#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২১)
” আপনি আমার মন খারাপ করেছেন, এর শাস্তি হিসেবে আপনাকে আজ দুটো চুমু খাব আর কানে কানে একটা কথা বলব। ”
নিবিড়ের স্নেহপূর্ণ শাস্তির কারণ শুনে চাপা হাসল কোমল। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল রান্নাঘরের কাছটায়। এখানে কোনো কাজ নেই তার। তবুও এখানটায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। এক রুমের বাসা হওয়ায় কোমল চাইলেও অন্য কোথাও যেতে পারে না। নিবিড়ের চোখের আড়াল হতে পারে না। এই সুযোগটাই পুরোপুরি ব্যবহার করে নিবিড়। পড়া রেখে নানান প্রশ্ন করবে, চেয়ে থাকবে, নাহয় কোনো এক অদ্ভুত আবদার করে বসবে। অনুমতি পাওয়ার জন্য বাচ্চাদের মতো জেদ করবে। কিছু সময়ের জন্য সেই সুযোগটা স্থগিত রাখতে চাচ্ছে কোমল। ঠিক করেছে নিবিড়ের পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে। অল্প দূরত্বে, একটু আড়ালে।
কোমল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়। পায়ে ব্যথা হয়। ইচ্ছে হয় একটু বসতে। বসার জন্য উদ্যত হতেই নজরে পড়ে ছোট্ট জানালাটি। ভাবে, বাসার ভেতরে ঢোকার পর বাইরে বেরুনো হয়নি তার। বাড়ির আশপাশটাও দেখা হয়নি। জানালার ওপাশে কী আছে, তা দেখার সাধ জাগে মনে। কোমল বসার চিন্তা ত্যাগ করে। জানালাটি বেশ উঁচুতে হওয়ায় কোমল কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। তাই পায়ের গোড়ালি শূণ্যে তুলে শরীরটাকে লম্বা বানানোর চেষ্টা করছে। তখনই নিবিড়ের আগমন ঘটল। পেছন থেকে বলল,
” আমি উঁচু করব? ”
কোমল চমকায়। ঝটিতে পায়ের গোড়ালি নামায়। অপ্রস্তুত গলায় বলল,
” না। ”
নিবিড়ও পিড়াপিড়ি করল না। বলল,
” পড়া শেষ। চলুন শুয়ে পড়ি। ”
” সত্যি শেষ? ”
” হ্যাঁ। ”
নিবিড় ঘুমিয়ে গেলেও কোমল সজাগ। কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসছে না। হঠাৎ এই নিদ্রাহীন রোগের কারণ খুঁজতে মরিয়া হয় সে। ব্যাকুলমনে সময় গুণতে গুণতে মনে পড়ে নিবিড়ের শাস্তির কথা। সে বলেছিল দুটো চুমু খাবে, কানে কানে একটা কথা বলবে। তেমন কিছুই করেনি সে। তাহলে কি কোমল সেই শাস্তি পাওয়ার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছে? কোমলের মন আরও অশান্ত হয়ে পড়ে। ইচ্ছে হয়, নিবিড়কে ডাকতে, ঘুম ভাঙিয়ে মনে করিয়ে দিতে, তার একটি শাস্তি দেওয়ার কথা। কোমলের ইচ্ছে পূরণ হয় না। নিবিড়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর উৎসাহ পায় না। ছটফট মনে চোখ বন্ধ করে আবারও সময় গুণায় মন দেয়।
____________
নিবিড়ের সেই মধুর সম্বোধনেই কোমলের ঘুম ভাঙল আরও একবার। দেখা মিলল নতুন সকালের। আফসোসের ওজন আরও একটু বাড়িয়ে ওযু করতে গিয়ে হেসে ফেলল। চোখদুটোতে পানি ছিটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” রাতের শাস্তি সকালে দিয়েছ কেন? ”
” আপনার চোখের ক্লান্তি দূর করতে। ”
” কানে কানে কথা বলাও শেষ? ”
” না। মনে হচ্ছে, এখনও সময় হয়নি। ”
