— রাফিদ তোমার মাকে বুঝাও। সে যেনো সংসারে অ*শান্তি সৃষ্টির চেষ্টা না করে ।
ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নিজের প্রানপ্রিয় স্ত্রীর কণ্ঠে স্পষ্ট ক্রো*ধ খুঁজে পেলো রাফিদ। তবে মাকে নিয়ে এভাবে বলায় কিছুটা রা*গ হলো তার। সে শান্ত স্বভাবের মানুষ আর সবকিছু বিবেক বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে। তাই নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
— কি হয়েছে তিথি? তুমি এভাবে বলছো কেনো?
তিথি রা*গী কণ্ঠে বললো,
— তোমার মা আমাকে কাজের লোকের মতো খা*টা*নো*র চিন্তায় আছে। প্রথমে তো আমাকে বলেছে ঘর ঝা*ড়ু দিয়ে মু*ছ*তে, যেখানে রহিমা বুয়া রেগুলার এই কাজ করে। তারপরও আমি এতবড় ঘর ঝা*ড়ু দিয়ে মু*ছে*ছি। এখন আবার নতুন ঝা*মে*লা শুরু করেছে। কাজের বুয়া রান্না করে দিয়েছে তাও সে নাকি ওই রান্না খাবে না। আমার হাতের রান্না খাবে। আমি বললাম যে আমি এখন রান্না করবো না। পরে করবো কিন্তু তাতে সে মানলোই না। উল্টো আমাকে এক গা*দা কথা শুনালো। সে আমার হাতের রান্না খাবে মানে খাবেই। এটা একভাবে আমাকে জ্বা*লা*নো*র পদ্ধতি। আমি কি বুঝি না ভেবেছে? কাজের বুয়া থাকতে আমি কেনো রান্না করবো? বলো?
রাফিদ শান্ত কণ্ঠে বললো,
— দেখো তিথি মায়ের বয়স হয়েছে। আর এই সামান্য বিষয়ে রা*গ করলে চলবে? মায়ের যখন ইচ্ছা করছে তোমার হাতের রান্না খেতে, তাহলে একটু ক*ষ্ট করে রেঁধে নাহয় খাওয়ালে। সমস্যা কোথায়?
তিথি ফ্যা*চ*ফ্যা*চ করে কাঁ*দ*তে শুরু করলো। কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তে বললো,
— বুঝেছি তুমিও আর আমাকে ভালোবাসো না। তাই তো এভাবে বললে। আমি এখন রান্না করতে পারবোনা মানে পারবোনা। তোমার মায়ের এসব ব্যবহার আমি মোটেও স*হ্য করবো না জেনে নাও। রাখো ফোন, মায়ের আঁচল ধরে ঘুরো যাও।
ঝা*ড়ি দিয়ে ফোন কে*টে দিলো তিথি। রাফিদ কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই সুযোগ টা আর পেলো না। ফোন রেখে মাথা নিচু করে বসে রইলো সে। কিছু একটা ভাবতে লাগলো। কল কা*টা*র পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার ফোন বে*জে উঠলো রাফিদের। সে ভাবলো তিথি আবার ফোন দিয়েছে হয়তো কিছুক্ষন আগের ব্যবহারের জন্য স*রি বলতে। কিন্তু ফোন হাতে নিতেই দেখলো তার মা সীমা বেগমের কল। দ্রুত কল রিসিভ করে সালাম দিলো সে। অপর প্রান্ত থেকে সালামের জবাব দিলেন সীমা বেগম। তারপর বললেন,
— এই কি মেয়ে কে তুই বিয়ে করলি বাপ? একটু তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছি বলে কতো কথা শুনালো। আর রান্না তো করলোই না। ছেলের বউয়ের কাছে এতো কথা শোনার আগে আমার ম*র*ণ হলো না কেন?
