#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_২২
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
মাধবীলতা আজ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাধবীলতাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে ঠিকি। তবে পুরোনো দিনের সেই অনুভূতি আর জাগ্রত হয়নি স্পর্শের মনে। তবে একটু একটু করে মায়া জন্মাতে শুরু করেছে স্পর্শের মনে। স্পর্শ হয়তো আর কখনোই মাধবীলতা’কে নিজের ভালোবাসার মানুষ হিসেবে মেনে নিতো না। তবে নানুর দেওয়া কসমের কারণে নত হতেই হলো স্পর্শকে।
স্পর্শ মাধবীলতাকে নিয়ে পুনরায় তার ঠিকানায় চলে এসেছে। এতদিন সাগর আর আবীর মিলে ব্যাবসাকে সামলেছে।
রাতে যখন বাড়িতে পৌঁছে সকলে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে বসেছে তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। আবীর গিয়ে দরজা খুলে দেখে সাগর আর সুবর্ণা। আবীর তাদের ভিতরে নিয়ে আসে।
” স্যার , ভাবী আপনারা কেমন আছেন?
সুবর্ণা আর সাগরকে একসাথে দেখে স্পর্শ খুশি হয় অনেকটা।
” আরে সুবর্ণা যে। আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমাদের দুই জামাই বউয়ের কী খবর?
” হ্যাঁ স্যার অনেক ভালো।
” স্যার শব্দটা অফিসেই ব্যবহার কোরো কেমন? কেনো তোমাকে কী আমি অফিসের বাইরে বোনের মতো ভালোবাসি না নাকি? পর কেনো দাও আমাকে বলো তো?
সুবর্ণা জিভে কামর দিয়ে বলে,
” ইশ ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া।
” হা হা হা। ঠিক আছে। কিন্তু তোমার হাতে এসব কী?
” আসলে সাগর বলল আজ নাকি আপনারা বাড়ি ফিরবেন। ভাবলাম রাত হলে তো খাবার রান্না করতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়াও ভাবী অসুস্থ। এতো রাতে কীভাবে সব সামলাবে। তাই ভাবলাম আজ আমিই আপনাদের খাওয়াবো।
” এসবের কী প্রয়োজন ছিল বলো তো? হোটেল থেকে এনেই খেতে পারতাম।
” না ভাইয়া এই কাজ একদম করবেন না। আর ভাবীর ক্ষেত্রে তো একদমই নয়। ভাবীকে এসময় বাইরের কোনোভাবেই খাওয়াবেন না৷
” আচ্ছা ঠিক আছে।
সুবর্ণার কথা শুনে মাধবীলতা অনেকটা খুশি হয়। কতো খেয়াল রাখে সবাই তার।
খাওয়া শেষ করে সবাই গল্প করতে বসে। গল্পের ফাঁকে আবীর স্পর্শকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ভাইয়া আপনাকে একটা কথা বলার ছিল!
” বলো কী বলবে? অনুমতি নিতে হচ্ছে কেনো?
আবীর আমতা আমতা করে বলল,
” আসলে আপনাকে প্রথম যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করাই! সেদিন রাস্তায় নয়নের সঙ্গে দেখা হয়। সেদিন বলেছিল ওর মা নাকি আপনাকে দেখতে চায়। নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াবে আপনাকে। যখন আপনার অবস্থা সম্পর্কে বললাম তখন তিনিও এসেছিলেন। আপনাকে ডেকেছিল। যদি সময় হয় তাহলে একবার দেখা করতে যাবেন।
” দেখা কেনো করব না? যত যাই হোক মায়ের হাতের রান্না কী আর মিস করা যায়।
স্পর্শ আর মাধবীলতা ঘুমোতে গেল।
স্পর্শ মাধবীলতাকে একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তবে স্পর্শ কেনো এমনটা করে সে নিজেও জানে না। স্পর্শের মনটা কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে। ভাবে এক, করে আরেক। করতে চায় এক, হয়ে যায় আরেক। তেমনিভাবে সবসময় চায় মাধবীলতাকে বুকে টেনে নিতে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বুকে টেনে নিতে পারে না মাধবীলতাকে। স্পর্শ শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে একমনে কিছু ভাবছিল। হঠাৎই মাধবীলতার কথায় চোখ সরিয়ে নেয়।
” আমি কী এভাবেই সারাজীবন শাস্তি ভোগ করব?