কোমল আর কিছু বলল না। নীরবে ওযু শেষ করে নামাজে দাঁড়াল। সিজদাহতে লুটিয়ে পড়তে মস্তিষ্কে অনেক কিছু ঘুরতে থাকল। মতিন মিয়ার সিক্ত চোখ, আকুল অনুরোধ, সমর্পণ করা দায়িত্ব। মুহূর্তেই কোমলের চিন্তা-ভাবনা সজাগ হলো। বিদ্যুৎ পাখার মতো ঘুরতে থাকল মনজুড়ে। তার উপস্থিতিতে নিবিড়ের পড়ালেখা ঠিকমতো হচ্ছে না। এই শেষ সেমিস্টারগুলোতে তার মনোযোগী আরও প্রখর হওয়া উচিত। তন্মধ্যে কুলসুম নাহারকে একা ফেলে এখানে থাকাও ঠিক হচ্ছে না। তার চাওয়া ছিল ছেলের রাগ ভাঙানো। ভাঙিয়েছে। তারপরও এখানে থাকা কেন? কোমল মোনাজাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিল, গ্রামে ফিরে যাবে। নিবিড়কে মানানোর জন্য সহজ উপায় খুঁজতে থাকে, পায় না। বাধ্য হয়ে নিজের ভাবনাটাই মেলে ধরে। নিবিড় মত-অমত কিছুই প্রকাশ করে না। নীরবে কোমলের দিকে তাকিয়ে থাকে। শব্দহীন কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে কোমলের হাত চেপে ধরে হঠাৎ। ব্যাকুলচিত্তে বলল,
” তাহলে কথা দেও, আমি ডিগ্রি পেলেই তোমরা এখানে চলে আসবে। আমরা একসাথে থাকব। ”
কোমল পড়ে গেল বিপদে। সে জানে, কুলসুম নাহার গ্রামে সব ফেলে ঢাকা আসতে চাইবেন না একদম। এমন অবস্থায় কথা দেয় কী করে? রাখতে পারবে না নিশ্চিত।
কোমলের নীরবতা দেখে নিবিড় অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। কোমলের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” কথা না দিলে আপনাকে যেতে দেব না। ”
” আবার পাগলামি করছ। ”
” হ্যাঁ, করছি। আপনাকে কথা দিতেই হবে। ”
” যদি কথা রাখতে না পারি? ”
” পারবেন। আমার বিশ্বাস আছে আপনার উপর। ”
কোমল মুগ্ধ চোখে তাকাল নিবিড়ের একরোখা মুখটায়। সে পুনরায় বলল,
” এছাড়া তো উপায়ও নেই, কোমল। মা ঢাকা না আসলে থাকবে কোথায়? বাড়িটা তো আর আমাদের নেই। ”
নিবিড়ের কণ্ঠস্বর ভার। শুকনো চোখদুটো ভিজে উঠতেই কোমল বলল,
” কথা দিলাম। ”
তারপরের সময়টুকুও শব্দহীন কাটল। কোমলকে বিশ্রামে রেখে নিবিড় নিজে সবকিছু গুছিয়ে দিল। ব্যাগপত্র নিজের কাঁধে নিয়ে ছোট্ট করে বলল,
” আসুন। ”
নিবিড়ের এই শান্ত আচরণ একটুও পছন্দ হচ্ছে না কোমলের। কেমন এক দুঃখবোধে বুকটা বর্ষার মাটির মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। নিস্তব্ধ রাতের মতো অন্ধকার ঠেকছে চারপাশ। বোবার মতো খোলা দরজার চৌকাঠ পেরুতে নিলে নিবিড় বলল,
” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি? ”
তার এই অনুমতির উত্তর মুখে দিল না, ইশারাতেও না। নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরল কোমল। নিবিড় দুই হাতে সেই বাঁধন আরও গভীর করল। চোখ বন্ধ করে অনুভব করল, দুটো হৃদয়ের প্রথমবারের মতো এক হওয়া, স্পর্শে আসা, হৃৎস্পন্দনের পরিচয় পাওয়া।
________________
বাড়িতে ফিরে এসে কোমল আরেক সমস্যার মুখোমুখি হলো। আনিস মোল্লা কিছুতেই কোমলকে ঐবাড়ি থাকতে দিবেন না। পুরুষ বিহীন দুটো মেয়ে মানুষ কী করে থাকবে? কোমল মোহন কাকার নাম তুলতেই জানান, তার বাড়িতে চুরি হয়েছে। অনড়ার নিরাপদের জন্য মোহনকে নিবিড়ের বাড়ি থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সেই সুযোগেই চোর হাত চালিয়ে দিয়েছে। এখন ক্ষতিপূরণ তার অর্থ ভাণ্ডার থেকেই যাচ্ছে। একমাত্র মোহনই তার বিশ্বস্ত কর্মচারী। সে ব্যতীত অন্য কাউকে পারিবারিক ব্যাপারে জড়াতে চান না। কোমল বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলতে পারছে না। এদিকে কুলসুম নাহার মুখ ঘুরিয়ে বসে আছেন। তিনি কিছুতেই স্বামীর বাড়ি রেখে অন্য বাড়িতে উঠবেন না৷ প্রয়োজনে একাই থাকবেন। কোমল কোনো উপায় না পেয়ে কল দিল নিবিড়ের নাম্বারের। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। গড়গড় করে পুরো সমস্যার কথা জানানোর পর নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
” আপনি নিজের বাসায় থাকতে চান? ”
কোমলের কণ্ঠস্বর নিভে এলো। ধীরে ধীরে বলল,
” তুমি অনুমতি দিলে তবেই থাকব। ”
” যদি না দিই? ”
” থাকব না। ”
” বাবার কথার অবাধ্য হবেন? ”
কোমল নিরুত্তর থাকলে নিবিড় বলল,
” ফোনটা মায়ের কাছে দেন। ”
” আচ্ছা। ”
কুলসুম নাহার মোবাইল কানে নিলে নিবিড় দৃঢ়স্বরে বলল,
” হয় ঢাকা আসবে নাহয় কোমলদের বাসায় যাবে। বলো কোনটা চাও? ”
কুলসুম নাহার কেঁদে দিলে নিবিড় বলল,
” আমি এক ঘণ্টা পরে আবার কল দিব। এরমধ্যে তুমি সব গুছিয়ে তৈরি থাকবে। ”
কুলসুম নাহারের কান্নার বেগ বাড়লে নিবিড় নরম স্বরে বলল,
” মা যেমন সন্তানের ভালো চায়, সন্তানও তেমন মায়ের ভালোটা চায়। আমি যদি তোমাদের চাওয়া রাখতে একা এত বছর ধরে এখানে থাকতে পারি, তুমি কেন পারবে না, মা? ”
মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে কল কেটে দিল নিবিড়। মোবাইল কান থেকে নামিয়ে ভাবছে, এটা এখানে রয়ে গেল কী করে। তার স্পষ্ট মনে আছে, কোমলের ব্যাগে ভরে দিয়েছিল। মোবাইল যেখান থেকে পেল সেখানে একটা প্যাকেটও আছে। তার নিচে চাপা দেওয়া একটা কাগজের টুকরো। তাতে লেখা,
‘ অন্যরা খুশি হয়ে উপহার দেয়, আমি দিলাম প্রয়োজনে। আশা করছি, ফিরিয়ে দিবে না। যেমনটা তোমার বাক্সবন্দি ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিইনি আমি। সেদিন তুমি খুশি ছিলে, আজ আমি। ‘
একঘণ্টা পর নিবিড় কল করল আনিস মোল্লার নাম্বারে। একবার রিং হতেই রিসিভ হলো। কোমলের গলা পেয়ে নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
” মা, আপনাদের বাড়িতে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কান্না করছে এখনও? ”
” না। ঘুমাচ্ছে। ”
” আপনি ঘুমাবেন না? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখন? ”
” তুমি কেটে দিলে শুয়ে পড়ব। ”
” তাহলে কেটে দিই। ”
” আচ্ছা। ”
নিবিড় কল কেটে দিল। কোমল মোবাইল বাবার রুমে রাখতে যাবে তখন আবার কল আসল। রিসিভ করতেই নিবিড় বলল,
” শুভ বিবাহ বার্ষিকী। ”
কোমল চুপ করে থাকলে নিবিড় আবার বলল,
” আমাদের বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। এটা আপনি জানতেন, মনে ছিল। তবুও আজকে চলে গেলেন। আমি দুঃখ পেয়েছি। ”
