তুমি আছো তুমি রবে পর্ব -১৮

#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১৮ #রেহানা_পুতুল
দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার আলো আঁধারি ছুঁইছুইঁ করছে ধরনীর কোলে। নদীর বুকে স্রোতময় বিস্তৃত জলরাশি। মাথার উপরে উদার আকাশের বিশালতা।

ঝিনুকের উদাস দৃষ্টি মিলিয়ে যায় সাদা মেঘ কেটে নীড়ে ফেরা উড়ন্ত গাঙচিলের পানে। প্রণয়ের ভেলায় ভেসে যাচ্ছে দুটি হৃদয়।

খানিকপরেই আকাশে উঁকি দিবে পাণ্ডুর চাঁদ। তার রহস্যময় আলো ছড়িয়ে পড়ে নদীতরঙ্গে এক আলোছায়ার মায়াবী রূপ খেলা করবে। নিস্তরঙ্গ নদীর স্বচ্ছ টলটলে জলে অবাধে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে ঝিনুকের। এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে মাঝিও যেন ক্লান্ত।

তার ডাকে আরশাদের ধ্যান ভাঙে।
মামা চারদিক আন্ধার হয়ে গেলো। সব ঘাট ঘোরা হলো। এবার কই যামু?

আরশাদ উপরে মুখ তুলে হাই ছাড়ে। সামনের ঘাটেই ভিড়ান। আমরা টং দোকান থেকে কিছু খাবো। তারপরেই যে ঘাট থেকে উঠেছি,সে ঘাটে নামিয়ে দিবেন।

নৌকা ভিড়ানো হলো। ঝিনুক আহ্লাদী সুরে,
আমি চিতই পিঠা খাব মরিচ ভর্তা আর শুটকির ঝাল ঝাল ভর্তা দিয়ে।

আরশাদ হেসে জিজ্ঞেস করলো, আর কি খাবে?

রঙ চা খাব।
আর?
চানাচুর ভর্তা খাব।
আর?
দুই ফুচকা খাব।
আর?
আর কিছুইনা।

এখানে সব পদ খাওয়া নিষেধ?

ঝিনুক ঢং মাখা কন্ঠে, কার নিষেধ?
আমার।
কারণ?

কারণ ভর্তা,চানাচুর,শুটকি এসব খেলে রাতে আমার গুরুতর সমস্যা হবে।

ঝিনুক নাক কুঁচকে উহু, খাব আমি সমস্যা হবে আপনার? ক্লিয়ার করেন বলছি।

ক্লিয়ার করা যাবেনা জনসম্মুখে। বুঝে নিতে হবে।

হুহু। আজাইরা। আমি খাবই খাব।

ঝিনুক পছন্দের সবকিছু এক এক করে খেয়ে নিলো। আরশাদ ও নিজের পছন্দ মতে সামান্য কিছু খেলো।

ঝিনুক বলল, দূরে চেয়ে দেখুন। সন্ধ্যার পরে বুড়িগঙ্গার এপাড়ে এলে গ্রামের স্বাদ পাওয়া যায়। কি ঝিরিঝিরি বাতাস। উফফস! কি যে প্রশান্তি লাগছে। শুনলাম শ্যামল বাংলা নামে এখানে একটা রিসোর্ট আছে। দেখতে নাকি মনোরম?

হুম জানি। তুমি এসেছে কখনো?
নাতো।

আজ ও চাইলে আমরা যেতে পারতাম। কিন্তু নদীর মাঝেই যে আমরা সময় শেষ করলাম।

সেটা কার জন্য? ডাগর চোখের পাতা দুটোকে নাচিয়ে জানতে চাইলো ঝিনুক।

যদি বলি তোমার জন্য। তুমি বললে নৌকায় চড়া তোমার দারুন পছন্দ। তাইতো নদীর বুকেই ভেসে ভেসে ঘুরলাম আমরা। এবার চলো। মাঝি বিরক্ত হয়ে যাবে।

এভাবে এক বিকেল সন্ধ্যা তুমুল আনন্দ শেষে বাসায় ফিরে এলো দুজনে। রুমে গিয়ে ফ্রেস হলো । রাতে ডিনার শেষে ডাইনিং এ বসেই সবাই গল্প করছে। তখন জামান খান জানালেন,
আরশাদ কাল তোর চায়না যেতে হবে জরুরি।

আরশাদ মন খারাপ করে ফেললো। কালই বাবা?

হুম কালই। সমস্যা কি। সবসময় তো এমন যাচ্ছিস তুই। ফ্যাক্টরিতে একটা মালের ডাইস ভেঙ্গে গিয়েছে। তুই চায়নার যে ফ্যাক্টরি থেকে আগে বানিয়েছিস ডাইসটা। ওখান থেকেই বানিয়ে নিবি। আমার সাথে তাদের কন্টাক হয়েছে। খরচ কম পড়বে এবার।

আরশাদ বলল ওখানে গেলেতো পনেরোদিন লেগে যায় কাজ গুছিয়ে নিতে। আচ্ছা যাব বাবা।

শুনে স্বস্তির দম ফেললেন জামান খান ও জোবেদা বেগম।

আরশাদ চোরাচোখে ঝিনুকের দিকে একবার চাইলো। লক্ষ্য করলো ঝিনুকের সারামুখজুড়ে অমাবস্যা নেমে এসেছে। রাতে ঝিনুককে বুকে নিয়ে আরশাদ শুয়ে গেলো। ঝিনুকের দিক থেকে কোনকিছুতেই কোন বারণ নেই।

কিন্তু আরশাদ মনে মনে ভাবছে, কোনকিছুর স্বাদ একবার পেয়ে পরে দূরত্ব তৈরি হলে কষ্ট অনুভূত হয় প্রবল। না পেলে তেমন হয়না। কারণ এর স্বাদ কেমন সেটাই ত জানা হলোনা। আবার ভাবছে এতদূরে যাবো, স্বর্গীয় সুখটাকে সম্বল করেই যাব নাকি। এমন দ্বিমুখী ভাবনায় আরশাদ দুলছে। ঝিনুক মুখ গুঁজে রইলো আরশাদের বুকে।
আরশাদ ভেবে দেখলো ঝিনুকের এখনো আড়ষ্টতা কাটেনি। দুজনের সম অনুভূতি কাজ না করলে পরিপূর্ণতা আসেনা কোনকিছুতেই।

আরশাদ ঝিনুকের কানের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিলো। মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে,
এই ঝিনুক উঠো।

ঝিনুক আধভাঙ্গা গলায়,নাকি নাকি সুরে বলল, কেন? ঘুমাব আমি।

আমিতো কাল চলে যাচ্ছি। এখন ভালোবাসার সুরা পান করে বেহুঁশ হবো তুমি আমি । আরশাদ উঠে গিয়ে আলমারি খোলে। বিকেলে এনে লুকিয়ে রাখা দুটো বিয়ারের বোতল বের করে। ঝিনুক ঘোর আপত্তি করে।
প্লিজ খাও বউ। আরেহ ড্রিংকস এর মধ্যে সবচেয়ে নরমাল হলো এটা। খাওনা বলে বিয়ারের ছিপি খোলে। গ্লাসে ঢেলে ঝিনুককে পান করায়। ঝিনুক সব খেতে পারেনা। আরশাদ নিজের বোতলের ও বাকি বোতলের সব অনায়াসে শেষ করে ফেলে।

ঝিনুক এলানো দেহমন নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। আরশাদের চোখ লালবর্ণ ধারণ করে। যেন বহুদিনের প্রতিক্ষারত বনের ক্ষুধার্ত পশু। কামুক থেকে কামুকতা আচ্ছন্ন করে তাকে। ঝিনুকের ও সুপ্ত হৃদয়ের চিলেকোঠায় স্বামীকে একান্ত করে পাওয়ার তীব্র বাসনা জেগে উঠে নদীর শুকনো চরের মতো।

রাতের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে দুটো দেহ এক হয়ে মিশে যায়। গলাগলি করতে করতে তারা পূর্ণ মাতাল হয়ে উঠে। পরিপাটি বিছানা হয়ে যায় ওলট পালট। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখন তাদের মুঠোয় বন্ধী। মনে হয় অনাদিকালের সুখ উপভোগের প্রতিজ্ঞা করেছে তারা এই গভীর রাতে। যেন স্মরনীয় করে রাখতে মগ্ন এই দীর্ঘ সময়ের অপার্থিব আনন্দটুকুকে।

সকালে ঝিনুক আরশাদের আগেই উঠে গিয়ে শাওয়ার নেয়। চুলকে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নেই। যেন অন্যরা না বুঝতে পারে। আরশাদ ও তারপরে উঠে যায়। শাওয়ার নিয়ে নেয়। লাগেজ গুছিয়ে নেয় বের হওয়ার জন্য। রুম থেকে বের হওয়ার আগে ঝিনুকের কপালে মোলায়েল করে চুমু খায়। চোখ চোখ রেখে বলে শুকরিয়া ঝিনুক আমাকে রাতে শ্রেষ্ঠ সুখ দেওয়ার জন্য। ঝিনুক লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। আরশাদকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। আরশাদ নাস্তা খেয়ে বের হয়ে যায় মা, বাবা,বোন থেকে বিদায় নিয়ে।

ঝিনুক ক্লাসে চলে যায়। কেমন যেন উড়ুউড়ু লাগছে তার। কিছুই ভালোলাগছেনা। বন্ধুদের সাথে পড়া নিয়ে,পরিক্ষা নিয়ে আলাপ চলে।

হাসিব ক্লাসে ঢুকতেই জুলি বলল,
ওই যে আমাদের টাউট বয় এসেছে। কিরে টাউট আজ এত দেরি যে?

হাসিব ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কিছু বলছিস?

ঝিনুক বলল, কিরে তোরে কি বোবা ভূতে ধরল নাকি?

হাসিব ব্যাগ থেকে তার একটি খাতা বের করলো, কিছু লিখলো। অতঃপর খাতাটি এগিয়ে দিলো তাদের সামনে।

” গতকাল বিকেলে আব্বুসহ শপিং এ গিয়েছি। রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখে মনে হলো আমার জিএফ রুমা। আনমনা হয়ে আব্বুকে বললাম, দোস্ত দেখ তোর ভাবি। কি সুন্দর না? এরপর থেকেই কানে শুনিনা আর। ”

ওহ মাই গড! বলে পুরো ক্লাসের সবগুলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

ঝিনুক বলল,তোরে কেন আমরা পটকা, টাউট বলি বুঝলিতো এবার বয়রা হাসিব ?

হাসিব কান চেপে ধরে উঃ করে নিজের সিটে গিয়ে বসলো।

ঝিনুকের বাবার নতুন ব্যাবসা ধীরে ধীরে লাভজনক হচ্ছে। আগের মতো তাদের এখন টেনেটুনে মাস পার করতে হয়না। জামান খান থেকে ঋন নেওয়া টাকাও নির্ধারিত হারে প্রতি মাস শেষে দিয়ে দিচ্ছে।

ব্যাবসায়ীক নানাকারণে দুইমাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও আরশাদ দেশে ফিরতে পারছেনা। ঝিনুকের সাথে রোজ ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিং হয়। ভিডিও ফোনেও গল্প হয়। রোজকার বাসার খোঁজ খবর নিতেও ভুল করেনা।

ঝিনুকের সাথে এক বিকেলে আরশাদের অল্পস্বল্প মনোমালিন্য হয়। কারণ ঝিনুক ফেসবুকে বন্ধুরাসহ তোলা একটি গ্রুপ ছবি আপলোড দিয়েছে। আরশাদ ঝুম করে সে ছবিতে দেখলো ঝিনুকের কাঁধে একটি অচেনা ছেলের হাত। এটা আরশাদকে পীড়িত করেছে। ঝিনুক ও রাগ করে কথা বলা বন্ধ দিলো।

বিয়ের অপর নাম নতুন জীবন। অনেকটা শরৎকালের পাতার রঙের মতো। পরিবর্তনশীল অত্যাশ্চর্য সুন্দর। শুরুতেই পাওয়া যায় না বরং তা ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে।