মাধবীলতার শীতল কণ্ঠের জবাব কী দেবে ভাবতে পারছে না স্পর্শ। না বুঝার ভান করে উল্টো প্রশ্ন করে বসে,
” কোন শাস্তির কথা বলছো? আর তুমি কেনো শাস্তি পাবে?
মাধবীলতা স্পর্শের অগোচরে চোখের পানি মুছে নিল।
” আমাকে কী একটা সুযোগ দেওয়া যায় না মাধবীলতা থেকে আবারো তোমার মায়াবতী হওয়ার?
স্পর্শ জবাব না দিয়ে চুপ করে রয়েছে। মাধবীলতা আবারো বলে,
” এতদিন শাস্তি দিয়েও তোমার মন ভরেনি? তুমি তো ঘুমিয়েই ছিলে পাঁচটি বছর। কিন্তু আমার করা ওই একটা অপরাধের বেদনা আমা কুরে কুরে খাচ্ছিল। এই পাঁচটি বছর কীভাবে কেটেছে সেটা একমাত্র আমিই জানি।
” আচ্ছা বাদ দাও না এসব কথা। রাত অনেক হয়েছে এবার ঘুমাও। নাহলে শরীর খারাপ করবে তোমার।
” আচ্ছা একটা কথা বলব?
” ঘটা করে অনুমতি কেনো নিচ্ছো? বলে ফেলো কী বলবে!
” আমি যদি কখনো মরে যাই তাহলে তুমি সুখী হবে না? তুমি আমার উপর রাগ, অভিমান করে আছো তাই না? যদি আমিই না থাকি তাহলে তোমার রাগ অভিমান দিয়ে কী করবা?
মাধবীলতার ভাঙা কণ্ঠে কথাগুলো শোনার সঙ্গেই স্পর্শের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। মনে হচ্ছে এই বুঝি জীবনের কোনো মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেললো। মাধবীলতার মুখোমুখি হয়ে বলল,
” এসব কী বাজে বকছো বলো তো? তোমার কিছু হবে না। আমি রয়েছি তো তোমার সঙ্গে।
” এটাকে সঙ্গ বলে না। দয়া করা বলে। গুড্ডু আমি একটা মেয়ে। আমারও ইচ্ছে করে স্বামীর বুকে ঠাই পেতে, তার বুকে মাথা রেখে একটু শান্তির ঘুম দিতে। কেনো পারছি না আমি এসব করতে বলো? কেনো আমাকে আপন করে কাছে টেনে নিচ্ছো না তুমি?