রাফিদ ক*রু*ন কণ্ঠে বললো,
— এসব কি ধরণের কথা আম্মা? আর কখনো এমন কথা বলবে না। আমার ক*ষ্ট হয়। আর তিথির হয়তো এখন ইচ্ছা করছে না রান্না করতে। পরে নাহয় ওর হাতের রান্না খেও।
এবার সীমা বেগম কা*ন্না শুরু করলেন। কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তে বললেন,
— বিয়ের এক সপ্তাহ হলো না আর তুই এখনই বউ ভ*ক্ত হয়ে গেছিস। বউয়ের হয়ে কথা বলছিস। এখন তো আর মায়ের কথা ভালো লাগবে না। বউ যা বুঝাবে তাই ঠিক মনে হবে। বউ তো না মি*নি*মি*না শ*য়*তা*ন একটা। ও নিশ্চয় তোর কাছে ফোন করে আমার নামে উ*ল্টা*পা*ল্টা কথা বলেছে তাইনা? আর তুই ওর কথা শুনে এখন ওর পক্ষে কথা বলছিস।
রাফিদ বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
— না মা তুমি যা ভাবছো তা ঠিক নয়। আমি তো শুধু….
রাফিদের কথা শেষ হতে দিলেন না সীমা বেগম। রা*গী কণ্ঠে বললেন,
— আমাকে আর উ*ল্টা*পা*ল্টা পড়াতে আসিস না বাপ। আমার চুল এমনি এমনি পা*কে নি। সবটাই বুঝি আমি। আর এসব মেয়েরা কেমন হয় তাও আমার জানা।
রাফিদ কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু তার পূর্বেই কল কা*টা*র টু*ট টু*ট শব্দে হ*তা*শ হলো সে। ভাবতে লাগলো নিজের জীবনের কথা।
~অতীত~
বাবা-মা, বড় বোন আর রাফিদ। একটা ছোট সুখী পরিবার ছিলো তাদের। কিন্তু এই সুখের পরিবারের ভা*ঙ*ন ধরে যখন সীমা বেগম প্যা*রা*লা*ই*স*ড হয়ে যান। রাফিদের বয়স তখন সবে ষোলো। আর রাফিদের বড় বোন সিনথির বয়স বিশ। সীমা বেগম প্যা*রা*লা*ই*স*ড হওয়ার দুইদিনের মাথায় নতুন বউ নিয়ে হাজির হোন রাফিদের বাবা। বেরিয়ে যায় তার আসল রূপ। নতুন বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখন থেকে তিনি ওই স্ত্রীর সাথে আলাদা বাড়িতে থাকবেন। তবে তার ছেলে মেয়ে আর প্রথম স্ত্রীর যাবতীয় খরচ উঠাতে রাজী তিনি। মাসের শেষে মোটা অংকের টাকা পাঠিয়ে দিবেন বলে নতুন বউয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যান রাফিদের বাবা রফিক। সেদিন নিজের মা কে পা*গ*লে*র মতো কাঁ*দ*তে দেখেছে রাফিদ। শা*ন্ত*না দেয়ার ভাষা তার জানা ছিলো না। সেদিন সে একটা জিনিস শিখেছে, দুঃ*সময়ে যারা হাত ছেড়ে যায় না তারাই প্রকৃত আপনজন। তার ছোট মস্তিষ্কে প্র*তি*বা*দ জন্মেছে। কেনো মানুষ সুসময়ে পাশে থাকলেও দুঃ*সময়ে হাত ছেড়ে চলে যায়? নিজের বাবার প্রতি এক আকাশ ঘৃ*ণা জন্মায় রাফিদের মনে। বাবা তো চাইলে পারতো নিজের অ*সু*স্থ বউয়ের সেবা করতে, তাদের দুই ভাইবোনের দেখাশোনা করতে। কিন্তু তিনি তা করেন নি। নতুন সুখের স*ন্ধা*নে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সেদিন রাফিদের ইচ্ছা করছিলো বাবার দেয়া সব কিছু ছেড়ে মা, বোন কে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। কিন্তু চাইলেই যে সব সম্ভব হয় না। তাদের শেষ আ*শ্র*য় যে তাদের বাবাই। তাদের হেল্প করার মতো কেউ ছিলো না। আর তার বয়স কম ছিলো, সে চাইলেও তেমন কিছু করতে পারতোনা। হয়তো কোনো কাজ জোগাড় করে পে*ট চা*লা*তে পারতো কিন্তু মায়ের চি*কি*ৎ*সা*র কথা ভেবে বাবার আ*শ্র*য়েই থেকে যায় তারা।
