প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৭)
দেখতে দেখতে রাত গড়ালো, আঁখি যাওয়ার পর আদ্রিশ প্রচন্ড রা*গে তার কক্ষের জিনিস ভাং*চুর করেছে তারপর বাইরে কোথাও চলে গিয়েছিল,কাজের লোক দিয়ে কক্ষ পরিষ্কার করিয়েছে রিদিকা,এবার আদ্রিশ ঘরে ফিরল,রিদিকা আদ্রিশের জন্য অপেক্ষা করছিল তার কক্ষেই আদ্রিশ আসতেই হাসিমুখে তার পাশে গেল এগিয়ে।
″তুমি এসেছ,কোথায় গিয়েছিলে?সেই সকালে বের হয়েছিলে আর এখন আসছ,এত কল দিলাম একটাও ধরলে না,আমার চিন্তা হয় না বুঝি তোমার জন্য?ফ্রেস হয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি,খাবে।″
″খাব না খিদে নেই,তুমি একটু একা ছেড়ে দাও আমায়,প্লিজ।″
কথাটা বলে আদ্রিশ রিদিকাকে পাশ কাটিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরল চিৎ হয়ে,রিদিকা এবার ওর মাথার পাশে এসে বসল,আদ্রিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বলল।
″আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি দেখবে খুব জলদি ঘুম চলে আসবে।″
″প্লিজ তুমি যাও,আমি ঠিক আছি।″
″আমি কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে,তাছাড়া আঁখি তো চলেই গেছে,এখন তো আর ফিরবে না,তাই এখন এখানে আমি থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই।″
″আঁখি ফিরবে,ওকে ফিরতেই হবে।আর ও আসুক না আসুক,ওর অবস্থান ওরই থাকবে আমার জীবনে।″
″ওর জন্য এত ভাবো আর আমার জন্য কোনো ভাবনা নেই তোমার মধ্যে, ওকে তো আমি বা তুমি যেতে বলি নি,ও নিজে থেকেই গেছে,আমি তো বলছি না ওকে ফিরিয়ে এনো না,ওর জায়গাও আমাকে দিতে বলছি না,তবে আমার জায়গা তো আমাকে দেওয়া যায়,না কি এক রাতেই মন ভরে গেল।″
″রিদিকা তোমাকে চলে যেতে বলেছি চলে যাবে,এত প্যাচাল করছ কেন?″
রিদিকা বেশ অভিমান নিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললে তার কথার প্রতিক্রিয়ায় গর্জে উঠে আদ্রিশ উক্ত কথা বলে উঠল।রিদিকা আর কিছু না বলে বেশ শব্দ করে কেঁদে ছুটে কক্ষ ত্যাগ করল।
বেশ বিরক্তিকর একটা অনুভুতি খেলিয়ে গেল মুহুর্তেই আদ্রিশের মনের ভিতর,তবে সেই বিরক্তিটা আসলো নিজের উপর,তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মনে সে এভাবে পী*ড়াদা*ন করতে চায় নি,অল্পসময় কথাটা নিয়ে অনেক গভীর ভাবনায় তলালো সে অতঃপর উঠে এগিয়ে গেল রিদিকার কক্ষের পানে।
আঁখি নিজের গাড়িতে করে নিজের করা বাড়িতে চলে আসলো,আঁখির সপ্ন মহল নাম রাখা বাড়িটার।বাড়িটা আঁখির নিজের টাকায় গড়া,স্বামী সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন থেকে আলাদা হওয়ার চিন্তা আঁখির কখনো ছিল না,কিন্তু আঁখির সেই ছোটবেলা থেকেই সপ্ন ছিল নিজের টাকায় একটা বাড়ি করবে,সেই সপ্নটা এই তো একমাস আগেই পূরণ হল,আঁখি ভেবেছিল বাড়িটা করলে কখনও কখনও বেড়াতে আসবে এখানে সবাইকে নিয়ে কিন্তু এটাই টার স্থায়ী আশ্রয় হবে ভাবনাটা কল্পনাতেও টোকা দেয় নি আঁখির