#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৬
“সানিয়া আর এ পৃথিবীতে নেই”
বাক্যখানা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তা যেনো বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করলো।মুহূর্তেই চোখে ঝাপসা দেখতে আরম্ভ করলেন আরহান সাহেব।সিক্ত নয়ন ও নিস্তেজ স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“সা সা সানিয়া! সানিয়া নেই?কি বলছেন ভাইজান?”
অতঃপর আরহান সাহেবকে সব খুলে বলেন তার বড় ভাই।আরহান সাহেব জানতে পারেন তার স্ত্রী মিসেস. সানিয়া আরহান ইবনান একটি দূর্ঘটনার স্বীকার হয়ে সেই অল্প বয়সে প্রাণ হারিয়েছেন। জীবনে আবারও পরিস্থিতি এতোটা নির্মম হওয়ায় কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গিয়েছিলেন আরহান সাহেব।একদিকে নিজের স্ত্রীর মৃত্যু, আরেক দিকে নিজের সদ্য মা হারা কিশোর সন্তান আর বিপরীত দিকে টাকা,নিজের লাভবান ব্যবসা, ক্যারিয়ার, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।আরহান সাহেব নিজের সামনে শুধু দুটো পথ খোলা দেখতে পান তখন।একটা পথে আবেগ আর আরেকটা পথে বাস্তবতা।যদি তখন তিনি আবেগকে বেছে নিতেন তাহলে হয়তো তখনই দেশে ফিরে আসতেন।আর সে-সময় দেশে ফিরলে সে যে আর বিদেশের মাটিতে পা রাখতে পারবেন না তাও জানা ছিলো তার।ফলে দেশেই কাজের সন্ধান করতে হতো।কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং কর্মসংস্থানের দূরাবস্থা অজানা নয় আরহান সাহেবের।দেশে ফিরলে আবারও সেই বেকারত্ব, টাকার অভাব, মানুষের কাছে ছোট হওয়া, অসম্মানিত হওয়া আর এসবের প্রভাবে নিজের ভবিষ্যৎ যেমন-তেমন নিজের সন্তানকেও সুন্দরভাবে, সম্মানিতভাবে মানুষ করতে পারতেন না তিনি।আর এসব কথা চিন্তা করেই সে সময় নিজেকে শক্ত করেছিলেন আরহান সাহেব।হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও তা নিজের বুকে চেপে রেখে বিদেশের মাটি আঁকড়ে ধরে থেকেছিলেন।নিজের বড় ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার সন্তানের দেখাশোনা করার।
পুরোনো স্মৃতি হতে বেরিয়ে আসেন আরহান সাহেব। চোখের কোন মুছে নেন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে।তার কাছে সে সময় বিদেশে থেকে যাওয়ার সে সিদ্ধান্ত টা সদাসর্বদাই সঠিক বলে মনে হয়।কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের এই সঠিক সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্ন ওঠে আরহান সাহেবের।প্রশ্ন জাগে নিজের স্ত্রীর সাথে কি অন্যায় করেননি তিনি?অন্তত শেষ বারের জন্যেও কি নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে একটি বার দেখতে আসা উচিৎ ছিলো না তার?
