অনলের ফোন বেজে উঠলো। মূহুর্তটিতে ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হলো অনল। কিন্তু ফোনের নাম্বারটি দেখা মাত্র দেরি করলো না। অধীর কন্ঠে বললো,
“শিহাব ভাই, রেজাল্ট দিয়েছে”
“হ্যা, অনল। মাত্র বোর্ডে টাঙ্গালো। তোমার বউ তো ছক্কা পিটিয়েছে। এতো কঠিন প্রশ্নেও সে এ পেয়েছে। ভাবা যায়। আনসারী স্যারের মাথায় হাত। উনি কি করবেন বুঝছেন না। উপরন্তু যে মেয়েটি কমপ্লেইন করেছিলো সে এসে স্বীকারোক্তি দিয়েছে হিংসের বশে সে এই কাজ করেছে। হয়তো মেয়েটিকে বছরখানেকের জন্য রাস্টিকেট করবেন। আর তোমার বিষয়টা কাল আসলেই জানতে পারবে। আনসারী স্যারের মুখখানা দেখার মতো ছিলো অনল”

শিহাবের কথাটি শুনতেই প্রফুল্লচিত্তে অনল বললো,
“ধন্যবাদ ভাই, এতো ভালো একটা খবরের জন্য। রাখছি”

ফোন রেখে অনল ছুটে এলো ধারার কাছে। শিহাবের নাম শুনতেই ধারার বুক ধক করে উঠেছিলো। বিকালে রেজাল্ট প্রকাশের কথা। এতো কিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিলো ব্যাপারটা। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“আমি কি তোমার মান রাখতে পেরেছি?”
“আলবত! দেখতে হবে না বউটি কার। আমরা জিতে গেছি ধারা, তুই সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিস তুই ও পারিস”
“তুমি খুশি তো?”
“ধুর পা’গ’লি! যেখানে তুই আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিস, আমি কি অখুশি হতে পারি। আজ আমার থেকে খুশি হয়তো কেউ নয়। আবারো ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য। আমার প্রণয়টাকে এতো যতনে রাখার জন্য। ভালোবাসি, গোটা তুই টাকে ভালোবাসি”

ধারা টলমলে চোখে তাকিয়ে রইলো অনলের চোখের দিকে। নিদারুণ মাদকতা যেনো এই নয়নজোড়ায়। হৃদয়টা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। অনল উষ্ণ ঠোঁট ছোয়ালো ধারার অশ্রুসিক্ত চোখে। নরম কন্ঠে বললো,
“এই চোখজোড়া যে আমার বড্ড প্রিয়। তার এই অলংকারটুকু কিভাবে নষ্ট হতে দেই!”

*******

নিগূঢ় রাত, অনল গভীর ঘুমে। ধারা এখন নির্ঘুম জেগে আছে। মনে একটি বিশ্রী কৌতুহল জেগেছে। সেলিম সাহেবের চিঠি পড়ার এক দুর্বার ইচ্ছে তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে। হৃদয় আর মস্তিষ্ক বারবার যেনো যুদ্ধ করছে। মস্তিষ্ক বারবার তাকে বাধা দিচ্ছে। অথচ হৃদয় বলছে ‘একটি বার পড়লে কি হবে?’ অবশেষে জয়ী হৃদয় হলো। ধারা চুপিসারে চিঠিগুলো নিয়ে বসলো। ল্যাম্পের আলোর নিচে রাখলো চিঠিগুলো। সময়ের ছাপ চিঠিগুলোতে স্পষ্ট। সাদা কাগজ হয়ে উঠেছে বেরঙ বল পেনের কালির বর্ণ হয়ে উঠেছে বিবর্ণ। গোটা গোটা করে লেখা। ধারা পড়তে লাগলো চিঠি গুলো।

প্রিয় সুরাইয়া,
আমার সালাম নিও। গত চিঠিতে জানতে চেয়েছিলে আমি কেমন আছি। আমি ভালো আছি। শুধু এখানে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কষ্টটি অবশ্য নিজের সৃষ্ট। আসলে কি বলতো! মানুষ না সুখ খুঁজতে ভালোবাসে। কিন্তু তারা অনুসন্ধানে এতোই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যে সুখটা সামনে থাকলেও বুঝে না। আমার মতো অভাগা আর কি। এই দেখো না, সুখ খুঁজতে এখানে আসা। সুখী হতে রোকসানাকে বিয়ে করা। অথচ আমি পৃথিবীর সব থেকে অসুখী। আফসোস খুব বাজে জিনিস। কুড়ে কুড়ে খায় এই আফসোস। দেখো না, এখন আফসোস হয়। দেশে কি সুখে ছিলাম আমরা। এতো অর্থ ছিলো না। কিন্তু সুখে ছিলাম বলো। রোজ খেটে আসতাম, তুমি আমার অপেক্ষায় থাকতে। আমি তোমার জন্য বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসতাম। তোমার হাতে দিতেই কি লজ্জা তোমার। অথচ অর্থ আমাকে এতোই অমানুষ করে দিলো যে সুখটাও চোখে ধরলো না। আসলে একটা ক্ষোভ ছিলো, বাবাকে মিথ্যে প্রমাণ করার ক্ষোভ। বাবার তোমাকে বেশ পছন্দ ছিলো জানো তো। তোমার জন্য গ্রাম থেকে সবথেকে বড় মাছটা সেই পাঠাতেন। আমার কাছে আদিক্ষেতা মনে হতো। আমার এখনো মনে আছে বিয়ের দিনও বাবা আমাকে থা’প্প’ড় দিয়েছিলেন আমি বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না বিধায়। এখন মনে হয় জানো আমার তো অ’জা’তের সাথে বিয়েটা না হলে হয়তো তুমি ভালো থাকতে। আমি হিরের মূল্য বুঝি নি সুরাইয়া। কাঁচের পেছনে ছুটেছি। আচ্ছা! তোমার বড্ড অভিমান তাই না! তাইতো আমি আসার আগেই পাড়ি দিলে। সেদিন যদি একটু আগে আসতাম তোমায় দেখতে পেতাম। তোমার ক্ষমার আমি যোগ্য নই, আমি চাই না তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তবে আরেকটি বার তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে। আরেকটিবার তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে। সুরাইয়া, আমি কি এই গ্লানি বয়েই সারাটাজীবন কাটাবো। ওপারে কি মিলবে দেখা! পরজীবনে একটি তোমায় দেখার স্বাদ যে রয়েই গেলো গো! তুমি আমাকে অন্যভাবেও তো শাস্তি দিতে পারতে। এই আত্মগ্লানি যে বড্ড নিষ্ঠুর সুরাইয়া। আচ্ছা! আমি যদি আমি যদি অন্যায় না করতাম তুমি কি থাকতে আমার সাথে, আমার পাশে থাকতে! আফসোস উত্তরটা পাওয়া হলো না।
ইতি
পা’পী সেলিম

ধারা আর পড়লো না। রেখে দিলো চিঠিগুলো। দম আটকে আসছে। খুব রাগ হচ্ছে মানুষটির প্রতি। আবার এক কোনে দয়াও হচ্ছে। যে মানুষের দোষী সে মানুষটাই আজ নেই। তার ক্ষমাটা ইহজীবনে জুটলো না তার। চোখ মুছে নিলো ধারা। চুপিসারে শুয়ে পড়লো অনলের পাশে। অনলের গা ঘেষে শুতেই বলিষ্ঠ হাত টেনে নিলো তাকে বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ঘুমিয়ে যা, বেশি ভাবিস না”

ধারা অবাক হলো বটে। তবে কিছু বললো না। শান্ত বাচ্চার মতো গুটিশুটি মেরে লেপ্টে রইলো অনলের বুকে_______

*********
সেলিম সাহেবদের প্যাকিং শেষ পর্যায়ে। তারা আগামীকাল ই অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যাবেন। অবশেষে তার কাজ শেষ হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে সে নিশ্চিন্ত। অনল তার অফার ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই সে বেশ খুশি। মাঝে মাঝে হেরে যেয়েও আনন্দ হয়। এর মাঝে ডোরবেল বাজলো। সেলিম সাহেব নিজে খুললেন। খুলতেই বেশ অবাক হলেন৷ কারণ ধারা দাঁড়িয়ে আছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। হয়তো আবারো কথা শুনাতে এসেছে। এটা তার প্রাপ্য। তাই অমলিন কন্ঠে বললেন,
“ভেতরে আসো”
“একটু কথা আছে। বেশি সময় নিবো না”
“আসো”