” তাহলে শাস্তি দেও। ”
” ইচ্ছে করছে না। ”
” তাহলে ঘুমাও। ”
” আচ্ছা। ”
এইবার কোমল কল কেটে দিল। মোবাইল নিয়ে বাবার রুমে যেতে ইচ্ছে হলো না তার। হঠাৎ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল শরীর, মন। কুলসুম নাহারের পাশে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে আবার কল আসল। রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলল,
” আপনাকে ছাড়া ভালো লাগছে না, ঘুম আসছে না। কী করব আমি? ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২২)
প্রায় দুই সপ্তাহ পর বুবুর কাছে পড়তে বসেছে অনড়া। শুরুতে খুব উৎসাহ দেখাল। ভীষণ মনোযোগী ভাব দেখাল। বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে বেশ পড়ল। অংক কষল খাতা ভর্তি করে। কোমল খুশি হলো। ধরে নিল, অনড়া বদলাচ্ছে। পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝছে। অনড়ার মাথায় হাত রেখে দোয়া করছিল গোপনে গোপনে। তখনই সে বলল,
” বুবু, তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি? ”
কোমল হালকা হেসে বলল,
” আচ্ছা। ”
বুবুকে জড়িয়ে ধরে হৃদ্যতাপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” আমাকে ভালোবাসো না? ”
” বাসি। ”
” অল্প? ”
” অনেক। ”
” তাহলে এতদিন আমার খবর নেওনি কেন? পড়াওনি কেন? ”
” পড়ানোর মতো অবস্থায় ছিলাম না, তাই পড়াতে পারিনি। কিন্তু খবর নিয়েছি। ”
” নেওনি। ”
” নিয়েছি। বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। কল করলেই প্রথমে তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি। একবার তো বাবাকে তোর কাছে পাঠিয়েও ছিলাম। তুই কথা বলিসনি। বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি। ”
অনড়া বুবুর বুক থেকে মাথা তুলল। অপরাধি সুরে বলল,
” তুমি রাগ করেছ? ”
” না। ”
” কেন? ”
” ঐ যে বললাম, অনেক ভালোবাসি তাই। আমি বুঝতে পেরেছি, তুই অভিমান করেছিস। কখনও তো তোকে ফেলে দূরে গিয়ে থাকিনি। অভ্যেস নেই। একা একা লেগেছে খুব, তাই না? ”
অনড়ার চোখ ছলছল করে উঠল। বুবুর বুকে মুখ লুকাতেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
” তোর কি কোনো চিঠি আসার কথা ছিল? ”
চিঠির প্রসঙ্গ উঠতে অনড়ার চোখ আবার ভিজে উঠল। ঝড় শুরু হলো বুকের ভেতর। সেই অদৃশ্য ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হওয়ার পূর্বে নিজেকে সামলে নিল। চোখ মুছে বলল,
” না। ”
” মা যে বলল, তুই নাকি চিঠির খোঁজ করছিলি। ”
অনড়া বুবুকে ছেড়ে দিল। ব্যথায় লাল হওয়া চোখদুটি বইয়ে নিবদ্ধ করে বলল,
” মনে হয় চিঠি ভুল ঠিকানায় গিয়েছে। ”
” সে কী! ঠিকানা ঠিক করে দিসনি? ”
” আমার ঠিকানা না, বুবু। ”
” তাহলে? ”
” আমার চিঠি ভুল ঠিকানায় গিয়েছে। ”
” তুই চিঠি লিখেছিস? কাকে? ”
অনড়ার বুক ভেঙে আসতে চাচ্ছে চৈত্রের খরার মতো। চোখ দুটো টলমল করছে বর্ষার পুকুরের মতো। কী করে বলবে সে বুবুর বরকেই চিঠি লিখেছিল!