তখন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি টুকটাক বিজনেস করতে থাকে রাফিদ। আর এতে বিজনেস সম্পর্কে অনেক ভালো আইডিয়া হয়ে যায় তার। কিন্তু ভালো কোনো বিজনেস শুরু করার জন্যও অনেক টাকার দরকার। এর মধ্যে তার বোন সিনথির বিয়ে হয়ে যায়। সীমা বেগম ভালো একটা ছেলে দেখে সিনথির বিয়ে দিয়ে দেন। তারপর থেকে রাফিদ একাই নিজের মা কে সামলাচ্ছে। যদিও সীমা বেগম মে*ন্টা*লি অনেক স্ট্রং। স্বামীর জন্য দ্বিতীয়বার আর কখনো সে ভে*ঙে পরে নি।
রাফিদের বয়স যখন ২৩, তার অনার্স প্রায় শেষের দিকে তখন তাকে একটা ফ্যাক্টরির দ*লি*ল দেয় তার বাবা রফিক সাহেব। বলেন সেই ফ্যাক্টরি তিনি ছেলের নামে করে দিয়েছেন। আসলে তখন তার ব্যবসার অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না। অ*ঢে*ল সম্পত্তির মালিক তিনি। অনেক বিজনেস আছে তার। ছেলে কে দিতে চাওয়া ফ্যাক্টরি থেকে মোটা অংকের আয় পেতেন তিনি। কিন্তু সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে না পারায় সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পথে ছিলো। তারও বয়স হয়েছে। তিনি সামলাতে পারছিলেন না। তাই চাচ্ছিলেন ছেলে নতুন করে হা*ল ধরুক। তার আর কোনো ছেলে নেই, দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও এক কন্যা হয়েছে তাই তিনি ছেলে কে হাত করার প্রচেষ্টায় ছিলেন। রাফিদ সেটা ঠিকই বুঝতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, দলিল আর ফ্যাক্টরি সে নিবে না।
মা কে নিজের মতামত জানানোর জন্য আ*ড়া*লে নিয়ে যায় রাফিদ। মা কে অনেক সম্মান করে সে। মায়ের মতামত ছাড়া কিছুই করে না। ফ্যাক্টরি নিবে না বলাতে ক্ষি*প্ত হোন সীমা বেগম। রাফিদ অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সীমা বেগম কে। কিন্তু তিনি বেঁ*কে বসেন। তার মতে, তার ছেলে মেয়ের ভাগ তিনি কিছুতেই রফিকের দ্বিতীয় স্ত্রী নামক কা*ল*না*গি*নী কে ভো*গ করতে দিবেন না। রাফিদ মানতে না চাইলে এক পর্যায়ে রা*গা*রা*গি শুরু করেন সীমা বেগম। রাফিদ মা কে হা*ই*পা*র হয়ে যেতে দেখে রাজী হয়ে যায়। নিয়ে নেয় ফ্যাক্টরির দায়িত্ব।
রাফিদ যখন প্রথম তার বাবার দেয়া ফ্যাক্টরীতে যায়, তখন সেই ফ্যাক্টরির অবস্থা ডু*বো ডু*বো ছিলো। যেকোনো সময় ব*ন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। দীর্ঘ তিন বছর ক*ঠো*র পরিশ্রম করে সেই ডু*বে যাওয়া ফ্যাক্টরি কে টে*নে তুলে রাফিদ। নিয়ে যায় পূর্বের অবস্থায়।