ধারা ভেতরে এলো। সেলিম সাহেব তার ব্যালকনিতে নিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে বেতের চেয়ার পাতা। সেখানেই বসলো ধারা। আকাশে সাদা মেঘের মেলা। শরতের তাপ মুখে আছড়ে পড়ছে তার। ধারা তার চিঠিগুলো এগিয়ে দিলো সেলিম সাহেবের দিকে। তিনি অবাক কন্ঠে বললেন,
“এগুলো তোমার কাছে?”
“পেয়েছি, একটা-দুটো পড়েছি ও। যেহেতু মালিক আমি না তাই ফিরিয়ে দিলাম। আপনাকে কিছু কথা বলবো, প্রথম আমি চ্যালেঞ্জ জিতে গেছি। অবশ্য এটা বলার প্রয়োজন নেই। আপনার ব্যাগ গোছানো দেখে বোঝা যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, সেদিন আপনাকে অনেককিছু বলে ফেলেছিলাম, বয়সে আপনি বড় এটা আমার বলা উচিত হয় নি৷ যদিও আপনি কথা শোনার মতোই কাজ করেছেন। যাক গে, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা হলো আমি আর আপনার প্রতি ক্ষোভ, রাগ, অভিমান রাখবো না। এগুলো অহেতুক। শুধু শুধু আমার কষ্ট হয়। আর একটা অনুরোধ, আমার উপর এই জো’র’পূ’র্ব’ক ভালোবাসাটা চাপিয়ে দিবেন না। সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। ভালোবাসা জোর করে আসে না। মন থেকে আসে। মা আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। আপনি এই ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেন নি। হয়তো আপনার শাস্তিটুকু ওই অনুতাপের মাঝেই আছে। মানুষটা তো নেই। আফসোস, তার ক্ষমাটা আপনার ভাগ্যে নেই। যাই হোক, আজ উঠছি। আর আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। আসবেন, ভাববেন না আমি দিলাম। দাওয়াতটা নানাভাই দিয়েছেন”

বলেই উঠে দাঁড়ালো ধারা। সেলিম সাহেব সেখানেই বসে রইলেন। মেয়েটাকে এতো শান্ত এই প্রথম দেখলেন। মেয়ের ক্ষমা হয়তো পেলেন, কিন্তু “বাবা” ডাকের আফসোস টা রয়েই গেলো। অবশ্য এই শাস্তিটুকু প্রাপ্য। কিছু অন্যায় ভোলা যায় না। কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হয় না______

*******
শুক্রবার,
লাল বেনারসিতে বসে আছে ধারা। অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে তাকে। সে অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছে অনলের আসার। কমিউনিটি সেন্টারে স্টেজে সে বসে আছে। অপরদিকে অনল এবং তার বন্ধুরা বর পক্ষের গাড়ি নিয়ে আসছে। বাড়ির সকলে এখানে উপস্থিত কনেপক্ষ হিসেবে৷ এবার অনলের গাড়ির আসার পালা। প্লাবণ ই এই বুদ্ধি বের করেছে। এক বাড়িতে বিয়ে বলে কি কনেপক্ষ, বরপক্ষের নিয়ম কানন মানবে না। বন্ধুমহল ও এসেছে ধারাকে সাহস দিতে। বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা! অবশ্য এসবে আরেকটি কান্ড ঘটেছে। বিবিসি দিগন্ত তার এলমেলো হৃদয়টা মাহির সম্মুখে রেখেছে। মাহির উত্তর জানা হয় নি। জমজের দায়িত্ব জুতোর উপর। তারা ধারাপুর বোন হিসেবেই আছে। তাদের পুরো বাহিনী সকাল থেকে জুতো লুকিয়ে রেখেছে। এতো আনন্দ মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো যখন স্মৃতি ছুটে এলো, উৎকুন্ঠিত হয়ে বললো,
“ধারা, আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে”……………
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#অন্তিম_পর্ব

এতো আনন্দ মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো যখন স্মৃতি ছুটে এলো, উৎকুন্ঠিত হয়ে বললো,
“ধারা, আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে”

স্মৃতির কথাটা শুনতেই ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো ধারার। এক অজানা ভয়ে বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। কথাগুলো দলা পাকাচ্ছে। তবুও খুব কষ্টে বললো,
“কেনো? হাসপাতালে কেনো?”
“অনলদের একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। প্লাবণ মাত্র ফোন দিয়ে জানালো। আমি ওখানে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”