অনড়ার দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা করার সময় মোবাইল বেজে উঠল। দুজনেই চমকে কেঁপে উঠে সেই শব্দে। স্ক্রিনে নিবিড়ের নাম দেখে অনড়া দৃষ্টি সরিয়ে নেয় চট করে। বই-খাতা তুলে বেরিয়ে আসতে চাইলে কোমল থামিয়ে বলল,
” কোথায় যাচ্ছিস? পড়াগুলো শেষ কর। ”
বুবুর আদেশ অমান্য করা সম্ভব হলো না অনড়ার। পূর্বের মতো বই-খাতা মেলে বসলে কোমল কলটা ধরল। সালামের উত্তর নিয়ে সুধাল,
” কেমন আছ? ”
” একটুও ভালো না। ”
” খাওয়া হয়েছে? ”
” কিছু খেতে পারছি না। ”
” ক্লাসে যাওনি? ”
” অসুস্থ তো। ”
” আচ্ছা, রাখছি। ”
কোমল সত্যি কল কেটে দিল। নিবিড়কে নিয়ে কোনো উদ্বেগ দেখা দিল না। অনড়ার পড়ার দিকে ঝুঁকে আসলে ফোনটা আবারও বেজে উঠল। বাজতেই থাকল। রিসিভ করার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না তার মধ্যে। বেশ কয়েকবার কল কেটে যাওয়ার পর বার্তা এসে পৌঁছাল। কোমল বার্তাটি খুলল। তাতে লেখা, ‘ আমি একটুও মিথ্যা বলছি না। বিশ্বাস না হলে অনুমতি দিন। এসে দেখিয়ে যাই, আমি আপনিহীনা কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ‘ কোমল উত্তরে লিখল, ‘ আমার দোয়াতে শুধু তুমি না, তোমার সুস্থ ভবিষ্যতের চাওয়াও থাকে। ‘ নিবিড় দ্বিতীয় বার্তায় লিখল, ‘ স্বামীর জরুরি চাওয়া পূরণ করছেন না, সেজন্যই আপনার দোয়া কবুল হচ্ছে না। সুস্থ হওয়ার বদলে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ‘ কোমল বার্তা আদান-প্রদান বন্ধ করতে লিখল, ‘ মোবাইলের অপব্যবহার করছ তুমি। ‘ এরপর নিবিড়ের আর কোনো বার্তা আসেনি। কোমল খুশি হতে গিয়েও মনখারাপ করে ফেলল। চিঠি আদান-প্রদানে বেশ সময় লাগে। জরুরি খবর পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল উপকারী। সেই ভাবনায় ইচ্ছে করে, লুকিয়ে মোবাইলটা নিবিড়ের টেবিলে রেখে এসেছিল। দুলাল ভাই নেই যেহেতু, কাজে দিবে। মাঝেমধ্যে খোঁজ নেওয়া যাবে। কিন্তু নিবিড় মাঝেমধ্যে শব্দটাকে বিলিন করে দিয়েছে যেন। সময়-অসময়ে কল করে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দিচ্ছে। প্রথম দিকে কোমল চিন্তায় পড়ে গেলেও এখন অভ্যাস করে নিচ্ছে। প্রশ্রয় দিতে চাচ্ছে না একদম। তাহলেই তার পাগলামি বেড়ে যাবে কয়েকশো গুণে।
নিবিড় বার্তা পাঠানো বন্ধ করে দিলেও মন গিয়ে বসে আছে মোবাইলের স্ক্রিনে। কোমল সেই মন ফিরিয়ে আনতে বাবার রুমে গেল। আনিস মোল্লা বাইরে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মেয়ে মোবাইল ফেরত দিতে চাইলে বললেন,
” একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দূরে যাচ্ছি। চাইলেও হুট করে ফেরত আসতে পারব না। মোবাইল তোর কাছেই থাক। ”
কোমল লজ্জায় মাথা হেঁট করে ফেলল। নিবিড়ের পাগলামিকে কিছুতেই বাঁধতে পারছে না সে। বাবাকেও সহ্য করতে হচ্ছে। মোবাইল নিয়ে বাইরে বেরুতে পারেন না। দুই মিনিট বাদে বাদে কল করে নিবিড়। তিনি যতই বুঝিয়ে বলেন, বাইরে আছেন। বাসায় গিয়ে কোমলকে বলবেন, কল দিতে। নিবিড় বুঝতে চায় না। দিনকে দিন তার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে যেন। লাজ-শরমের তো চিহ্নটুকুও নেই!