দাম্পত্যজীবনকে গুরুত্বপূর্ণ ও মধুর করে তুলতে দুজনের মাঝে রাগ,অভিমান,অনুরাগ,অনুযোগ, ঝগড়া,টুকটাক ভুল বোঝা, এসবের প্রয়োজন রয়েছে। নয়তো পথচলাতে একগেঁয়েমি চলে আসে। সম্পর্ক হয়ে উঠে খসখসে পলেস্তরার মতো।

আরশাদ ও দুদিন হেয়ালি করে কোন যোগাযোগ করেনি। কিন্তু মন পড়ে থাকে ঝিনুকের কাছেই। ঝিনুকের ও একি হাল। কোন মেসেজ এলো কিনা একটু পর পর চেক করে দেখে।

আরশাদ ঝিনুককে ভেবে,
কি রাগ তার। একটু কিছু বলাও যায়না। গরম তেলের মতো ছ্যাত করে উঠে। থাক আমি একটা মেসেজ দিই। আগে থেকে স্বাভাবিক না করলে ঢাকায় গেলে আমাকেই পস্তাতে হবে।

” যেদিন তুমি এলে আমার শূন্য এ ভুবনে।
বুঝিনিকো নিঃস্ব হবো তোমায় ভালোবেসে।

দিনে দিনে হলে তুমি কত যে আপন
তোমায় নিয়ে পাড়ি দিব সাধের এ জনম।
যদি কভু যাও হারিয়ে সত্যি যাব মরে।
তুমি আছো তুমি রবে চিরদিনই আমার হয়ে। ”

মেসেজ পড়ে ঝিনুক আপন মনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। মোবাইলটা অধরের মাঝখানে চেপে ধরলো। কবিতাটির উপর চুমু খেলো। বিড়বিড়িয়ে,
ইসসরে! প্রেমিক কবি সাজার কি চেষ্টা।

আর কত রাত একা থাকব। গুনগুনিয়ে গানটি গাইতে গাইতে । মেসেজের রিপ্লাই দিলো,
‘ এবার আসুক তারেএএ আমি মজা দেখাবো। ‘

আরশাদ রিপ্লাই দিলো,
মজা নিতে সদা এক চরণে রাজি এ অধম।

দেখতে দেখতে ঝিনুকের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ গেলো। রেজাল্ট ও দিয়ে দিল নিদিষ্ট সময়ে । আরশাদ দেশে চলে আসলো। ঝিনুককে কয়েক স্থানে ভর্তি পরিক্ষা দিতে বলল। ঝিনুক সরকারি যেগুলোতে চান্স পেলো। সেগুলো বাসা থেকে দূরে। অবশেষে সবার সম্মতিতে তার পছন্দের ভার্সিটিতে ভর্তি হলো।

আরিশার বিয়ের লঘন এলো। দুদিন বাদেই আরিশার হলুদ সন্ধ্যা। পুরো বাডিজুড়ে সাজসাজ রব। গায়ে হলুদের নাচের রিহার্সাল চলছে। ঝিনুক যেহেতু নাচ জানে তাই হলুদ রাতে আরশাদ ঝিনুক ও নাচবে সিদ্ধান্ত হলো।

জোরে গান বাজছে। সে গানের তালে তালে রিহার্সাল চলছে। যার যাকে ভালো লাগে তার হাত ও কোমর ধরেই দুলে দুলে নেচে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে মিলে। আবার মেয়ে মেয়ে ও মিলে। আরিশাও নাচচে তার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে।

আরশাদ রুমের পর্দা ফাঁক করে দেখে ঝিনুকের হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ভিতর তার খালাত ভাইয়ের হাত। দুজনে নেচে চলছে উচ্ছ্বল হাসিতে মাখামাখি করতে করতে।
নিমিষেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো সে । ঝিনুককে কিছুই বললনা। ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পানির বড় একটা মগ হাতে নিল। মেঝেতে জোরে আছাড় মারলো। কাচের ঝনঝন শব্দে সবার মাঝে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করলো।

চলবেঃ ১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here