#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ২০
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা
সুধা মির্জার ভেতরটা আত্মচিৎকার করছে।সবার জেনে যাবে এই ভয়েই তো এতোবছর চন্দ্ররেখাকে দূরে রেখেছিলেন।চেষ্টা করলেন।সফলও হলেন।সত্য কে ঢেকে রাখতে পারলেন কি!সবচেয়ে বড় সত্য তো,তিনি এখনো লুকিয়ে রেখেছেন।সে যদি কোনোদিন সবার সামনে আসে!সবাই তো তখন সবটা জেনে যাবে।সুধা মির্জা কারো পরোয়া করেন না।তার চিন্তা কেবল নিজের মেয়েকে নিয়ে।চন্দ্ররেখা এখনো তার মাকে ঝাপটে ধরে আছে।সুধা মির্জা পুনরায় বলতে লাগলেন,
-‘চন্দ্ররেখা যখন আমার পেটে এলো নিধির মধ্যে তখন থেকেই পরিবর্তন শুরু হলো।সারোগেট মা হওয়ায় আমার বেশ স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছিলো।ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী,চন্দ্ররেখার বাবা সেসময় আমার বেশ যত্ন করতো।একদিন নিধি আমার রুমে এলো,চন্দ্ররেখা আমার পেটে তখন সাত মাস চলে।আমার হাতে ধরে রিকোয়েস্ট করলো,তার ভুল হয়ে গেছে;বাচ্চাটা যেন আমি নষ্ট করে ফেলি।তাজওয়ার এ কথা শুনে,নিধির ওপরে বেশ রাগ হয়।তাদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ ঝগড়া হয়।একদিন তর্কাতর্কির মাত্রা বেড়ে যায়।তাজওয়ার নিধির গায়ে হাত তোলে।এরপর থেকে তাজওয়ারের ভাই তামিম চৌধুরীর সাথে নিধির ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়।বেড়ে যায় তাজওয়ারের সাথে নিধির দূরত্ব। আমি নিজেও কয়েকবার নিধিকে বোঝাতে গিয়েছিলাম।আমাকে দেখলে নিধি ভীষণ হাইপার হয়ে যেত।আঘাত করার চেষ্টা করতো!তাজওয়ারও তখন আমাকে এক রুমে বন্দি করে রাখতো।আপনাদের সাথে ইচ্ছে করেই চিঠিতে যোগাযোগ করতাম।ফোনে কথা বললে যদি দেশে থাকার বিষয়টি ধরে ফেলেন সেই ভয়ে!
আট মাস শেষের পথে,নয় মাসের আগেই চন্দ্ররেখার জন্ম হয়।চন্দ্ররেখার বাবা চন্দ্ররেখাকে কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি আর তাজওয়ার ভেবেছিলাম চন্দ্ররেখাকে দেখলে হয়ত নিধির মধ্যে পরিবর্তন আসবে।যতই আমার পেটে থাকুক,বাস্তবিক অর্থে চন্দ্ররেখা তো তাজওয়ার আর নিধির অংশ।কিন্তু নিধির মধ্যে কোনো পরিবর্তন এলো না।সে চন্দ্ররেখাকেও আঘাত করে বসলো!তাজওয়ারের সাথে নিধির সম্পর্ক অবনতির শেষ পর্যায়ে।সে সময় নিধি কাউকে তোয়াক্কা করলো না।তামিমের সাথে অবৈধ সম্প……
সুধা মির্জা চুপ হয়ে গেলেন।চন্দ্ররেখার দেহের স্পষ্ট কম্পন অনুভব করলেন।আর যাইহোক নিজের বোনের অপকর্মের কথা,তারই মেয়ের সামনে কোনোভাবেই তিনি মুখে আনতে পারবেন।
-‘আপনাদের এক বছর পরে দেশে আসার কথা বললেও,চন্দ্ররেখার কথা ভেবে আরো একবছর চৌধুরী বাড়িতে কাটিয়ে দিলাম।আঁকড়ে ধরলাম চন্দ্ররেখাকে!সে একবছর আমার কাছেই বড় হলো।এদিকে আপনারা চিঠির পর চিঠি পাঠাতে থাকলেন।যখন চিঠি পড়ে জানতে পারলাম ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে, আমার ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হলো।বাবা মারা যাওয়ার আগে তার হাত আঁকড়ে ধরে যে কথা দিয়েছিলাম!জীবনে যতো বাঁধাই আসুক,মির্জা ইন্ডাস্ট্রি, চাঁদোয়া মহল এবং চাঁদোয়া মহলের এর প্রতিটি মানুষকে আঁকড়ে ধরে থাকবো।কেউ না জানলেও মা আমার আর নিধির মাঝের ঘটে যাওয়া সবকিছুই জানতেন।বজলুকে দিয়ে আমার কাছে একদিন খবর পাঠালেন। চন্দ্ররেখাকে দেখার জন্য নাকি বড়ভাই চৌধুরী বাড়িতে আসছেন।আমি ধরেই নিয়েছিলাম,ভাই নিধিকে আপন করে নিলে সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে।আমরা সবাই মিলে বোঝালে নিধি নিজের ভুল বুঝতে পারবে।সব মিলিয়েই চন্দ্ররেখাকে তার বাবা ভরসায় রেখে,আমি ঝিল্লিপুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।আমি আসার দু’দিন পর বড়ভাই চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।আমার বিশ্বাস ছিলো,তিনি নিধি আর তাজওয়ার আর চন্দ্ররেখাকে সাথে নিয়েই ফিরবেন।কিন্তু ভাইকে একা ফিরতে দেখে আমার সব বিশ্বাস নিমিষেই চুরমার হয়ে গেল।এরপর ভাইয়ের কাছ থেকে যখন জানতে পারলাম নিধি তাজওয়ারকে ডিভোর্স দিয়েছে,আমি দিশেহারা।মা ছাড়া আমার বাচ্চাটা কি করে বড় হবে!কার কাছে থাকবে?কে খেয়াল রাখবে!আমি তখন আমার মায়ের কাছে ছুটে গেলাম,সবাইকে সবকিছু জানাতে চাইলাম।মা বাঁধা দিলেন।নিজের মাথা ছুঁয়ে কসম দিলেন।