#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩১
পরীক্ষার খাতার ঝড়ের গতিতে চলছে কলম। ক্রমাগত লেখার পরে ক্ষণে ক্ষণে হাতে টান পড়ছে। ব্যথায় টনটন করে উঠছে। ব্যথাকে দূর করতে মাঝে মাঝে হাত ঝাড়া দিচ্ছি। কিছুটা দূরত্বে ফ্যান থাকার ফলে ঘেমে একাকার হয়েছি। জানালার পাশে সিট পড়েছে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি অদূরে নিবদ্ধ করছি।
হাতের সিলভার রঙের ঘড়িটার দিকে অবলোকন করলাম। ফুড়িয়ে এসেছে সময়। দশ মিনিট উচ্ছিষ্ট। শান্তি অনুভব করলাম। কলমের কেপ লাগিয়ে বেঞ্চিতে রাখলাম। শরীর টানটান করে খাতার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তাজ্জব বনে গেলাম। দু’চোখের পলক সেকেন্ডের ব্যবধানে থেমে গেল। দ্রুত খাতা স্পর্শ করলাম। একটু আগের লেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যতায়। প্রতিটি পৃষ্ঠার একই হাল। অবিলম্বে লেখা বিহীন সাদা খাতায় পরিনত হল। এই কলমটা আসার সময় কিনে এনেছি। নিশ্চয়ই ভেনিস কলম। লোকটা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভেনিস কলম দিয়েছে। সময় মাত্র দশ মিনিট। এই সময়ে পুনরায় লেখা সম্ভব নয়। মাথা ধরে উঠেছে, কী করব বুঝতে পারছি না।
পেছন থেকে আঁখি মৃদু গলায় বলল, “চড়ুই কোনো সমস্যা? তোকে নার্ভাস লাগছে।”
উপলব্ধি করলাম তরল পদার্থগুলো কপাল গড়িয়ে পড়ছে। ম্যাজিকের ন্যায় সেখানে ধ্রুব স্যার উপস্থিত হলেন। তার বিষয় পরীক্ষা দরুন জানতে এলেন ‘প্রশ্নপত্র কেমন হয়েছে।’
সবাই খুশি মনে প্রতুক্তি করতে পারলেও আমি পারলাম না। চশমার ভেতর দিয়ে কেবলমাত্র খাতার দিকে আমার নিবদ্ধ দৃষ্টি। ধ্রুব পুরো কক্ষ পর্যালোচনা করার সময় আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ক্ষিপ্র গলায় বললেন, “প্রশ্ন কেমন হয়েছে?”
কম্পিত গলায় সঙ্কিত হয়ে বললাম, “ভা-ভালো!”
“ভালো এবং ছোট একটা প্রশ্ন করেছি, এতে এত কাঁপা কাঁপি করছ কেন?
লেখা শেষ?”
মৃদু আওয়াজে, “হম!”
“কিন্তু খাতা খালি কেন?”
এবার নিজেকে সংযত করতে ব্যর্থ হলাম। বেঞ্চিতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম। এত এত কষ্ট করে লেখার পর আমি কিচ্ছু লিখিনি। আজকে সকালে ধ্রুবের কড়া হুংকার, তারপরেও কেন একটু সচেতন হইনি। খাতা হাতে পাওয়ার পর আরও ঝাড়বে।
কিয়ৎক্ষণ সরল গলায় ডাকলেন আমায়। আমি ক্রমশ কেঁদেই চলেছি। ধ্রুব আমার পাশের মেয়েকে আমায় ডাকতে বললেন। ভার্সিটিতে অবস্থানরত ছাত্রীর গায়ে হাত দেওয়া সাজে না।
আমি চোখ মুখ মুছে ধীরে ধীরে ধ্রুবের মুখশ্রীর দিকে তাকালাম। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?”
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “আমার খাতা, আমার লেখা।”
“সেটাই তো জানতে চাইছি, কী হয়েছে?”
সংক্ষেপে বললাম, “ভেনিস।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। খাতাটা হাতে নিয়ে পুরো খাতায় নজর বন্দি করলেন। পুনরায় খাতাটা বেঞ্চিতে রাখলেন। লিপ্ত হলেন গভীর মানসিক উদ্বেগে। আশে পাশে সন্দিহান চোখে চেয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “লেখার সময় দেখে লিখবে না? আশ্চর্য!”
