#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ৩০
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা
চাহান মির্জা একাধারে শিক্ষিত,কৌতুহলী ,জ্ঞানী,বিচক্ষণ একজন মানুষ।বিংশ শতাব্দীর মানুষের তুলনায় তার চিন্তাধারা ছিলো বেশ উন্নত।কৈশোরে পদার্পণ করা মেয়ের বেপরোয়া,জেদী,উড়নচণ্ডী,অস্থির ও নির্ভয় আত্মভাবে প্রলুব্ধ হয়ে মির্জা ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন।তার ধারণা ছিলো, আপাদমস্তক শক্ত খোলসে আবৃত এই মেয়ে একাই তাদের কোম্পানিকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিবে।১৯৯৫ সালে মির্জা ইন্ডাস্ট্রি তৈরির সকল কাজ পুরোপুরি ভাবে সম্পন্ন হয়।চাহান মির্জা নিজে ও তার বড় মেয়ে সুধা মির্জা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে ধীরে ধীরে কোম্পানিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে থাকে।দেড় বছরের মাথায় তাদের কোম্পানি দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভিনদেশে বেশ নাম অর্জন করেন।সবার মুখে মুখে তখন সুধার প্রশংসা!ঘরে যে আরো একজন শান্ত,নিরব,ধৈর্যশীল,ঘরকুনো,মমতাময়ী মেয়ে আছে সেটা সকলে ভুলেই বসে।ছোটবেলা থেকে দোয়া মির্জা নিধিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করে চলেছেন।নিধি নিজেও তার মায়ের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতো।মুখ ফুটে কখনো কিছু না চাইলেও, মনে মনে সে ছিলো ভালোবাসার কাঙাল।হয়ত নিধির মুখচোরা স্বভাব তার মায়ের অবহেলার জন্য দ্বায়ী!দোয়া মির্জার সকল ভালোবাসা কেবল সুধা,বড় দুই ছেলে,ছেলের বউ আর বড় নাতি শারাফকে ঘিরে।নিধির এসবে তেমন কোনো কষ্ট হতো না।তার জন্য ছিলো ‘গা সহা’ ব্যাপার।সব খারাপের একটা ভালো দিক থাকে!নিধির শান্ত স্বভাবের জন্য বিশেষ করে বড় দু’ভাইয়ের বেশ আদরের ছিলো!চাহান মির্জা দুই মেয়েকে সম পরিমাণ ভালোবাসালেও, কোম্পানির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নিধির সাথে তার দূরত্ব বেড়ে যায়।তবুও মনে মনে নিধিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন তিনি!খুব করে চাইতেন নিধিকে মির্জা ইন্ডাস্ট্রির যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে!কিন্তু মেয়েটি বরাবরই ভীতু!তবুও চাহান মির্জা নিধিকে বেশ স্নেহ করতেন।মেয়ের নম্র ও ধীর স্বভাবে তিনি বরাবরই মুগ্ধ হতেন।দিনের শুরুতে নিধির মুখ দেখে যেকোনো কাজ শুরু করা ছিলো তার নিত্য কার্য।নিধি ছোট থেকে বাবা পাগল মেয়ে!সবকিছুকে বাবার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া ছিলো তার জন্য সাধারণ ব্যাপার।অপরদিকে দাম্ভিকতার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে রাখা সুধা ছিলো একরোখা। তার একমাত্র কমফোর্ট জোন ছিলো নিধি!দিনশেষে নিধি ছিলো সুধার আশ্রয়স্থল।দু’বোন সম্পর্ক ছিলো তালা চাবির ন্যায়।একজন ছাড়া অপরজন গুরুত্বহীন!সবকিছু ভালোই চলছিলো।ব্যবসায়িক কাজে চাহান মির্জার দেশের বাহিরে যাতায়াত ছিলো।সেখানকার মানুষের অনেক কিছু তিনি অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন।অতিশয় বিজ্ঞ মানুষ হওয়ায় তার মাথায় হুটহাট দুর্দান্ত ধরনের বুদ্ধি খেলা করতো। সিদ্ধান্ত নেন তিনি অত্যাধুনিক সিস্টেমের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করবেন।যার নাম হবে #চাঁদোয়া_মহল।মূলত চাহান মির্জা ও দোয়া মির্জা নামের সংমিশ্রণে এই চাঁদোয়া মহল। সেই সাথে চাহান মির্জা ছোটখাটো একটা মারকিউরি ফ্যাক্টরি তৈরির চেষ্টা চালাবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেন।তিনি জানতেন পারদ মানুষের শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর।পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে এটি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট করে।মিথাইল মার্করি সবচেয়ে বেশি বিপদজনক।কিন্তু চাহান মির্জার দুঃসাহসিক উদ্যম তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না!দেশের পাশাপাশি বিদেশ থেকে তিনি চাঁদোয়া মহলের জন্য ও মারকিউরি তৈরির বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট যোগাড় করেন।