তিলোত্তমা
পর্বঃ ৭
★
কাউসার আলী একবার আমার দিকে আরেকবার নিশার দিকে তাকাচ্ছে, এখনো বোধহয় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি বেচারা! কিছুক্ষণ এমন রামগড়ুরের ছানার মত এদিক-ওদিক তাকিয়ে তারপর কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে বেরিয়ে ভিজিটর্স রুমের দিকে চলে গেলো।
-‘মামনি! তুমি এখানে বসো, আমি দেখছি তোমার চোখে কী হয়েছে।’- নিশাকে বললাম আমি।
মেয়েটা ভীষণ বাধ্য। লক্ষ্ণী মেয়ের মত সেখানে বসে পরলো। আগামী সপ্তায় একটা মাইনর অপারেশন করা লাগবে ওর চোখে, সেজন্যেই আজকে চোখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট তৈরি করা জরুরি। ভালোমতো ওর অবস্থাটা কাগজে টুকে নিয়ে বোর্ডে পিন আপ করে রেখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। কী মিষ্টি একটা বাচ্চা! চোখ দুটো এত্ত অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর! ইশ, এই চোখজোড়ায় কিনা খোদা আলো দেননি!
-‘তুমি এবারে শুয়ে শুয়ে গান শুনতে পারো মামনি।আমি আসছি, কেমন?’
নিশা ছটফট করে ওঠে।
-‘না মাম্মাম! তুমি গেলে আর আসবেনা আমি জানি! কত্ত খুঁজেছি তোমাকে আমি, আবার গেলে আবার খুঁজতে হবে! সে অনে-ক কষ্টের কাজ মাম্মাম!’- নিশা ঠোঁট উল্টায়।
কী অদ্ভুত কথা বলছে এ মেয়ে! কই গেছে ওর মা? ইতিউতি এদিক-ওদিক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিশাকে শান্ত করা গেলো। ভীষণ মায়াকাড়া চেহারা মেয়েটার, গোলগাল, নাদুস-নুদুস, টকটকে গায়ের রঙ আর সবচেয়ে নজরকাড়া ওর চোখজোড়া… ঘন আঁখিপল্লবে ঘেরা একফালি হিজলের বনের মতো!
কিন্তু আমার তো আবার রাজকপাল! এই আদরের ডিব্বা বাচ্চাটাকে ছেড়ে এখন নাকি ঐ কাউছারালীকে বোঝাতে যেতে হবে! উফফ, আমার মা এত যন্ত্রণা তৈরি করতে পারে!
★
-‘দেখুন কাউসার সাহেব, আপনার সাথে তো আমার আগে কথাটথা তেমন হয়নি। আপনার কথা হয়েছে মা’র সাথে, আর আমার এই ব্যাপারটা মা জানেননা। সেজন্যে আপনিও জানেন না…’
-‘মানি? কি ব্যাপাড়ের কথা বলচো তুমি?’
-‘জ্বি বলছি, আপনি জাস্ট কোনো কোশ্চেন না করে শুনুন প্লিজ…’
-‘কুসচেন কড়বোনা মানি কি? আমার অনেক কুসচেন আচে, সেগুলুর আঞ্চার না পেলে তো এই বিয়ের ব্যাপাড়টা এগুবে না…’
ধ্যাত্তেরি ব্যাটা উল্লুক! কথা কী বলি সেইটা শোন আগে তারপর তোর ‘কুসচেন-আঞ্চার’ খেলিস যত খুশি!
মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে হাসিমুখ করে বললাম-
-‘জ্বি অবশ্যই ‘কুসচেন’ করবেন, আগে আমাকে সব বলতে দিন। এরপর আপনার সব ‘কুসচেন’-এর ‘আঞ্চার’ আমি দেবো!’- মনে মনে একটা বিশাল বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিয়ে মিথ্যে কথাগুলি আরেক দফা গুছিয়ে নিই। তারপর হড়বড় করে বলতে আরম্ভ করি-
-‘দেখুন এই নিশা মেয়েটা আসলে আমারই মেয়ে! বেশ ক’বছর আগেই ওর বাবা, মানে দিবস রাইয়্যানের সাথে আমার পরিচয় হয়। দিবসের একটু তাড়া ছিলো বলে আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে নিই কিন্তু তখনো পড়ালেখা করছিলাম বলে কাউকে জানাইনি। প্রায় তিন বছর মা-বাবাকে হোস্টেলে থাকবার কথা বলে দিবসের সাথে ছিলাম আমি, সেসময়েই নিশার জন্ম হয়। তারপর আমার পড়ালেখাটাও শেষ হলো আমাকেও মা-বাবার সাথে যেয়ে আবার থাকতে হলো! এখন নিশার দেখাশোনা দিবসই করছে, নিশা সুস্থ হলেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ও যাবে আমাদের বাসায়… আশা করি এর মধ্যিখানে আপনি ঢুকে পরে গণ্ডগোল বাঁধাবেন না!’- বুদ্ধি করে নিশার ফাইল ঘেঁটে ওর বাবার নামটা দেখে নিয়েছিলাম। কথাগুলি বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম কাউসার আলীর ফর্সা গালদুটো ধীরে ধীরে লাল বর্ণ ধারণ করছে…
-‘কিন্তু নিশাকে দ্যাখলে ত তুমার মেয়ে বইলা মনে হয় না!’
ওরে খোদা! লাল্টু মিয়ার দেখি আসল বুলি বেরিয়ে গেছে! তবু আধা শুদ্ধ আধা অশুদ্ধ জগাখিচুড়ি ভাষার চেয়ে এ অনেক ভালো! কিন্তু, এই উজবুকটা এখন প্রমাণ দাবি করবে নাকি? উফ, মহা ছ্যাচ্চড় তো!
-‘দেখেন আপনি তো ওর বাবাকে দেখেন নাই… নিশার মতই সুন্দর দেখতে। আমি যেমন রাত্রি, সে তেমন দিবস- বুঝসেন?’
তবুও কাউসার আলীর চোখেমুখে অবিশ্বাসের ভাবটা কাটেনি, বরং বিচিত্র ক্রোধে চেহারা আরো লালবর্ণ ধারণ করেছে। উপার্জনক্ষম মেয়ে, ঢাকায় ফ্ল্যাটের আশা সব এমনভাবে হাতছাড়া হতে দেখলে অবশ্য এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক!
-‘দেখুন বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার! শুধু শুধু আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ, বলুন? আপনার মত এমন সুদর্শন, হ্যাণ্ডসাম পাত্র কেউ যেচে পরে হাতছাড়া করে?”- উফ! এই গাধাটাকে কী করে যে সরাই! তেল দিয়ে পিছল করে দেখি কাজ হয় কীনা!
কাউসার আলী আর কোনো বাদ-প্রতিবাদ করেনা। ধপ করে ভিজিটর্স চেয়ারে বসে কিছু একটা ভাবতে থাকে বোধহয়। করুকগে যা খুশি, আমার ঘাড় থেকে আপদ নামলেই বাঁচি! সিন্দাবাদের ভূত একটা ঝুলিয়ে দিয়েছেন মা!
গোঁয়ারগোবিন্দটাকে সেখানেই ফেলে রেখে চিলড্রেনস ওয়ার্ডে ফেরত যাই আমি। নিশাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে একটু পরেই ফিরে আসবো, বেচারি মেয়েটা বোধহয় অপেক্ষা করে আছে!
-‘নিশা মামনি! এইযে আমি এসে গেছি… বলেছিলাম না চলে আসবো?’- একটা টেডি বিয়ার জড়িয়ে ধরে খাটে শুয়ে ছিলো মেয়েটা, আমার গলা শুনেই লাফ দিয়ে উঠে বসে। আমার দিকে পেছন ফিরে নিশার বেডসাইড টেবিলে ফলমূল আর শুকনো খাবার গুছিয়ে রাখছিলো কেউ একজন, অতর্কিতে পেছন ফিরে লোকটা। পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবার আগেই অস্ফুটে একটা বাক্য বেরিয়ে আসে তার মুখ দিয়ে -‘মিহির! তুমি আসবে আমি জানতাম!’