বোঝালেন এই সমাজ কখনো এক অবিবাহিতা মেয়েকে বাচ্চাসহ মেনে নিবে না!আমিও তখন মায়ের কাছে শর্ত দিলাম,আমাকে যেন কখনো বিয়ের জন্য জোর না করা হয়।আমি আজীবন চন্দ্ররেখার মা হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রেখা তার মাকে ছেড়ে সোজা দাঁড়ালো।সুধা মির্জার ডান হাত নিজে হাতের মুঠোয় নিয়ে,উলটো পিঠে চুমু খেলো।সুধা মির্জা কথা থেমে গেল।তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন।চন্দ্ররেখা তার মায়ের চোখের পানি আলতোভাবে মুছে দিলো।হামিদ মির্জা ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন,বুকে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে তার।বক্ষের বা’পাশ হাত দিয়ে চেপে ধরলেন।আস্তে আস্তে হেঁটে সোফার বসে পড়লেন।শারাফ ব্যতিত বাকি সবার মধ্যে উৎকন্ঠা কাজ করছে।এরপর কি হলো!শারাফ তার চন্দ্রপ্সরার দিকে তাকিয়ে আছে।সে জানে তার স্ত্রী তার ওপর বেজায় অসন্তোষ।চন্দ্রপ্সরার ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা হলো।সুধা মির্জা কান্না থামিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলতে লাগলেন,
-‘এছাড়া চন্দ্ররেখাকে কেউ অবৈধ বা অপবিত্র বলুক,আমি মা হয়ে সেটা কখনো মেনে নিতে পারতাম না।সবার মুখ বন্ধ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণও সে সময় ছিলোও না!আমি চাইলে সেদিন চন্দ্ররেখাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারতাম।তাজওয়ারও আমাকে কখনো বাঁধা দিতো না।কিন্তু চন্দ্ররেখার শৈশবকাল ট্রলের স্বীকার হোক,মানুষের নোংরা কথার বিষাক্ত বাণে জর্জরিত হয়ে কাটুক আমি চাই নি!মা হয়ে আমার বাচ্চাটাকে জেনেশুনে কি করে কষ্ট দেই আমি?সেদিন থেকে চন্দ্ররেখার ওপর থেকে সব দাবি তুলে নিলাম।আমি না হয় সকলের অজান্তেই চন্দ্ররেখা জন্মদাত্রী হয়ে থাকলাম!মাঝে মাঝেই আড়াল থেকেই দেখতাম,নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতাম।দূর হতে শতশত দোয়া করতাম।নিধিরও খবর নিয়েছিলাম আমি।তার জন্যই তো আজ আমি চন্দ্ররেখার মা হতে পেরেছি!কি করে ভুলি তাকে!বোনের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারি নি।তামিম আর নিধি তারা দু’জনে চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেদের আলাদা সংসার তৈরি করেছিলো।কিছুদিন পর আচমকা দু’জনই একদম নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।’
শারাফ তীক্ষ্ণ চোখে সুধা মির্জার দিকে তাকালো।সুধা মির্জা খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
-“কয়েকজনের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম।তারা দু’জন নাকি বাহিরের এক দেশে নিজেদের মতে স্যাটেল হয়ে গেছে।এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ পাই নি।”
সুধা মির্জার কথা শেষ হতেই চন্দ্ররেখা তার হাত দুটি ছেড়ে দিলো।দু’হাতে নিজে চোখমুখ মুছে নিলো।এলোমেলো অবস্থায় হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।হাঁটতে যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!চন্দ্ররেখার প্রস্থানের দিকে সকলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।সুধা মির্জা মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন।এদিকে শারাফের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এতো শান্ত কেন তার চন্দ্রপ্সরা!কি চলছে তার মনের ভেতর?শারাফ যে এই ইগনোর মেনে নিতে পারছে না।সুধা মির্জা শারাফের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন।শারাফ মাথা নেড়ে চন্দ্ররেখার পিছু পিছু গেল।
——–
চন্দ্ররেখা বিছানার কিনারা ঘেঁষে মেঝেতে বসে আছে।শাড়ির কুঁচি এলোমেলো হয়ে গেছে।আঁচলের জমিনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখ দুটো ফুলে ফেঁপে উঠেছে।এই বুঝি রক্ত গড়িয়ে পড়লো!শরীর শিরা উপশিরায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।নিজের কাছে নিজেকে অসহ্য মনে হচ্ছে।সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসছে।বুক জ্বালাপোড়া করছে।দু’হাতে নিজের চুল টেনে ধরলো।বিড়বিড় করে বললো,
-‘আমাকে সহ্য করতে না পারলে,এই দুনিয়াতে আনার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলে মা?আমার ভুলটা কোথায় ছিলো?দাদি তাহলে ঠিকি বলেছিলো।আমার জন্য খানিকটা মায়াও হলো না!কেন মা!কেন এমন করলে?’
