#নীরদের_বিষাদিনী-(৭)
আজ আবার রাফার হাত একজনের নামে মেহেদী দিয়ে রাঙিয়েছে।পূর্বের থেকেও বড় করে তার বিয়ের সবগুলো অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে।আবিদা তো ভীষণ ব্যস্ত।অবশেষে মেয়ের দুঃখ ঘুচতে চলেছে।শায়লা নিজের ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।এদিকে রোহানের কোনো পাত্তা নেই।কোলের মেয়েটিকে রাফার কাছে দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।রোহান বিছানাতে শুয়ে আছে।
“কী ব্যাপার?তোমার শরীর খারাপ?”
অলস ভঙ্গিতে উঠে বসলো রোহান।উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,
“নীরদ ও রাফার বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারছিনা।”
“কেন?”
“সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো শায়লা।”
শায়লা মনোমুগ্ধকর হাসি হাসলো।বাচ্চা হওয়ার পর থেকে স্ত্রীর প্রতি আরো বেশী আসক্ত হয়ে উঠেছে রোহান।হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো।
” শুনেছি ভাইয়ের বিয়ের উপলক্ষে তরী আপু এসেছে।”
“হুম।ও কল করেছিলো আমাকে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোহান।শায়লা মুচকি হেসে শুধালো,
“একটা জিনিস দেখাবো দেখবে?”
“কী?”
“এক মিনিট।”
আলমারি থেকে একটা ফটো এলবাম বের করে নিয়ে এলো শায়লা।স্বামীর পাশে বসে বলল,
“এটা নতুন করিয়েছি।আচ্ছা তোমার মনে আছে এই ছবিটার কথা?আমাদের আকদের দিনের?আমার হাত কেঁ টে ছি ল দেখে তুমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলে।”
“কীসের হাত কেঁ টে ছি ল শায়লা?তুমি আলতা মেখে এসেছিলে।বাবা-মায়ের সামনে লজ্জা পাবে দেখে ঔষধ লাগানোর নাটক করেছিলাম।”
শায়লা কপট রাগ দেখালো।পরের ছবিটা তাদের দুজনের হলুদের।পাশাপাশি বসানো।
“হলুদের দিন তো তুমিও জ্ব লে যাওয়ার নাটক করেছিলে।আমার মনে নেই ভাবছো।”
রোহানের মুখবিবরে অতীতের সুখের স্মৃতিচারণের আভা দেখা যাচ্ছে।শায়লাকে জড়িয়ে ধরলো।
“এলবামটা আমার জন্য সারপ্রাইজ ছিল?”
“হু।চলো সবগুলো ছবি দেখি।”
দুজনে একে একে সব ছবি দেখতে লাগলো।তাদের বিয়ে,প্রথম হানিমুন,মেয়ের জন্ম সবকিছু।আচমকা রোহানের চোখে অশ্রু এসে জমা হলো।শায়লার মুখে পূর্বের মতো স্নিগ্ধ হাসি।
“শুনো রোহান।তুমি আর তরী আপু বছর বছর আগে দুজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে।রিলেশন বিশ্বাসী ছিলেনা।অথচ নীরদ ভাই সেটা হতে দেয়নি।তার নিজস্ব বহু কারণ থাকতে পারে।তুমি কষ্ট পেয়েছো মানছি।তবে এইযে সুখের, দুঃখের মুহুর্ত গুলো আমরা একত্রে না হলে কখনো পেতাম না।দুজনের পথ আলাদা থাকতো।তুমি কী বলতে পারবে আমি অসুখী রেখেছি তোমাকে।”
রোহান তৎক্ষনাৎ বিরোধাভাস করে বলল,
“একদম না শায়লা।পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ আমি।তোমাকে পেয়েছি বলে কথা।”
“একটা সিক্রেট বলি তোমাকে?আমার বাবার কাছে তোমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব নীরদ ভাই পাঠিয়েছিল।যেদিন আকদ হলো সেদিন খুব করে বলেছিল আমার ভাইটা সুখী হবে।দেখো আজ আমরা খুব ভালো আছি।জীবনে অনেক না পাওয়া থাকে।কিন্তু বৈধতায় কখনো অপূর্ণতা থাকেনা।তরী আপু নিজের জায়গায় ভালো আছে।আমরা সকলে ভালো থাকলে নীরদ ভাই কেন খারাপ থাকবে?রাফা বহু কষ্টে স্বাভাবিক হয়েছে রোহান।নীরদ ভাই অতীতে ভুল করেছে কীনা সঠিক করেছে সেই হিসেবটা বাদ দাও।মনের কষ্টকে দমিয়ে রাখো।জীবনে একবার না হয় অন্যায়কারীর সাথে আপোষ করলে।তুমি বুঝেছো আমার কথা রোহান?”