ঝুঁকে পরে নিশাকে আদর করছিলাম আমি, মাথা উঁচু করতেই লোকটার চোখে চোখ পড়ে আমার। চেহারাটা একনজর দেখলেই বোঝা যায়- ইনিই নিশার বাবা! মেয়ে একদম বাপের চেহারা পেয়েছে…নিশার ঐ হিজল বনের মত পল্লবঘেরা চোখজোড়াও এই লোকের DNA থেকেই ধার করা! প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উনি, চোখে চোখ পরতেই খানিকটা সংকুচিত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন-
-‘Sorry! আমি ভেবেছিলাম মিহির… মানে নিশার মা এসেছে! আপনার কণ্ঠস্বর একেবারে মিহিরের মতো!’
ওহ! তবে এই ব্যাপার! নিশা মেয়েটা চোখে প্রায় একদমই দেখতে পায়না, কণ্ঠস্বর শুনেই বেচারিকে মানুষে মানুষে তফাত করতে হয়। এজন্যেই একটু আগে আমাকে ওর মাম্মাম বলে ভুল করেছে মেয়েটা।
-‘বাপি! এটাই মাম্মাম! তুমি চশমা পরে দেখো তো ভালোমতোন! মাম্মাম, বাপিকে চশমাটা দাও তো… ‘- নিশার জোর প্রতিবাদী কণ্ঠ বেজে ওঠে ঝনঝন করে। নিশার মা কই, এদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আদতে কী হয়েছে কে জানে! পাকেচক্রে আমি কেমন কেমন করে এখানে এসে গিট্টু পাকিয়ে গেলাম!
-‘এক্সকুজ মি! আপনিই কী দিবোস সাহেব?’
কণ্ঠটা কানে আসতেই পিলে চমকে যায় আমার!
কাউসার আলী!
ব্যস, এটুকুই বাকি ছিলো! উজবুক উল্লুকটা কিনা লাফাতে লাফাতে আবার এখানে এসে হাজির হয়ে গেছে! ইয়া মাবুদ, এবারে কী হবে! বানিয়ে বানিয়ে যেসব আকাশ-কুসুম শুনিয়েছি উল্লুকটাকে, কাকতালীয়ভাবে সব ই মিলে গেছে! এই দিবস বলে লোকটা আসলেও দেখতে নিশার মতই সুন্দর… কিন্তু এবারে কাউসার আলী যদি সব ফাঁস করে দেয়, তখন?
-‘জ্বি আ…আমিই দিবস রাইয়্যান! কিন্তু আপনাকে ঠিক…’
-‘আই এম কাউছার, কাউছারালী- ফ্রম মুহিপুর সদর! আপনি কি জানেন আপ্নার ‘ইস্ত্রি’ মানে উয়াইফ রাতরির সাথে আমার মেইরিজ প্রায় ঠিকঠাক হয়ে গিয়েচে…’- হায় খোদা! উল্লুকটা সব ঘেঁটেঘুঁটে হালুয়া পাকিয়ে দিলো! এবারে?
নিশার বাবা চোখ পিটপিট করে একবার কাউসার আলীর দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকান। এই বেচারা না চেনেন উজবুক কাউসারালীকে না চেনেন তার ‘ইস্ত্রি ওরফে উয়াইফ রাতরি’-কে! মেয়ের চিকিৎসা করাতে এসে রেডিমেড একখানা ‘উয়াইফ’ জুটে যাওয়াতে তাকে খুব একটা আনন্দিত মনে হচ্ছেনা, না হওয়াটাই স্বাভাবিক! দু’পা পিছিয়ে কাউসারালীর পেছনে যেয়ে দাঁড়াই আমি, তারপর হাতজোড় করে অনুরোধের ভঙ্গিতে ইশারা করি দিবসকে উদ্দেশ্য করে। লোকটাকে দেখে সরল-সোজা, নিপাট ভালমানুষ বলেই মনে হচ্ছে আমার, অন্তত কাউছারালীর তুলনায় নিঃসন্দেহে বেটার অপশন! কাউছারালীর ভূতটাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য এবারে আমাকেই বোধহয় সিন্দাবাদের ভূত হয়ে এই দিবস রাইয়্যানের ঘাড়ে ঝুলে পড়তে হবে! কী আর করার আছে… তবু যদি এযাত্রায় বাঁচা যায়!
