#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৩
#অধির_রায়
রাতে ঝড়ো বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ বেশ ফর্সা৷ সূর্য্যি মায়া উঁকি দিচ্ছে৷ বড় আমগাছের পাতার একটু ফাঁকা অংশ ভেদ করে আসছে সূর্যের আলো৷ সূর্যের আলো ইহানের হাত ঘড়িতে পড়ছে। ঘড়ির গ্লাসে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে চিকচিক করছে৷ উনি রিক্সা উঠে বলল,
“উঠে আসো৷ দাঁড়িয়ে আছো কেন? যেতে ইচ্ছা করছে না৷”
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম৷ উনার হাতে ভর করে রিক্সায় চেপে বসলাম৷ আজও কেমন অজানা সংকোচ নাড়া দিচ্ছে মনে৷ গন্তব্য কোথায় জানা নেই? রিক্সা চলতে শুরু করল আপন গতিতে। হাতের উপর হাত রেখে উনার কাঁধে মাথা দিলাম৷ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি শুধু আমার৷ আপনার দিকে কখনও কেউ নজর দিতে পারবে না৷ আমি ভাবতেই পারছি না আপনি আমার হৃদয়ে জোড়ে জায়গা করে নিবেন৷”
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখে আমার দিকে নিষ্পলক তাকান৷ আমার হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে বলল,
“আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি তোমার হাত ছাড়ব না৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তোমার সাথে চলতে চাই৷”
আমি উনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি৷ কানের কাছে হালকা কালো বর্ণের তিল ঝলঝল করছে৷ এতোদিন চোখে পড়লেও তেমন খেয়াল করিনি৷ কালো তিলটা উনার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ইচ্ছা করছে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করি৷ প্রতিবারের মতো এবারও নিজের ইচ্ছাকে কুরবানী দিলাম৷ ত্যাগের মাঝে সকল ভালোবাসা নিহিত। উনি অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে কাকে দেখছ? নেশাভরা চাহনি অন্য কিছু সাড়া দিচ্ছে৷”
এদিক ওদিক দিকে নিজেকে সংযত করলাম৷ উনি তো আমার দিকে তাকান নি৷ উনি কিভাবে জানলেন আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি? আমার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারেন৷ আমতা আমতা করে জবাব দিলাম,
“আপনাকে দেখার কি আছে? রাস্তার আশেপাশে অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছি৷ আমি ভুলেও আপনার দিকে তাকায়নি৷”
উনি আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছেন কিনা বুঝতে পারলাম না৷ তবে মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকান৷ মুচকি হেঁসে বলল,
“আমার পাশে একটা বোকা মেয়ে বসে আছে৷ সে নিজেকে খুব চালাক এবং চতুর ভাবে৷ সে জানেনা সে কতটা বোকা৷”
আমি গলায় বললাম,
“রাস্তাঘাটে মেয়েদের বোকা বললে আমি মেয়ে হয়ে সহ্য করব না৷ আমি আপনার নামে ইভটিজিং এর মা’ম’লা করব৷”
“আমাকে সাথে নিয়ে যেতে পারো৷ আমিও মামলা করব৷”
সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি কিসের জন্য মামলা করবেন৷ আপনি তো ইভটিজিং এর স্বীকার হোননি৷”
আমি মামলা করব আমার কানের পাশে যত্নে বেড়ে উঠা তিলটার প্রতি একজন মেয়ে লোভনীয় চোখে তাকিয়েছে৷”
এভাবে ফেঁসে যাব ভাবতেই পারিনি৷ হাতেনাতে চো*র ধরলে যেমন পরিস্থিতি হয়৷ আমার ঠিক এমন অবস্থা। হাতির ঝিলে এসে আমাদের রিক্সা থামল৷ আমার হাত ধরে তিনি ঝিলের নির্জন একটা জায়গায় আসেন৷ পানিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশাপাশি বসে আছি৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ উনার দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগছে৷ উনি উনার পকেট থেকে শরতের বকুল ফুলের মালা বের করলেন৷ শরৎ কালেও যে বৃষ্টি হয় জানা ছিল না৷ শুধু বৃষ্টি নয়৷ ঝড়ো হাওয়ার সাথে মূলধারার বৃষ্টি৷ নিজ হাতে আমার ঘন কেশে পড়িয়ে দিলেন৷ মুচকি হেঁসে বলল,
“তোমাকে এখন পরিপূর্ণ লাগছে৷”
তাজা ফুলের গন্ধ নাকে আসছে৷ উনি বকুল ফুল কখন কিনলেন? উনি সব সময় আমার সাথেই ছিলেন৷ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি বকুল ফুল কোথা থেকে পেলেন? আপনি সব সময় আমার সাথে ছিলেন৷ দেখে মনে হচ্ছে একদম তাজা জীবন্ত ফুল৷”