আনিস মোল্লা মেয়ের কাছে মোবাইল রেখে বেরিয়ে গেলেন।
___________
নিবিড়ের পাগলামি বন্ধ করার জন্য নানান পন্থা ব্যবহার করেছে কোমল। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। একসময় বাধ্য হয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখল। পরিকল্পনা ছিল, নিবিড়কে ভয় দেখানো। সে যে খুব রাগ করছে সেটা বুঝানো। বুঝাতে পারলে আবার খুলবে। তার সেই পরিকল্পনা কাজ করল। ফোন বন্ধ পেয়ে নিবিড় বেশ ঘাবড়ে যায়, ভয় পায়। ভয়ের মাত্রাটা এতটাই বেশি ছিল যে, সে মাঝরাতে ছুটে এলো গ্রামে। সোজা গিয়ে হাজির হলো মোল্লাবাড়িতে। মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম চোখে দরজা খুলে দাঁড়াল কোমল। তিনি ফিসফিসে বললেন,
” খবর না দিয়ে চলে এসেছে। কোনো সমস্যা? ”
” কে এসেছে, মা? ”
” নিবিড়। ”
কোমলের চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেল নিমিষেই। বিস্ময়াপন্ন হয়ে সুধাল,
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। এত করে বললাম ভেতরে এসে বসতে। আসলই না! ”
” কেন? ”
” বলল তো অনুমতি নেই। ”
কোমল মাকে রেখে দ্রুত হেঁটে গেল সদর দরজার দিকে। আড়াল থেকে বলল,
” ভেতরে এসো। ”
নিবিড় ভেতরে আসল। কোমলের রুমে ঢুকেই বলল,
” একটু পানি দিবেন? ”
কোমল রুমের আলো জ্বালিয়ে এক ঝলক তাকাল নিবিড়ের দিকে। সেই এক ঝলকে দেখল, নিবিড়ের অযত্নে বেড়ে উঠা চুল-দাঁড়ি-গোঁফ, মলিন গালদুটি, নির্ঘুমে ভার হওয়া দুটি চোখ, ঢিলে হওয়া শার্ট। জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা দুশ্চিন্তা ফিরে এলো কোমলের। উদ্বিগ্নচিত্তে বলল,
” তোমার এ কী অবস্থা! ”
নিবিড় শুকনো হেসে বলল,
” এবার বিশ্বাস হলো? ”
কোমল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে গেল রান্নাঘরে। পানির সাথে নানান পদের খাবার নিয়ে ফিরে এসে আরেকদফা অবাক হলো। নিবিড় রুমে নেই। সে খাবার হাতে পুরোবাড়ি খুঁজে বেড়াল নিবিড়কে। চোখের পলকে হাওয়া হওয়া মানুষটাকে স্বপ্ন বলে বোধ হলো। দুঃস্বপ্ন ভেবে নিজের মনকে শান্ত করতে ব্যস্ত হলে রাবেয়া খাতুনের আগমন ঘটল। জিজ্ঞেস করলেন,
” খাবার নিয়ে এখানে কী করছিস? নিবিড় এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? ”
কোমল উত্তর দিতে পারল না। খাবারের থালা মায়ের হাতে দিয়ে রুমে ফিরে গেল। মোবাইল চালু করে কল দিল নিবিড়ের নাম্বারে। ধরতেই ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কোথায়? ”