বিরক্তিকর নজরে ব্যাপারটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তৃতীয় সারির কর্ণারে থাকা মেয়েটা কিছু একটা বললেন। আমি নিজের চিন্তায় মশগুল থাকায় শ্রবণ হলনা সেই কথন। মেয়েটার থেকে কমলা পানীয়ের বোতল নিয়ে সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন। ছিপি খুলে এক ঢোক পান করলেন। অতঃপর হাতে নিয়ে খাতার উপর ছিটিয়ে দিলেন। বিষয়টা বোধগম্য হতেই খাতা টেনে সরিয়ে ফেললাম। অশ্রুসিক্ত চোখে পলক ফেলে বললাম, “কী করছেন আপনি? ভিজে যাচ্ছে তো!”
“আমি বুঝে নিবো, রাখো এখানে..
প্রথম শব্দগুলোতে মার্জিত শব্দ ব্যবহার করলেও পরবর্তী শব্দে দ্বিগুণ তেজ প্রকাশ করলেন। আমি কাঁপা কাঁপা হাত বেঞ্চিতে রেখে মাথানত করে রইলাম। তিনি তার মর্জিমত ঢেলে অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “দেখো, এবার ঠিক আছে কি-না!”
পানির সংস্পর্শে এসে লেখাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হল। অপ্রত্যাশিত হাসির রেখা ফুটল। দু’গালে হাত স্থাপন করে মৃদু হেসে বললাম, “থ্যাংক ইউ!”
“ওয়েল কাম” তো বললেনই না, বিনিময়ে বাজখাঁই ভীষণ দিলেন, “ফ্যাচ ফ্যাচ কাদা কোথায় শিখেছ বলো তো? আগে তো দেখিনি। তখন স্ট্রং ছিলে। মানুষের ধীরে ধীরে উন্নতি হয় আর তোমার অবনতি হচ্ছে।
নেগেটিভ কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সর্বপ্রথম মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, অতঃপর বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে। নাকের জলে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলে সমস্যা থেকে বের হওয়া তো যাবেই না, বরং সে জল দিয়ে দেশ তলিয়ে যাবে।”
কথন থামার পূর্বেই স্থির পাজোড়া গতিশীল করে দ্রুত বেগে অগ্ৰসর হলেন। আর পাঁচটা সময়ের মত এক কর্ণপথ দিয়ে ঢুকল অন্য কর্ণপথ দিয়ে বেরিয়ে এলো। তার গমনপথের দিয়ে চেয়ে কিস্ ছুঁড়ে দিলাম। গালে হাত দিয়ে অপ্রকাশিত স্বরে বললাম, “মাই বেস্ট হাজবেন্ড।”
“এই মেয়ে কী হচ্ছে এইসব?” পাশের সিটে বসা মেয়েটার এমন প্রশ্ন শ্রবণ হতেই ফিরে দেখলাম। অধর চেপে বললাম,”সমস্যা কী?”
“স্যারকে তুমি কিস্ ছুঁড়লে কেন? তুমি একদম স্যারের আশেপাশে যাবেনা। তোমার জন্য স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, লাঠিচার্জ করেছে। তুমি স্যারের আশেপাশে গেলে আমরা বিক্ষোভ করব। বুঝেছ?”
“কচু করবে।”
[আমার বিড়াল আমাকে বলে ম্যাও, যত্তসব। আমার সাতবছর আগের বিয়ে করা বর, আমাকে বলে দূরে থাকতে] ঈর্ষা জাগল ঈষৎ। কে ধ্রুবকে এত পারফেক্ট হতে বলেছে। পারফেক্ট না হলে মেয়েরা এভাবে লাইন দিতো না। অসহ্যকর, বিরক্তিকর।
মুখ ভেংচি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
পরীক্ষা শেষ। বেল বেজেছে মিনিট খানেক পূর্বে। ভারাক্রান্ত মন সমেত ক্যাম্পাসে বসে আছি। আমাকে গোল করে বসেছে বন্ধুমহল। আজকের ব্যাপার নিয়ে বড়সড় গন্ডগোল ঠেকছে তাদের কাছে। আঁখি জোর গলায় বলে, “তোর আর ধ্রুব স্যারের ভেতরে কী হয়েছে বলত?”