দিবস সাহেব কী বুঝলেন কে জানে, সেই একইভাবে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি তখনো ইশারায় অনুরোধ করে যাচ্ছি, আঙুল দিয়ে কাউসার আলীকে দেখিয়ে মাথা নাড়িয়ে যেভাবেই হোক কিছু একটা বোঝাতে চাইছি…
-‘আ..উমম! আমি আসলে মানে আমি বুঝিনি ব্যাপারটা এখনো! ঠিক কী বলছেন আপনি?’- অবশেষে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় দিবসের।
-‘এইযে রাতরি, সে কি আসলেও আপ্নার উয়াইফ? ফেমিলি থেকে আমাদের মেইরিজটা ঠিকঠাক হয়েচে কিন্তু রাতরি এখন বলচে যে বাসায় না জানালেও ওর বিয়ে হয়ে গেসে আরো আগেই আপ্নার সাথে… আর আপ্নার মেয়েও রাতরিকে মাম্মাম বলে ডেকেসে… ‘
দিবস সাহেবকে তর্জনী দিয়ে ঘাড়ের পেছনে চুলকাতে দেখা যায়। চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের কোণায় পরিষ্কার করে আবার চোখে লাগান, তারপর ছোট্ট দুটো কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন-
-‘জ্বি কথা সত্য! ‘রাতরি’ আর আমার ‘মেইরিজ’টা হয়েছিলো…আশা করি আপনি আপনার ‘ফেমিলি’কে বুঝিয়ে বলবেন ব্যাপারটা! আর রাতরির বাসায় কাউকে জানাবেন না প্লিজ…’
আর কথা বাড়ায় না কাউসার আলী, কটমট করে একবার আমার দিকে তাকায়। তারপর গটগটিয়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে যায়। বুকে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা নাকে-মুখে বের করে দিয়ে ধপ করে নিশার পাশেই বসে গেলাম আমি। বোধহয় উজবুকটার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিললো অবশেষে!
-‘I think you owe me some explanations!’- দিবস সাহেবের কণ্ঠটা কানে আসে আমার।
-‘অবশ্যই অবশ্যই!’- কোনোমতে ঢোঁক গিলে বলি আমি। some explanations তো কমই বলেছেন এই লোক, বিশাল এক্সপ্লানেশন পাওয়ার অধিকার আছে উনার!
-‘আসলে হয়েছে কী… এই উজবু..মানে এই কাউসার আলীর সাথে মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। কিন্তু দেখতেই তো পেলেন কী রামছাগ..মানে কী অদ্ভুত এই লোকটা। আজকে কথা নেই বার্তা নেই সে এখানে এসে হাজির হয়েছে…ওদিকে নিশাটাও ঠিক তখনি জানিনা কেনো ওর আমাকে ওর মাম্মাম বলে ভুল করলো। শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে…’
-‘তাই এই সিন্দাবাদের ভূত ঘাড় থেকে নামাতে মিথ্যে গল্প আঁটলেন- তাইতো?’
ইশ! এই লোকটা কি একেবারে মনের ভেতরের কথা পড়তে পারে নাকি? আমি যে মনেমনে কাউসার আলীকে সিন্দাবাদের ভূত নাম দিয়েছি সেটাও জেনে গেছে!
-‘মানে.. I’m extremely sorry… তৎক্ষণাৎ এই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিলো, আমি আসলে কীভাবে কি করবো…’
-‘It’s okay! No need to panic! আমি বুঝেছি ব্যাপারটা, আর সত্যি বলতে ঐ উজবুকটার সাথে আপনাকে মানায় ও না! ঠিক কী দেখে আন্টি মানে আপনার মা একে আপনার জন্য পছন্দ করলেন…’
নিশার বামপাশের বেডের বাচ্চাটার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম আমি, মুখ না তুলেই উত্তর করলাম-
-‘নিশা যে বললো আপনাকে চশমাটা পরে নিতে… ঠিকঠাক পাওয়ারের চশমা পরেছেন তো? অমন লম্বা, সুদর্শন, টকটককে ফর্সা পাত্র পাওয়া তো আমার মত মেয়েদের জন্য সৌভাগ্য…’
-‘ওহ! এই ব্যাপার! বুঝেছি…’- দিবসের গলায় ইতস্তত ভাবটা প্রকট হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি বেশি অস্বাভাবিক হয়ে উঠবার আগেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে দেয়া দরকার, অচেনা-অজানা একটা মেয়ের অসম্পূর্ণ অনুরোধে যেভাবে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছেন উনি- অভাবনীয়!
