#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৯
মন খারাপের সুর বুকে বয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহীতেই চলে এলো সভ্য। রাত তখন তিনটে পনেরো বাজে। ফারজানা বেগমকে ফোন করে ঘুম থেকে উঠিয়ে ঘরে প্রবেশ করা হয় সভ্যর। এরশাদ রাতে রাতেই পুনরায় পারি জমিয়েছে ঢাকা। সভ্যর কোনো মিটিং, কাজের কথা সব তো তাকেই সামলাতে হবে। বিধায় তার সভ্যর সাথে রাজশাহী থাকা মোটেও উচিত হবে না।
— সভ্য, ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার নিয়ে আসি।
ফারজানা বেগমের মমতাময়ী কথা। সভ্য ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কেডস হতে পা উন্মুক্ত করছিলো।
— না মা। তুমি যাও ঘুমিয়ে পরো। আমি এখন কিছু খাবো না।
— ক্ষুধা লাগেনি? কখন খেয়েছিস না খেয়েছিস। আর এরপর আসার আগে ফোন করে আসবি। যা তা অবস্থা। কতক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে ছিলি কে জানে?
সভ্য মায়ের কৃত্রিম রাগ হাসি মুখে দেখে গেলো। কেডস, ঘড়ি খুলে মাথার চুলগুলোয় একবার হাত ছুঁয়ে বলল
— মা এক গ্লাস পানি দেও আমাকে।
ফারজানা বেগম ‘যাচ্ছে’ বলে পা বাড়ালেন পানি আনবেন বলে। সভ্য সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে গা এলিয়ে দিলো। বিযুক্ত আঁখিতে কাটলো তার মিনিট দুয়েক। অতঃপর খানিকটা চমকে দেওয়া কন্ঠ তার কর্ণপাত হলো। চোখ খুলল নিমিষেই।
— এই নিন পানি।
সাবিহার কন্ঠ। সে হাতে ঝকঝকে কাঁচের গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সভ্য হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিজের হাতে স্থানান্তর করলো। সভ্য আশপাশ নজর করে বলল
— মা কোথায় গেলো?
— বড় মাকে আমি ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ সকালে ওনার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। ঘুম কম হলে অসুস্থ হবে।
সাবিহা আজ বেশ স্বাভাবিক হয়ে কথা ব্যাক্ত করছে সভ্যর সম্মুখে। সভ্য পানির গ্লাস মুখে নেওয়ার আগে বলে উঠলো
— ওহ। তুমি এতো রাতে জেগে আছো, ঘুমাওনি?
— ঘুমিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আবার ঘুম ভেঙেছে।
কথাটা বলতে বলতে সাবিহা নিঃশব্দে বসে পরলো সভ্যর পাশে। সভ্য পানি পান করে গ্লাসটা সম্মুখের ছোট টেবিলে রেখে দিলো। হুট করে জরো হলো আড়ষ্টভাব। তার ফ্রেশ হতে হবে। কিন্তু সাবিহা যে হুট করে পাশে বসলো! আচমকাই যাওয়া যাচ্ছে না।
— সন্ধ্যার বাবা?
সভ্যর বিড়াট অস্বস্তির ভাবনার মাঝে হঠাৎ সাবিহার গাঢ় অনুভবের ডাক। বুকের মাঝখানটায় যেন দুম করে পরলো কিছু। সভ্য চমকে পাশ ফিরে চাইলো। অদ্ভুত সুন্দর এক ডাক! সভ্যর ঘোর কাটে না কাটে না ভাব। সে কি বলবে? তার কি বলে সাড়া দেওয়া উচিত? বলবে কি, বলো সাম্যর মাম্মা।
— বলো..
বহু কষ্টে অপ্রস্তুতের আসক্তি তাড়িয়ে সভ্য সাড়া দিলো সাবিহার ডাকে। সাবিহা হঠাৎ চোখের দৃষ্টি গাঢ় করলো। সভ্যকে আরো এক দফা চমকে দিতে সে বলে উঠলো ফিসফিস করে
— স্যালুট ব্যাক সাম্যর বাবা।
— কেন?
— আপনি আজ আমাদের আপনার পরিচয়ে পরিচিত করে দিয়েছেন বলে। সুষ্মিতার…..