চন্দ্ররেখার মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। বাবা,বাবা বলে চিৎকার করে উঠলো।তার বাবা ছাড়া সবাই স্বার্থপর!এই মূহুর্তে বাবাকে তার ভীষণ প্রয়োজন।সবাই রেখে চলে গেলেও,একমাত্র বাবাই তো তাকে আগলে রেখেছিলো।চন্দ্ররেখা যে কষ্ট পাচ্ছে,বাবা কি সেটা দেখসে না?
শারাফ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।চন্দ্ররেখার অবস্থা দেখে তার কলিজা কেঁপে উঠলো।বুকভার হয়ে আসছে।রেখার প্রতিটি চিৎকার তার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে।এ চিৎকার যে ভয়াবহ পীড়া দিচ্ছে শারাফ রেখার দিকে এগিয়ে গেল।শারাফের উপস্থিতি টের পেতেই চন্দ্ররেখা উঠে দাঁড়াল।হন্তদন্ত হয়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল।এখানে আর এক সেকেন্ডও থাকবে না!শারাফের সাথে তো একদমই না।এই মানুষটা সব জেনে শুনে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।শারাফ কি ভেবেছে?বিয়ে করেছে বলে চিরকাল আঁটকে রাখতে পারবে!শারাফ রেখার অভিসন্ধি বুঝতে পারলো।দৌড়ে যেয়ে চন্দ্ররেখাকে জড়িয়ে ধরলো।রেখা শারাফের দিকে মুখের দিকে একবার ফিরেও তাকালো না।নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শারাফকে ধাক্কা মারলো।শারাফ খানিকটা সরে গেলেও, পুনরায় শক্ত-পোক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।রেখার রাগ যেন বেড়ে গেল।সে শারাফের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলো।বুকে ও পিঠে এলোপাতাড়ি খামচি দিতে লাগলো।সমস্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে লাগলো। শারাফকে নাড়াতে না পেরে এক পর্যায়ে বুকপটের মাঝে কামড় দিলো।শারাফ বিমূর্ত।এই মানবীর দেওয়া সব কষ্ট সে অনায়াসে সহ্য করে নিতে পারবে।কিন্তু বিরহ যে মেনে নিতে পারবে না।এর আগেই তার দম আঁটকে যাবে।
-“ছেড়ে দিন আমাকে,থাকবো না আমি।”
-‘ছাড়বো না,থাকতেই হবে।’
-‘কিসের দায়বদ্ধতা আমার?’
-‘বিগত রজনীতে আমার আসক্তির কাছে আপনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন।আমার ভেতরটা যে আপনার থেকে প্রশ্রয় পেয়ে বসে আছে।নিজের সম্পূর্ণটা অন্তনিহিত করেছি আপনাতে…….ভুলে গেছেন?আপনি ভুলে গেলেও যে আমি ভুলতে পারবো না।’
শারাফের শীতল কন্ঠস্বরে চন্দ্ররেখার শরীর শিরশির করে উঠলো।কাল রাতের কথা মনে পড়লো।মানুষটার বেপরোয়া স্পর্শ।ভালোবাসাময় সেই বচন।উভয়ের মাঝের উদ্বেলিত হওয়া উন্মাদনা,যেই উন্মাদনায় রেখার নিজেকে হারিয়েছে…… চাইলেও কি ভুলতে পারবে?ভেতরটা নরম হয়ে এলো।শারাফ চন্দ্ররেখাকে ছেড়ে দিয়ে,তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।রেখার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। অবরোধমুক্ত গর্ভে উষ্ণ চঞ্চু ডুবিয়ে দিলো।চন্দ্ররেখা কেঁপে উঠলো,চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল।শরাফের চুল আঁকড়ে ধরলো।শারাফ ফিসফিস করে বলল,
-‘যে নেশায় মজেছি আমি।সে নেশা এক সময় আপনাকে জড়িয়ে ধরবে।আঁকড়ে ধরেছি আমি আপনাকে,আপনি অদ্বিতীয় কেবল আমারই।দিনশেষে এই আপনাতেই আমি বিলীয়মান।আমার সাথে সাথে আপনার উচ্ছেদ অনিবার্য।’
চলবে