#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৭)
শালুকের সব পরীক্ষা শেষ হতে ১৫ দিন সময় লাগলো। পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো সেদিন শো রুম থেকে বের হয়েই ধ্রুব গাড়িতে উঠলো। শালুককে আগেই বলে রেখেছে রেডি হয়ে থাকতে।
শালুকের কেমন শূন্য শূন্য লাগছে চলে যাবার কথা শুনেই।আবার কবে আসবে কে জানে!
কতোদিন হয়ে যাবে কারো সাথে আর দেখা হবে না।বাবা মা’কে দেখবে না।
স্কুল থেকে ফিরেই শালুক উদাস হয়ে বসে রইলো। আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলো সবার কথা। আজ চলে গেলে আবার কবে সবার সাথে দেখা হবে কে জানে!
আর এসএসসি পরীক্ষা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন!তখন তো আর আসা হবে না বাড়িতে।
এভাবে কি আর পারবে সবার সাথে সময় কাটাতে?
কিছু সময় জীবন থেকে একবার চলে যাবার পর হাজারো সময়, সুযোগ এলেও আগের সেই মধুর সময়টা আর আসে না।
কোনো একদিন শালুকের ও সময় হবে,বৃদ্ধ বয়সে অফুরন্ত সময় থাকবে তখন এভাবে বিপদে ফেলার মতো কেউ থাকবে না। কাউকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।কিন্তু এই যে এখন বাবা মা চাচা চাচী দাদা দাদী আছে এরা সবাই কি থাকবে?
তখন কি মানসিকতা এখনকার মতো থাকবে?
এসব ভাবতে ভাবতে শালুকের চোখের কোন ভিজে গেলো।
শাপলা কলেজ থেকে এসে শালুকের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোর?”
শালুক বোনকে ধরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আজকে চলে যাবো আপা।ধ্রুব ভাই আসতেছে আমাকে নিতে।”
শাপলার ভীষণ মন খারাপ হলো শুনে।বোনের চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, “আমাদের ভাগ্যটা এরকম কেনো বল তো!কতো হাসিখুশি ছিলাম আমরা, কতো সুখী ছিলাম আমরা সবাই।অথচ একটা ঝড়ে আমাদের সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সবার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে।
নয়না আপা ও আসে না,আফিফা আপার বর ও আপাকে আসতে দেয় না।তুই চলে গেলি কতো দূরে।আমি একেবারে একা হয়ে গেছি রে।নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে এখন।
মনে হয় এক মরুভূমিতে একা বেঁচে আছি।মা চাচীরা সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। দিবা ছোট মানুষ, ও ওর মতো থাকে।নিজেকে মনে হয় একা নিঃসঙ্গ তাল গাছের মতো।
ডানা থাকলে আমি ও উড়ে যেতাম।এখন ডানার অভাবে একা দাঁড়িয়ে আছি।
আমাকে ছেড়ে তোরা সবাই চলে গেলি নিজ নিজ ঠিকানায়। ”
শালুকের মন খারাপ হলো আরো বেশি বোনের কথা শুনে। আসলেই তো!
ধ্রুবর সাথে তো তার দিন কেটে যায়।শাপলা একা বাড়িতে থাকে কিভাবে!
ওর কেমন লাগে জানি।
শাপলা বললো, “আয় তোর ব্যাগ গুছিয়ে দিই।”
দুবোন মিলে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।
রান্নাঘরে হাসনা বেগম ভীষণ ব্যস্ত। ধ্রুবর পছন্দের খাবার রান্না করছেন তিনি।বক্সে করে সব দিয়ে দিবেন।ধ্রুব যে বাড়িতে এক গ্লাস পানি ও খাবে না তা তিনি জানেন।
তাই তড়িঘড়ি করছেন।তার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে সবাই কাজ করছে। আদিবা বেগম দুধ পুলি পিঠা বানাচ্ছেন।
সবাই ভীষণ ব্যস্ত।ধ্রুব এলো রাত ১০ টার দিকে।এসে দেরি করলো না আর। সবার সাথে দেখা করে, কথা বলে শালুকের হাত ধরে বের হয়ে এলো।
শালুক নিরবে অশ্রুপাত করছে তাও দেখলো ধ্রুব।কিন্তু কিছু বললো না।
প্রতিটি মেয়ের জন্যই এই মুহুর্ত ভীষণ বেদনাদায়ক। এই সময়ে তাকে যদি বলা হয় এতো কান্নার কি আছে তবে তা হলো চরম অমানবিকতা।
এই সময়টা প্রতিটি মেয়ের জন্য খুবই নাজুক সময়। তাদের মন তখন অল্পতেই আঘাত পায়।
রিকশায় বসে ধ্রুব শালুকের মাথা নিজের বুকে নিয়ে বললো, “আমি বুঝতে পারছি তোমার খুবই খারাপ লাগছে শালুক। আমি এ ও জানি তোমাকে আরো কয়েকটা দিন থাকতে দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমার দিকটা তুমি একবার ভেবে দেখো শালুক। আদনান যেকোনো সময় বের হয়ে আসতে পারে, তারপর তোমার যদি কোনো ক্ষতি করে ও?আমার জায়গায় তুমি নিজেকে দাঁড় করিয়ে একবার ভেবে দেখো আমি কি ভুল করেছি না-কি ঠিক করেছি।আমি তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাই না শালুক।.১% রিস্কও আমি তোমাকে নিয়ে নিতে পারবো না। তবুও যদি তোমার মনে হয় আমার কাজটা ভুল হয়েছে তবে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত শালুক। ”