অনার্স এ ভর্তি হওয়ার পর কলেজেই রাফিদের পরিচয় হয় তিথির সাথে। তারা সেম ইয়ার আর সেম ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট ছিলো। প্রথমে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্কে জ*ড়ি*য়ে যায় তারা। দীর্ঘ পাঁচ বছরের রিলেসন ছিলো তাদের। অনার্স শেষ হওয়ার পর তিথি যখন বিয়ের চা*প দিচ্ছিলো, তখন রাফিদ তিথি কে ওয়াদা করে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরপরই তিথি কে বিয়ে করবে সে।
মাস্টার্স কমপ্লিট হওয়ার পর সীমা বেগম কে তিথির ব্যাপারে জানায় রাফিদ। কিন্তু তিথি গ*রী*ব ঘরের মেয়ে হওয়ায় আর বাবা না থাকায় তিনি বিয়েতে রাজী হোন না। সীমা বেগমের মতে তিনি তার একমাত্র পুত্রকে এমন ঘরের মেয়ের সাথে কখনোই বিয়ে দিবেন না।
এতদিন মায়ের সব মতামত মেনে নিলেও এবার মানতে পারেনা রাফিদ। সে তার মা কে যেমন ভালোবাসে তেমন তিথিকেও অনেক ভালোবাসে। মা কে বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে থাকে সে। কিন্তু সীমা বেগম মানতে না*রা*জ। দু*শ্চি*ন্তা*য় কয়েকদিনে অবস্থা খা*রা*প হয়ে যায় রাফিদের। সে যে তিথিকে দেয়া ওয়াদা ভ*ঙ্গ করতে চায় না। চায় না নিজের বাবার মতো প্র*তা*র*ণা করতে। সীমা বেগম ও চি*ন্তি*ত হয়ে যান রাফিদের অবস্থা দেখে। তার প্রানবন্ত, হাসিখুশি ছেলেটার হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। ভেবেছিলেন কয়েকদিন পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও ছেলের একই অবস্থা দেখে ছেলে কে বোঝাতে তার রুমে যান সীমা বেগম। রাফিদ মা কে দেখে উঠে বসে। মা কে পাশে বসিয়ে তার হাত চে*পে ধরে কা*ত*র কণ্ঠে বলে উঠে,
— মা আমি তিথিকে অনেক ভালোবাসি। তুমি যেমন শুধু বাবাকেই ভালোবাসো। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমি কখনো সুখী হতে পারবোনা। আমি ভালো নেই মা, আমি ভালো নেই। আমি তোমাদের একজনের জন্য অপর জনকে ছাড়তে পারছিনা। আমি পা*গ*ল হয়ে যাচ্ছি।
ছেলের অবস্থা দেখে না চাইতেও বিয়েতে মত দিয়ে দেন সীমা বেগম। তবে তিথিকে তিনি পুত্রবধূ রূপে মানতে পারেন নি। অবশেষে বিয়ে হয় তিথি আর রাফিদের। শেষমেষ এতো বছরের ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ায় প্র*চ*ন্ড খুশি ছিলো রাফিদ আর তিথি। কিন্তু খুশি হতে পারেন নি সীমা বেগম।
————
অতীত থেকে বেরিয়ে আসে রাফিদ। তিথির সাথে তার বিয়ের আজ মাত্র ষষ্ঠ দিন। আর আজই এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় চি*ন্তা*য় পরে যায় সে। সে বুঝতে পারছে, তার মা যেমন তিথিকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি তেমন তিথিও শাশুড়ির এমন ব্যবহার মানতে পারছেনা। রাফিদ কি করবে বুঝতে পারছেনা। তার মা আর তার স্ত্রী দুজনই যে তার প্রা*ণ। সামনে কি হতে চলেছে ভেবে কপালে দু*শ্চি*ন্তা*র ছা*প পড়লো রাফিদের।
চলবে,
#সুখপাখির_উড়াল
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_১
(