কথাগুলো বলেই মাধবীলতা কেঁদে ফেলে। স্পর্শ আর বিলম্ব না করে মুহূর্তেই মাধবীলতাকে নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।
” কান্না বন্ধ করো। এই যে দেখো তোমাকে আমার বুকে জড়িয়ে নিয়েছি। প্লিজ আর কেঁদো না।
মাধবীলতা ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই চলেছে। আস্তে আস্তে কান্না বন্ধ হলে স্পর্শ একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
” দেখো মাধবীলতা! অনেক সময় মানুষের মন ও মস্তিষ্ক একইভাবে কাজ করে না। আমার মন চাইলেও মস্তিষ্ক বাঁধা দেয়। কিন্তু তুমি আর কষ্ট পেও না। দেখো আমি তো চেষ্টা করছিই আবার আগের মতো হতে। আবারও তোমাকে ডুবে যেতে। আস্তে আস্তে অবশ্যই সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে একদম মন খারাপ করবে না। সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। আর সেই নির্দিষ্ট সময়টা না আসা পর্যন্ত কোনোকিছু আশা করা বোকামি। শুনো তুমি তোমার অধিকার থেকে সব করবে। তোমার যেটা মনে চাইবে সেটাই করবে। আশা করি আর বলে বোঝাতে হবে না। তবে আমাকে সময় দাও। আমি আস্তে আস্তে নিজেকে ঠিক করে নেবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। কাল নয়নের মা’কে দেখতে যাব।
মাধবীলতা আর কথা না বাড়িয়ে স্পর্শের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরেরদিন সকালে মাধবীলতার ডাকে ঘুম ভাঙে স্পর্শের। আড়মোড়া উঠে বসে স্পর্শ। স্পর্শ ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল, মাধবীলতার পড়নে লাল বেনারসি শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা আর হাতে একটা কফির কাপ। মাধবীলতার এমন সাজসজ্জা দেখে স্পর্শ খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে মাধবীলতা চায় তার সাথে একটু দুষ্টুমি করতে। স্পর্শ মনে মনে ভাবছে যে, ” মাধবীলতা এখন অন্তঃসত্ত্বা, তাই তাকে কোনভাবেই হতাশ হতে দেওয়া যাবে না। স্পর্শ একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কফির কাপটা টেবিলে রেখে মাধবীলতাকে ধরে আলতো করে কোলে বসিয়ে দেয়। মাধবী লতার গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে,
” সকাল সকাল এতো সাজুগুজু করেছ যে!
” এমনিতে মন চাইলো তাই সাজলাম। কেমন লাগছে বলো?
” বলব?
” হ্যাঁ অবশ্যই বলবে!
” অনেক মিষ্টি লাগছে তোমায় দেখতে। এরকমভাবে প্রতিদিনই বাড়িতে সেজেগুজে থাকবে। কীরকম যেন কাজের মেয়ের মতো থাকো সবসময়। জানো সমাজে কিছু কিছু মেয়ে আছে। এরা বাড়িতে, স্বামীর সামনে সবসময় কাজের মেয়ের মতো, অগোছালো, উদাসীন হয়ে থাকে। কিন্তু যদি একবার বাইরে বের হয় তাহলে দেখবে পুরো পৃথিবীর সাজসজ্জার ব্যবস্থা করেছে। মুখে হাজারটা মেকআপের প্রলেপ, পড়নে আধুনিক পোশাক! আরো কতকিছু। স্বামীর ভালোবাসার চেয়ে বাইরের ছেলেদের কুদৃষ্টি এদের অনেক বেশি মজা লাগে। সংসারে কী আর এমনি এমনি আগুন লাগে? ঘরের থেকে পরের চিন্তা বেশি।
” আচ্ছা বাবা এখন থেকে আমি সবসময়ই তোমার জন্য সেজেগুজে বসে থাকবো। এখন কফি টা খেয়ে নাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আজ স্পর্শের এমন মিষ্টি ব্যবহারে মাধবীলতার মনে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।
সবাই নয়নের বাড়ির দিকে রওনা হয়। আবীর যাওয়ার পথে কিছু ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে নেয়।
আবীর নয়নের বাড়ির সামনে গিয়ে হর্ণ বাজাতে থাকে। নয়ন তড়িঘড়ি করে বাইরে বেড়িয়ে আসে। স্পর্শ আর আবীরকে দেখে নয়ন অনেকটাই খুশি হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলতে থাকে,
” মা দেখো কে এসেছে!
নয়নের চিৎকার শুনে নয়নের মা তাড়াতাড়ি বাইরে আসে। স্পর্শকে দেখে অনেকটা হতভম্ব হয়ে যায়। নয়নের মায়ের চোখে অশ্রু।
” বাবা তুমি সুস্থ হয়েছ?
স্পর্শ এগিয়ে গিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
” সুস্থ তো হতেই হতো বলুন। আপনাদের সবার এতো ভালোবাসা ফেলে আমি কোথায়’ই বা যাব? আপনাদের ভালোবাসা আর দোয়ায় আল্লাহ ঠিকই সুস্থ করে দিয়েছেন।
” আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো আর কখনোই তোমাকে দেখতে পাবো না।
স্পর্শ সেই কথার আর জবাব দেয় না। মাধবীলতাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
” এটা আপনার বউমা।
মাধবীলতা এগিয়ে নিয়ে সামাল করতে যাবে তখনই নয়নের মা থামিয়ে দিল,
” থাক মা পায়ে হাত দিতে হবে না। বেঁচে থাকো। বাহ কী মিষ্টি দেখতে বউমা। আসো তোমরা ভিতরে। সেদিন পুরোটা দিন কাটিয়েছে সেখানেই। নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে স্পর্শকে।
স্পর্শ বসে পেপার পড়ছিল। মাধবীলতা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে স্পর্শকে দিয়ে পাশে বসে পড়ে।
” তোমাকে একটা কথা বলতাম। আজ অনেক বছর হয়ে গেল বাবার বাড়িতে যাই না। বাড়ির সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
” তাহলে চলো গিয়ে ঘুরে আসি।
” তুমি সত্যি বলছো?
” মিথ্যেই বা বললাম কখন?
মাধবীলতা ভাবতে পারেনি স্পর্শ এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে।
পরেরদিনই দু’জন চলে আসে মাধবীলতার বাড়িতে। মাধবীলতার মা বাবা স্পর্শ আর তাদের মেয়েকে দেখে অনেক খুশি হয়েছে।
মাধবীলতার মা’কে পেয়ে নিজের মায়ের অভাব পূরণ হয় স্পর্শের। ছেলের মতো আদরযত্ন করে স্পর্শকে। আজ অনেকদিন পর স্পর্শ মিহিকে পেয়ে মন বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল।
রাতের খাবার শেষ করে স্পর্শ শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” মা মাধবীলতা এখানে কয়েকটা দিন থাকুক। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। আমাকে যেতে হবে।
” সে’কি বাবা তুমি থাকবে না? তুমিও থেকে যাও ক’টা দিন।
মাধবীলতাও তার মায়ের তাল মিলিয়ে বলে,
” মা তো ঠিকই বলেছে। থাকো ক’টা দিন।
” না মা আজ নয়। অন্য কোনো সময় এসে অনেকদিন থাকবো নাহয়। আজ আসি। আর মাধবীলতার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। ও কিন্তু নিজের প্রতি একদম বেখেয়ালি।
” আচ্ছা ঠিক আছে বাবা তুমি চিন্তা কোরো না।
এভাবেই কাটতে থাকে দিনকাল। আজ মাধবীলতা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্পর্শ মাধবীলতাকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিছু চেক-আপের জন্য। চেক-আপ করানো শেষ হলে মাধবীলতাকে আলতো করে ধরে গাড়িতে তুলে দেয়। তারপর স্পর্শ যখনই গাড়ির দরজা খুলে উঠতে যাবে তখনই মাথায় কেউ আঘাত করে।
জ্ঞান যখন ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরতেই স্পর্শ চারিদিকে মাধবীলতাকে খুঁজতে শুরু করে। আবীরকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করে মাধবীলতা কোথায়?
কিন্তু আবীর বলতে পারে না। তৎক্ষনাৎ স্পর্শের ফোন টুংটাং শব্দে বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখে কেউ একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। ভিডিও দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শ “মাধবীলতা” বলে গগন ফাটানো শব্দে চিৎকার দেয়। #একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_২৩
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
মাধবীলতার হাত কাঁটার ভিডিও স্পর্শের চোখের সামনে চালু রয়েছে। মাধবীলতার এমন করুণ দশা দেখে স্পর্শের কলিজা শুকিয়ে যায়। এই প্রথম স্পর্শ এতটা ভয় পাচ্ছে। এর আগেও জীবনে বহুবার অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। কখনো এতটা ভয় কাজ করেনি স্পর্শের মনে। হঠাৎই স্পর্শের মনে পড়ে মাধবীলতার সেই রাতের কথা। ” আমি মরে গেলে তুমি খুশি হবে তাই না?