আবার প্রশ্ন এও জাগে যে, নিজের সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে কি সে নিজের সন্তানের সাথেই অন্যায় করে বসেছিলো?সদ্য মা হারা কিশোরটার কি তখন তার বাবার একটু স্নেহের স্পর্শের প্রয়োজন ছিলো?ঐ সময় বাচ্চাটার কি নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে হয়নি?ঐ কিশোর টার তো পুরো দুনিয়াই ছিলো তার মা।হটাৎ করে যখন নিয়তি তার কাছ থেকে কেড়ে নিলো তার দুনিয়াটা তখন কি করে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো সাড়ে ১২ বছর বসয়ী ছেলেটা?ঐ সময়টা বা ঐ দিনগুলোই হয়তো তার জন্যে প্রকৃতি হতে প্রাপ্ত সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম বা নিকৃষ্টতম দিনগুলো ছিলো।ছেলেটা সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলো।আপন মানুষ বা স্নেহ-ভালোবাসাশূন্য এক একলা নগরীর বাসিন্দাতে পরিনত হয়েছিলো ছেলেটি।অন্তত ঐ সময়টায় প্রয়োজন ছিলো তার নিজের বাবাকে।প্রয়োজন ছিলো বাবার আদর, স্নেহের, ভালোবাসার।
কথাগুলো ভাবতেই বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন আরহান সাহেব।কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন তিনি।মনে মনে ভাবেন আফিম কোনোভাবে তার উপর রেগে নেই তো?তার প্রতি অভিযোগ পুষে রাখেনি তো?হয়তো রেখেছে। না রাখলে কেনো এতো এরিয়ে চলে তাকে?কেনো মাসে একটা দিন ভিডিও কলে ঠিক মতো কথা বলতো না তার সাথে।হ্যাঁ,রিয়াদ সবসময় কাজের বা ব্যবস্তার অজুহাত দিয়ে এটা-সেটা বুঝিয়েছেন তাকে।কিন্তু সে তো অবুঝ নয়।একটু হলেও আন্দাজ করতে পারতেন।
নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে আরহান সাহেব মৃদু স্বরে বলে ওঠেন,
-হ্যাঁ হয়তো অন্যায় করে ফেলেছিলাম নিজের স্ত্রী, সন্তানের সাথে।কিন্তু আমি সে অন্যায় করেছিলাম বলেই আজ আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত এবং অনেকের আদর্শ।
!!
নাফিয়ার ঠোঁটে দৃষ্টি নিবদ্ধ আফিমের।নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মেয়েটির ঠোঁটে আলতো করে হাত বুলচ্ছে সে।তার গরম নিঃশ্বাস নাফিয়ার নাক-মুখে আছড়ে পরছে।চোখজোড়া বুঁজে রেখেছে মেয়েটা।আফিমের প্রতিটি স্পর্শে শিহরিত হচ্ছে সে।আফিম তার বাম হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরে রাখা নাফিয়ার কোমরের বাঁধন পূর্বের চেয়ে আরো দৃঢ় করে।মেয়েটিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে নাক ডুবায় তার গলায়।কাঁধের দিকটায় নাক ঘষতে ঘষতে বলে ওঠে,
-Your smell is like a drug to me Miss. Sheikh.
আফিমের উচ্চারিত শব্দগুলো কানে আসতেই মুখশ্রীতে লাজের ছাপ প্রকাশ পেলো নাফিয়ার।ঠোঁটে ফুটে উঠলো লজ্জা মিশ্রিত আলতো এক হাসি।
আফিম নাফিয়ার কাঁধ হতে কান অব্দি ছোট ছোট চুমু বসিয়ে খানিকটা সরে আসে মেয়েটির থেকে।মেয়েটার কোমর হতে ধীরে ধীরে হাত উপরে তুলে গাল অব্দি এনে থামে।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে নাফিয়ার লালাভ মুখশ্রী।ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রয় মেয়েটির মুখ পানে।অতঃপর ধীরে ধীরে সে অগ্রসর হয় মেয়েটির ঠোঁটের ধারে।আলতো করে চুমু বসায় ঠোঁটের এক কোণে।
ঠোঁটের কোনে আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ ও খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ধারালো স্পর্শে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের হার বাড়তে বাড়তে এখন যেনো আর একটু হলেই মৃত্যু ঘটবে মেয়েটার।নিজের মাঝের শিহরণ সইতে ব্যর্থ হয়ে খামচে ধরে সে আফিমের কাঁধ।
নাফিয়ার অস্বাভাবিক নিঃশ্বাসের গতি আফিমের আকর্ষণ যেনো আরো বৃদ্ধি করছে।আরো উন্মাদ হচ্ছে ছেলেটা।অজানা ঘোরে বিলীন হয়ে মেয়েটার ঠোঁটের কোন হতে ঠোঁট সরিয়ে এবার সোজা ঠোঁট স্পর্শ করতে উদ্ভূত হয় সে।ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করার পূর্বেই ফোন বেজে ওঠে আফিমের।রিংটোনের তীব্র শব্দ ও ভাইব্রেশনের ফলে ঘোর কাটে উভয়েরই।দূরে সরে আসে পরস্পর হতে।
!!
