#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ২৭
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা
আধপাকা বড় ঘরটির ঠিক পেছনের দিকে ছোটখাট পার্ক।দুপুরের শেষভাগ হওয়ায় প্রায় লোকশূন্য।দুই একটি বাচ্চা মাঝারি স্লিপারের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে।পার্কের একপাশে সারি সারি গোলাপ গাছ।হরেক রঙের গোলাপ।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।হাত পা অসার হয়ে গেছে। নোনতা পানি চোখে টলমল করছে।চন্দ্ররেখার ভয়ার্ত চেহারা দিকে তাকিয়ে উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলো বজলু।তামাক পোড়া চঞ্চুর ফাঁকে হলদেটে দাঁতগুলো গোধূলির লালচে আলোয় কুৎসিত দেখাচ্ছে।রেখার শরীর ঘিন ঘিন করে উঠলো।হাসির তালে তালে সামনে থাকা মাঝবয়েসীর ষান্ডামার্কা তনু দুলেছ।কানের লতি অবদি বড় বড় চুল।উসকোখুসকো অবস্থা।লাল চোখজোড়া থেকে যেকোনো সময় উত্তপ্ত লাভা ঠিকরে বের হয়ে আসবে।ঝলসিয়ে দিবে চন্দ্ররেখার পাখি নরম অঙ্গ পতঙ্গ।রেখার অন্তরআত্মা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠসে।ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে।ভরসার আশ্রয় খুঁজে চলছে।কয়েক কদম পিছিয়ে গেল সে।মাটিতে পড়ে থাকা মাঝরি খেলনা ট্রাকের সাথে পা বেজে পড়েই যাচ্ছিল।পেছন থেকে বলিষ্ঠ এক জোড়া হাত আগলে ধরলো।প্রশস্ত বক্ষের সাথে লেপ্টে গেল তুলতুলে শরীর।পরিচিত পুরুষালী গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারলো।মুখ তুলে তাকালো চন্দ্ররেখা।শান্ত চোখে চোখ পড়তে অস্থির হৃদয় নিমিষেই স্থির হয়ে এলো।বিভৎস্য সেই হাসি আর কর্ণে প্রবেশ করছে না।সুঠামদেহী দীর্ঘকায় যুবকের তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি দেখে বজলু থতমত খেয়ে গেল।আমতাআমতা করে বললো,
-“আসলে নতুন বউয়ের সাথে একটু মশকরা করছিলাম।এতো ভয় পেয়ে….
তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে পুরো কথা শেষ করতে পারলো না বজলু।চন্দ্ররেখার সামনে ঝুকে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে হাতজোড় করলো। কন্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো।বিড়বিড় করে বলল,
-“মা……..বেশি ভয় পেইছো?মাফ কইরা দেও।আমি বুঝতে পারি নাই,তুমি এতো ভয় পাইয়া যাইবা!”
চন্দ্ররেখা নিশ্চুপ।শারাফ এগিয়ে এসে সামনাসামনি দাঁড়ালো।বলিষ্ঠ দেহের আড়ালে চলে গেল রেখা।প্রিয়তমের পৃষ্ঠের সাথে মিশে রইল।বুক ধুকধুক করছে তার।চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।শারাফের কঠিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বজলু ঢোক গিললো।
-“বৃহৎ হৃৎপিণ্ডের অধিকারী মানুষ তো আপনি!শারাফ মির্জার স্ত্রীকে অহেতুক ভয় দেখানো তো আর চারটেখানি কথা না?”
ঠোঁটে ফুটে ওঠা তীর্যক হাসি কয়েক সেকেন্ডেই হারিয়ে গেল।কপালের শিরা ফুলে উঠলো।চোয়াল কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে গেল। বজলুর পাঞ্জাবির কলার চেপে তার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির মাংসল দেহ খানিকটা উঁচু করে ধরলো।মূহুর্তেই দীঘলতার দিক থেকে পাঁচ ইঞ্চি ফারাক কমিয়ে এনে বজলুকে নিজের মুখ বরাবর তুলে ধরলো।
-“আজকের পর আমার আপনজনদের সামনে আপনার দৃষ্টি আর গলার স্বর দু’টোর একটাও যদি উঁচু হয়, তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার গুরুজন।”
-“শারাফ!কি করছো কি,তুমি?হয়েছে কি?”
ইস্পাত দৃঢ় কন্ঠ শ্রবণ হতেই বজলুকে ছিটকে ফেললো শারাফ।সুধা মির্জা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসলেন।তার চোখে বিস্ময়।কিছু বলতে চাইলেন।তার পূর্বেই শারাফ বলে বসলো।
-“কি হয়েছে সেটা আপনার ডান হাতকে জিজ্ঞেস করুন।আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম।আমার স্ত্রীর অবহেলা হবে জানলে কখনোই আপনার সাথে আসতে দিতাম না।”
রেখা কেঁপে উঠলো।শারাফের ভরাট রুক্ষ স্বর।মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলো।পিঠ খামচে ধরলো।সুধা মির্জা বাকহারা।তার নজর যেয়ে পড়লো ভয়ার্ত চন্দ্ররেখার দিকে।মেয়েকে আগলে ধরতে তিনি এগিয়ে এলেন।হাত বাড়ালেন।সুযোগ দিলো না শারাফ। পেছনে ঘুরে চন্দ্ররেখার হাতের কব্জি চেপে ধরলো।পা বাড়ালো নিজস্ব গন্তব্যের উদ্দেশে।সুধা মির্জা পুরোপুরি স্তদ্ধ।বেশ কিছু সময় নিয়ে ধাক্কাটা সামলে নিলেন।বাড়ানো হাত গুটিয়ে নিলেন।বুকের কাছে চেপে ধরলেন।ডান চোখ থেকে সূক্ষ্ম একটা পানি বিন্দু গাল ঘেঁষে থুতনিতে যেয়ে ঠেকলো।সাথে সাথে মুছে নিলেন।রোদ চশমার কারণে আগুন রাঙা লাল চোখ কারো দৃষ্টি আটকালো না।
-“বিশ্বাস করুন….বড়মা।আমি একটু মজাই করছিলাম। ভয় দেখাতে চাই নাই।শারাফ বাবা এভাবে রাইগা যাবে বুঝি নাই।”
সুধা মির্জা তাৎক্ষণাৎ পিছনে ঘুরলেন।চড় মারার উদ্দেশ্যে হাত উঠালেন।বজলুর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেলেন।হাত নামিয়ে নিলেন।যতোই কিছুই হোক না কেন,এই মানুষটার ওপরে সামান্য কারণে হাত তোলার অপরাধ করতে পারেন না তিনি।এখনো মনে পড়ে।রাস্তা থেকে তুলে এনে বাবা তাদের দুবোনের হাতে ছয় বছরের ছোট বজলুর হাত ধরিয়ে হাসি হাসি মুখে বলেছিলেন,
-“আজ থেকে এটা তোদের ছোট ভাই।ওরে বড় করার দায়িত্ব তোদের ওপর বর্তালাম।”
নিধি সে দায়িত্ব বোঝা মনে করলেও,সুধা মির্জা সেই দায়িত্বকে ভালোবাসা হিসেবে নিয়েছিলেন।শৈশব থেকেই নিজের মনের মতো গড়ে তুলেছেন বজলুকে!বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এই মানুষটি তার পাশে আজ পঁচিশ বছর যাবত ছায়ার মতো আছে!প্রথম প্রথম তাকে আপা বললেও,মির্জা গ্রুপের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে যেদিন টেনে নিলেন।সেই থেকে চেনাজানা বজলু বদলে গেল!সবার মতো তাকে বড়মা বলে সম্বোধন করা শুরু করলো।তার দু’ভাইয়ের চেয়ে বজলুর মর্যাদা কোনো অংশে কম নয়!সুধা মির্জা নিজেকে ধিক্কার জানালেন।বুক থেকে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো।ধীর পায়ে হেঁটে সামনে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লেন।এক দৃষ্টিতে সামনে থাকা ফাঁকা ছোট দোলনার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—–
চৌধুরী বাড়ির ছাদে এমনই একটা দোলনা ছিলো।চন্দ্ররেখার তখন ছ’মাস।সারাদিন এক কক্ষে বন্দি থাকতে থাকতে পাগল হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো সুধা মির্জার।একটু শান্তির আশায় রেখাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ছাদে যেয়ে বসে ছিলেন।বাড়িতে তখন দু’জন সার্ভেন্ট আর তিনি।নিধি গিয়েছিলো বাহিরে।দোলনায় বসেছেন কি,বসেন নি!আচমকা রেখার শিশু কন্ঠের চিৎকার কানে পৌঁছতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।নিচে যেয়ে দেখলেন মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ছটফট করছে তার কলিজার টুকরো।কান্নার দমকে নরম মুখটি লাল হয়ে গেছে!দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম!সামনে টলমলে পায়ে দাঁড়িয়ে নিধি।মেঝেতে আছড়ে পড়েন সুধা মির্জা।সযত্নে বুকের কাছে চেপে ধরেন নরম শরীরটিকে।মেয়ের কান্নায় জীবনের প্রথম চিৎকার করে কেঁদে উঠেন।সেদিন প্রথম প্রাণপ্রিয় ছোট বোনের গায়ে হাত তুলেছিলেন সুধা মির্জা।অথচ আজকে!আটকাতে পারলেন না মেয়েকে।নিষ্ঠুর পৃথিবীর!নিষ্ঠুর তার নিয়ম!সুধা মির্জা নিজ মনে প্রশ্ন করলেন,বিয়ের পর সন্তানের ওপর মায়ের কোনো অধিকার থাকে না কেন!কেন মেয়েরা পর হয় যায়!চট জলদি উত্তরও পেয়ে গেলেন।আসলে মেয়েটা পর হয় না কখনো।দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায়,আপনত্ব মলিন হয়ে যায়।
——-
-“আপনি গাড়ি থামাবেন!নাকি আমি চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিবো?”
ক্রোধে অন্ধ হওয়ায় উপক্রম।গাড়ির ব্রেক কষলো শারাফ।রাগ দমাতে গাড়ির হুইলে লাগাতার ঘুষি মারতে লাগলো।পাশের সিটে বসে থাকা রমণী কেঁপে উঠলো।ইশশশ,,,নিজের মুখনিঃসৃত শব্দগুলো যদি মুছে ফেলা যেতো!কি করবে বুঝে পারলো না!দিশেহারা অবস্থা।পর মূহুর্তে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শারাফের হাত আঁকড়ে ধরলো।পুরুষালী বাহুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“বাবার পর আপনি আর মা দুজনই আমার আপনজন।আপনাদের দু’জনকে আমি চাই।পিছনে,সামনে,উভয় পাশে সর্বত্রই চাই।”
শারাফের মন কিছুটা নমনীয় হয়ে এলো।শক্ত শরীর আগের চেয়ে কিছুটা শিথিল।কষ্টের ভারে চন্দ্ররেখার কথা গুলিয়ে যাচ্ছে।গলায় দুঃখ কাঁটা আঁটকে আছে।
-“আপনার রাগের যথার্থ কারণ আছে!স্বামী হিসেবে যথাযথ অধিকারও আছে। তাই বলে মায়ের সাথে কঠিন করে কথা বলতে পারেন না!আমি আপনাদের দু’জনকেই সম্মান করি।এই মূহুর্তে মাকে ছেড়ে চাঁদোয়া মহলে প্রবেশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।প্লিজ!যা হয়েছে ভুলে যান।প্লিজ!”
চন্দ্ররেখা কান্নারত ইনোসেন্ট মুখের দিকে তাকিয়ে শারাফ শরীর উত্তপ্ত হয়ে গেল।সব ভুলে সে তার চন্দ্রপ্সরাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো।কপালে সুদীর্ঘ চুম্বনে নিজেকে সিক্ত করলো।
——-
ইতিমধ্যে বিকেল হয়ে এসেছে।অল্প সংখ্যক বাচ্চারা পার্কে জড়ো হয়েছে।সুধা মির্জা দশ মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন।উঠে দাঁড়াতেই কোথ থেকে চন্দ্ররেখার দৌড়ে আসলো। আঁকড়ে ধরলো তাকে।বুকে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করে কিছু বললো।সুধা মির্জার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।সেই হাসিতে কারো মন ঠান্ডা হয়ে এলো ।সদর দরজার দাঁড়িয়ে থাকা একজোড়া চোখে প্রশান্তি জ্বলজ্বল করে উঠলো।
চলবে
ইনশাআল্লাহ! শীঘ্রই শেষ করে দিবো।