শায়লার কথা এতোক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলো রোহান।রাফার বিয়েতে বেশ অমত ছিল তার।তবে মা,বাবার উপর কিছু বলতে পারেনি।অনেকটা রাগ উঠেছিল নিজের পরিবারের প্রতি।কিন্তু শায়লা কতোসহজে ব্যাপারটা বুঝালো। তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে পুনরায় শায়লা বলল,
“আমরা খুব ভালো আছি রোহান।”
“একদম ঠিক বউ।খুব ভালো আছি।”
কথাটি বলে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে বাহিরে চলে গেলো রোহান।রাফা তখন সবেমাত্র শুকনো মেহেদী শুকিয়ে ধুয়েমুছে বাবুর কাছে এসে বসেছে।ছোট্ট মেয়েটি কতো আরামে ঘুমাচ্ছে।আজ তার হলুদও ছিল।চেহারায় কোনো মলিনতা নেই।রোগাটে শরীর সজীবতার নিচে চাপা পড়েছে।রোহান আচমকা এসে বলল,
“চল রাফামণি।এক জায়গায় যেতে হবে।”
ঘড়ির পানে তাঁকিয়ে রাফা ভ্রুক্রুটি করে বলল,
“এই রাত বারোটার সময় তোমার সাথে কোথায় যাবো আমি?”
“আরে চল তো।বুঝলি বহু বছর আগে একটা পদার্থ স্বপ্ন দেখেছিল।তার হবু বউ গায়ের হলুদের দিন লুকিয়ে তার সাথে দেখা করতে এসে হলুদ খাইয়ে দিয়েছিল।আর আমি সেই পদার্থের স্বপ্ন পূরণ করবো না?তা কী কখনো হয়?”
রাফা অল্প সময় চোখ দুটো ছোট ছোট করে রোহানের কথার মর্মাথ বোঝার চেষ্টা করলো।ইতিমধ্যে তার হাতে টান পড়েছে।হাঁটা বাদ দিয়ে তার ভাইকে শুধালো,
“ডাক্তারকে তুমি পদার্থ কেন বলো ভাইয়া?বহু বছর পর তোমার মুখে এই ডাক শুনলাম।”
রোহান গর্বের সহিত বলল,
“বিয়ে হোক এরপর বুঝবি।তবে ছোট করে বলি অপদার্থের থেকে পদার্থ ভালো শোনায়।”
(***)
গায়ের হলুদের ঝামেলায় নীরদের চশমাটা ভেঙে গিয়েছে।সে ছোটখাটো একটা অন্ধ।এজন্য ঝামেলা হচ্ছে।এরমধ্যে তরী তাকে একবারও রাফার সাথে কথা বলতে দেয়নি।ফোনটা রেখে দিয়েছে।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে নীরদের।বিষাদিনীর মেহেদী রাঙা হাত দেখার জন্য হৃদয়টা শুকিয়ে যাচ্ছে।অনেকটা দুঃখিত,আহত মন নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করলো সে।তবে নিজের সামনে আরেকটা মানুষের উপস্থিততে বিব্রত হলো সে।তার মা হয়তো কোনো মেহমানকে এখানে থাকতে বলেছে।তাই চলে যাওয়া শ্রেয় মনে করলো।পা রুমের বাহিরে রাখবে এমন সময় শুনতে পেলো,
“এই ডাক্তার।”
“কে কে?”
“বাহ!এখুনি চিনতে পারলেন না।”
নীরদ তড়িঘড়ি করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলো।নাহ সে কল্পনা করার মতো অসুস্থ নয়।তবে কী সত্যিই রাফা এলো?অবেলায় হলুদ ফুল হয়ে।হাত ভর্তি মেহেদী দেখে নীরদের মনে য ন্ত্র ণা হতে লাগলো।শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“বিষাদিনী,বিয়ের রঙ লেগেছে তোমার শরীরে।এতো সুন্দর কেন লাগছে?”
রাফা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো।পূর্ব দিক থেকে শীতল সমীরণ মেয়েটার গা ছুঁয়ে গেলো।নীরদের উষ্ণ শ্বাসে ঈষদুষ্ণ ফু্ঁ দিয়ে বলল,
“আপনি বড় পা ষা ণ ডাক্তার।”
“কেন এলে বিষাদিনী?”
“আপনাকে সি ডি উ স করতে।”
কথাটি বলে হেসে ফেললো রাফা।নীরদ বিরস মুখে বলল,
“মোমেন্টটা নষ্ট করলে।”
“একদম।আচ্ছা হা করুন তো।”
“আমার প্রিয় কিছু করে এনেছো তাইনা?”
“একদম।”
নীরদ হা করলে তার মুখের ভেতর হলুদ ঢুকিয়ে দিলো রাফা।থু থু করে ফেলে দিলো ছেলেটি।
“ছিঃ রাফা এটা কী করলে?”
“কেন আপনার স্বপ্নপূরণ করলাম।”
“এক মিনিট।তোমাকে কে বলেছে এটা?রোহান?”
“হ্যাঁ।”
নীরদ উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
“এর মানে বিয়েটা মেনে নিয়েছে ও।কোথায় সে?”
“নিচে ড্রয়িংরুমে।হ্যাঁ মেনে নিয়েছে।”
“ওহ রাফা।আমি কী যে খুশি হলাম।তুমি থাকো এখানে।বউকে কাল সারাদিন পাবো।কিন্তু বন্ধুকে পাবো না।”
“আরে শুনেন তো।”
দৌড়ে বাহিরে চলে গেলো নীরদ।নিচ থেকে দুই বন্ধুর চিল্লানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।নিশ্চয় পূর্বের মতো মিথ্যা ঝগড়া করছে তারা।রাফা সুখের শ্বাস ছাড়লো।ফিসফিস করে বলল,
“আসলেও ডাক্তার বড় পদার্থ।”
চলবে।
লেখাঃসামিয়া খান প্রিয়া