“আমি একটু আগেই কিনেছি৷ মন অন্য জায়গায় পড়ে থাকলে সেদিকে খেয়াল থাকে না৷ কার কথা ভাবছেন ম্যাডাম।”
আমি কোন জবাব দিতে পারলাম না৷ পড়ন্ত বিকেলের সূর্য পানিতে ঝিকিল দিচ্ছে৷ প্রকৃতির সৌন্দর্য সব সময় আমাদের মুগ্ধ করে৷ আমি মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে বিজি৷ রাত এগারোর টার দিকে বাসায় ফিরলাম৷ সারাদিনের ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম চলে আসল৷
প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়৷ স্বাধীন ভাবে এক কদম এগিয়ে যাওয়া যাইনা৷ মায়ের গর্ভ থেকে যুদ্ধ করে পৃথিবীতে আসতে হয়৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ যুদ্ধ বহাল থাকে৷ কলেজে প্রথম দিকে ঠিকঠাক থাকলেও আজ সব কিছু ভিন্ন। আমাকে দেখেই সকলেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে৷ প্রথম দিকে আমাকে সবাই মেনে নিলেও এখান মেনে নিতে পারছে না৷ তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছে নতুন সময় সাদরে গ্রহণ করেছে৷ এখন আর পাচ্ছে না৷ আমি সামনের বেঞ্চে বসতেই ছোঁয়া বলল,
“শালিক তুমি এ বেঞ্চে বসতে পারবে না৷ তোমার মতো কালো মেয়ের সাথে আমি বসতে পারব না৷ আমার আম্মু কালো মানুষের সাথে চলতে মানা করেছেন।”
ছোঁয়ার রেশ ধরে সবাই বলতে শুরু করল,
“হ্যাঁ শালিক আমরা তোমার সাথে বসতে পারব না৷ তুমি আজ থেকে পিছনের বেঞ্চে বসবে৷ তোমার মন কালো সেজন্য তোমার চেহারা কালো৷”
এদের কথা শুনে তপোধনে চলে যাচ্ছি৷ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আজও কুসংস্কার বিশ্বাস করে আসছে৷ নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। আজ মনে পড়ছে আশার কথা, বড়লোক ঘরের মেয়ে হয়েও কোন অহংকার ছিল না৷ আমাকে খুব ভালোবাসতো৷ নিহা, সানী একে একে স্কুল ফ্রেন্ডের কথা মনে নাড়া দিচ্ছে। তারা একবার অবহেলা করলেও আরেরকবার বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম৷ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
“আমি পিছনের বেঞ্চে কেন বসবো? ছোঁয়ার বসতে ইচ্ছা না হলে সে পিছনে বসতে পারে৷ এখানে বসলে আমি কিছু মনে করব না৷”
আমার কথায় ছোঁয়া রেগে যায়৷ আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কটমট করে বলল,
“শাকিল তুমি পিছনে বসতে৷ আমরা তোমার জন্য তো পিছনে বসতে পারিনা৷ এখানে তুমিই একমাত্র কালো মেয়ে৷ আমরা তোমার সাথে বসতে পারব না৷”
“আমি যেখানে সিট পেয়েছি সেখানেই বসবো৷ আমাকে পিছনে বসতে বলার তুমি কে? তুমিও এই কলেজের ছাত্রী আমিও এই কলেজের ছাত্রী৷ আমাকে আর একবার পিছনে বসতে বললে ছুটির পর তোমাকে পি*টা*ব।”
ছোঁয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পেলো না৷ ছোঁয়ার গায়ের রং ফর্সা৷ দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। ছোঁয়ার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে৷ অন্যরা কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ তার আগেই স্যার রুমে চলে এসেছেন৷ ক্লাসের মাঝে মাঝে ছোঁয়ার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছি৷ সে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নিজেই পিছনে গিয়ে বসেছে৷ ছুটির পর একে একে চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো। ছাত্র জীবনে ছুটির ঘন্টা বাজা মানেই ঈদ৷ সকলের মুখের হাসির রেখা ফুটে উঠে। আমি নিজ জায়গায় বসে আছি৷ আমার উদ্দেশ্য হলো ছোঁয়ার ভয় দূর করা৷ ছোঁয়ার আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই ছোঁয়ার হাত ধরে ফেললাম৷ ছোঁয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কোমল গলায় বললাম,
“জোরে কথা বললে এখানেই মে*রে ভু*ত বানিয়ে দিব৷ চুপচাপ আমার পাশে বসো৷”
দুই মিনিটের মাঝেই সমস্ত রুম ফাঁকা হয়ে যায়৷ ছোঁয়া ভয়ে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। আমি ছোঁয়ার হাতের উপর হাত রাখতেই ছোঁয়া ভেজা গলায় বলল,
“প্লিজ শালিক আমাকে ছেড়ে দাও৷ আমি তোমার সাথে আর কখনও খারাপ ব্যবহার করব না৷”
“আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না৷ চল তোমার সাথে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে৷”