শালুক এর বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না। ধ্রুব ভুল কিছু করে নি।রিকশা থেকে নেমে দু’জনে বাসে উঠলো। ধ্রুব শালুককে সীটে বসিয়ে দিয়ে নেমে গিয়ে বার্মিজ আচার,তেঁতুলের আচার,চিপস,জুস,কেক কিনে আনলো।
চলন্ত গাড়িতে শালুক ঘুমিয়ে পড়লো ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে।ধ্রুবর মনে হলো কতো লক্ষ,কোটি বছর যেনো পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। শালুক তার থেকে দূরে ছিলো।
আজ বহুদিন পর ধ্রুবর মনে হলো প্রাণপাখি তার খাঁচায় ফিরে এসেছে। শালুকের কপালে একটা আলতো করে চুমু খেলো ধ্রুব।
শীতে শালুক ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। হুডির জিপার খুলে ধ্রুব শালুককে ভেতরে টেনে নিয়ে হুডি দিয়ে ঢেকে দিলো।
ভোর রাতে নিজেদের বাসায় এসে পৌছালো দুজনে।শালুক বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে গেলো। বাকিটা সময় ধ্রুব আর ঘুমাতে পারলো না।
বাড়ি থেকে দেওয়া খাবারের বক্সগুলো বের করে সব গরম করে রাখলো।
একটা ফ্রিজের যে ভীষণ প্রয়োজন তা আবারও অনুভব করলো ধ্রুব।
একাউন্টে প্রায় ৪২ হাজার টাকার মতো আছে।ধ্রুব ঠিক করলো আজকে দিনেই একটা ছোট ফ্রিজ কিনে আনবে বলে।
শালুক ঘুম থেকে উঠে দেখে ধ্রুব নেই।চলে গেছে নিজের কাজে।খাবার রেডি করা।বাড়ি থেকে গরুর মাংস রান্না করে দিয়েছে হাসনা বেগম, ধ্রুব রুটি বানিয়ে রেখেছে।
হাত মুখ ধুয়ে শালুক খেয়ে নিলো।
খাওয়ার পর আপনাতেই আজ বই নিয়ে বসে গেলো পড়তে।ধ্রুবর এতো কাজ করা দেখে শালুকের মনে হলো ধ্রুবর এতো পরিশ্রমের প্রতিদান হিসেবে হলেও তার ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
সারাদিন কাজ করার পরেও যে মানুষটা তাকে এতো যত্ন করে পড়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য এর চাইতে উত্তম বিকল্প আর কিছু নেই শালুকের।
ধ্রুব বাসায় ফিরলো রাতে।নিশার মা এরমধ্যে অনেকবার কল দিয়েছে। কিন্তু ধ্রুব রিসিভ করে নি।
শালুক অবাক হলো ধ্রুবকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার আরেকটা টিউশনি আছে না?”
ধ্রুব হেসে বললো, “ওটা ছেড়ে দিয়েছি।”
শালুক বুঝতে পারলো না কেনো ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস ও করলো না। ধ্রুব শো-রুমের ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে বললো, “তুমি একটু বাজারের ব্যাগগুলো খুলে রাখো।আমি গোসলটা সেরে নিই।ফ্রিজ কিনেছি একটা, আমার ফোনে কল আসলে রিসিভ করিও।বাসার সামনে এসে ওনারা কল দিবেন।”
শালুক চোখ বড় করে তাকালো।তারপর বললো, “এই শীতের মধ্যে গোসল করবেন?”
ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর লাজুক হাসি দেখে শালুক ভ্রু কুঁচকে তাকালো।শালুককে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুব বললো, “কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো বোকা ফুল, তোমাকে যে খুব সকালে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার কষ্ট দিচ্ছি না।আমার অভ্যাস আছে।”
শালুক বুঝতে পারলো না ধ্রুবর কথা। ধ্রুব বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার পর শালুক বুঝলো ধ্রুব কি বলেছে।এমনিতে আগে থেকেই শালুক একটু আধটু জানতো কিন্তু এবার বাড়ি যাবার পর দাদী তাকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বলেছে।সেসব শুনে শালুক লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেছে।
আজ ধ্রুবর মুখে এই কথা শোনার পর শালুকের নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হলো।
আসলেই সে বোকা,ধ্রুব তাকে এমনি এমনি বোকা ফুল বলে না।
লজ্জায় শালুকের কান গরম হয়ে উঠলো। ধ্রুবর কল এলো সেই সময়। ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো বাথরুম থেকে, কে কল দিয়েছে।
শালুক বললো, “নাম সেইভ নেই,আননোন নাম্বার। ”
ধ্রুব গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বললো, “রিসিভ করে কথা বলো।আমাদের ফ্ল্যাটের নাম্বার বলে দাও।আমি বের হচ্ছি।”
শালুক রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিশা কান্না করতে করতে বললো, “স্যার,কেনো চলে গেলেন এভাবে? আমি কী অপরাধ করেছি স্যার?আমি থাকতে পারবো না আপনাকে না দেখে।প্রমিস করছি স্যার,আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হবো না।আপনার যেভাবে পছন্দ আমি সেভাবে চলবো।আম্মু আমাকে খুব বকেছে আপনি আর আসবেন না শুনে।আর এরকম হবে না স্যার।প্লিজ আপনি আসুন।”
শালুক হতভম্ব হয়ে শুনতে লাগলো সব।ধ্রুবর স্টুডেন্ট ছেলে না-কি মেয়ে তা শালুক কখনো জানতে চায় নি।ধ্রুব ও কখনো বলে নি। শালুক ভেবেছে ছেলে স্টুডেন্ট। কিন্তু মেয়ে স্টুডেন্ট জানতে পেরে শালুকের হাত পা কেমন কাঁপতে লাগলো।
ভয়ে শালুক কল কেটে দিলো। লুঙ্গি পরে ধ্রুব বের হয়ে এলো। চুল মুছতে মুছতে বললো, “কি বললো ওরা?এসেছে? ”
শালুক মাথা নিচু করে বললো, “আপনার স্টুডেন্ট কল দিয়েছে। আপনি তাকে পড়াতে যাচ্ছেন না বলে খুব কষ্ট পাচ্ছে সে।”
শালুকের কথায় ধ্রুব বিষাদের সুর শুনতে পেলো। মুচকি হেসে শালুককে জড়িয়ে ধরে বললো, “বিশ্বাস করো শালুক।তুমি ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আর কোনো পিছুটান নেই।আমার জন্য কে কষ্ট পেলো, কে মরে গেলো সেসবে আমার কিছু আসে যায় না।কিচ্ছু না।আমার মাথাব্যথা শুধু আমার বোকা ফুলকে নিয়ে, আমার জন্য সে কষ্ট না পেলেই হলো।
ওর নাম নিশা।তিন মাস পড়িয়েছি ওকে আমি। মেয়েটাকে আমি বলেছি ও আমি বিবাহিত। ওর সামনে বসেও তোমার সাথে কথা বলেছি।কিন্তু ও বিশ্বাস করতে চাইছে না।এজন্য ওকে পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছি।
এজন্য তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝে মন খারাপ করে থাকো তবে আমার চাইতে কষ্ট আর কেউ পাবে না।শুধুমাত্র তোমার আমার মধ্যখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিশা যাতে না ঢুকতে পারে তার জন্যই আমি ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।এরপর আমার আর কি করার আছে বলো?”
শালুক ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর বললো, “আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার খুব খারাপ লেগেছে। কেনো লেগেছে আমি জানি না।তবে আজ এটুকু অনুধাবন করতে পেরেছি আদনানের কথা শুনলে আপনার কাছে কেমন কষ্ট লাগতো। এতো দিন আপনার সেই কষ্ট আমি অনুভব করতে পারতাম না।কিন্তু আজকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সেই যন্ত্রণা। আমি ছাড়া যেমন আপনার আর কেউ নেই,আজ এই মুহূর্তে ভীষণভাবে অনুভব করছি আপনি ছাড়া আমার ও এই পৃথিবীতে একান্ত আপন বলে কেউ নেই।আমি আপনাকে হারাতে পারবো না। ”
শালুক নিজেই ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। শালুকের কান্না দেখে ধ্রুব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।তারপর শালুকের মুখ উপরের দিকে তুলে একটা চুমু খেলো।
সারা শরীর কেঁপে উঠলো শালুকের, মনে হলো বৈদ্যুতিক শক খেয়েছে সে।
শালুক নিজ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবকে।সেই চরম রোমান্টিক মুহুর্তে নিষ্ঠুরের ন্যায় ধ্রুবর কল এলো।ফ্রিজ নিয়ে এসেছে।
লজ্জা পেয়ে শালুক বারান্দায় ছুটে গেলো।
চলবে……#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৮)
মাস শেষ হতেই ধ্রুব টের পেলো সামনের দিনগুলো তার জন্য বেশ কঠিন হতে যাচ্ছে যদি না এর মধ্যে সে আরেকটা টিউশনি যোগাড় করতে পারে।
সামনের মাসে ফাইনাল পরীক্ষা ধ্রুবর, ভার্সিটিতে ফি বাবদ অনেকটা টাকা খরচ হয়ে গেছে,এরপর আবার ফ্রিজ কিনতে হয়েছে।ফ্রিজ কেনার পর ধ্রুবর জমানো টাকা ছিলো ৯হাজার টাকা।
বেতন আর দুইটা টিউশনি থেকে পাচ্ছে ২২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। এর উপর মাসে বিদ্যুৎ বিল যায় প্রায় ১ হাজার টাকা, ধ্রুবর ভাড়া যায় মাসে ২ হাজার টাকা।
বাকি ৪ হাজার টাকা দিয়ে সারা মাস চালাতে হয়।
প্রতিদিন খাবারে মাছ,মাংস না থাকলে ধ্রুবর কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। তার মনে হয় সে শালুককে ভালো রাখতে পারছে না।
শালুক হয়তো এসব দিয়ে খেতে পারছে না আরাম করে।
খাবার সময় ধ্রুবর বেশ খারাপ লাগে। ইদানীং সকালে আর রাতে খেতে বসলে ধ্রুব মাছ,মাংস খেতে চায় না।
শালুক বুঝতে পারছে না ধ্রুবর সমস্যা কোথায়।বাসায় আসলে ধ্রুবর চেহারায় কেমন চিন্তার ছাপ দেখতে পায় শালুক।
কিন্তু কেনো এতো চিন্তা করছে ধ্রুব সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না শালুক।
ধ্রুবর এই চিন্তিত চাহনি শালুকের সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কান্না পায় শালুকের ধ্রুবকে এভাবে বিমর্ষ হয়ে থাকতে দেখলে।
ধ্রুব হন্যে হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজছে। কিন্তু কিছুতেই সময় মিলছে না তার।
দুর্মূল্যের বাজারে ৪ হাজার টাকায় নিজেদের সংসার চালানো ও ধ্রুবর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাতে ধ্রুব বাসায় এলে শালুক আজ মুখ ফুলিয়ে রাখলো।বিকেলে শালুক নিজেই রান্না করেছে। প্রতিদিন মাছ,মংস খেতে খেতে শালুকের কেমন অরুচি ধরে গেছে খাবারে।
শালুক আজ আলু ভর্তা,শিম ভর্তা,ডাল ভর্তা,ডিম ভর্তা,বেগুন ভর্তা,টমেটো ভর্তা,পেঁয়াজ -মরিচ দিয়ে ডিম ভেজে নিলো। বিকেল ধরেই আস্তে আস্তে এসব আয়োজন করেছে শালুক।আর শালুকের এই আয়োজনে সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিলো ইউটিউব। মায়ের থেকে শুনেছে বাহারী রকমের ভর্তা, খুদের ভাত ধ্রুবর ভীষণ পছন্দ।
সেটা দেখেই শালুক ইউটিউব থেকে ভর্তা রেসিপি দেখতে লাগলো। দেখে তার নিজের ও ইচ্ছে হলো ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে।তার উপর কয়েক দিন ধরেই মাছ মাংস খেয়ে শালুকের ও অরুচি এখন।
ধ্রুব বাসায় এসে চেঞ্জ করে নিলো। শালুকের গম্ভীর মুখখানা দেখে শঙ্কিত হয়ে গেলো। শালুকের চিবুক তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
শালুক মাথা নাড়িয়ে জানালো,”না।”
ধ্রুব আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”
শালুক বললো, “কিছু হয় নি,এমনিই ভালো লাগছে না। ”
ধ্রুব তারিখ হিসেব করলো, বাড়ি থেকে এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। কে জানে হয়তো বাড়ির কথা মনে পড়েছে।ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে শালুক? বাড়ি যেতে চাও?”
শালুক আগের মতো গম্ভীর হয়ে বললো, “না।”
ধ্রুব আবারও চিন্তা করলো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি অন্য সমস্যা হয়েছে? ন্যাপকিন শেষ হয়ে গেছে? ”
শালুক লজ্জা পেলো না মোটেও,তেমনই আগের সুরে বললো, “না।”
ধ্রুব আর ভেবে পেলো না তাহলে কি হতে পারে। শালুকের পাশে বসে পড়লো ধ্রুব শালুকের বাম হাতের আঙুল নিজের ডান হাতের আঙুলের মধ্যে রেখে বললো, “কি হয়েছে তাহলে শালুক? এভাবে মন খারাপ করে আছো কেনো? তোমার মন খারাপ হলে আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার মনে হয়। তোমার মুখের হাসি আমার পৃথিবীকে আলোকিত করে তোলে।জেনে ও কেনো তুমি এরকম করে আছো বলো?সারাদিন পরে বাসায় এসে তোমার মলিন মুখ দেখলে মনে হয় আমি বুঝি ব্যর্থ।রাজকন্যাকে রাজরানীর মর্যাদা দিতে পারছি না।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয় শালুক। ”
শালুক ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, “এই যে কয়েকদিন আপনি মন খারাপ করে থাকেন,আপনার হাসির আড়ালে ফুটে উঠে গভীর চিন্তা।তখন আমার কেমন লাগে?আপনি তো সারাদিন বাহিরে থাকেন,কাজে ব্যস্ত থাকেন।আমার সময় কিভাবে কাটে বলেন? আমার পড়া শেষ হয়ে গেছে সব বিষয়, বই নিয়ে বসলে আপনার চিন্তিত চাহনি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। সারাদিন ধরে অপেক্ষায় থাকি কখন আপনি বাসায় আসবেন।আমি চাতকের মতো আপনার অপেক্ষায় বসে থাকি কিন্তু আসলে দেখি আপনার চিন্তাযুক্ত মুখ।তখন আমার অবস্থা কেমন হয় তা ভেবে দেখেছেন আপনি?
আমি হয়তো আপনাকে ততটুকু ভালোবাসতে পারি নি যতোটুকু আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন।কিন্তু বিশ্বাস করেন,আপনার ভালোবাসা মহাসাগর সমান হলে আমার ভালোবাসা যদি বিন্দুসম ও হয়,তাও আমার কাছে আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ।
সেখানে আমার ও ঠিক এরকম কষ্ট হয়।আমি আপনাকে বলতে পারি না, ভাবি আজ না হয় কাল ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরেই দেখছি এই অবস্থা। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ”
ধ্রুবর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। শালুককে বুকে নিয়ে বললো, “আমার বোকা ফুলের যে আমার জন্য এতো কষ্ট হয় তা তো আমি আগে বুঝি নি।বুঝলে কিছুতেই তাকে এই কষ্ট করতে দিতাম না আমি। এই যে দেখো,আমি এখন হাসছি।আর এরকম হবে না শালুক।”
শালুক ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার নিজের চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো।
ধ্রুব আস্তে একটা ফুঁ দিতেই দুই চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়লো। ধ্রুব দুই হাত পেতে তা তুলে নিলো।
তারপর মুচকি হেসে বললো, “আমার রাজরানীর চোখের এক ফোঁটা জল ও যে আমার হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দেয়।মনে হয় যেনো কোনো এক অদৃশ্য তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে আমার হৃৎপিন্ড।”
শালুক বললো, “তাহলে আমাকে বলেন, কেনো আপনার মন এতো খারাপ ছিলো? কি নিয়ে এতো চিন্তায় আছেন আপনি? ”
ধ্রুব হেসে বললো, “কিছু না শালুক। আমার সব চিন্তাই তোমাকে নিয়ে।কিভাবে তুমি খুশি থাকবে এটা ছাড়া আমার আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই।”
শালুক ধ্রুবর হাত চেপে ধরে বললো, “আমি আপনার সহধর্মিণী, আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার সমস্যা মানে আমার সমস্যা। আপনার কষ্ট মানে আমার কষ্ট। আমার কষ্টের ভাগিদার যেমন আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ হতে পারবে না তেমনই আপনার সকল কষ্ট, চিন্তা ভাবনার অর্ধেক ভাগিদার আমি ও।আমাকে বলেন আপনার কি হয়েছে। ”
ধ্রুব মুচকি হেসে বললো,”আমার শালুক তো দেখি মাশাল্লাহ অনেক বুঝদার হয়ে গেছে। অনেক গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বিশ্বাস করো,আমি তোমার চিন্তাই করছি।কিভাবে তোমাকে ভালো রাখতে পারবো এটাই ভাবছি শুধু।মনে হচ্ছে আমি তোমাকে সেভাবে রাখতে পারছি না যেভাবে চাচা চাচী তোমাকে যত্নে রাখতো। আমার সেই সামর্থ্য এখনো হয় নি।এই ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়।”
শালুক বললো, “আপনি আমাকে যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে রাখছেন আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির স্ত্রী ও তার স্বামীর থেকে এই ভালোবাসা পাচ্ছে না। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না কোনো কিছুতে।জানি না জীবনে কোন দিন কোন পুণ্য করেছি নিজের অজান্তে, আর তার বিনিময়ে আল্লাহ আমার জোড় আপনার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। ”
ধ্রুবর বুকের ভেতর কেমন খুশীর জোয়ার বইতে লাগলো শালুকের কথা শুনে।তারমানে তার শালুক তাকে পেয়ে সুখী। ধ্রুব মনে মনে আল্লাহকে বললো, “এই মেয়েকে যেনো আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খুশী রাখতে পারি। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।”
ধ্রুব হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেলো। ঢাকনা দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখা দেখে ধ্রুব ঢাকনা সরিয়ে দেখতে লাগলো। এতো রকমের ভর্তা দেখে চমকে গেলো ধ্রুব।সেই সাথে তার জিবে জল চলে এলো।
শালুকের পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো, “এতো কিছু কেনো করতে গেলে তুমি? হাত জ্বলছে নিশ্চয়? ”
শালুক হেসে বললো, “হাতে পলিথিন পেঁচিয়ে নিয়ে করেছি।আপনি খুশি হন নি?আমি জানি ভর্তা আপনার প্রিয়।”
ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “বাহ!আমার বউয়ের দেখি আমার পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে ও ভাবনা রয়েছে। আমার কেমন আনন্দ লাগছে তুমি বুঝবে না শালুক। আমি ভীষণ খুশী। তবে এতো কিছু করার দরকার ছিলো না। একটা ভর্তা হলেই আমার হতো। ”
দুজন মিলে পরম তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেলো।
শালুক ধ্রুবর কাছ ঘেঁষে ঘুমালো। আদুরে বেড়ালের মতো ধ্রুবর গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো ঘুমের ঘোরে। ঠান্ডা পড়ছে ঝাঁকিয়ে। ধ্রুব বুকের মধ্যে টেনে নিলো শালুককে,তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
আদনান বাড়িতে ফিরলো ১ মাস ১৫ দিন পরে।আদিবা বেগম আদনানকে বসার রুমে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন।তারপর তেড়ে গিয়ে বললেন,”কেনো এসেছি এই বাড়িতে? তোকে কে ঢুকতে দিয়েছে? ”
আদিবা বেগমের চিৎকারে হাসনা বেগম ছুটে এলেন।বড় জা কে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আমি ওর জামিন করে ছাড়িয়ে এনেছি ভাবী।আপনার পায়ে পরি আপনি ওকে কিছু বলবেন না।আমি জানি ভাবী আপনার কেমন বুক পোড়ে ওর জন্য। ভাবী,আদনান এই বাড়ির বড় ছেলে।সবার আগে ওই তো আমাকে চাচী বলে ডেকেছে । ও হয়তো অনেক বড় অন্যায় করেছে, কিন্তু তাই বলে বাড়ির ছেলেকে এতো দিন জেলে থাকতে দেখতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। সেখানে আপনার কি কষ্ট হচ্ছে তা আমি টের পাই ভাবী।আপনার নির্ঘুম রাত, চোখের নিচের কালো দাগ সাক্ষী দেয় আপনার মনে প্রচন্ড যন্ত্রণা।
আর যার জন্য ওকে জেলে যেতে হয়েছে সে তো এখানে নেই এখন তাহলে কেনো ছেলেটা কষ্ট পাবে?শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষ ভুল করে। আদনান হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতোদিনে। ওকে আর শাস্তি দিয়েন না।”
আদিবা বেগম হাসনা বেগমকে ছেড়ে দিয়ে আদনানের সামনে এসে দাঁড়ালেন।তারপর হঠাৎ করেই আদনানের চুলে খামচি দিয়ে ধরে বললেন,”এখনই ক্ষমা চা তুই হাসনার পায়ে ধরে। তোকে দুধকলা দিয়ে সবাই আদর করে পুষেছে পরিবারের বড় ছেলে বলে কিন্তু সেই তুই কালসাপ হয়ে ছোবল দিলি বাড়ির মেয়েকে।ক্ষমা চা তোর চাচীর পা ধরে। ওর জায়গায় আমি থাকলে জীবনে ও তোকে ছাড়িয়ে আনতাম না।”
আদনান মাথা নিচু করে বললো, “জানি মা।এটুকু বুঝতে পারছি এতোদিনে সবাইকে কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছি। আমি আর দেশে থাকবো না মা।তোমাদের সবাইকে সুখী করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাহিরের দেশে চলে যাবো।তখন আর তোমাদের কারো আমাকে নিয়ে ভয় পেতে হবে না।
আমার একটাই আফসোস মা,আমার মনের কথাটা আমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারি নি।”
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৯)
দেখতে দেখতে ২ মাস কেটে গেলো। শীতের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে ধ্রুবর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। বন্ধুদের থেকে বেশ কিছু টাকা পয়সা ধার করতে হলো ধ্রুবকে যেই সময় শালুকের টাইফয়েড হলো।
ধ্রুবর তখন দিশেহারা অবস্থা। শালুক একা বাসায় থাকে,এদিকে নিজের পরীক্ষা, চাকরি,টিউশন।
কি করবে ধ্রুব ভেবে উঠতে পারলো না।
শেষে ঠিক করলো শালুকের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত একজন মহিলা রাখবে বাসায়।ধ্রুবর অনুপস্থিতিতে সে যাতে শালুককে দেখে রাখতে পারে।
কিন্তু বললেই তো হয়ে যায় না কোনো কাজ।কাকে রাখবে,যাকে রাখবে সে কতোটুকু বিশ্বস্ত তা ও তো জানতে হবে।
শেষে ধ্রুব বাড়িওয়ালার কাছে গেলো। তাকে নিজের সমস্যা খুলে বলতেই তিনি তার বাসায় কাজ করে এরকম একজন মহিলাকে পাঠালেন।
তার কাজ হচ্ছে শালুককে সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো। শালুকের কিছু লাগলে এগিয়ে দেওয়া।এটুকুই কাজ তার।
প্রায় ১২ দিনের জ্বরে শালুকের চেহারা মলিন হয়ে গেছে, মাথার চুল সব ঝরে পড়ছে, ভীষণ শুকিয়ে গেছে শালুক।
ধ্রুবর ভীষণ কষ্ট হয় শালুকের দিকে তাকালে।
এক দিকে হাতে টাকা পয়সার টানাটানি, আবার অন্যদিকে শালুকের চিকিৎসা, বাসায় একজন মহিলা রাখায় তার মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন।
ধ্রুব তবুও নিজেকে সামলে নিলো। কিছুতেই ভেঙে পড়বে না বলে বারবার নিজেকে নিজে বুঝাতে লাগলো।
বিপদ যিনি দেয়,তিনিই আবার বিপদ মুক্ত করেন।
রোজ বাসায় যাবার সময় ধ্রুব ফল নিয়ে যায়,নিজের হাতে কেটে শালুককে খাওয়ায়।দিনে নিজে থাকতে পারে না যখন ঘন্টায় ঘন্টায় কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে শালুক কি খেলো না খেলো।
অভাব অনটন, প্রেম ভালোবাসা সব কিছু নিয়ে দুজনের দিন কেটে যাচ্ছিলো।
কিন্তু এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া আরো দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলো।
সেই মুহুর্তে ধ্রুবর মনে হলো পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে তার।
এমনতেই প্রায় ২২-২৩ হাজার টাকার মতো ধার করতে হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া আরো বাড়ানোর জন্য সংসার খরচ চার হাজার থেকে নামিয়ে দুই হাজারে আনতে হলো।
শালুকের এই মুহূর্তে পুষ্টিকর খাবার দরকার একদিকে।
ধ্রুব টিউশনি শেষ করে রাস্তার পাশে বসে রইলো।
এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার চাইতে অসহায় এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার পরেও তাকে ভালো রাখতে পারছে না সে।
হতাশায় নিমজ্জিত হলো ধ্রুব।বাসায় যাওয়ার মতো অবশিষ্ট শক্তি ও যেনো তার দেহে নেই।
অনেকক্ষণ পথে বসে থাকার পর ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে গেলো কোনোমতে।
শালুক জেগেই ছিলো ধ্রুবর অপেক্ষায়। শালুকের শরীর এখন আগের চাইতে অনেকটা ভালো।ধ্রুবর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আজ নিজেই রান্না করেছে শালুক। বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি, ভাত,ডাল,বেগুন দিয়ে শুঁটকি আর বেগুন ভর্তা বানিয়েছে।
ধ্রুবর হঠাৎ করে মনে হলো, এখন তো রান্না করতে হবে। এতো দেরিতে রান্না করলে শালুক কখন খাবে।
নিজের উপর ভীষণ রাগ উঠলো ধ্রুবর।এতোটা বেখেয়ালি হলো কিভাবে সে এটাই ভেবে পেলো না। কেনো এতোক্ষণ বাহিরে সময় নষ্ট করলো!
পরমুহূর্তে ঠিক করলো শালুকের জন্য হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসবে।নয়তো শালুকের খাওয়ার খুব দেরি হবে।
ধ্রুব কে আবারও বের হতে দেখে শালুক আটকালো।সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছেন এখন আবার? এমনিতেই তো দেরি করে বাসায় ফিরেছেন।”
ধ্রুব মাথা চুলকে বললো, “একটু বাহিরে যাচ্ছি। রান্না করতে তো দেরি হয়ে যাবে,তোমার ও খেতে দেরি হবে তখন।তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি গিয়ে। ”
শালুক হাত চেপে ধরে বললো, “কোনো দরকার নেই।আমি রান্না করেছি আজ।আসুন খাবার খাবো।”
ধ্রুব তাকিয়ে রইলো শালুকের দিকে। তারপর বললো, “তোমার রান্না করার কি দরকার ছিলো? তোমার শরীর এখনো ঠিক হয় নি শালুক। ডিম সিদ্ধ করেছো?”
শালুক মাথা নাড়িয়ে জানালো, করে নি।
ধ্রুব কথা না বাড়িয়ে চুলায় ডিম সিদ্ধ দিলো।তারপর ঢাকনা সরিয়ে দেখলো শুঁটকি রান্না করেছে শালুক। হতভম্ব হয়ে গেলো ধ্রুব।বাহিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো শালুক? ”
শালুক বললো, “এতো অবাক হওয়ার কি আছে?আমি কি রান্না করতে পারি না না কি?খুব ভালো না হলেও তো,কিছুটা পারি।খাওয়া যায় আমার রান্না।আপনার মতো হয়তো সেরা রাঁধুনি না আমি। ”
ধ্রুব হতবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো?”
শালুক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”সমস্যা কি?”
ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “তুমি শুঁটকি রান্না করেছ শালুক! এটাই তো আমার জন্য আশ্চর্যের ব্যাপার। ”
শালুক মাথা নিচু করে বললো, “আপনার তো অনেক প্রিয় একটা খাবার। তাই ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি।হালাল খাবারই তো এটা তাহলে কেনো এতো নাক সিঁটকাই।সেই জন্য রান্না করেছি।”
ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “আমি জানি শালুক তুমি কেনো আজ শুঁটকি রান্না করতে চেষ্টা করেছ।ফ্রিজে মাছ মাংস কিছুই নেই।”
শালুক ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর বললো, “আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না এসব।প্রতিদিন কিভাবে মানুষ মাছ মাংস খেতে পারে আপনি বলুন?আপনি নিজেও তো পারেন না।প্রতিদিন আমাকে খাওয়ান,নিজে খান না ”
ধ্রুব চুপ হয়ে গেলো। শালুক আস্তে করে বললো, “ভাড়া বাড়িয়েছে বলেছে আপনাকে?”
ধ্রুব চমকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এই কথা কে বলেছে?”
শালুক মুচকি হেসে বললো, “বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছে বিকেলে।উনি বলেছেন।”
ধ্রুব খাবার সাজাতে সাজাতে বললো, “তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।আমি আছি তো।”
শালুক খেতে খেতে বললো, “আপনার তো একটা টিউশন ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি আজকে বসে বসে হিসেব করেছি।আর আজকেই জীবনের বড় হিসেব মেলাতে পেরেছি।আপনার চিন্তার কারণ বের করতে পেরেছি। ”
ধ্রুব খাওয়া বন্ধ করে বললো, “কি বলছো তুমি? ”
শালুক হাসলো। জ্বরে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের নিচে কালি জমেছে শালুকের। চোখ বড় বড় লাগছে আগের চাইতে এখন।ধ্রুবর মনে হলো এই বুঝি বনলতা সেনের সেই পাখির বাসার মতো বড় বড় চোখ!