কথাটি ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠে স্পর্শের।
ভিডিওর শেষে একটা মেয়ে বলে,
” যদি তোমার বউয়ের সাথে শেষ দেখা করতে চাও তাহলে চলে এসো সেই পুরোনো গোডাউনে। যেখানে তোমাকে তোমার বউ নিজ হাতে মারার চেষ্টা করেছিল।
ভিডিওটি শেষ হতেই স্পর্শ বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে যায়। মাথা প্রচুর ভার লাগছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয়। এমন সময় আবীর কেবিনে এসে বলে,
” ভাইয়া আপনি কোথায় যাচ্ছেন অসুস্থ শরীরে?
স্পর্শ আবীরকে ধরে বলল,
” মাধবীলতা খুব বিপদে রয়েছে। ওরা ওকে প্রচুর কষ্টে রেখেছে। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নাহলে আমার মায়াবতীকে বাঁচাতে পারবো না।
আবীর গাড়ি ছোটাতে লাগলো সেই পুরোনো ঠিকানায়। স্পর্শের মাথা এখনো ভনভন করছে ব্যাথায়। স্পর্শ ভাবতে পারছে না এখন তার ক্ষতি কে করতে চাইবে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই স্পর্শ দেখতে পায় মাধবীলতা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। একে তো মাধবীলতার পেটে আট মাসের বাবু রয়েছে। তারউপর এতটা নির্মম অত্যাচার। ভাবতেই স্পর্শের প্রতিটি শিরা-উপশিরা যেন কেঁপে ওঠে রাগে। আজ কোনো চ্যালা নেই। শুধু একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শের সামনে। স্পর্শ মাধবীলতার দিকে ছুটতে গেলেই মেয়েটি স্পর্শকে থামিয়ে দেয়।
” উহুম একদমই এই ভুল কোরো না। নাহলে তোমার প্রাণপাখির প্রাণটা ফুস করে উড়ে যাবে।
স্পর্শ থেমে যায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,
” কে তুমি? আর কেনো এভাবে ওকে কষ্ট দিচ্ছো? কী চাই তোমার?
মেয়েটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
” কী চাই আমার? এইতো বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। চাই তো আমার অনেক কিছুই। প্রথমে তোমার প্রাণ, আর তারপর তোমার আদরের স্ত্রী মাধবীলতার প্রাণ
কী দেবে আমায় এই দু’টো উপহার? হাহাহা জানি দেবে না। কিন্তু আমি ঠিকই এগুলো আদায় করে নেবো। চাইলেই তোমার মাধবীলতাকে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ওকে এটা দেখাতে চাই যে ভালোবাসার মানুষটাকে মরতে দেখতে কেমন লাগে।
স্পর্শ চিৎকার দিয়ে বলল,
” কেনো এসব করছ তুমি?
” তুমি তো কিছু করোনি। করেছে তোমার আদরের মাধবীলতা। রোহানকে মেরে বড্ড ভুল করেছে।
এমন সময় মাধবীলতার আর্তনাদ ভেসে আসে স্পর্শের কানে।
” আমাকে বাঁচাও। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।
স্পর্শ কোনকিছু না ভেবেই এগোতে থাকে। হঠাৎই কোনোকিছুর সঙ্গে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। পিছনে তাকিয়ে দেখে রোহান। স্পর্শ নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রোহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” বেঁচেই আছিস তাহলে? কিন্তু তোর গলায় তো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাই না? পিছন থেকে আঘাত করার স্বভাব বদলায়নি এখনো।
” হা হা হা এতো সহজে কী করে মরি বল? মাধবীলতা ছিল কাঁচা খেলোয়াড়। ছুরি কীভাবে মারতে হয় সেটাও জানে না। তাই বেঁচে গেলা। মাধু সোনা আমাকে মারার চেষ্টা করে যে ভুলটা করেছে সেটার খেসারত তো আজ দিতেই হবে। আগে তোকে ওর চোখের সামনে মারবো। আমি জানি তোর সঙ্গে শক্তিতে পেড়ে উঠতে পারবো না। তাই এবার বুদ্ধি খাটিয়েছি। তুই চাইলেও আমাকে মারতে পারবি না। কেননা আমার শরীরে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোর মাধবীলতা খালাস হয়ে যাবে।
এবার স্পর্শ রোহানের পিছনে তাকায়। রোহানের পিছনে তো আবীরের থাকার কথা! কিন্তু নেই কেন? স্পর্শ চোখদুটো বন্ধ করে কিছু সময়ের জন্য! তারপর মনে মনে ভাবে” বিপদের সময় মানুষকে পাশে পাওয়া যায় না। কিন্তু আবীর তো আমার সঙ্গেই এসেছিল হঠাৎ করে এভাবে কোথায় উবে গেল?
রোহান আবারো বলে ওঠে,
” কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি ভয় পেয়েছিস নাকি?
স্পর্শ ঠোঁট বাঁকা করে সে বলে,
” ভয় তাও আবার তোকে? তোকে কি পাগলে কামড়েছে নাকি? একটা কাজ করতে পারিস। তুই তোর নামটা পরিবর্তন করে রুহানি রাখতে পারিস। কেননা ছেলেদের কোন বৈশিষ্ট্যই নাই তোর মাঝে।
সঙ্গে সঙ্গে রেগে গিয়ে রুহান স্পর্শক একটা ঘুসি মারে। যার ফলে ছিটকে গিয়ে একটু দূরে পড়ে স্পর্শ।
এমন সময় আবীর পিছন থেকে বলে ওঠে,
” ভাইয়া আমি মেয়েটাকে ধরেছে আপনি রোহানের শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিন।
আবীরের কাজে স্পর্শের মুখে বিশ্ব জয় করার মতো একটা হাসি ফুটে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে রোহানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” কিরে এতক্ষণ যেন কী বলছিলি? আমাকে খুন করে তারপর মাধবীলতাকে খুন করবি? তোদের এসব খুনাখুনির চক্করে আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
রোহানের মুখে আতঙ্কের ছাপ।
স্পর্শ আস্তে আস্তে রোহানের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
” এবার নাকি বুদ্ধি করেই মাঠে নেমেছিস? আরে বেকুব যুদ্ধক্ষেত্রে বুদ্ধি আর শক্তি! দু’টোরই সমানভাবে প্রয়োজন হয়। তুই কেমন ছেলে বল তো? লড়াই করার আগে বলিস আমি তোর সাথে শক্তিতে পেড়ে উঠব না। কেনো শুধু শুধু বাচ্চাদের মতো কর্মকাণ্ড করছিস বল তো? বেঁচে ছিলি, কোথাও চলে যেতে পারতি। জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতিস। কিন্তু না! তোর জীবন-মরণের খেলা খেলতে বড্ড বেশিই ভালো লাগে দেখছি। এবার তোকে কী করব বল?