কথাটা মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে সময় নিলো ধারার। সে কিছুসময় ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা মূহুর্তেই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। এমনটা তো হবার ছিলো না। আজকের দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে সুখময় দিন ছিলো। প্রকৃতি কি তবে তার জীবনে সুখটি লিখেন নি? একটি বই এ পড়েছিলো, “পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ সম্ভবত কষ্ট পাবার জন্যই জন্মায়। টাকা পয়সার কষ্ট নয়, মানসিক কষ্ট”—- ধারার সাথেও কি তাই হবে? তার প্রণয় প্রহেলিকা কি প্রহেলিকা হয়েই রইবে? ভাবতেই অবাধ্য ঝড় হানা দিলো হৃদয়ের অন্তস্থলে, তার চোখে জমলো কিছু বিষন্নতা। স্মৃতি ধারাকে হালকা করে ধা’ক্কা দিলো। নরম কন্ঠে বললো,
“তুমি কি যাবে?”

ধারা কিছু না বলে মাথা উপর নিচ দোলালো শুধু। কথাগুলো যেনো দলা পাকিয়ে গিয়েছে তার। অপরদিকে রাজ্জাক ধপ করে বসে পড়লো, সুভাসিনীর অশ্রু বাধ মানছে না। স্মৃতি কিছু বলতেও পারছে না, কারণ প্লাবণ তাকে শুধু হাসপাতালের নামটুকুই বলেছে আর কিছুই বলে নি। জামাল সাহেবকে দেখা গেলো সবচেয়ে স্থির। তিনি রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“ইলিয়াস তুমি ধারার সাথে যাও। রাজ্জাক এখানে থাকুক”

ইলিয়াস মাথা নাড়ালো। ধারা, স্মৃতি, বন্ধুমহল এবং ইলিয়াস রওনা দিলো হাসপাতালের পথে। পুরোটা রাস্তা থমথমে হয়ে ছিলো ধারা। শুধু শান্ত নজরে তাকিয়ে ছিলো পিচঢালা পথের জন্য। তার চোখের সামনে ভাসছে গতরাতের স্বর্ণালী মূহুর্তগুলো। বিয়ের জন্য কনে বরকে আলাদা ঘরে রাখার নিয়ম জারি করেছিলেন সুভাসিনী। যখন উৎসবে মুখর ঘরটি ঘুমন্ত তখন চুপিসারে মই এর সাহায্যে এসেছিলো অনল। কোনো মতে বারান্দায় উঠে ধীর কন্ঠে ডাকলো ধারাকে। অনলের কন্ঠ শুনেই চমকে উঠলো ধারা। আগে পাশে চোখ গেলো। জমজেরা ঘুমে কাঁদা। তারা ঘুম মানে একদিকে শান্তি। নয়তো সারাঘরে মাইক দিয়ে জানিয়ে দিতো। ধারা চুপিসারে পা টিপে এগিয়ে গেলো বারান্দায়। অনল রেলিং পেরিয়ে প্রবেশ করলো, ধারাকে দেখতেই মুখে ফুটে উঠলো মুগ্ধ হাসি। ধারা অবাক কন্ঠে বললো,
“এতো রাতে আসলে যে?”
“কি করবো, তোর শ্বাশুড়ী যে প্যারাটা দিচ্ছে। বর বউ কিনা আলাদা থাকবে মানা যায়?”

অনলের অভিযোগে খিলখিল করে হেসে উঠলো ধারা। তারপর বললো,
“বিয়ে করার জিদ তো তোমার ছিলো? ভুগো”
“বি’চ্ছুগুলো ঘুম?”
“হ্যা, তুমি মই পেলে কিভাবে?”
“আমার টিম আছে না?”

ধারা উঁকি দিতেই দেখলো প্লাবণ এবং রবিন দাঁড়িয়ে আছে। ধারা এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো। বন্ধু হবার পুরো ফয়দা তুলছে অনল। নয়তো রাত তিনটে তে এভাবে পাহারা দিতে দাঁড় করায়। অনল ধারার দিকে অপলক চাহনীতে তাকিয়ে আছে। পূর্ণচন্দ্রিমায় নিজের চন্দ্রিমাকে দেখতে এক অসামান্য শান্তি অনুভূত হচ্ছে। অনল ধীর কন্ঠে বললো,
“আমার ঘুম হচ্ছে না ধারা, কি করা উচিত?”
“কেনো ঘুম হচ্ছে না কেনো?”
“বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তুই ছাড়া যেনো সব শুন্য”
“আর একটা রাত, তারপর আর শুন্য লাগবে না”
“আজ পৃথিবীর জন্য জ্যোৎস্না রাত, আমার জ্যোৎস্নাবিলাসটা নাহয় তুলে রাখলাম আগামীকালের জন্য। আমার প্রণয়িনীর সাথেই না হয় জ্যোৎস্নাটা দেখবো”