আর কিছু ব্যাক্ত করতে চাইলো না সাবিহা। সভ্য কিয়ৎক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো সাবিহার দিকে। অতঃপর অনুচ্চ স্বরে বলে উঠলো
— থ্যাঙ্কস
এরপরই এক চিলতে হাসি সভ্যর মুখে। সকল আড়ষ্টতা শূন্যে উবে দিয়ে উঠে পরলো সভ্য। নিজ ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে চলতে চলতে বলল
— শুনলাম আমার ঘরের মানুষগুলো নাকি আমার ঘরেই থাকছে? আই হ্যাভ গট ফান্সি ফর ইট।
সাবিহা সোফায় বসেই লাজুক মুখে হাসলো সভ্যর কথার পিঠে। সভ্য সেদিন চলে যাওয়ার পর সাবিহা আর ঘর ছাড়েনি। পুরোদস্তুর সভ্যর ঘরের ঘরোনী হয়েছে সে। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্থানান্তর করেছে সভ্যর রুমেই।
.
ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে সময়ের খোঁজ নিতেই জানা হলো ভোর সাড়ে চারটা বজতে চলেছে। সভ্য আর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো না। ভোর হতে চলল। এখন আর ঘুমিয়ে লাভ নেই। ঘুমোলে আবার ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই উঠতে হবে। তারচেয়ে বরং সকালের নাস্তা সেরে আটটা ন’টায় ঘুমের সাথে সাক্ষাৎ করলে ঢের ভালো হবে। এই ভাবনা মনে চেপে সে রুমের একটা চেয়ার টেনে এনে স্থাপন করলো বিছানার কাছে। বেলকনিতেই বসতে চেয়েছিল কিন্তু সাবিহার জন্য বসা হলো না। একটু আগে সভ্যর মা এসেছিলেন আবার। তার ফোন ছিল এঘরে। নিতে এসে সভ্যকে সতর্কবার্তা জানিয়ে দিয়ে বলে গেলেন সাবিহার নাকি দু’দিন হলো প্রচন্ড জ্বর। আজ একটু কমেছে। দু’দিন হলো।সেবা যত্ন তিনিই করছেন। ঘুম হয় না তার দুই রাত হলো মূলত এ কারণেই তার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল আজ। রাহেলা ইসলামেরও জ্বর। মূলত এখন তাদের পরিবারে জ্বর আত্নীয় হয়ে এসেছে। সভ্য পরখ করে এটাও বুঝেছে ফারজানা বেগম কথা বলতে বারংবার গলা পরিষ্কার করেছেন। ওনারও বুঝি ঠান্ডা লেগেছে।
— ঘুমাবেন না?
হঠাৎ ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় সভ্যকে পরখ করে সাবিহা প্রশ্ন ছুড়লো। সভ্য ঠোঁট প্রসারিত করে বলল
— নাহ। তুমি ঘুমাও।
সাবিহা বিছানার প্রস্থ ধরে শুয়েছিল। মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে তার। সে উঠে সোজা হয়ে বিছানার দৈর্ঘ্য বরাবর শুতে চাইলো। মাথা তুলতেই সভ্য নিষেধ করে জানিয়ে দিলো
— যেভাবে আছো ওভাবেই থাকো। বললাম তো আমি ঘুমাবো না।
— আচ্ছা।
সভ্যর আদেশ মেনে নিয়ে সাবিহা শুয়ে পরলো পুনরায়। বন্ধ করলো চোখ। সভ্য চেয়ারে বসেই অনিমেষ তাকিয়ে রইল সাবিহার পানে। একটা সময় এই মেয়েটা ছিল আদব বিমীন। বিনয়, নম্রতা তার মাঝে একটুও ছিল না। সবসময় তার অহংকার ছিল। রূপ নিয়ে তার অশেষ অহংকার ছিল। কিন্তু আজ তারই মাঝে কোমল এক সত্ত্বার দেখা মিলেছে। কত পরিবর্তন সাবিহার! সভ্য এর কারণ খুঁজে পেয়ে হুট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সন্তান সত্যিই বড় একটা নেয়ামত। এই ছোট একটা প্রাণ কতগুলো পরিবর্তন আনতে পারে! সাবিহাকে পরিবর্তন করে দিলো। সভ্যর মনের ঘৃণা চাপা দিচ্ছে। মা বাবা নামক সুন্দর একটা অনুভূতি জাগিয়ে দিয়ে দু’টো মানব মানবীকে এক করে দিচ্ছে। যারা হয়ে উঠেছিল একে অপরের চোখের বালি। এই ভাবনা গুলো সময় নিয়ে সভ্য পরখ করে একটা সময় আলতো স্পর্শ করলো সাবিহার কপালে। তাপমাত্রা অত্যধিক নয়। তবে জ্বরের আছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
— সভ্য ভাই, একটা কথা বলবেন?