রোহান কোনোকিছু না ভেবে স্পর্শকে মারতে আসে। স্পর্শ প্রথমে রোহানের চোয়ালে ঘুষি বসিয়ে দেয়। তারপর বুকে সজোরে লাথি মারে।
” ভাইয়া আমাদের বেশি সময় নষ্ট করলে চলবে না। ভাবীর অবস্থা অনেক খারাপ।
স্পর্শ আর বিলম্ব না প্রথমে রোহানের ঘাড় মটকে দেয়। তারপর পালা করে চারটি হাত-পা ভেঙে দেয়। রোহানের চিৎকা গুলো ছিল শোনার মতন।
এমন সময় মেয়েটি আবীরকে ধাক্কা মেরে মাধবীলতাকে লাথি মারে। যার ফলে মাধবীলতা মাটিতে পড়ে যায়।
আবীরও সঙ্গে সঙ্গে গান বের করে মাথায় গুলি চালিয়ে দেয়। তারপর কনফার্ম হয়ে নিল মরেছে কিনা। ওখানেই লাশ দু’টো ফেলে দেয়। স্পর্শ ছুটে আসে মাধবীলতার কাছে। গাড়িতে তুলে হাসপাতালে উদ্দেশ্য ছুটতে থাকে। মাধবীলতা ব্যাথায় ছটফট করছে। চোখ দিয়ে নোনাপানি টুপটুপ করে পড়েই চলেছে। মাধবীলতার এতটা কষ্ট দেখে স্পর্শের চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ছে। মাধবীলতা মুখ ফুটে বলল,
” আমি তো মরেই যাব। কিন্তু আফসোস তোমার মনে আর জায়গা করে নিতে পারলাম না। এতগুলো মাড কেটে গেল তারপরও তোমার সেই মায়াবতী হয়ে উঠতে পারলাম না। দেখলে তো, আমি আমার অপরাধের শাস্তি ঠিকই পেলাম। এখন আর কেউ প্রতি রাতে এসে কানের কাছে বুকে ঘুমাবো বলে জ্বালাতন করবে না তোমায়।
স্পর্শ মাধবীলতার মুখের উপর আলতো হাত রেখে বলে,
” কিচ্ছু হবে না তোমার মায়াবতী! এসব কথা বাদ দাও। তুমি কোনোরকমে চোখ দুটো খোলা রাখার চেষ্টা করো।
মাধবীলতা একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। আজ কতদিন পরে স্পর্শের মুখে মাধবীলতা ডাকটি শুনতে পেলো। মাধবীলতা আর কিছু বলতেই পারলো না। চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে যায়। স্পর্শের চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরেই চলেছে।
হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মাধবীলতাকে অপারেশন থিয়েটারে দেওয়া হয়। আবারো রক্ত দিতে হলো স্পর্শ। রক্ত দিয়ে যখন বাইরে এলো তখন দেখলো স্পর্শের পুরো পরিবার চলে এসেছে। মিহি স্পর্শকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। মাধবীলতার মা এসে কান্নারত কণ্ঠে বলে,
” বাবা আমার মেয়েটা বাঁচবে তো?
” মা আপনি চিন্তা করবেন না। কিচ্ছু হবে না আমার মায়াবতীর। ওর কিছু হলে যে আমিও আর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবো না।
স্পর্শ ধপ করে বসে পড়ে। আনমনা হয়ে ভাবতে থাকে, ” তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা হয়তো তুমি জানো না মায়াবতী। তুমি যবে থেকে আমার জীবনে এসেছো তবে থেকে আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনি। আমার অভিমানের দেয়ালে সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছিল। হে আল্লাহ তুমি আমার মায়াবতীকে সুস্থ করে দাও। কথা দিলাম আজ থেকে একমুহূর্তের জন্যেও তোমাকে এতটুকু কষ্ট পেতে দেবো না।
সাগরের কণ্ঠে স্পর্শের ধ্যান ভাঙ্গে।
” স্যার, ভাবী এখন কেমন আছে?
স্পর্শ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। সাগরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” অপারেশন চলছে।
স্পর্শের চোখ দিয়ে এখনো পানি গড়িয়েই চলেছে।
” স্যার নিজেকে সামলান।
স্পর্শ আবারো দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আজ যেন বারবার দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে স্পর্শ।
” আর নিজেকে সামলানো! জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত কেটে গেল নিজেকে সামলাতে সামলাতেই। যখনই একটু সুখের নাগাল পাচ্ছি তখনই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না আর কতকাল এভাবে চলবে! সাগর আমাকে একটু ধরো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
সাগর স্পর্শকে ধরে বসিয়ে দেয়।
স্পর্শের চোখদুটো আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে। কেনো জানি না স্পর্শের মনে হচ্ছে সবকিছু বোধহয় এখানেই থেমে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।
এমন সময় ডক্টর বেরিয়ে আসে। ডক্টর আসার সঙ্গে সঙ্গে সাগর স্পর্শকে নিয়ে ডক্টরের সামনে যায়।
” ডক্টর আমার মায়াবতী এখন কেমন আছে? ও সুস্থ হয়েছে তো?
”
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,