বলেই ধারার কপালে উষ্ণছোঁয়া দেয় অনল। ধারা অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিতে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে হলদে পাঞ্জাবীতে প্রিন্স উইলিয়াম কে। জ্যোৎস্নায় যেনো তার সৌন্দর্য্য একটু বেশি মনোমুগ্ধকর লাগছে। ধারা বেহায়ার মতো কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তার চোখে চোখ রেখে মৃদু কন্ঠে আওড়ালো,
“তুমি প্রণয়ে বাধিবে
নাকি প্রহেলিকায় রাখবে?
আমি প্রণয়িনী তোমায় চাই
প্রহেলিকার দ্বার খোল
চলো হৃদয়ে হারাই” (জান্নাতুল মিতু)

গাড়ির ব্রেক কষতেই কল্পনার মাঝে ভাঙ্গন ধরে। স্মৃতি ধীর কন্ঠে বলে,
“আমরা পৌছে গেছি”

ধারা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে। এরপর শাড়িটা তুলে ছুটে ভেতরে। ভেতরে যেতেই করিডোরে দেখা যায় প্লাবণ এবং রবিনকে। তাদের দেখতেই ধারা ব্যাগ্র কন্ঠে শুধায়,
“অনল ভাই কোথায়?”

প্লাবণ এবং রবিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ইকরাম তখন ঔষধ হাতে প্রবেশ করে। ধারার চোখ টলমলে হয়ে রয়েছে। প্লাবণ ধীর কন্ঠে বলে,
“সরি ধারা, তোমার এই সুন্দর দিনটা আমাদের জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে”
“হয়েছেটা কি বলবেন তো, সে কোথায়?”
“আসো আমাদের সাথে”

বলেই একটা রুমে নিয়ে যায় ধারাকে। সারাটা পথ তার হৃদস্পন্দন বাড়াই ছিলো। রুমে প্রবেশ করতেই ধারা হতবাক হয়ে গেলো। দীপ্ত, সেলিম সাহেব এবং তিশাও সেখানে উপস্থিত। আর শুভ্র বিছানায় অর্ধশায়িত অনল। অনলের বা পা টা বালিশের উপর রাখা। পায়ে্র পাতায় প্লাস্টার লাগানো। ধারাকে দেখতেই অনল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“তুই এখানে কেনো?”
“প্লাবন ভাইয়া আনিয়েছেন”

অনল প্লাবণের দিকে চোখ পাঁকালো। প্লাবণ বললো,
“উপায় কি? তুই যে জিদ করেছিলি? সে কিছুতেই হাসপাতালে থাকবে না। এদিকে পায়ে প্লাস্টার লাগা”
“আমার বিয়ে কি এই হাসপাতালে থেকে হবে”

প্লাবণ এবং অনলের মাঝে বাধলো তর্কযুদ্ধ। ধারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে একটা সময় বিরক্ত হয়ে বললো,
“হয়েছেটা কি একটু বলবে?”
“তোমার বর, অতিউৎসাহে পা ভেঙ্গে বসে আছে”

প্লাবণ পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলো। সিড়ি থেকে নামার সময় বেখেয়ালীতে অনল খেয়াল করে নি সেখানে পানি ছিলো। সকালবেলায় বিনা নোটিশে বৃষ্টি হবার জন্য সিড়িতে হালকা পানি জমেছিলো। ফলে পানিতে পিছলা খেয়ে এক সিড়ি মিস করে ফেলে। ফলে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় সে। রবিন এবং ইকরাম তাড়াতাড়ি তাকে তুলে। কিন্তু বিপাক বাধে যখন দাঁড়াতে গেলে দেখে পা আর ফেলতে পারছে না। ফলে তারা কোনো মতে ধরে ধরে তাকে গাড়িতে তোলে। অনলকে গাড়িতে তোলার সময় দীপ্তদের সাথে দেখা হয়। ফলে তারা তিনজনও যুক্ত হয়। সেন্টারের বদলে প্লাবণ গাড়ি নিয়ে আসে হাসপাতালে। ডাক্তার এক্স রে করে জানান তার পায়ের ফ্রাকচার হয়েছে। ফলে সেখান প্লাস্টার করে দিয়েছেন। কিন্তু অনল তো অনল সে মোটেই হাসপাতালে থাকবে না। সে এখন তার বিয়েতেই যাবে। তাই বাধ্য হয়ে প্লাবণ স্মৃতিকে ফোন করে। শুধু বলে,
“ধারাকে নিয়ে আসো”