নিজের কাজের মাঝেই কুসুমের চোখ যায় রিয়াদের দিকে।ছেলেটা নিজে এসে সাহায্য করছে একজন জুনিয়র স্টাফকে।অফিসে বসের পর যার ক্ষমতা সব থেকে বেশি সেই মানুষটার মাঝে নেই কোনো দাম্ভিকতা।আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্রে দেখা যায় উচ্চ পদস্থ মানুষগুলো তার থেকে নিন্ম পদস্থ কর্মচারীদের উপর কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নিজে আরাম-আয়েশ করতে পছন্দ করে।অথচ রিয়াদের বেলায় ব্যাপার খানা একদম উল্টো।তার মাঝে না আছে নিজের ক্ষমতার দম্ভ আর না আছে কাজের প্রতি বিন্দু পরিমাণ অবহেলা।অতিরিক্ত পরিশ্রমী এই ছেলে।কাজকেই যেনো ভালোবাসে সে। এসব কিছু ভাবতেই চোখমুখে স্পষ্ট মুগ্ধতা ফুটে ওঠে কুসুমের।এই অফিসে জয়েন করার বেশ ক’দিন হয়ে গিয়েছে তার।আর এই দিনগুলোয় সে সবথেকে বেশি আকৃষ্ট হয়েছে রিয়াদের প্রতি।রিয়াদের অতিরিক্ত পরিশ্রম, দায়িত্বশীলতা,সততা,বিনয় বা সহায়ক মনোভাবে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে কুসুমকে।সে ঠোঁটে মুগ্ধতার হাসি নিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে রিয়াদের দিকে।গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ছেলেটাকে।
জুনিয়র স্টাফের সাথে কথা বলার মাঝেই চোখ যায় রিয়াদের কুসুমের দিকে।মেয়েটা তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে।মেয়েটার এমন অদ্ভুত চাহনির কারণ বোধগম্য হয় না রিয়াদের।মনে মনে সে বলে ওঠে,
“এভাবে কেনো তাকিয়ে আছে এই মেয়ে আমার দিকে?নজর রাখছে আমার উপর?শিট!এই মেয়ে সত্যিই শত্রু পক্ষের কেউ না তো?একে কি কেউ নজর রাখার কাজ দিয়ে পাঠিয়েছে? নির্ঘাত এমন কিছুই হবে।নাহয় কাজে নতুন হয়েও ওর পারফরম্যান্স এতো ভালো হওয়ার কথা ছিলো না।কাজ কত নিট এন্ড ক্লিন করে করে।নতুন হলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা না।অর্থাৎ যেই পাঠিয়েছে একদম প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়েছে।এই মেয়ের দিকে আমার বিশেষ নজর রাখতে হবে।”
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই জুনিয়রকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রিয়াদ অগ্রসর হয় কুসুমের দিকে।কুসুমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হাত ঘড়িটা দেখে নেয়।অফিস টাইম শেষ।ঘড়ি দেখে নিয়ে রিয়াদ বলে ওঠে,
-মিস.কুসুম,কাজ কি শেষ নাকি ওভার টাইম ডিউটি করতে চাইছেন?
হটাৎ রিয়াদের এমন প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় কুসুম।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে,
-শেষ স্যার।
-ফাইন!আজ আমি আপনাকে আপনার বাসা অব্দি ড্রপ করবো।২ মিনিটে আপনাকে আমার গাড়িতে দেখতে চাই।
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না রিয়াদ।রিয়াদ যেতেই ঠোঁটে বড়সড় হাসি ফুটে ওঠে কুসুমের ঠোঁটে।মনের কোনো এক কোনে আশা জাগে,
“রিয়াদও কি তবে আমাকে পছন্দ করতে আরম্ভ করেছে?যদি আমাকে পছন্দ নাই করতো তাহলে কি এতো স্টাফদের মাঝে আমাকেই ড্রপ করতে চাইতো?”
!!
ঠোঁট উল্টে আফিমকে উদ্দেশ্য করে নাফিয়া বলে ওঠে,
“ক’টা বাজে দেখেছেন?”
কল কেটে নিজের ফোনটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আফিম তাকায় নাফিয়ার দিকে।ব্রু কুঁচকে একবার সময় দেখে নিয়ে বলে ওঠে,
-৬ টা বাজে।কিছু হয়েছে?