হেসে শালুক বললো, “আপনি আবারও নিশাকে পড়ানো শুরু করেন।”
ধ্রুব চোখ মুখ শক্ত করে বললো, “বাজে কথা বলবে না শালুক। ”
শালুক বললো, “আপনার মেইন চিন্তা তো এটাই,উপার্জন কমে গেছে,তার উপর সামনের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে ১৭ হাজার টাকা। আমি বুঝতে পারছি আপনার মানসিক পেরেশানি কতোটা এই মুহূর্তে। তার মধ্যে আমার ও এরকম জ্বর হলো। নিশ্চয় আপনাকে অনেক ধারদেনা করতে হয়েছে। এই সময়ে এতো খরচের মধ্যে আমার জন্য একজন বাড়তি মানুষ রাখতে হয়েছে। আমি খুব ছোট নই যে এসব বুঝবো না।”
ধ্রুব খাওয়া শেষ করে বললো, “এতটা বড় ও হয়ে যাও নি যে এতো চিন্তা তোমার করতে হবে এই সময়। আমি আছি তো।আমাকে ভাবতে দাও।”
খাওয়ার পর শালুকের ঔষধ এনে খাইয়ে দিলো ধ্রুব।বিছানায় শুয়ে তারপর বললো, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শালুক। তোমাকে কোনো লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিই,আমি আমার হলে চলে যাবো।”
শালুক হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার কাছ থেকে এক চুল দূরে ও আমি যাবো না।এসব চিন্তা বাদ দিন আপনি। ”
ধ্রুব হাসলো। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললো, “কাছে ও তো আসো না আমার। ”
শালুক তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে বললো, “এই যে কাছে আছি। ”
ধ্রুব শালুকের হাত চেপে ধরে বললো, “আরো কাছে আসা যায় না?যতো কাছে আসলে দুজন মিশে একাকার হয়ে যেতে পারবো? ”
শালুক লজ্জা পেয়ে মাথা লুকালো ধ্রুবর বুকে।ফিসফিস করে বললো, “ভীষণ ঠান্ডা পড়ছে।”
ধ্রুব ও শালুকের মতো ফিসফিস করে বললো, “তাহলে আরো ঠান্ডা লাগুক তোমার শালুক। ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা লাগুক, যাতে আমি হই তোমার উষ্ণতার চাদর।”
প্রথমবারের মতো দুজনের মধ্যে ভীষণ ভালোবাসার লেনাদেনা হলো,প্রবল শীতের রাতে দুজনে একে অন্যকে উষ্ণ করে তুলতে লাগলো। সেই রাতে তৃপ্ত হলো দুজনের চাতক মন।
শালুক সকালে ধ্রুবকে বকতে লাগলো। ধ্রুব হাসতে লাগলো। এক অজানা সুখে ধ্রুবর দেহ মন তৃপ্ত হয়ে আছে।সোয়েটারের উপর শালুক চাদর জড়িয়ে নিলো।তবুও যেনো শীত কমছে না তার।
ধ্রুবকে সে কথা বলতেই ধ্রুব হেসে বললো, “আসো তাহলে, আবারও উষ্ণ করে দিই তোমাকে। ”
শালুক লজ্জায় লাল হয়ে বললো, “দূর,আপনি ভীষণ খারাপ। এর চাইতে ভালো আমাকে লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিন।”
ধ্রুব শালুকের পাশে বসে হেসে বললো, “এখন যে আমি কিছুতেই তোমাকে ছাড়বো না বোকা ফুল,ফুলটাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিলে রাতে তার শীত করলে আমি তো তার শীত দূর করতে পারবো না। এখন যে তোমাকে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিজের সাথে। ”
শালুক বললো, “একটা কথা বলি,রাগ করবেন না বলুন।”
ধ্রুব বললো, “আচ্ছা, বলো।”
শালুক বললো, “আমরা এই বাসাটা ছেড়ে দিই।এতো বড় বাসার তো আমাদের কোনো দরকার নেই তাই না?আমরা দুজন মানুষ। একটা রুম হলেও আমাদের চলে যাবে।অযথা ১৭ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকার কি দরকার তাহলে? ছোট একটা বাসা নিন আপনি, এক রুমের হলে আরো ভালো হয়।এতে করে আমাদের সব দিক থেকেই সুবিধা হবে।”
ধ্রুব অপলক তাকিয়ে থেকে বললো, “অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই শালুক। তোর মনে আছে, ছোট বেলায় এই তুই ভীষণ জেদ করতি আমার ছাদে একটা রুম আছে তোর নেই কেনো এটা নিয়ে। তুই বলতি তোর ভীষণ বড় রুম লাগবে।জোর করে ছাদের একটা ঘর দখল করেছিস তুই।আর আজ সেই তুই কি সুন্দর করে বলছিস একটা ছোট রুম হলেই চলবে।
সময় কেমন করে খেলে মানুষকে নিয়ে, তাই না শালুক?
ছিলি কোথায় রাজ বাড়িতে, আমার জন্য তোকে এখন থাকতে হচ্ছে গাছতলায়। ”
শালুক ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে বললো, “সেখানে আমি রাজকন্যা ছিলাম,অতিথি ছিলাম।সেই রাজমহল আমার আজীবনের জন্য ছিলো না। এখন আমার যা আছে তা একান্তই আমার। এখানে আমি রানী,সর্বাধিকারী এই রাজ্যের। এটাই যে আমার জন্য চিরস্থায়ী ঠিকানা। আপনি সাথে থাকলে আমি সব জায়গায়, সব পরিবেশে থাকতে পারবো। আপনি ও তো ছিলেন সেই রাজ্যের যুবরাজ। আপনার যদি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে আমার কেনো থাকবে না।”
ধ্রুব একটা চুমু খেয়ে বললো, “কথা দিচ্ছি শালুক,একদিন একটা রাজবাড়ী করে দিবো তোমায়।”
সেদিন আর ধ্রুব শো রুমে গেলো না,বহুদিন পর দুজন বের হলো বাহিরে।একই সাথে কিছুটা ঘুরাঘুরি ও হবে,বাসা দেখা ও হবে।
এবার আর রেষ্টুরেন্ট যাওয়া হলো না,টং দোকানের চা রুটি, ফুচকা,চটপটি খেয়ে আনন্দ চিত্তে দুজন বাসা খুঁজে বের করলো।
চলবে……
রাজিয়া রহমান
চলবে….
রাজিয়া রহমান
রাজিয়া রহমান