#জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১৮।
রাতের মধ্য ভাগ হতে চলেছে। হাতের দু’আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলে পুড়ে ওভাবেই শেষ হচ্ছে। নিকোটিনের টিমটিম আলো আঁধারের মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে। হুট করে নিভে গেলো আলো। গ্রীষ্ম আবার নতুন করে আরেকটি সিগারেট ধরালো। এবার ওঁর দু’ঠোঁটের মাঝে রেখে টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ছাড়লো ধোঁয়া। বড্ড আনচান আনচান করছে ওঁর মন। লাভ ফ্যারি হোটেলের সামনেই গাড়ির সিটে হেলে বসে আছে গত দু’ঘন্টা যাবত। মনের মাঝে অজস্র প্রশ্ন,
” ভাদ্রের সাথে আবার কি করতে এসেছে মার্জান?”
এই প্রশ্নটা যেন আরো বেশি খোঁচাচ্ছ ওঁকে। গ্রীষ্ম কয়েকবার লাভ ফ্যারির ভি আই পি রুমের দিকে হাত বাড়িয়ে দরজার কঁড়া নাড়তে গিয়ে থেমে গেছিলো। চোখে শুধু ভাসছে, রুমটির ভিতর ঢুকছে ওঁরা এক সাথে। গ্রীষ্মের মাথার রগ টান টান হয়ে উঠেছে। ওঁ মাথার চুল টেনে ধরলো। এই মুহুর্তে ওই রুমটি থেকে মার্জানের চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে আনতে ইচ্ছে হলো ওঁর। ঘন্টা দু’য়েক এর আগের ঘটনা মনে করতে লাগলো গ্রীষ্ম। গ্রীষ্ম লাভ ফ্যারির প্রাইভেট রুমে বসে ছিলো রায়হানের সাথে। রায়হান ওঁর নিজের বিজনেস প্লেস তৈরি করতে চায়। এবং প্রথম ডিল গ্রীষ্মের সাথেই করবে, এই নিয়ে দু’জনের মাঝে চলছিলো ডিসকাশন। কিন্তু তাদের কথোপকথনের মাঝে নির্ঝরের কল আসে, নির্ঝরের কথা অস্পষ্ট শোনাতে ওঁ চলে আসে করিডরে। ঠিক তখনি অপেন হয় লিফট। মার্জানকে এখানে হন্তদন্ত হয়ে আবার আসতে দেখে ভ্রুকুচকা ওঁ। কিন্তু পরক্ষণেই মার্জানকে ভাদ্রের রুমে যেতে দেখে মাথার উপর বাজ পাড়লো যেন ওঁর। গ্রীষ্ম চোখ খুললো। হাতে নিকোটিন আবার জ্বলে পুড়ে ছাই, ওঁ আবার ধরালো। আজ ওঁ এখানেই অপেক্ষা করবে, হ্যাঁ এখানেই, মার্জানের কাছে ওঁর কৈফত চাই। কিন্তু গ্রীষ্মের আর বেশিক্ষণ থাকা হলো না… ওঁর বাসা থেকে রহিম চাচার ফোন এলো। গ্রীষ্ম বিরক্তি নিয়ে চোখ কুচকালো। বার কয়েক কেঁটে দিয়েও লাভ হলো না.. ফোন তুলতেই চিন্তিত হয়ে উঠলো ওঁর মুখ। গলা দিয়ে বেড় হলো একটি শব্দ,
” আসচ্ছি!”
না চাইতেও স্থান ত্যাগ করলো গ্রীষ্ম। হওয়ায় ভেসে আসচ্ছে এ সি কামরাটিতে লেমন ফ্লেভারের সুবাস। মার্জানের এই সুবাসটি অন্য সময় হলে নাক টেনে নিজের ভিতরে ভোরে নিতো। কিন্তু এই মুহুর্তে কাঁটার মতো বিঁধছে শরীরে। তার উপর ভাদ্রের এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বেখাপ্পা লাগছে খুব। মনে হচ্ছে ক্ষুদার্ত কোনো কুকুরের সামনে এক টুকরো মাংস। মার্জান নিজে সংযত রাখার চেষ্টা করলো। ভাদ্র মুখ খুললো,
” মার্জান… মাই ডিয়ার মার্জান, তোমাকে কাছে পাবার আশায় দেখো কতটাই না আজ কাহিল আমি!”