হাতের স্পর্শ কপালে পরতেই সাবিহা আচমকা বাঁক ফুটালো। সভ্য মৃদু চমকালেও ধীর কন্ঠে বলল
— বলো।
— আমাকে কি সত্যিই কখনো ভালোবাসবেন না?
— বাসবো। সাম্য সন্ধ্যার মা ছাড়া আমার ভালোবাসার মতো আর কে আছে?
হঠাৎ নরম সুরে জবাব দিলো সভ্য। সাবিহার বুকে মুহূর্তেই উঠলো প্রশান্তির ঢেউ। সে চোখ খুলে চাইলো সভ্যর পানে। বলে উঠলো
— সত্যি?
সভ্য মনের কিছু অবাধ্যতা, কিছু অনিচ্ছা দমিয়ে রেখে বলল
— হুম। মিথ্যা কেন মনে হয়?
সাবিহা সভ্যর প্রশ্নে শুধু মুখে হাসি নিয়ে পলকহীন দেখলো সভ্যকে। জ্বরের দরুন তার চোখ লাল। মুখটা শুকিয়ে চুপসান হয়েছে।
— আপনি আমার থেকে একটা কামড় পাবেন। সুষ্মিতা কে গোলাপ দেওয়ার কারণে। বাংলাদেশে তো ফুলের কোনো অভাব ছিল না। আপনি তাহলে সুষ্মিতাকে গোলাপ কেন দিলেন?
.
.
.
— সভ্য, বুঝলাম না কিছু। জ্বর ঠান্ডা সাবিহার লেগেছে। কিন্তু তুই কেন গলায় কাপড় পেচিয়ে রেখেছিস?
সকাল সকাল সভ্য সম্মুখীন হলো এহেন কথার। ফারজানা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। দৃষ্টি তার সভ্যর গলায়। সভ্য আচমকা থতমত খেয়ে গেলো। হাতে তার গ্রিন টি। প্রত্যহ খেতে হয়। কিন্তু আজ খেতে এসে বোধ হয় বেজায় ভুল হয়ে গেছে।
— আ… আমারও ঠান্ডা লেগেছে মা। গলা ব্যাথা, প্রচুর গলা ব্যাথা করছিলো তাই গলায়…
থতমত ভাব নিয়ে সভ্য এটুকুই বলল। ফারজানা বেগম ছেলের কথা নিঃসন্দেহে সত্য ভেবে আফসোসের সাগরে ডুবে গেলেন। এহেন সময় পাশ থেকে রওনক বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলো
— ভাইয়া, গলার স্বরে তো কোনো সমস্যা নেই। একদম পরিষ্কার কন্ঠ আপনার।
সভ্য এবার অসহায় হয়ে গেলো। হুট করে তার দৃষ্টি গেলো নিজের রমের দরজায়। সাবিহা নিশ্চয়ই নিশ্চিতে ঘুমায় এখন। আর সভ্য নিশ্বাস আটকে পরিস্থিতি সামলায়।
— গলার ভেতরে সমস্যা নেই আমার। সমস্যা হলো আমার উপরে।
বিরক্ত আর দুঃখের মিশ্রণে বলা কন্ঠ সভ্যর। ফারজানা বেগম চলে গেছেন রান্না ঘরে। রওনক বুঝলো না সভ্যর কথা। সে সোফায় বসে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যর পানে। পুনরায় বলল
— আপনি পুরাই বলদ। ঠান্ডা লাগছে তাও আবার গোসল দিছেন সকালে।
চলবে…..
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)