-‘যাকগে আমার কথা ছাড়ুন! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! না চিনে না জেনে যেভাবে রিস্ক নিয়ে সাহায্য করলেন…’
-‘ওয়েলকাম! চোখের সামনে কাউকে নদীতে পরে যেতে দেখলে যে কেউই সাহায্য করবে… তারজন্য চেনাজানা থাকা লাগেনা!’
বাপরে বাপ! এ দেখি ফটাফট উত্তর দিতে এক্সপার্ট! যেনো উত্তরখানা মুখে তৈরি করাই ছিলো!
-‘ভালো উপমা দিয়েছেন! এরপর আর কিছু বলার পাচ্ছি না। একনজর দেখেই মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু আইডিয়া করে ফেলেন দেখছি আপনি! কাউসার আলীর ব্যাপারটা একেবারে ঠিকঠাকই ধরেছেন!’
দিবস সাহেব অল্প হাসেন। এরমধ্যেই নিশাকে কোলে নিয়ে একটা কমলালেবু ছিলে ছিলে খাওয়াতে বসে গেছেন। ডানদিকের ফাঁকা বেডটায় বসেছি আমি, আপাতত হাতে তেমন কাজ নেই। আর তাছাড়া এই বাপ-বেটিকে দেখতে ভালই লাগছে, কেমন শান্তি শান্তি দৃশ্য!
-‘আপনার ঐ কাউসার আলীকে দেখে আমাদের গ্রামের একজনের কথা মনে পরে গেলো, বুঝলেন? ভালো ছাত্র বলে বেশ নামডাক ছিলো তার গ্রামের মধ্যে, সেই দাপটে ধারেকাছে ঘেঁষা যেতো না। ঐ থাকেনা কিছু? নন্দকুমার টাইপের? ঐরকম আরকি। ছোটোবেলা থেকে গ্রাম্য ভাষা শিখেছে আর একটু বড় হতেই নিজেকে বিশাল কেউকেটা ভাবা শুরু করেছে। তো ফলাফলে যা হলো- এই কাউসারের মত একইরকম ভাবে জগাখিচুড়ি করে কথা বলতে আরম্ভ করে দিলো সে ছেলে! তো একবার হয়েছে কি- এক পিচ্চি মেয়ে, এই ধরুন নিশার থেকে একটু বড় হবে, একা একা স্কুলের মাঠে ঘুরছিলো। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের জংলামত জায়গাটার দিকে চলে যাচ্ছিলো বাচ্চাটা, তা আবার আমাদের হিরোর চোখে পরলো- সাথে সাথে সে মাঠের অপর প্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে বলতে আরম্ভ করলো- ‘অ্যাঁই মেয়ে, অ্যাঁই মেয়ে! ওকানে যেওনা, ওটা জঙ্গল! ওকানে যেও না…’- ঠিক এই পর্যায়ে এসে বাবার সাথে নিশাও গলা মেলালো! বাপ-বেটির যুগ্ম কণ্ঠ কানে এলো আমার-
-‘ওকানে হাপ আছে!’- টেনে টেনে সুর করে একইভাবে কোরাসের মত বেজে উঠলো গলা দুটো! কী সুন্দর! কী অপার্থিব সুন্দর! নিশা মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে সাপের ছোবলের মত ভঙ্গি করে দেখাচ্ছিলো বলার সময়, ওর অঙ্গভঙ্গি দেখে অজান্তেই খলখল করে হেসে উঠলাম।
-‘নিশার দেখি মুখস্থ কাহিনী! এই গল্প কতবার করেছেন মেয়ের কাছে?’- হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলাম।
-‘অনেকবার! এমনকি নিশাকে কোনোকিছুতে বারণ করতে হলে শুধু বলবেন- ‘নিশা! ওকানে হাপ আছে, খবরদার যেওনা!’- ব্যস তাতেই হবে!’- কমলালেবুটা খাওয়া হতে নিশার মুখটা ভেজা রুমালে মুছে দিতে দিতে বললেন দিবস। বাপ-বেটিকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো, এরকম সুন্দর, মিষ্টি একটা পরিবার কি আদৌ কখনোও হবে আমার? নাকি ঐ কাউসার আলীই শেষমেশ জুটবে কপালে…
(চলবে)