মার্জান মনে মনে হাসলো। ভাদ্র এবার কিছুটা গা ঘেষে বসলো ওঁর পাশে। মার্জান স্বরে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। মার্জানের চুলে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো আবার ফিসফিস করার মতো,
” আই মিসড ইউ সো মাচ্।”
মার্জান ধারালো দৃষ্টিতে তাকালো,
” বাট আই হেইট ইউ। আমি আমার মার ঠিকানা চাই।”
বলেই হাত বাড়ালো ভাদ্র। ভাদ্র ফিক করে হাসলো,
” আগে আমারটা পাই। ”
বলেই আরো কাছে এলো। মার্জান ওঁর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো,
” আমি এবার তোমার কোনো কথায় আসছি না।”
ভাদ্র এবার দু’হাত তুলে ফেললো,
” ওকে ফাইন। এমনিতেও তোমার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই।”
বলেই ভাদ্র উঠে গেলো, ওর পার্সোনাল ব্যগের কাছে। এই সুযোগ ভাদ্রের সার্ভ করা ড্রিংসে নেশার ঔষধ মিলিয়ে দিলো মার্জান। ভাদ্র ততক্ষণে একটি কাগজ হাতে নিয়ে ফিরে এসে বসলো ওঁর পাশে। কাগজটি দিয়ে বলল,
” এখানেই পেয়ে যাবে তাকে।”
মার্জান কাগজ তুলে অ্যাড্রেস দেখল। এবং প্রশ্ন করলো,
” আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো? যে তুমি আমায় ঠকাচ্ছো না?”
ভাদ্র ওঁর ড্রিংসের গ্লাস হাতে তুলে চুমুক দিলো। বলে উঠলো,
” এছাড়া কোনো পথ তোমার কাছে আছে কি? আর এমনিতেও টগর আন্টিকে দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। যা আমার ছিলো, সব পেয়ে গেছি।”
মার্জান হতাশার শ্বাস ছাড়লো। ভাদ্র ওঁর ড্রিংকস খতম করেই মার্জানের হাতে ধরিয়ে দিলো অন্য গ্লাসটি, মার্জান না চাইতেও কিছুটা খেলো। পরমুহূর্তেই চক্কর মারলো যেন মাথায়। ভাদ্রের মাথাও তখন নেশা চড়ে উঠেছে। মার্জানকে ওঁ ঘোলা দেখতে শুরু করেছে। মার্জানের দিকে হাত বাড়াতেই মার্জান ইচ্ছে করেই বাকি ড্রিংকস টুকু ফাললো ওঁর উপর। এবং অতি ভদ্রের সাথে বলল,
” মাই এপোলোজাইজ। ”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। ভাদ্র ওঁর জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে উঠলো,
” সমস্যা নেই আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি। ”
বলে ওয়াশরুমে গেলো ওঁ। সেই সুযোগে রুমের দরজা খুললো মার্জান সঙ্গে সঙ্গে, ওঁর মতেই কাপড় আর গেট আপ পড়া মেয়ে ঢুকে পড়লো কামরায়। মার্জান ঢুলকে ঢুলতে পাশেই আরেকটি রুমে ঢুকে গেলো। এদিকে ভাদ্র কাপড় পাল্টে একটি তয়াল গায়ে জড়িয়ে কামরায় এলো। ঘোলাটে মার্জানের কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটিও ওঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলে গেলো বিছানায়। এদিকে হুঁশ ছাড়া ভাদ্র টেরই পেলো না.. কখন ওঁর ভিডিও তৈরি হয়ে গেলো। মার্জান ঢুলতে ঢুলতে পাশের ঘরে এসে দরজা লাগলো। এই রুমে ছিলো ভাদ্রের সাথে মেয়েটি। যাকে ভাড়া করে এনেছিলো মার্জান। মার্জানের শরীর জ্বলছে, সে ঢুলছেও খুব, নির্ঘাত ভাদ্র বজ্জাত টা ওঁর ড্রীংকসে কিছু মিলিয়েছে। মার্জান এবার অনুভব করলো, ওঁর শরীরে অদ্ভুত কিছু শিহরণ খেলা করছে। ওঁর মনে পরে গেলো বিগত ছয় বছর আগের সেই রাতটির ঘটনা। ঠিক একই রকম লেগেছিলো তখন, সেদিনের সেই কালরাত্রিতেই অল্প বয়সে মা হতে হয়েছিলো তাকে। যদিও মৃণালকে পেয়ে খুব খুশি ওঁ। কিন্তু একই অবস্থা আবার পড়ে নিজেকে ঘৃণিত মনে হচ্ছে। চটজলদি ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে ঢলে ঢলে পরিস্কার করতে লাগলো নিজেকে, উত্তেজনায় বুঁদ হয়ে মার্জান সেখানেই জ্ঞান হারায়….
————
নিস্তব্ধ করিডোরে গ্রীষ্মের দ্রুত পায়ের শব্দ চলছে। খানিক দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালো হসপিটালের ভি আই পি ওয়ার্ডের সামনে। রহিম চাচা গ্রীষ্মকে দেখেই বলে উঠলো,
” বেগম সাহেবা ঠিক আছে এখন। আপনার দাদি এসেছেন ছোট সাহেব?”
গ্রীষ্মের মাথার রগ দাঁড়িয়ে গেল। অনিতার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
” মা.. আমি তোমাকে আষাঢ়ের মতো ছেঁড়ে যাবো না। কেন ভয় পাও প্রতিবার? দাদিজান কখনো আলাদা করতে পারবে না তোমার থেকে আমাকে।”
অনিতা পিটপিট করে চোখ খুললো। টেনশনে পুরো মুখ নীল যেন। অনিতা গ্রীষ্মের হাত টেনে নিজের হাতে নিলো ব্যথিত কন্ঠে বলল,
” আষাঢ় চলে যাবার শোক সিতে পেরেছিলাম তুমি ছিলে বলে, কিন্তু মা-জানের জেদ এবার কেড়ে নিয়েি ছাড়বে তোমায়।”
আবার ফুপিয়ে উঠলো অনিতা। আষাঢ় ছিলো গ্রীষ্মের জমজ ভাই, যে নিখোঁজ হয়েছে আজ ছ’বছর। কোনো রকম খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ওঁর। এবার তো ধরেই নিয়েছে মারা গেছে সে। কিন্তু গ্রীষ্ম তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। মোটেও নয়। গ্রীষ্ম ওঁর মাকে শুয়ে দিয়ে বের হয়ে এলো। এবার ওঁর দাদিজানের সাথে শেষ বারের মতো কথা বলা দরকার। কিন্তু বাড়ি ফিরে পাওয়া গেলো না তাকে। জানা গেছে, উনি কোনো হোটেলেই উঠেছেন। অনিতা যতদিন আছে এ বাড়িতে থাকবেনা এখানে। তাই গ্রীষ্ম বাহিরে পা বাড়ায় কিন্তু তখনি টুং করে শব্দ হয় ওঁর ফোনে।নির্ঝোরের নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও আসে ওঁর ফোনে। না চাইতেও অপেন করে ওঁ।মার্জানের সাথে ভাদ্রের অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো গ্রীষ্মের ঘরের সকল আসবাব নিমিষেই ঝংকার শব্দ তুলে মাটিতে গাড়া গড়ি করতে লাগলো। কয়েক টুকু কাঁচের টুকরো বিঁধে গেছে হাত পায়ে… ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত……
চলবে,
চেষ্টা করবো এক দিন পর পর গল্প দিয়ার। যদি আপনারা পাশে থাকেন তো…