সুধা তখন পড়াশোনা ও ব্যবসাতে পুরোপুরি মগ্ন।নিধির ও তার সম্পর্কের মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে যায়।এদিকে হামিদ মির্জা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।মেজো ভাই হাফিজের দিন কাটে শহরে।নিধি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে।সেই একাকিত্বের সঙ্গী ছিলো পাঁচ বছর বয়সী শারাফ।শান্ত, ধীর, অচঞ্চল সেই সাথে সকলের আদরের নেওটা!নিধির ক্ষেত্রেও অব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। শারাফকে নিয়ে একুশ বছর বয়সী নিধির নির্জীব দিনগুলো আনন্দে অতিবাহিত হচ্ছিল।
——–
মির্জা গ্রুপের দু’বছর পূর্তির উপলক্ষ্যে বেশ বড় বড় বিজনেসম্যান ও ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের আমন্ত্রণ করা হয়।সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম তাজওয়ার চৌধুরীর সাথে নিধি সুধার সাক্ষাৎ হয়।সদ্য যুবক তাজওয়ার মাত্রই তখন তার পৈতৃক ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।প্রথম দেখায় দৃঢ় চোখের অধিকারী তাজওয়ারের সুদর্শন রূপে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে সুধা।অপরদিকে তাজওয়ার চৌধুরী তার মন প্রাণ দিয়ে বসে প্রশমিত নরম মনের নিধিকে।সহজ,সাবলীল।কৃত্রিমতার ছোঁয়া বিহীন ভীষণ দূর্লভ সেই রমণী!ধূর্ত চাহান মির্জার উদ্দেশ্য ছিলো ফাংশনের অজুহাতে ফেমাস বিজনেসম্যানদের কাউকে মারকিউরি ফ্যাক্টরির পার্টনার করা।অনেকেই বেঁকে বসে। তাজওয়ার চৌধুরী একমাত্র নির্লিপ্ত ছিলেন।তার লক্ষ্য ছিলো ভিন্ন!কেবল প্রেয়সীর সান্নিধ্য!তিনি চাহান মির্জার সাথে ডিল করেন।তিনি এক মাসের সময় নেন।প্রথমে ছোট পরিসরে পারদ তৈরির কার্যক্রম শুরু করবে তারা।এতে যদি মানুষের বা পরিবেশের ক্ষতি হয়। তাহলে সেই স্থান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে।পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ প্রান্তের দিকে গড়ে তোলা গোডাউনে,মিথাইল মার্কারি তৈরির কাজ শুরু হয়।কয়েকজন ফার্মাসিস্টও সেই কাজে নিয়োগ হন।চাহান মির্জা সুুধার সাথে নিধিকেও যুক্ত করেন।কোমলমতি কে কঠোরমতি বানানোর ছোট্ট একটা প্রয়াস!তাজওয়ার চৌধুরীর সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব সাদাসিধা নিধিকে কাবু করে বসে।লোকচক্ষুর আড়ালে গড়ে ওঠে নিধি মির্জা ও তাজওয়ার চৌধুরী প্রগাঢ় প্রণয়!অকঠিন যুবতী তখন প্রেম তৃষ্ণায় বিভোর।মোক্ষম সময়ে এসে তাজওয়ার চৌধুরী প্রশাসনের লোকের কাছে নেগেটিভ রিপোর্ট করে বসেন।সীল গালা করে দেওয়া হয় সেই ক্যামিকেল পূর্ণ গোডাউন।ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন চাহান মির্জা।তাজওয়ারের নাম শুনলে ক্ষেপে উঠতেন।নিধির তখন দিশেহারা,বিভ্রান্ত!অকূল পাথারে একাকী নিমজ্জিত অবস্থা তার।বাবা ও প্রেমিক পুরুষ!যেকোনো একজনকে উপেক্ষা করা তার জন্য ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার।অবশেষে তারা দু’জনে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।নিধি ঘোর বিরোধিতা করলে,তাজওয়ার চৌধুরী নিধিকে আশ্বস্ত করেন।তাদের বিয়ের পর সবকিছু এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
সুধার চোখে সমস্ত বিষয়টি ধরা পড়ে যায়।হৃদয়ে জাগ্রত হয় পরশ্রীকাতরতা!জেদি সুধা তখন পাগলপ্রায়! ভালোবাসার বোন তখন চরম দুশমন!ঠিক পালিয়ে যাওয়া আগের দিন সুধার বদৌলতে দোয়া মির্জার কাছে সবকিছু খোলাসা হয়ে যায়।তাজওয়ারকে না পেলে সুধা আত্নহত্যা করবে বলে হুমকি দিতে থাকে।উপায় না পেয়ে দোয়া মির্জা নিধি মেরে জ্ঞানহীন করে ঘরে আটঁকিয়ে রাখেন।চাহান মির্জা তখন নিজের ব্যবসায়িক ফিল্ডে মগ্ন।ছয় মাস আগেই হাফিজ ও হামিদ মির্জা তাদের পরিবার নিয়ে শহরে স্যাটেল হয়ে যান।পরিস্থিতির সুযোগে অন্ধ ভালোবাসার ঘোরে নিজের গর্ভস্থ মেয়ের সাথে দোয়া মির্জা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম কাজটি করে বসেন। নিধির পরিবর্তে সুধাকে নিধি সাজিয়ে তাজওয়ার চৌধুরী কাছে পাঠিয়ে দেন।আর সমস্ত কিছুর সাক্ষী হয় বজলু নামের বালক!
চেহারা এক হওয়ায় তাজওয়ার চৌধুরী সুধা আর নিধির মাঝের পার্থক্য করতে পারেন নি।মনে তখন প্রিয়তমা নিধিকে হাসিল করার আনন্দ!তার মাথায় কোনো ধরনের কোনো ভাবনাও আসে নি।অনায়াসে বিয়ে করে নেয় নিধি বেশধারী সুধাকে।অপরদিকে জ্ঞান ফিরতেই নিধি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে পড়ে।তার সাজানো গোছানো পৃথিবী তখন পুরোপুরি ধ্বংস।নিজেকে সবকিছু থেকে একেবারে গুটি নেয়।এমতাবস্থায় চাহান মির্জা হার্ট অ্যাটাক করে বসেন।একদিকে সদ্য দাঁড় করানো কোম্পানি,অপরদিকে আধনির্মিত চাঁদোয়া মহল! চারদিকে ভরাডুবি অবস্থা!দোয়া মির্জা নিধির দারস্থ হন।মেয়েকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।নিজের ভুল বুঝতে পেরে বেশ অনুতপ্ত হন।নিধির কাছে হাত জোর করে মিনতি করেন।নিধি ওপর মির্জা গ্রুপের দায়িত্ব সঁপে দেন।সুধা যদি নিধি হয়ে তাজওয়ারের সাথে সংসার করতে পারে,তাহলে সে কেন সুধা হয়ে ব্যবসা সামলাতে পারবে না?নিধি এসব ভেবে নিজেকে শক্ত করে তোলে।মির্জা গ্রুপকে আঁকড়ে ধরে।তার সঙ্গী হয় বজলু।স্নিগ্ধ নিধি হয়ে উঠে বিধ্বংসী সুধা!ততদিনে বাড়ির দুই ছেলে বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ঝিল্লিপুরে হাজির হন।দোয়া মির্জা কৌশলে সুধা নাম বদলে দেন। চাহান মির্জার অবস্থার জন্য নিধিকে দ্বায়ী সাবস্ত করে নিধির সম্মুখে তাকে দোষারোপ করতে থাকেন।হামিদ মির্জা ও হাফিজ মির্জা এক প্রকার দ্বিধান্বিত মনে সবটা মেনে নেন।মনে মনে তাদের পলাতক বোনের ওপরে ঘৃণা জন্মায়।অবশ্য এসবের জন্য নিধি নিজেকেই দ্বায়ী ভাবে।সে যদি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিতো,তাহলে হয়ত………
মৃত্যুর পূর্বে চাহান মির্জা নিধিকে ডেকে পাঠান।আর কেউ না চিনলেও তিনি নিধিকে চিনতে পারেন।হসপিটালের বোকা অবস্থায় তিনি বদ্ধ গোডাউনে করা ক্রাইমে জড়িত মানুষদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও তাদের ওপরে করা ক্যামিকেল এক্সপেরিমেন্টের কথা উন্মোচন করেন।মূলত তিনি ছিলেন একজন সাইকোপ্যাথ।সবকিছুর ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে তিনি বেশ আনন্দ পেতেন।এমনকি সুধার ওপরেও তিনি এক্সপেরিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেন।তার বদ্ধ পরিপক্ক ধারণা ছিলো,যে করেই হোক অন্যায়কারীকে যথাযথ শিক্ষা দিতে হবে।মানুষের পাপমোচন করতে হবে।এর জন্য তাদের ওপরে তিনি অত্যাচার করতেন।ইলেকট্রিক শক দিতেও কার্পণ্য বোধ করতেন না।তাজওয়ার চৌধুরী ছিলেন চাহান মির্জার সমস্ত বিকারগ্রস্ততার প্রত্যক্ষদর্শী!সেই নেগেটিভ রিপোর্টও ছিলো এসব কিছুকে কেন্দ্র করে।দীর্ঘদিন ক্যামিকেল,বিভিন্ন ক্ষতিকর ড্রাগ নিয়ে কাজ করার কারণে চাহান মির্জার হার্টের সমস্যা হয়।মরার আগ মূহুর্তে তিনি নিধিকে দিয়ে ওয়াদা করান।পাপীষ্ঠাদের যে শাস্তি পেতেই হবে!মানুষের আড়ালে সেই গোডাউনকে কি করে টর্চার সেলে পরিণত করতে হবে তা নিয়ে নির্দেশ দেন চাহান মির্জা। মৃত্যুপথ যাত্রী বাবার বিষন্ন জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে নিধি মির্জা ঘোরগ্রস্তের ন্যায় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হন।ততোদিনে তিনি কাঠিন্যের আস্তরণে বন্দী এক মানবী।দয়া মায়াহীন পাষাণী।
চলবে
সুধা-নিধি কনফিউশান কেমন লাগে পাঠক/পাঠিকারা?😵