সেলিম সাহেব ও বোঝাবার চেষ্টা করেছে অনলকে, কিন্তু ফলাফল শুণ্য। দীপ্তও এটাও বলে,
“ভাঙ্গা পায়ে বিয়ে করবে? ছবিতে কেমন আসবে বলো? এর চেয়ে মাস খানেক পর বিয়েটা করো”
“আমি কি ছবি তোলার জন্য বিয়ে করছি? আমি আমার বউ কে বিয়ে করবো। আর আজ ই করবো”

অনলের যুক্তির সামনে যেনো সকলেই ব্যার্থ। ধারা হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেলো না। প্রিন্স উইলিয়ামকে এই প্রথম এতো জেদীরুপে দেখলো সে। নির্বিকার চিত্তে, ভাবগুরুগম্ভীর মানুষটি আজ বাচ্চার মতো জেদ করছে, ভেবেই ভালো লাগছে তার। এই জিদটিও তো তার জন্য। ধারা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ডাক্তার কি রিলিজ দিয়েছে?”
“হ্যা, ডাক্তার বলেছে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো, তোমার বর ই বলছে সে কমিউনিটি সেন্টারে যাবে”

ধারা একটু থেমে বললো,
“আপনার একটু বাহিরে যান, আমি কথা বলে দেখছি”

ধারার কথায় কেউ বাধা দিলো না। সবাই বাহিরে চলে গেলো। ইলিয়াস জানিয়ে দিলো,
“আরে চিন্তা কইরো না। কিছু হয় নি, সিড়ি দিয়ে পড়ে পা ভাঙ্গছে। পায়ে পট্টি লাগছে। বেড রেস্ট দিছে”

সবাই চলে গেলে ধারা তার সামনে দাঁড়ায়। মাঝায় হাত দিয়ে বলে,
“জেদ করছো কেনো?”
“এখন তুই লেকচার দিবি না”
“আজব, তুমি এই অবস্থায় বিয়ে করবে?”

অনল একটু চুপ করে রইলো। তারপর কন্ঠ নরম করে বললো,
“আজকের দিনটার জন্য এতোদিন প্রতীক্ষা করেছি, প্লিজ ধারা বাধা দিস না। আর আমাদের জীবনে তো কখনোই কিছু স্বাভাবিক ছিলো না। বিয়েটাও না হয় একটু ভিন্নভাবেই হোক”

অনলের অদ্ভুত যুক্তির কাছে হার মানলো ধারা। অবশেষে ভাঙ্গা পায়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ হলো। ইলিয়াস তো বলেই উঠলো,
“এই না হলো, আমার ভাতিজা। একটু আকটু পা-টা ভাঙ্গলে কিছুই হয় না। বিয়েটাই আসল”

অনল বিয়েতে পৌছালো ভাঙ্গা পা নিয়ে হুইল চেয়ারে। বিয়েটাও হলো খুব সুন্দর ভাবে। এদিকে এশা আশাকে দেখালো উদাশ। অনল ভাইয়ের জুতো চু’রি করেও লাভ হলো না। কারণ অনল দাঁত বের করে বললো,
“ওই জুতো বেঁচে ঝালমুড়ি খাস”

ফলে জমজেরা অন্য বুদ্ধি বের করলো। কোন ফাঁকে তারা দীপ্ত, প্লাবণ, রবিন এবং ইকরামের জুতো চুরি করে নিলো। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“অনল ভাই, তুমি না হুইল চেয়ারে চলে যাবে। তোমার বন্ধুরা কি করবে? তারা যদি খালি পায়ে যেতে চায় আমাদের আপত্তি নেই”

দীপ্ত পড়লো মহাবিপাকে। এই জুতোজোড়া বাদে নগ্ন পায়ে যেতে একেবারেই রাজী নয় সে। ফলে অনলকে অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল, ওরা যা চায় দিয়ে দাও। নয়তো এই বোনেরা আমাকে শান্তি দিবে না। ওদের ভরসা নেই”