“কী হবে, কিছু হয়নি।” একরোখা জবাব আমার।
প্রিয়া হা হুতাশ করতে করতে বলল, “আমি সিউর তোদের ভেতরে কিছু একটা চলছে।”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম, “কে বলেছে তোদের?”
“কে আবার বলবে? ভার্সিটির মেয়েদের দেখেছিস। কী সাংঘাতিক মাইরি। স্যারকে পুলিশে ধরায় ভার্সিটিতে কী বিক্ষোভ। তারপরে থানায় চলে গেল। ওদের জন্যই তো ধ্রুব স্যারকে ছাড়তে হয়েছিল।”
তারিফের কথায় সম্মতি দিয়ে নিরব বলে, “একদম। কী গলা মাইরি, একদম বাঁশ। তোকেও খুঁজেছিল।”
বিগত দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা বোধগম্য হল। অথচ আমি জানতামই না। সকালের অগোচরে নিজেকে প্রচুর রকম কটুক্তি করলাম।
প্রিয়া আলতো হেসে বলে, “তোর কি ধ্রুব স্যারকে ভালোলাগে?”
সকলে চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে আমার মুখশ্রীর দিকে চেয়ে আছে। তা দেখে টেনে টেনে বললাম, “চুপ করবি। উনি আমার স্যার হয়।”
“আচ্ছা উনি।”
“চুপ করবি তোরা, সবসময় মজা। আমি চললাম..
আমি উঠতেই হাত ধরে ফেলল প্রিয়া। ফোড়ন দিয়ে বলে, “ধ্রুব স্যারের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, চড়ুইকে ভালোবাসবে। তাহলেও হয়েছে।”
কথাটা আমাকে বিদ্রুপ করে বলা হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। রাগান্বিত স্বরে বললাম, “কেন আমাকে ভালোবাসা যায়না?”
আঁখি ছোট করে বলে, “যায়, কিন্তু ধ্রুব স্যার নয়। অন্য কেউ।”
রাগে গজগজ করতে করতে বললাম, “চ্যালেঞ্জ করছিস আমায়। ঠিক আছে। ঐ ধ্রুব যদি ‘ভালোবাসি’ বলে, তাহলে মেনে নিবি তো। বাই..
কাউকে বাক্য উচ্চারণ করতে না দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে বেরিয়ে এলাম। সবকিছু বিষাদময় ঠেকছে। ইচ্ছে করছে সবাইকে জানিয়ে দেই, “ধ্রুব আমার হাজবেন্ড।”
ভার্সিটির বাইরের রাস্তাটা অন্যসব রাস্তার থেকে তুলনামূলক নিচু। গতরাতের বৃষ্টির পানি জমে আছে রাস্তায়। এদিকে গাড়ি নেই বললেই চলে। আসার সময় ভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে গাড়ি থেকে নামতে হয়েছিল। আর ধ্রুব! সে তো আমাকে রেখেই চলে এসেছে। এখন আবার বাড়ি ফিরতে হবে। সূর্য নেই। বৃষ্টিহীন পরিচ্ছন্ন আকাশ। হাতের সহায়তায় প্ল্যাজু একটু উঁচু করে হাঁটা দিলাম। প্যাঁক প্যাঁক শব্দ হচ্ছে। শব্দটা একটু তীক্ষ্ণ হতেই পাশে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। ধ্রুব গভীর ভাবে পানির ভেতরে হেঁটে আসছে। মনে হচ্ছে, পানি নেই, শুষ্ক মাটি। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাকে অতিক্রম করে চলে গেলেন। আমিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। ধ্রুবের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম তিনি রিক্সা ভাড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন। ফট করে রিক্সায় উঠে একপাশে সেঁটে গেলেন। তার ব্যবহারে আমাকে বসার আহ্বান করেন। আমি এড়িয়ে গেলাম। তিনি সত্বর কণ্ঠে বললেন, “কী হলো, এদিকে কোথায় যাচ্ছো?”
“বাড়িতে যাচ্ছি।” রিনরিনে জবাব।
“সামনে আমি সমান গর্ত। পানিতে ভরে আছে। জামা কাপড় নোংরা হলে আমি কিন্তু একটা টাকাও নষ্ট করব না।”
লাগবে না, আমি ধুয়ে নিবো।
“ডিটারজেন্ট কিনতে টাকা লাগবে। একই হলো তো!”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩২
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রিকশার কাছে দাঁড়ালাম। ধ্রুব এক সমুদ্র সমপরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে সেঁটে আছে। বিরক্তিকর দম ত্যাগ করলাম। সকালের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের নিমিত্তে এখন আমার অভিমান ধরার কথা, অথচ আমাকে উপেক্ষা করে তিনি রাগ দেখাচ্ছেন। তাজ্জব ব্যাপার! অভিমানে জর্জরিত কণ্ঠে বললাম, “ধরুন।”
হাতে রক্ষিত কাগজপত্র এগিয়ে দিলাম। রিক্সার পা দানীতে পা রাখতে পারছিনা। ধ্রুব আমার পানে দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই হাত ধরলেন। কাগজগুলো নিলেন না। রূঢ় করে ধরলেন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “উঠে এসো।”
টেনে তুলেন উপরে। আমি তার পাশের ফাঁকা জায়গায় বসলাম। একটু ফাঁকা স্থান দু’জনের মধ্যে। হাতটা তার হাতের ভাঁজে আঁটক। বাহ্যিক দৃষ্টি থেকে লুকাতে ওড়নার আড়াল করে ফেললেন হাতজোড়া। রিক্সা গতিশীল হল। কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করতেই ধ্রুব রূঢ় কণ্ঠে বলে, “রিক্সা থাকান।”
আমি দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ভরকে গেলাম। ধ্রুবের গালে উপর সাদা আস্তরণ লেপ্টে আছে। ধ্রুব চোখজোড়া ছোটো ছোটো করে ক্রমশ পলক ফেলছেন। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম, “কী এগুলো? পান! পান খেয়ে চুন ফেলেছে কে? আমার মামারও এমন হয়েছিল। বাজারে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে একজন পানের পিক ফেলেছে। কী বিশ্রী গন্ধ। মনে হয়, লোকটা দাঁত ব্রাশ করে না।”
চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তুমি চুপ করবে, না-কি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো?”
আমারই দোষ! পাকনামি করতে কে বলেছে? দিলো তো ঝেড়ে। টান পড়ল ওড়নায়। কাঁধ হতে খসে পড়ার প্রয়াস করল। আমি দ্রুত বুকে হাত রেখে সামনে নিলাম। ধ্রুব আমার ওড়না দিয়ে গাল ঘসছে। ছিঃ! ছিঃ! কী বিশ্রী ব্যাপার। আমার ওড়নাটাই পেতে হল।
কিচিরমিচির ডাক শ্রবণ হতেই উপরের দিকে অবলোকন করলাম। উপরে ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ছে। এটা তাঁদেরই মহৎ কাজ।
আমি ওড়না টানতে টানতে মিনমিনে গলায় বললাম, “আমার ওড়না।”
“হ্যাঁ তোমার ওড়না। আমি খেয়ে ফেলছি না। একটু পরিষ্কার করছি, তুমি তো করে দিবে না।”
থতমত খেয়ে গেলাম। ওড়নার এক কোণা আঙুলে পেঁচিয়ে সৌজন্য হেসে স্থির হয়ে বসে রইলাম। না! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমার সাথে কথা বলছে না কিন্তু পরিষ্কার করার জন্য আমারই ওড়না ব্যবহার করছে। আমার অদৃশ্যতার মাঝেই ধ্রুব রিক্সা চালককে তার টাকা পরিশোধ করলেন। নেমে গেলেন রিক্সা থেকে। ওড়নার একপ্রান্ত তার হাতে থাকার ফলে টান পড়ল। দ্রুত তাকে অনুসরণ করে নেমে দাঁড়ালাম। পুনরায় গাড়ি গতিশীল হল। ধ্রুব আমায় রেখেই হাঁটা আরম্ভ করলেন। আমি ধ্রুবের পথ অনুসরণ করে চললাম। দোকানের কাছে গিয়ে দুইটা বোতল নিলেন। ওড়না ছেড়ে দিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাঁটা দিলেন। রুদ্র কণ্ঠে বললেন, “কিছু কিনে বাকি টাকা ফেরত নিয়ে এসো।”
অতঃপর বটগাছের তলায় খোলা হাওয়াতে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে গালের বেশ কিছুটা স্থান রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও ক্রমাগত একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছেন। উপরের স্ক্রিনের সরু আবরণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো বলে।
কথাগুলো হারিয়ে গেল শূন্যতায়। তার কাছে রুমাল থাকার সত্বেও আমার ওড়নাটা ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেললেন। ধ্যান ভঙ্গ হল দোকানদারের কথায়, “আর কিছু নিবেন ম্যাম?”
তড়িগড়ি করে বললাম, “জি!”
“বলছি আর কিছু নিবেন?”
“জি-না।”
বলতেই গিয়ের বাঁধল অধরে। স্মিত হেসে বললাম, “আইসক্রিম আছে!”
“জি আছে, চকলেট আর ভ্যানিলা ফ্লেভার। কোনটা দিবো?”
“দুটোই।”
বৃষ্টির দিনে গরম খাবারের স্বাদ বেড়ে যায় আর আমার আইসক্রিমের। এজন্যই হুট করে আইসক্রিম খেতে চাওয়া।
আইসক্রিমের পাশাপাশি খুচরা টাকাগুলো ধরিয়ে দিলেন হাতে। আমি তাল সংযত করে অগোছালো। পা ফেলে ধ্রুবের নিকট ফিরিয়ে দিলাম। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আইসক্রিম দুটির দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সাবধানে তার শার্টের বুক পকেটে খুচরা টাকাগুলো রাখলাম। একটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা আপনার খান।”
“বৃষ্টির দিন। এমনিতেও ঠান্ডা। আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ততক্ষণে ধ্রুবের পানি ফুড়িয়ে এসেছে। গালটা টমেটোর ন্যায় টকটকে লাল। চশমা বিহীন চোখজোড়া একটু লালচে আভা ছড়িয়েছে।
আমি খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এক কামড় বসালাম। উপরের অংশে লেয়ার চিবুতে চিবুতে অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কত খেয়েছি। কখনো হয়নি। ভয় দেখাবে না।”
প্রখর চাইনি নিক্ষেপ করে বললেন, “তুমি বাচ্চা, তোমাকে কেন ভয় দেখাবো। অসুস্থ হলে আমার টাকাই যাবে।”
ধ্রুবের অকস্মাৎ এরুপ কথা শুনে হতবাক হলাম। জর্জরিত হল মুখশ্রী। টাকার কাছে আমার সামান্য আবেগগুলো তুচ্ছ।
আইসক্রিমটা হাতেই রয়ে গেল। গলে গলে স্তরে স্তরে পড়ল কাঠি খসে। মুখে দেওয়া স্পৃহা হলনা। জোরপূর্বক মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম, “স্যরি। স্যরি। আমি সত্যিই দুঃখিত। ভুল হয়ে গেছে।”
পাশের ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট আইসক্রিমটুকু ফেলে দিলাম। ধ্রুবের ফাঁকা প্রায় পানির বোতল নিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। পরিশেষে ফাঁকা পানির বোতলটাও ফেলে দিলাম। ধ্রুবকে কিছু বলতে না দিয়ে বললাম, “বাড়িতে যাবেন না?”
সন্দিহান স্বরে বললেন, “হ্যাঁ। আইসক্রিমটা কেন ফেলেছ?”