-অনেক কিছু হয়েছে।আজ আপনার জন্য আমি পড়াতে যেতে পারলাম না।১টা মাসও হয়নি পড়ানো স্টার্ট করার তার মধ্যে এভাবে ফাঁকিবাজি করা ঠিক?
-উহু,মোটেই না।
-সব দোষ আপনার।এখন কি করবো আমি?ওরাও বা কি ভাবছে?
-শুক্রবার পড়িয়ে দিও তাহলেই হবে।
আফিমের কথা শুনতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।বলে ওঠে,
-গুড আইডিয়া!
নাফিয়ার কথায় বাঁকা হাসে আফিম।মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ওঠে,
-মিস.শেখ,তোমার কি মনে হয় কোনো কাজ সম্পূর্ণ না করে আধা-আধুরা রেখে দেওয়া উচিৎ?
ব্রু কুঁচকায় নাফিয়া।আফিম কি বুঝাতে চাইছে তা বোধগম্য হলো না তার।না বুঝেই বলে উঠলো,
-না,উচিৎ না।
-সম্পূর্ণ করা উচিৎ তাই না?
-হ্যাঁ।
কথা বলতে বলতে নাফিয়ার কাছে চলে আসে আফিম।দু’হাতে কোমর আঁকড়ে ধরে মেয়েটার।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-কল আসার আগে আমরাও কিছু করছিলাম যা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে।অসম্পূর্ণ রাখা টা তো অনুচিত হবে তাই না?
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৭
গাড়ির পাশাপাশি দুই সিটে বসে আছে দু’জন মানব-মানবী।কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।একজন গম্ভীর মুখে ড্রাইভ করছে।সেই সাথে মগ্ন হয়ে আছে নিজের বিভিন্ন চিন্তায়।অপরদিকে,নিরবে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে এক কৃষ্ণকলি।রমণীর ঠোঁটে লেগে আছে মুগ্ধতার আলতো হাসি।ড্রাইভ করতে থাকা এই গম্ভীরমুখো পুরুষ টার আশেপাশে থাকলে আজকাল অকারণেই শান্তি অনুভব করে সে।চোখ-মুখে ফুটে ওঠে মুগ্ধতার ছাপ।হৃদমাঝারে ছেয়ে থাকা মুগ্ধতা এবার ঠোঁট অব্দি আসে মেয়েটার।গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে,
“তোকে একার দেখার লুকিয়ে কী মজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না
একলা ছিল মন, ধূসর এতদিন
এক ঝলকে তোর, হয়েছে কী রঙিন
শুনতে পেলে যেই, নুপুর বাজে তোর
বেঁচে থাকাই দায়, মরে যাওয়া কঠিন”
আফিম ও আরহান সাহেবের বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন রিয়াদ।অনেক ভেবেও পরিস্থিতি সামলাবার মতো কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না তার।আর কুল-কিনারা খুঁজে না পাওয়ায় তার মেজাজ টাও ক্রমশ বিগড়ে যাচ্ছে।এসব চিন্তের মাঝেই হটাৎ এক অতুলনীয় সুরেলা ধ্বনি কানে এসে পৌঁছায় রিয়াদের।দৃষ্টি ফেরায় নিজের পাশে বসে থাকা এই অসাধারণ কন্ঠস্বরের মালকিন এক কৃষ্ণকলির দিকে।
রিয়াদের অবাক চাহনি দেখে গান থামায় কুসুম।বলে ওঠে,
-কিছু হয়েছে স্যার?
কুসুমের প্রশ্নে নিজেকে স্বাভাবিক করে রিয়াদ।স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে,
-আপনার গানের গলা সুন্দর মিস.কুসুম।গান গাইবেন?