অনল অতিসন্তপর্ণে তপ্ত নিঃশ্বাস গোপন করলো। এই ধানী লংকারা তার পকেট খসাবেই। চারজনের জুতো আটহাজারের মধ্যে ছাড়ালো। এর মাঝে মাহি দিগন্তকে আলাদা করে টেনে নিলো। দিগন্ত অবাক কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবি?”
“আমার বাসায় সম্মন্ধ দেখছে। আমি তিন বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারবো। এরপর কি করবি তুই বুঝে নে”

কথাটা বুঝতে না পেরে সে অবাক কন্ঠে বললো,
“মানে কি?”
“বোঝা লাগবে না তোমার। তুমি মুড়ি খাও। রা’ম’ছা’গ’ল কোথাকার”

বলেই গজগজ করতে করতে চলে গেলো মাহি। দিগন্ত বললো,
“মাহি আমি সত্যি বুঝি নি, যাস নে”

আজ জামাল সাহেবকে দেখালো সব থেকে আনন্দিত। অবশেষে তিনি দায়িত্বমুক্ত। সেলিম সাহেব তার কাছে এলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
“কাকা, আমি রাতে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছি। মেয়েটাকে দেখবেন”

জামাল সাহেব উত্তর দিলেন না। শুধু মৃদু হাসলেন। অভিমানের পাহাড়টা ভাঙ্গছে, একটু একটু করে। মানুষটাই তো নেই। এই মেকি অভিমান করে কি হবে!

নিগুঢ় রাত, পুর্ণ্যচন্দ্রিমা নয় আজ তবুও উজ্জ্বল রুপালী আলোতে ঝলমল করছে আধারের শহর। মৃদু বাতাসে উড়ছে ধারার খোলা চুল। অনলের টবের শিউলি ফুলের মৃদু গন্ধ মম করছে বারান্দা। অনলের ঘাড়ে মাথা রেখে আছে ধারা, তার স্থির চাহনী নীলাম্বরের দিকে। অনল আলতো হাতে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। হঠাৎ কি মনে করে বললো,
“খুব ভয় পেয়েছিলি তাই না? তোর চোখের গলা কাজল ই সেটার প্রমাণ ছিলো”
“তোমাকে হারাবার ভয়টা এতোটা প্রখর হবে জানা ছিলো না, পুরোটা রাস্তা ভেতরে ঝড় চলছিলো। তোমাকে ছাড়া যে সবকিছু শুন্য লাগে, হাহাকার করে উঠে আমার পৃথিবীটা”

অনল হাসলো, মেয়েটির প্রণয় উপভোগ করতে শান্তি লাগছে। অবশেষে তাদের প্রণয় প্রহেলিকা পরিণয়ের রুপ নিয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবতেও প্রশান্তি লাগে, হাজার ঝড়ের মাঝেও সে একা নয়। এই রমনীটি থাকবে সারাটাজীবন, প্রতি মূহুর্ত, প্রতিক্ষণ। অনল নরম গলায় বললো,
“আমার তপ্ত মরুভূমির এক পশলা বৃষ্টি তুমি, আমার ঠিকানাই তো তুমি। তাই তো আজ জিদ ধরেছিলাম। তুমিহীনা আমার প্রণয় প্রহেলিকা যে অসম্পূর্ণ”
“ভালোবাসো?”
“অব্যাক্তভাবে ভালোবাসি”

ধারা আলতো করে হাসলো, পাছে গড়িয়ে পড়লো একবিন্দু অশ্রু। এই অশ্রু বিষাদের নয়, এই অশ্রু পূর্নতার। তাদের প্রণয়ের পূর্ণতার। ধারা ধরা গলায় বললো,
“একটা গান শূনাবে? আমার যে বহুদিনের স্বপ্ন”

অনল অমত করলো না, বা হাতে আগলে ধরলো ধারার কাঁধ। সুর তুললো জ্যোৎস্না্য লেপ্টে থাকা রজনীর মায়ায়,
“একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী
একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি
রচি মম ফাল্গুনী”

ধারা চোখ বুঝে রয়েছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে শুনছে অনলের গান। গানটির মাঝে যেনো হাজারো আবদার, হাজারো অনুভূতি, হাজারো ভালোবাসা। মুগ্ধতার অপর নাম ই তো প্রিন্স উইলিয়াম। তাই তো বারে বারে বলতে ইচ্ছে করে, “আমি তোমার, শুধু তোমার প্রণয়িনী”

।।সমাপ্ত।।

মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here