” বাসে। ”
” চলে গেলে কেন? ”
” ভয়ে। ”
” কিসের ভয়? ”
” অনুমতি ছাড়া চলে এসেছি দেখে যদি রাগ করেন? আমি তো রাগী কোমলকে দেখিনি এখনও। ”
কোমলের খুব ইচ্ছে হলো বলতে, ‘ ঢাকা যেতে হবে না। এখানে থেকে যাও। আজ থেকে তোমার ছুটি। ‘ বলতে পারল না। মোবাইল কানে নিয়ে নীরব সময় কাটাল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
” যদি মোবাইলে জ্বালাতন করা বন্ধ করো, তাহলে মাসে একবার নিমন্ত্রণ পাবে। ”
” একবেলার বদলে যদি একরাত হয়, তাহলে জ্বালাতন বন্ধ হবে এখনই। ”
কোমল কিছু না বলে কল কেটে দিল। বাবার ঘুম ভাঙিয়ে বলল,
” একটা ভালো রাঁধুনির ব্যবস্থা করতে পারবে, বাবা? ”
______________
নিবিড় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখল, অল্প বয়সের একটি ছেলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই ভাঁজ করা একটি কাগজ ধরিয়ে দিল। তাতে লেখা,
‘ আমার প্রথম উপহার দ্বিতীয় উপহারের কাছে জমা দিয়ে যত্নশীল হও। নিমন্ত্রণ সঠিক সময়ে পেয়ে যাবে। ‘
দরজার তালা খুলে দিতেই ছেলেটি রুমের ভেতর ঢুকল। ব্যাগপত্র এক কোণায় রেখে রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” আপা এই ব্যাগে জমা রাখতে কইছে। ”
নিবিড় ব্যাগের মধ্যে মোবাইল জমা রাখল। তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে টেবিলে গিয়ে বসল। খাতা-কলম নিয়ে লিখল,
‘ আপনার উপহারের হাতে আংটি কেন? আমি আংটি হাতের রান্না খাব না। ‘
এইটুকু লিখে পাতা ছিঁড়ল। খামের ভিতর ভরে ঠিকানা লিখতে লিখতে রান্নার গন্ধ পেল। সঙ্গে সঙ্গে খাতা টেনে নিয়ে লিখল,
‘ গন্ধ বের হওয়া রান্না আমি খাব না। যদি বদহজম হয়? ‘
এই পাতাটিও ছিঁড়ে ভাঁজ করল নিবিড়। অন্য একটি খামে ভরে একই ঠিকানা লিখল। দুটো চিঠি সকালে ডাকবাক্সে ফেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে খেতে গেল। খাওয়া শেষে আরও দুটি চিঠি লেখা হলো। একটিতে লিখেছে,
‘ ভাত এত শক্ত হয়েছে কেন? নিশ্চয় লবণ দেয়নি। এমন ভুলো মনের রাঁধুনি আমার পছন্দ না। ‘
আরেকটিতে লিখল,
‘ ডিমের সাথে শুকনো মরিচ ভেজেছে কেন? আমার কাঁচামরিচ ভাজা পছন্দ। এগুলো কে বলে দিবে? ‘
সকালে ঘুম থেকে উঠে ডাকঘরের দিকে দৌড়াল নিবিড়। গুণে গুণে আটটি চিঠি ফেলে আসার পরও মনে হলো, কী যেন লেখা হয়নি।
চলবে
চলবে
[