কবুও,বাড়ির একটা কক্ষ বানিয়েছিল ওর আর আদ্রিশের জন্য,যেখানে তাদের সব রকমের ছবি টাঙানো ছিল,তাছাড়া আদ্রিশের পছন্দ অনুযায়ী বাড়িটা ডেকোরেট করেছিল আঁখি,ভেবেছিল ভালো একটা ছুটির দিন দেখে আদ্রিশকে এখানে নিয়ে এসে স্যারপ্রাইজ দিবে,সাথে সবাইকে নিয়ে এসে হৈ-হুল্লোড় করবে সারাদিন,কিন্তু কই হল তার আশা পূরণ,সুন্দর স্বপ্নগুলো সপ্ন রয়ে যাবে জানা থাকলে হয়ত তা কখনও ওভাবে সাজাত না আঁখি,ভা*ঙা এই অনুভুতির সাথে মানিয়ে নেওয়া যে কত দূরুহ হচ্ছে তা শুধু আঁখিই জানে,বাড়িতে এসেই কাজে লেগে গেল আঁখি,মন ভেঙে চু*র্ণবিচু*র্ণ তবে মনের সক্ষমতা এক চুলও কম হয় নি তার,শক্ত মানবীরুপে সরিয়ে নিল সব ছবি তার আর আদ্রিশের,সেগুলো ঠাই পেল স্টোররুমে এক কোণে,বাড়ির গার্ড আর কাজের লোক দিয়ে দিনে দিনে সব কিছুর সাজগোজ পাল্টে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাজাল সব আসবাবপত্র।এই বাড়ির দেখাশোনার জন্য সে কয়েকজন গার্ড আর কাজের দুজন লোক আগেই রেখেছিল।যাক সবকিছুই তার কাজে দিল,আজকে নিজে থেকেই আঁখি কাজে যায় নি,নিজের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাইল আজ সে।
হাতে আঁখির ছবি নিয়ে আজও বসে আছে আদৃত নামক সেই গম্ভীর পুরুষ,সবার কাছে তার গম্ভীর এই রুপখানা অটল থাকলেও আঁখির জন্য তার মন যে সবসময় এক পা*গ*ল উতলা প্রেমিক,কখনও তার সেই অ*কৃ*ত্রিম অসীম এই ভালোবাসা উপলব্ধি করানোর ক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি সেই কাঙ্ক্ষিত রমণীকে,আদৃত যে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল আর তার মাসুল প্রতিক্ষণে তাকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে আঁখির ছবি নিয়ে প্রায় দিনের মতই গল্পতে মশগুল আদৃত।
কি দেখছ এংরি বার্ড?দেখছ আমাকে?ঘৃ*ণা হচ্ছে না আমাকে দেখে বড্ড?হওয়ারই তো কথা, কখনও তোমার ভালোবাসার মর্ম দিতে পারি নি আর যখন দিতে চাইলাম তখন তুমি অন্য কারও হয়ে গেলে,জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুখটা তুমি অন্যতে পেয়ে গেলে,আমাকে নিজের প্রেমে আবদ্ধ করে দূরে চলে গেলে তুমি অনেক,অনেক সুখি আছো তাই না?হয়ত বিয়ে করে নিয়েছ,স্বামী সন্তান আছে তোমার।খুশি আছো তুমি আদ্রিশকে নিয়ে,তবে আমি যে সুখি নেই প্রিয়তমা,তোমার শোকে রোজ যে পোঁড়ে ম*র*তে হয় এই পা*ষা*ণ হৃদয়কে।
রিদিকা নিজের কক্ষের এক কর্ণে এসে দাঁড়িয়ে গেল,অতি আবেগ আর অভিমানে আবৃত হয়ে দুইহাতে মুখ চেঁপে বেশ শব্দ করেই কাঁদতে লাগল,আদ্রিশ পিছনে এল তার,নতুন বউকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ বিচলিত হল তার মনখানা,বুকের ভিতর আফসোসের এক সুর জাগ্রত হলো,তাই এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল রিদিকাকে,তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলত করে বলল।
ক্ষমা করা যায় না আমায়?ভালোবাসি বলেই তো ধমক দিলাম,আমার কি একটু রা*গারও অধিকার নেই?
রিদিকা এবার মুখ থেকে হাত সরালো,পিছন ফিরে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশকে,তার বুকে মাথা রেখে আহ্লাদি কন্ঠে বলল।
″সত্যিই ভালোবাসো?″
″হুম,ভালোবাসি।″
″তাহলে দূরে ঠেলে কেন দাও?″
উত্তরে আদ্রিশ কিছু বলল না।রিদিকা আবার বলল।
″এর মানে আমাকে পাশে রাখতে চাও না,ঠিক আছে কালকেই আমি আমার মা বাবার কাছে চলে যাব।″
″একদম বাজে বকবে না,তুমি কোথাও যাচ্ছো না।″
″এভাবে দূরত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না আদ্রিশ,হয়ত নিজের কাছে রাখো নয়ত দূরে পাঠিয়ে দাও।″
″আমি তোমাকে কোথাও দূরে পাঠাচ্ছি না।″
″তাহলে আপন করে নাও,ভালোবাসো আমায় যাতে আমি চাইলেও দূরে যেতে না পারি তোমার থেকে।″
রিদিকার আদ্রিশের বুক থেকে মুখ তুলে আহ্লাদী স্বরের উক্ত আবদার যেন ভুলিয়ে দিল আদ্রিশের সকল দুশ্চিন্তা,মাথায় চড়ল এক অদ্ভুত মোহের খেলা,রিদিকার নে*শা*ক্ত ডাকে সারা না দিয়ে পারল না আদ্রিশ,মুছে দিল হাত তুলে রিদিকার চোখের জল,দু’হাতের মধ্যেখানে রিদিকার মুখখানা আগলে নিয়ে এগিয়ে গেল তার অধরের ছোঁয়া পেতে।
একদিকে আদ্রিশ সুখের রাত্রী যাপন করছে ওপরদিকে আঁখি যাপন করছে বিনিদ্র রজনী,একা এই জীবনে আজ যে কাঁদতেও নেই কোন বারণ,একা দূর্বল পরারও তো কোনো ভয় নেই,কেউ অবলা বলে তো তাচ্ছিল্য করার থাকবে না, তাই একা এই ঘরে আজ বেশ শব্দ করেই কাঁদতে মগ্ন হল আঁখি,মা বাবার আদরের মেয়ে যার কান্নার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না কখনও দূর দূর অব্দি, দুঃখ যাকে কখনও ছুঁতেও পারে নি,তার বাবা যে ঢাল ছিল তার,তার নামে তার বাবার ছিল পৃথিবীর সকল সুখ।আজ সেই বাবার মেয়ে চিৎকার করে করে হেঁচকি টেনে কাঁদছে আর বলছে।
মা বাবা,দেখ না আজ তোমাদের এই পা*গ*ল মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে, আজ নেই কেউ তার চোখের পানি মুছে দেওয়ার মত,যার মধ্যে সকল সুখের আশ রেখেছিলাম,যার জন্য তোমাদের ছাড়তেও পিছপা হইনি সেই আজ আমায় কাঙাল করে ছেড়ে দিল,আজ তোমাদের কথা বড্ড মনে পরছে বাবা মা,তোমাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ারও কোনো সামর্থ্য নেই আমার,কোন মুখে যাব তোমাদের কাছে,আমি যে আমার ভাগের সাজাটা আজ পেয়ে গেছি বাবা দেখ,তুমি আর মা হলে হয়ত আজ আমার এ হাল হত না,কখনই এতটা ভেঙে পরতাম না আমি,আগলে নিতে তোমরা,কি করব নিজের দোষে সব হারিয়েছি,হারিয়েছি তোমাদের,পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়,এই অভাগীকে আর অভিশাপ দিও না তোমরা সে যে আর সইতে পারবে না।
ফোনের রিংটনে বেশ বিরক্ত হল আদৃত,আঁখির ছবি থেকে চোখ হটিয়ে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির করল,মা লেখাটা চোখে ভেসে আসায় বিরক্তি দূর হল মুহুর্তেই,ফোনটা রিসিভ করে বলল।
আসসালামু আলাইকুম আম্মু, কেমন আছো।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছিস বাবা?
এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?আর বাবা?
আমি আর তোর বাবা দু’জনই ভালো আছি। বলছিলাম কি ইশিকার তো একটা মেয়ে হয়েছে,তুই তো ছবিতে দেখেছিস ওকে,সামনাসামনি দেখতে বুঝি মন চায় না ওকে তোর?তুই আবারও মামা হয়েছিস,এবার তো চলে আয় দেশে আর কতদিন পরিবার থেকে দূরে থাকবি,ইশিকা বড্ড করে চাইছে তোকে দেখবে।
আসলে মা এখানে কাজের অনেক চাপ,চাইলেও আসতে পারি না,তা এখন রাখি একটা সার্জারি আছে ফ্রি হয়ে কল করব তোমায়।
কথাটা বলেই কল কেটে দেয় আদৃত,মায়ের সাথে জোর দিয়ে কখনও মিথ্যে বলার ক্ষমতা বা অভ্যেস কিছুই তার নেই,সর্বদা সত্য বলা আদৃত আজ দেশে ফিরার নামে নিজের জননীর সাথেই মিথ্যে বলে,কী বা করার আছে এই কঠিন পুরুষের,দেশে ফিরার নামে যে তার বুকের ভিতরের মোচড়ের পরিমাণটা হাজারগুণ বেড়ে যায়।
সুখের অনেকক্ষণ কাটানোর পর শান্তির এক নিদ্রা যাপন করছে রিদিকা তবে পাশে শুয়ে থাকা শ্যামবর্ণের সেই মায়াবী চেহারার অধিকারী পুরুষের ঘুম নেই,হাতে নিয়েছে ফোন,সুখের ক্ষণ পেরিয়ে গেলে মাথায় আবারও ভর করল আঁখির দুঃ*চিন্তা, তাই তাকে হুটহাট কিছু ম্যাসেজ করবে ভাবল।তবে এ কী! কোনোভাবেই আঁখির সাথে যোগাযোগ
করতে সক্ষম হল না আদ্রিশ,সবকিছুতেই আঁখি ব্লক করেছে তাকে,বন্ধ করেছে তার আঁখির খোঁজ নেওয়ার সকল রাস্তা, যা ক্ষণিকে মনে অস্থিরতার যোগান দিল আদ্রিশের।
সাত সকালে আরিয়ান মির্জা সাহেবের কপালে চিন্তার বেশ কটা ভাজ পরল,উক্ত অবস্থা তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাতসকালে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে হল উনার,উনি জানেন তার স্ত্রীর কান্নার কারণ,এটা যে এখন প্রায় দিনেরই কান্ড মিসেস শায়লা মির্জার,বেশ নিরাশতা নিয়ে উনি শায়লা মির্জার কাছে এসে বসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন।
″কেন কাঁদো শায়লা?ছেলে কাজ করে ওখানে,ওর ওখানে কাজ করতে পছন্দ তাই, করতে দাও না তাকে তার কাজ,এমনি তো সারাদিন কথা বলো,কখনও কখনও মধ্যরাতে উঠে কল দাও কাল রাতে যেমনটা দিলে,এভাবে ওর সাথে কথা বল প্রায় সারাদিনই আর কি চাই তোমার?″
″আমার আর কিছু চাই না,আমার শুধু আমার ছেলেকে চাই।সেই ৬ বছর আগে হঠাৎ করে কেন চলে গেল!আর কেন আসে না ফিরে বাড়িতে! বাবা হয়ে কি কখনও জানার চেষ্টা করেছ?আমি কিছুই জানি না তুমি যে করে পার আমার ছেলেকে এনে দাও,নইলে আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।″
কথাটা বলে শায়লা মির্জা বেশ রাগ দেখিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।আরিয়ান মির্জা ব্যার্থতায় ভরা এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
চলবে…….
আরোহী নুর……….।