সংক্ষিপ্ত জবাব, “খেতে ইচ্ছে করছে না।”
প্রতুক্তি করার সাথে সাথে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “তখন খেতে ইচ্ছে করছিল, এখন করছে না? ভ্যানিলা রেখেছ কেন? ওটাও ফেলে দাও।”
“এটা এঁটো করিনি। ভালো আছে। বাবুইও বৃষ্টির সময় আইসক্রিম খেতে পছন্দ করে। তাই নিয়ে নিলাম। ও অসুস্থ হলে আপনার খরচ দিতে হবে না, মামার সামর্থ্য আছে। চলুন, বাড়ি যাবো।”
ধ্রুবকে রেখেই পাজোড়া এগোলাম।
______
আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ ঝুলছে। পূর্ণিমার আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। চাঁদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কয়েকটা তারা জ্বলছে। নিভু নিভু প্রকট। আমার আর ধ্রুবের মাঝে চাঁদ তারার ব্যবধান। চায়ের কাপ সমেত প্রবেশ করলাম রমিলা আন্টির কক্ষে। বাবুই বসে বসে গেমস খেলছে। দুই তারিখ থেকে তার পরীক্ষা শুরু, অথচ আমার জন্য এই বাড়িতে পড়ে আছে। বই-খাতা ব্যতীত এসেছে।
রমিলা আন্টি পান বানাচ্ছেন। আমি কাপটা হাতে দিতেই মুচকি হাসলেন তিনি। বানানো পানটা মুখে না পুড়ে রেখে দিলেন সাজিয়ে। তৃপ্তিকর হাসি ফুটল তাঁর মুখে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “বাহ্। খুব ভালো হয়েছে। প্রতিদিন এককাপ করে খাওয়াবে। তবে এখন না, পরে। তোমার না পরীক্ষা, পড়তে বসো গিয়ে। আমার কিছু লাগলে সার্ভেন্টদের বলব।”
তিনি চা খাওয়াতে মগ্ন হলেন। ইতস্তত বোধ নিয়ে নম্র গলায় বললাম, “বাবুইয়ের পরীক্ষা, আমারো পরীক্ষা। পড়ার পাশাপাশি ওকে সাহায্য করতে হবে, আমরা বরং বাড়িতে চলে যাই।”
চিন্তিত হয়ে বললেন, “বাবুইকে আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তবে তোমাকে..
তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে, “কিন্তু কী আন্টি?”
“তোমাকে যাওয়ার অনুমতি আমি দিতে পারছিনা। তোমাকে ধ্রুব এনেছে।”
“আপনি তার মা, আপনার কথা কীভাবে ফেলবে? প্লীজ।!”
“তা ঠিক, তবুও। আমার ছেলে যেমন আমার মতামতকে প্রাধান্য দেয়, আমারও তো উচিত তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।”
আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। ধ্রুব বাড়িতে নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম ছাড়াই বেরিয়েছেন অজানায়। চাপা অভিমানে তার মুখোমুখি হওয়ার স্পৃহা ছিলনা। সরল
ভাষায় বললাম, “আন্টি, আমি আপনার সাথে আজ রাতে ঘুমাতে পারি?”
আন্টি মৃদু হাসলেন। তাঁর অভিজ্ঞ, জ্ঞানীগুণী চোখজোড়া অন্যকিছুর আভাস দিচ্ছে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ক্ষিপ্র গলায় বললেন, “কেন নয়। বড় একটা বিছানা। আমি আর বাবুই থাকছি। অনেকটা ফাঁকা পড়ে আছে। তুমি নিশ্চিতে শুতে পারো।
তবে কী জানো? অভিমান ভালো, দূরত্ব কিংবা অভিযোগ নয়। মিটিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অতিদ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আন্টি এবার পান মুখে দিতে গিয়েও দিলেন না। আঁচলে প্যাঁচ দিয়ে রাখলেন। ঘরের ভেতরকার আলো নিভিয়ে দিলেন। আমাদের শুতে বলে ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি সময় খরচ করলাম না। বিছানায় বালিশ আর কাঁথা ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। মাঝে বাবুই এবং দু’কিনারায় আমি আর আন্টি। এখন একটা ভারী ঘুমের প্রয়োজন। একবুক হাহাকার নিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস দিলাম। ধ্রুবের তিক্ত কথার ইতি টানতে হলেও ঘুম প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করতেই ভারী হয়ে এলো পাতা। আমি হাই তুলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিদ্রায় মগ্ন হতে। মনে মনে তখন ধ্রুবকে গভীরতর অভিযোগ করছি।
“আপনি পাষাণ ধ্রুব, বড্ড পাষাণ। আপনি আমার মন পড়তে পারেন না। আমার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোর দাম দিতে পারেন না। বড্ড নিষ্ঠুর। বড্ড..
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]