ছোঁয়া ভেজা গলায় বলল,
“আমি চা খাবো না৷ আমি বাড়িতে যাব৷ কলেজ ছুটির পর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না৷ দেরি হলে মা চিন্তা করবেন।”
রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ছোঁয়া চুপসে গেল৷ ছোঁয়া এতোটা ভিতু ভাবতেই পারিনি৷ দ্বিতীয় কোন কথা বলার সুযোগ পেল না৷ চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বললাম,
“তোমার ভয় তোমার দূর্বলতা৷ ভয়কে জয় করতে শিখো৷ এই ভয় তোমার সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷”
ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমার আম্মু সব সময় এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছেন৷ কখনও কারোর সাথে কথা বলতে মানা করেছেন৷”
“আমি তোমাকে মারামারি করতে বলছি না৷ ভয় পেলেও মুখে কখনও প্রকাশ করবে না৷ আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাব৷ আমিও তোমার মতো অনেক ভীতু টাইপের মেয়ে ছিলাম৷ কখনও মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পেতাম না৷ আমার গল্পটা তোমাকে শুনাব৷”
ছোঁয়ার চোখে মুখে উজ্জ্বল হাসির রেখা ফুটে উঠে। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“আমি শুনতে চাই৷”
চায়ের কাপ টেবিলে বলতে শুরু করলাম,
“আনন্দপুরের নিষ্পাপ মেয়ে শাকিল৷ সবুজের ছোট গাছের ছোঁয়ায় ভরে উঠতো কোমল মন৷ মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো তার প্রধান কাজ ছিল৷ তবুও লোক সমাজের চুক্ষুর আড়ালে থাকত সব সময় ৷ চুপি চুপি সবুজ বনে ঘুরে বেড়াতো৷ বাবা শখ করে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন৷ স্কুলে পিছনের বেঞ্চে তার জায়গা হতো৷ স্যাররাও কোনদিন পড়া ধরত না৷ শালিক নামে তাদের একটা ছাত্রী আছে জানেন না। আমার দিকে তাকানোর সময়টুকু নেই৷ অবলা শালিক তবুও এক একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দোয়ারে দোয়ারে ঘুরত। সবাই অপয়া বলে তাড়িয়ে দিতেন। সকালে আমার মুখটাও দেখত না৷ এক সময় আমার কিশোর জীবনে ফুটে বিয়ের ফুল৷ যৌতুকের বিনিময়ে আমার বিয়ে হয়৷ স্বামীর শারীরিক মানসিক অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বাবা জায়গা জমি বিক্রি করে যৌতুকের টাকা দেন৷ টাকাতে মন ভরে নি৷ প্রতিদিন শুরু হতো লা*থি উ*স্টা দিয়ে৷ মাটি আটকে ঘর করার স্বপ্ন দেখতান৷ স্বামীর রুচিশীল হয়নি বলে ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে দিলেন। লোক সমাজেও আমার আর কোন জায়গা হলো না৷ মুখ দেখতে চাইনা কেউ। সবাই অপয়া বলে দূরে ঠেলে দিতেন৷ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে জেনে যেতে পারিনি৷ শাকিলার বিয়েতে চো*রের অপবাদ দিলেন৷ চো*রের অপবাদে আমার ফুপি, দাদী সু*ই*সা*ই*ড করেছেন৷ চো*রে*র অপবাদ থেকে মৃত্যু অনেক ভালো৷ নিষ্ঠুর রাতের আঁধারে পালিয়ে আসি ঢাকা শহরে৷ শুরু হয় নতুন পথ চলা৷ দেয়ালে পীঠ ঠেকে যায় দু*ষ্টু লোকের চোখে লোভনীয় দৃষ্টিতে৷ বুঝতে পেরেছি নিজেকে শক্ত হতে হব। মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে৷ আমার মনের সকল দূর্বলতা ছিল চোখের পানি৷ আল্লাহর আমাকে ধৈর্য ধারণ করতে শিখিয়েছেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে আজ আমি এতদূর এগিয়ে আসছি৷ আল্লাহ তায়ালার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া।
চোখের কোণে পানি জমে উঠেছি৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম৷ ছোঁয়া কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলল। ছোঁয়ার দিকে পানি এগিয়ে দিলাম৷ পানি পান করে নিজেকে শান্ত করল৷ ছোঁয়াকে বললাম,
“বাসায় যাও৷ আমার কথা সম্পুর্ন তোমাকে বলতে পারিনি৷ সংক্ষিপ্ত কথায় তুমি ভেঙে পড়েছো৷ সকল ঘটনা জানলে তুমি এখন ঠিক থাকতে পারতে না৷”
ছোঁয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিল। বুঝতে পারলাম মেয়েটার মন অনেক কোমল৷ বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্টকর হয়ে পড়বে৷
চলবে….
রিচ দেখে লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি