#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০২
#তাশরিন_মোহেরা
‘আসলে সেদিন আপনার সামনে এভাবে পড়ে যাবো আশা করিনি। তাই নার্ভাসনেসের কারণে পানিটা ছুড়ে মেরেছিলাম।’
আমি ভ্রু জোড়া কুঁচকে মুখরের বিবরণ শুনলাম। হাত জোড়া ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বড্ড অবাক লাগছে এই ভেবে যে, কথাগুলো মুখর আমাকে বলছে ঠিকই তবে তার চোখ আমার সম্পূর্ণ বিপরীতে। আমি খানিক আঁচ করলাম ছেলেটা বোধহয় মেয়েদের সাথে কথা বলতে মোটেও অভ্যস্ত নয়। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও আমাকে কিছু বলতে না শুনে আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকালো মুখর। তারপর আবারো চোখ সরিয়ে বললো,
‘কি হলো? কিছু বলছেন না যে?’
আমিও এবার সোজাসাপটা বললাম,
‘আসলে আমি ভেবেছি আপনি আমাকে নয় কথাগুলো আপনার সামনে যে আলমিরাটা আছে তাকে বলছেন।’
মুখর খানিকটা লজ্জা পেল বোধহয়। আর সে লজ্জাটা ঢাকার জন্যই সে আচমকা কাঁশতে শুরু করলো। আমি সেদিকে অতোটা নজর না দিয়ে বললাম,
‘আর একটা কথা! কোনো মেয়ের কথা শুনে এভাবে সারাঘর তোয়ালে পড়ে ঘোরার তো কোনো মানে হয় না, মুখর সাহেব!’
মুখরের ভ্রু ক্রমেই সোজা থেকে বেঁকে গেল। সে আমার দিকে এবার সরাসরি তাকালো। বললো,
‘কোনো মেয়ের জন্য তোয়ালে পড়ে ঘুরি মানে?’
আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম,
‘মুগ্ধ আমাকে সব বলেছে কিভাবে একটা মেয়ে আপনাকে হ্যান্ডসাম না বলায় আপনি সবাইকে সিক্স প্যাক দেখিয়ে বেড়ান। দেখুন, আপনার এসব বাদ দেওয়া…’
আমার কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে না দিয়েই মুখর থমথমে পায়ে চলে যায় পড়ার রুমে। হঠাৎ আমাকে এমন উপেক্ষা করার হেতু বুঝলাম না। তাই আমিও তার পিছুপিছু আসি। দেখি পড়ার টেবিলে মুগ্ধ আপনমনে তুষারপাতের ছবি আকঁছে। কিন্তু তাতে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মুখর মুগ্ধের কান ধরে তাকে বসা থেকে টেনে তুললো। আমি বাধা দিতে যাবো এমন সময় মুখর তার আরেক হাত দেখিয়ে আমাকে কাছে আসতে নিষেধ করলো। মুখর এবার মুগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘তুই যে দু’ষ্টু এটা আমি খুব ভালো করে জানি। কিন্তু এই দুষ্টামির সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছিস তুই! আজকে তোকে আমি মেরে লা’ল করে দেবো, অ’স’ভ্য।’
মুগ্ধ তার কানটা ধরে অনবরত বলে যাচ্ছে,
‘উহু! ভাইয়া ব্যাথা পাচ্ছি তো। কি করেছি আমি?’
মুগ্ধকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। আমি বারবার মুখরকে বলছি,
‘ছেলেটাকে ছেড়ে দিন, মুখর সাহেব। ব্যাথা পাচ্ছে তো!’
আমার কথায় মুখরের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। সে মুগ্ধকে প’শ্চা’ৎ’দে’শে গুণে গুণে পাঁচটা থাপ্পড় মারলো। এর মাঝে বললো,
‘তোর ম্যামকে তুই কি বলেছিস? আমি হ্যান্ডসাম না এটা কোন মেয়ে বলেছে? বল তুই এ কথাটা কে বলেছে?’
মুগ্ধ মুখ কুঁচকে মা’রের ব্যাথাগুলো সহ্য করছে আর বলছে,
‘আম্মু বলেছে কথাটা।’
মুখর ধমকে বলে উঠলো,
‘আমাদের মা কে তাহলে এভাবে অন্য মেয়ে বানিয়ে দিয়েছিস কেন?’
মুগ্ধ মুখরের দিকে ফিরে বললো,
‘মা তো একটা মেয়ে-ই তাই না?’
মুগ্ধের কথা শুনে মুখর এবং আমার দুজনেরই মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেল। মুখর এবার মুগ্ধের দিকে তেড়ে আসতে আসতে বললো,
‘দাঁড়া তোকে! দেখাচ্ছি আমি।’
কিন্তু ততক্ষণে মুগ্ধ মুখরের নাগাল হতে বেরিয়ে গেছে দূরে, বহুদূরে! এদিকে মুহুর্তেই বোকা বনে গেলাম আমি নিজেই। ব্যাপারটা হলো কি? মুগ্ধ ব্যাপারটাকে এমনভাবে আমার সামনে উপস্থাপন করেছে যেন মুখরের ভালোলাগার মানুষ তাকে অপমান করেছে! আর সে অপমান সইতে না পেরে বে’চা’রা মুখর শোকে পাগল হয়ে গেছেন।
মুখর আমার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, আর আমি মাথা নিচু করে ফ্লোরে চেয়ে আছি। মুখরকে আমি ভালোমতো চিনি না, জানি না। অথচ তাকে ভুল বুঝে এতো কিছু বলে ফেললাম। ছেলেটা আমাকে কি ভাবছে কে জানে? এ কেমন মূর্খতা আমার? হে খোদা! ধরণীটা এখনই ফাঁক করে দাও, আমি এর মাঝে ঢুকে নিজের লজ্জাটুকু বাঁচাই!
হঠাৎ নাকে কিসের পোঁড়া গন্ধ পেলাম। আরেকটু শুঁকে নিলাম ভালোভাবে। ঠিক তো! কিছু একটা পুড়ে যাচ্ছে। তখনই উপরে তাকিয়ে মুখরকে বললাম,
‘চুলোয় কি কিছু বসিয়েছেন? পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।’
মুখরের মাথায় হাত! সে সামনে পা বাড়িয়েই বললো,
‘ওহ শি’ট! চুলোয় রুটি দিয়ে এসেছিলাম।’
.
বাগান থেকে ঘুরে ঠিক পড়ার রুমে এসে পড়লাম আমি। ঘরটাতে দুটো বেডরুম আছে। অথচ একটিতেও কোনো মানুষ দেখতে পেলাম না। মানুষ বলতে আমি আসলে মুখর আর মুগ্ধের মা-বাবাকে খুঁজছিলাম। তাদের কাউকেই পুরো ঘরে দেখতে না পেয়ে আমার কেন যেন ঘটকা লাগলো। মুগ্ধকে আমি পড়াতে আসি সকাল ৭ঃ৩০ এর দিকে। এই সময়ে সবারই বাড়িতে থাকার কথা! সে যাই হোক, আমার দ্বিধাটা দূর করতে সরাসরি মুগ্ধের কাছে জানতে চাইলাম,
‘তোমার বাবা মা কি এ বাসায় থাকেন না?’
মুগ্ধ ড্রয়িং করতে করতে উত্তর দেয়,
‘জ্বি না! আব্বু অনেক আগেই মারা গেছেন আর আম্মু আমার দাদাবাড়িতে থাকে, বরিশাল!’
মুগ্ধের বাবা নেই কথাটা শুনেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে দু দুটো ছেলে এই ঢাকা শহরে একা থাকে। মুগ্ধের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলাম। তার জন্য খুব মায়া হলো আমার। কিন্তু মুগ্ধ কেন যেন বারবার আড়চোখে আমার দিকে দেখতে লাগলো। একবার, দুইবার নয় কয়েকবার! ব্যাপারটা বুঝতে আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকি। এরপর হঠাৎ মাথায় আসে তার একটা শাস্তি তো পাওনা রয়ে গেল। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলছি না বলেই সে আমার দিকে এতোবার দেখছে। বাম হাতটা জোরে টেবিলের উপর রাখলাম যাতে মুগ্ধ ভয় পায়। বরাবরের মতোই সে চমকে উঠলো এ শব্দে। আমার দিকে নিষ্পাপ চাহনিতে চেয়ে আছে। এই চাহনি দেখে কারোরই বোঝার উপায় নেই ছেলেটা কয়েকদিন আগে তার ভাইকে নিয়ে যা তা বলেছে। আমি তীক্ষ্ণ নজরে তাকে দেখে বললাম,
‘দোষ একটা তো করেছো-ই। তোমার ভাই তোমাকে শাস্তি দিয়েছে এবার শাস্তি দেওয়ার পালা আমার, তাই না?’
সেও মাথাটা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। চোয়ালটা শক্ত রেখেই বললাম,
‘শাস্তি হিসেবে এই মুহুর্তে ‘নেমন্তন্ন’ কবিতাটি পরপর পাঁচবার লিখে দেবে।’
সাথে সাথেই মুখটা গোমড়া করে ফেললো মুগ্ধ। লিখতে তার একদমই ভালো লাগে না এ বিষয়টা আমি জানি। কিছুক্ষণ পরই সে মাথাটা ধরে বললো,
‘ম্যাম, আমার না খুব মাথাব্যথা করছে। মাথাটা একদম তুলতে পারছি না। উহুঃ!’
আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি ছেলেটা মাথাব্যথার ভান করছে। এইটুকু একটা ছেলের আবার মাথাব্যথা? আমিও হালকা কেঁশে তাকে বললাম,
‘বেশি ব্যাথা করছে?’
সেও উপর নিচ একবার মাথাটা দুলালো। আমি মনে মনে বললাম, ‘হাহ্! জেন্টলম্যান, তুমি চলো পাতায় পাতায় আর আমি চলি ডালে ডালে!’
আমি বললাম,
‘মাথাব্যথা হলে তো পড়তে খুব ইচ্ছে হয়। লিখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু তোমাকে দেখে তো একটুও মনে হচ্ছে না তুমি পড়তে কিংবা লিখতে চাইছো!’
মুগ্ধ এবার আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
‘সত্যি বলছেন? মাথাব্যাথা করলে কি সত্যিই পড়তে ইচ্ছে হয়?’
আমিও এবার তার মতো দুবার মাথা দুলালাম অর্থাৎ সত্যিই! আমি তাকে আবারো বললাম,
‘তার মানে তোমার মাথাব্যাথা করছে না, তাই না মুগ্ধ? কারণ তুমি লিখতে চাইছো না!’
সে এবার তড়িৎ খাতাটা নিয়ে লিখতে লিখতে বললো,
‘না ম্যাম! আমার খুব মাথাব্যথা করছে, খুব!’
আমি মুচকি হাসলাম। ব্যাটা এবার লাইনে এসেছে। হাসিটা কোনোরকম চাপিয়ে আমি বললাম,
‘ঠিক আছে, তুমি পাঁচবার লিখে নাও। এরপর তোমার ছুটি।’
ছুটির কথা শুনে মুগ্ধ দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে লিখতে শুরু করলো। মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি!
(চলবে)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৩
#তাশরিন_মোহেরা
রান্নাঘরের টুংটাং ধ্বনি চারিদিক মাতিয়ে তুলছে। সাথে পো’ড়া ঘ্রাণটা আরও গাঢ়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। মুগ্ধের লেখার এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমি যে ঘ্রা’ণটা পাচ্ছি তুমিও কি তাই পাচ্ছো, মুগ্ধ? আগের চাইতে বেশি?’
মুগ্ধ খাতার দিকে চোখ রেখেই বললো,
‘এই পো’ড়া গ’ন্ধে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, ম্যাম। প্রতিদিনই ভাইয়া কিছু না কিছু পু’ড়ে ফেলে।’
মুগ্ধ আর মুখরের জন্য বড্ড মায়া হলো আমার। আহা! কি কষ্টেই না নিজেদের দিন পার করছে দুই ভাই। ইদানীং মানুষের প্রতি প্রীতি-মায়া আমার একটু বেশিই যেন বাড়ছে। মুখরের উপর দুঃখ করে মন মাঝারে বললাম, ‘আহারে মুখর সাহেব! আপনার প্রতি মায়া হচ্ছে। তবে আপনি পারবেন, অবশ্যই পারবেন সব সামলাতে!’
আমার উৎসাহটা মুখরের কানে পৌঁছালো না ঠিকই তবে মনে মনে এমন করে সবাইকে উৎসাহিত করতে আমার বেশ লাগে! সেকেন্ড খানেক পর আমি পড়ানো শেষ করে উঠতে যাবো এমন সময় মুগ্ধের ডাক পড়লো। আমিও সায় দিলাম যেতে। দেখি সে নাস্তা নিয়ে এসেছে আমার জন্য। তবে আজ অন্যদিনের মতো বিস্কিট কিংবা পাউরুটি নাস্তায় নেই। আছে ভিন্ন কিছু। ভাবলাম,’আহা! এই প্রথম কোনো ছেলের হাতে বানানো নাস্তা খেতে যাচ্ছি। বাহ! কি সৌভাগ্য আমার।’
খাবারটা ঠিক আমার সামনেই রাখলো মুগ্ধ। বরাবরের মতোই খাবার দাবারের প্রতি আমার তেমন একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ নাস্তায় ভিন্ন কিছু দেখে খাবারের প্রতি আগ্রহটা আরও কমে গেছে। হ্যাঁ! ঠিকই দেখছেন। আগ্রহ বাড়ার বদলে কমে গেছে। কারণ নাস্তায় আজ এসেছে পো’ড়া কালো দুটো রুটি আর আধসেদ্ধ আলুভাজি। এটুকু দেখেই ভাবলাম আমার সৌভাগ্য ক্রমেই দু’র্ভা’গ্যে নেমে এসেছে! বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে গিয়েও বোধহয় আমার এতোটা বেগ পো’হা’তে হয়নি যতটা রুটিটুকুর আকার বুঝতে পো’হা’তে হচ্ছে!
নাস্তা দিয়েই মুগ্ধ আমার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। যেন আমি একজন মাস্টারশেফ আর তার মুখর ভাই একজন প্রতিযোগী! আমিও তার দিকে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে রুটিটা মুখে পুরলাম। যত যাই হোক, বাইরে তো ভদ্রতা দেখাতেই হবে। তবে ভদ্রতার খাতিরেও মুখের খাবারটা আর গ’লা’ধঃ’ক’র’ণ করা গেল না আমার পক্ষে। রুটিতে তো কোনো লবণ নেই-ই বরং আলুভাজিতে একদলা লবণের সমাহার আর মসলায় ভরপুর। আমি মুখশ্রী বিকৃত করে মুখের খাবারটা ফেলে দিলাম। এতে হেসে কুটি কুটি মুগ্ধ। হাসতে হাসতে সে বললো,
‘আমি জানতাম, ম্যাম! খাবারটা আপনার পেট পর্যন্ত যেতে পারবে না। এটা হলো আমার মুখর ভাইয়ের স্পেশাল টেলেন্ট। এমন খাবার বানায় যা কেউই গি’ল’তে পারে না।’
এটুকু বলে সে আবারো হো হো করে হাসতে লাগলো। আমি এক চুমুক পানি খেয়ে মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোমরা কি রোজ এগুলোই খাও?’
সে মুখটা তখনি মলিন করে বললো,
‘হুম!’
হঠাৎ ফোনের রিংটোনে চমকে উঠলাম। আজ কিছু বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল আমার। আমি এদিক সেদিক একবার তাকিয়ে দেখি কোথাও মুখর সাহেব আছে কিনা! নাহ! সে আশেপাশে কোথাও নেই। আমি ব্যাগ থেকে তক্ষুণি একটা আয়না আর লিপস্টিক বের করলাম। আয়না খুলে লিপস্টিক ঠোঁটে দেওয়ার মাঝপথে দেখি মুগ্ধ থুতনিতে দুইহাত রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কান্ড দেখছে। আমি লিপস্টিকটা পুনরায় ব্যাগে রেখে বললাম,
‘কি দেখছেন মুগ্ধ সাহেব?’
মুগ্ধ হালকা হেসে বললো,
‘এই লিপস্টিকে আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ম্যাম!’
আমি মুচকি হেসে তার মাথায় একটা চাপড় মারি। এটা আমার বহু পুরোনো অভ্যাস। খুব বেশি লজ্জা পেলে আমি পাশের জনকে চাপড় মারি। এরপরপরই তাড়া দিয়ে মুগ্ধকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
.
আজ কালি পুজোয় ভার্সিটি বন্ধ থাকায় খুব রয়েসয়ে মুগ্ধের বাসায় এলাম। এসে দেখি মুগ্ধ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আজ ছুটি বলে দেরিতে উঠছে। মুগ্ধের জন্য পড়ার রুমে অপেক্ষা করছি। তখনি আমার চোখ যায় ঠিক সামনের জানালায়। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেলি। তা দেখেও না দেখার ভান করছি। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না! চোখটা বারবার সেদিকে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে মনকে। শেষমেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে পড়ি। রুম থেকেই ডাকতে থাকি,
‘মুখর সাহেব! আছেন? মুখর সাহেব?’
মুখর শার্টের হাতা গুটিয়ে সেই চেনা পরিচিত বিরক্তিমাখা চাহনি দিয়ে সামনে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘কি হলো, মিস.তিথিয়া? কোনো সমস্যা?’
আমি তড়িৎ রুম থেকে বেরিয়ে তার ঠিক সামনে এসেই বললাম,
‘ঐযে! ওদিকে একজন আমাকে অনেকক্ষণ হলো ডিস্টার্ব করছে!’
আমার চোখে একঝাঁক ভয় দেখে মুখরও বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে আমার তাক করা আঙুল অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
‘কে ডিস্টার্ব করছে? ব্যাটাকে এখনই শায়েস্তা করছি।’
আমি মুখরের কথায় কিছুটা সাহস পেলাম। বললাম,
‘আপনি আমাকে প্রমিস করুন, তাকে একদম ধরে দূরে ফেলে দিয়ে আসবেন! প্রমিস করুন!’
মুখর এবার ভ্রুজোড়া আবারো কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললো,
‘মানে?’
আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
‘প্লিজ মুখর সাহেব। আপনি আগে আমাকে প্রমিস করুন, প্লিজ!’
মুখর কিছু বুঝতে না পেরেও দুবার মাথা দুলালো। দ্বিধায় পড়ে বললো,
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। প্রমিস করছি!’
এবার আমাকে নিয়ে সে জানালার কাছে যায়। জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে বলে,
‘কে ডিস্টার্ব করছে আপনাকে? বলুন আমাকে? কে আমাদের বাড়ির শিক্ষিকাকে ইভটিজিং করার সাহস পায়?’
আমি মুখরের পেছন হতে জানালার পাশের দেয়ালে আঙুল তাক করলাম। সেখানে একটি মাকড়সা বসে আছে। অন্য কোনো পোকামাকড় আমি তেমন ভয় না পেলেও মাকড়সাকে আমি যমের মতো ভয় পায়। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে মুখরকে বললাম,
‘এই যে, এই মাকড়সাটা আমাকে ডিস্টার্ব করছিলো।’
মুখর কিছুক্ষণ মাকড়সাটার দিকে তাকিয়ে পুনরায় আমার দিকে ফিরলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললো,
‘আপনি আমার সাথে মজা করছেন, মিস.তিথিয়া?’
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,
‘আশ্চর্য তো! আমি আপনার সাথে কেন মজা করতে যাবো? আমি এখানে আসার পর থেকে সে আমাকে ইভটিজিং করে যাচ্ছে! দেখুন, দেখুন। এখনো কেমন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!’
মুখর কোমড়ে দু’হাত গুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের রাগটুকু সামলালো যেন। আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
‘কি হলো, মুখর সাহেব! মাকড়সাটাকে ধরে দূরে ফেলে আসুন। আপনি কিন্তু প্রমিস করেছেন।’
সেই মুহুর্তেই পড়ার রুমে আগমন ঘটে মুগ্ধের। সে সোজা মাকড়সাটার দিকে এগিয়ে তাকে ধরে ছুড়ে মারে জানালার বাইরে। এরপর আমার দিকে ফিরে শাহরুখ খানের মতো দু’বাহু প্রসারিত করে বলে,
‘মে হু না!’
আমি ফিক করে হেসে উঠলাম তার আচরণে। মুখর সাহেবকে কিছুটা উপহাস করে বললাম,
‘আমার স্টুডেন্ট দেখি আপনার থেকেও বেশি সাহসী, মুখর সাহেব।’
মুখর আমার দিকে বিরক্তিতে চেয়ে বললো,
‘সাহসী না ছাঁই! শিক্ষিকা – ছাত্র দুইটাই পাগল।’
এই বলে হনহনিয়ে চলে যায় মুখর। আমি তার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট বের করে উপহাস করলাম আরও একবার। এরপর মুগ্ধকে বললাম,
‘দেখেছো, তোমার ভাইয়া কেমন জ্বলছে তোমায় নিয়ে! হুহ!’
(চলবে)