ঠোঁটে বড়সড় হাসি ফুটে ওঠে কুসুমের।হৃৎস্পন্দন খুশিতে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলছে তার।প্রথমে বিন্দাস মনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলেও এবার নিজের মাঝে ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করছে সে।নিজের অনিয়ন্ত্রিত খুশির পরিমাণ কমিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সে।চোখজোড়া বুঁজে নিয়ে ধীরে ধীরে সুর তোলে,
“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলে ধরা দেয়না
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলে ধরা দেয়না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছে পাগল হয়ে
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরিতেছে পাগল হয়ে
মরমে জ্বলছে আগুন আর নেভে না
সে যে আমার আমার আমার বলে
আমার হয়ে আর হলো না
সে যে আমার আমার আমার বলে
আমার হয়ে আর হলো না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
বহুদিন ভাবতরঙ্গে
ভেসেছি কতই রঙ্গে
বহুদিন ভাবতরঙ্গে
ভেসেছি কতই রঙ্গে
সুজনের সঙ্গে হলো দেখাশোনা
এখন বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে প্রাণ আর বাঁচে না
এখন বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে প্রাণ আর বাঁচে না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
পথিক কয় ভেবো নারে ডুবে যাও রূপসাগরে
পথিক কয় ভেবো নারে ডুবে যাও রূপসাগরে
বিরলে বসে করো যোগসাধনা
একবার ধরতে পারলে মনের মানুষ
চলে যেতে আর দিওনা
একবার ধরতে পারলে মনের মানুষ
চলে যেতে আর দিওনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলে ধরা দেয়না
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলে ধরা দেয়না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”
নিজের ভীষণ পছন্দের গান খানা কুসুমের অতুলনীয় সুরেলা ধ্বনিতে গাওয়া শুনতে শুনতে অসম্ভব এক ভালোলাগার জগতে বিলীন হয় রিয়াদ।প্রশান্তিতে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো যেনো তার।ঠোঁটে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি।হৃদয়েও যেনো মিলছে এক বর্ণনাতীত শান্তির ছোঁয়া।
গান শেষ হতেই চোখ মেলে তাকায় কুসুম।ধুকপুক করা হৃদয় নিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিয়াদের দিকে।কুসুমের চোখে চোখ পরতেই রিয়াদ ঠোঁটে বড়সড় হাসি টেনে বলে ওঠে,
-সাংঘাতিক সুন্দর কন্ঠস্বর আপনার।চাইলেই কিন্তু গায়িকা হতে পারেন।
ঠোঁটে বিশ্ব জয় করবার ন্যায় হাসি ফুটে ওঠে কুসুমের।সে বহু কষ্টে নিজের মাত্রাতিরিক্ত খুশি নিজের মাঝে চেপে রেখে কোনমতে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ স্যার।
!!
চোখ বুঁজে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফিম নাফিয়া।আফিমের হাতের বন্ধনে আবদ্ধ নাফিয়ার কোমর এবং নাফিয়ার হাতদ্বয় অবস্থান করছে আফিমের কাঁধে।উভয়ের ঠোঁটে ফুটে আছে মৃদু হাসি।আফিম আলতো করে নাফিয়ার নাকে নাক ঘষে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-Stop blushing Miss. Sheikh. I haven’t done anything yet now. [লজ্জা পাওয়া বন্ধ করো মিস. শেখ।আমি এখন পর্যন্ত কিছুই করিনি]
আফিমের কথা খানা লজ্জা কমাবার বদলে লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিলো নাফিয়ার।সে চোখ মেলে তাকালো আফিমের দিকে।ছেলেটার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি লেগে আছে।সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয় নাফিয়া।নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে সে বলে ওঠে,
-আমরা বাসায় কখন যাচ্ছি?
নাফিয়ার উক্ত প্রশ্নখানা মুহূর্তেই আফিমের মেজাজ খারাপ করে দিলো।কোমর আঁকড়ে ধরে রাখা তার হাতের বাঁধন ঢিলে হলো।নাফিয়ার থেকে সরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-আগামী কিছু দিন আমরা এখানেই থাকবো।
অবাক হলো নাফিয়া।একটা সাধারণ প্রশ্নে আফিমের এমন ব্যবহার বোধগম্য হলো না তার।কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পরলো আজ অফিসে থাকাকালীন সময়ের কথা।যখন আফিম চেচিয়ে বলছিলো,
“যে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে আসতে পারেনি সে কেনো এখন এসেছে?”
কথাখানা মনে পরতেই বেশ কয়েকটা প্রশ্ন উদিত হয় নাফিয়ার মনে।
প্রথম প্রশ্ন, আফিমের বাবা দেশে ফিরেছেন বলেই কী আফিম নিজের বাসায় যেতে অনিচ্ছুক?
দ্বিতীয় প্রশ্ন,আফিমের বাবা কেনো আসেননি নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে?
তৃতীয় প্রশ্ন,আফিম তার বাবাকে এতো বেশি অপছন্দ কেনো করে?শুধু কী এটিই কারণ যে তার মায়ের মৃত্যুতে তার বাবা উপস্থিত ছিলেন না?নাকি আরো কিছু কারণ আছে?
চতুর্থ প্রশ্ন, কী কী ঘটেছিলো আফিমের অতীতে?কেমন ছিলো আফিমের শৈশব ও কৈশোরকাল?
নিজের এসব প্রশ্নের উত্তর জানার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারলো না নাফিয়া।জিহ্বা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ ভিজিয়ে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে উঠলো,
-এখানে কেনো থাকবো?বাসায় কেনো যাবো না?
নাফিয়ার প্রশ্ন কর্ণকুহরে পৌঁছালো আফিমের।তবে গুরুত্ব দিলো না সে।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিলো নিজের।নাফিয়ার প্রশ্ন খানা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে উঠলো,
-কাল তৈরি থেকো তোমায় কলেজে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবো।
আফিমের কথায় অবাকের চরম শীর্ষে পৌঁছে গেলো নাফিয়া।অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
-মানে?কলেজে ভর্তি হতে হলে না ৫-১০ টা কলেজ পছন্দ করতে হয়, তারপর সেখান থেকে যে কলেজ আমাদের সিলেক্ট করে সেখানে না ভর্তি হতে হয়?
-এসব করা শেষ।সময় জ্ঞান যে তোমার নেই সে সমন্ধে ধারণা হয়েছে?
আফিমের প্রশ্নে ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকায় নাফিয়া।আসলেই সময় জ্ঞান তার নেই।এসএসসি পরিক্ষার পর যে ৩ মাস অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল তার ছিলো না।
!!
কুসুমের বাড়ির ধারে এসে গাড়ি থামায় রিয়াদ।তাকায় কুসুমের দিকে।জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-এইটাই আপনার ফ্ল্যাট?
পথ শেষ হওয়ায় মন খারাপ কুসুমের।এ পথ আরেকটু বড় হলে কি এমন ক্ষতি হতো!মন ভরা আফসোস নিয়ে তাকায় সে রিয়াদের দিকে।ছেলেটার করা প্রশ্নের উত্তরে বলে ওঠে,
-জ্বি স্যার।
উত্তরে রিয়াদ আর কিছু বলে না।যতটুকু পারছে পর্যবেক্ষণ করে নিচ্ছে সে এই জায়গাটাকে।এই মেয়ে সমন্ধে জানতে আবারও এদিকে আসবে বলেও ভেবে নিয়েছে।কুসুম গাড়ি থেকে বের হয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ স্যার ড্রপ করতে আসার জন্যে।আরেকটা আবেদন করবো?
মৃদু ব্রু কুঁচকে রিয়াদ বলে ওঠে,
-কি আবেদন?
ঠোঁটে আলতো হাসি টেনে কুসুম বলে ওঠে,
-ওয়েদার টা সুন্দর না স্যার?একদম যেনো চাময়!
-চাময় মানে?
-ওয়েদার ডিমান্ড বলে একটা কথা আছে না?এই ওয়েদারটা চা ডিমান্ড করে।তাই চাময়!
উত্তরে কিছু বলে না রিয়াদ।কুসুমের কথাগুলো শোনাটা এক প্রকার সময়ের অপচয় বলে মনে হচ্ছে তার।তাই ভাবলো এবার সোজাসুজি বিদায় নিয়ে রওনা দিবে।কিন্তু তার বিদায় নেবার আগেই কুসুম বলে ওঠে,
-স্যার আবেদন টা হচ্ছে,আপনার কি একটু উপরে আসার সময় হবে?আমি খুব ভালো চা বানাতে জানি।
এ প্রস্তাব খানা যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির ন্যায় ঠেকলো রিয়াদের।মেয়েটার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে পারলে ভালো হতো তার জন্যে।বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো সে।কিন্তু এখন আফিমের কাছে যাওয়াটা তার জন্যে সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাই সুযোগ খানা হাতছাড়া করতে হলো তার।বলে উঠলো,
-পরে কোনো একদিন আসবো মিস.কুসুম।আজ সময় নেই।
কথাগুলো বলে আর দেরি করলো না রিয়াদ।গাড়ি স্টার্ট দিলো সে।
চলবে।
[