#মধুবালা [১৩]
#ফারজানা_আক্তার
আমিই খু’ন করেছি ছোঁয়ার মাকে কারণ আমার মনে হয়েছিলো সেদিন রাতে আমার কথা সব ছোঁয়া শুনেছে। আমি সেদিন রাতে দরজা খুলে বাহিরে গিয়ে দেখলাম ছোঁয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। আর ছোঁয়া সবাইকে বলে দেওয়ার আগেই যদি আমি ওর মাকে শেষ করে দিতে পারি তবে ছোঁয়া আমার কথা ভুলে মায়ের শোকে ব্যস্ত হয়ে পরবে। আমি চাইলে ছোঁয়া কেও মা’র’তে পারতাম কিন্তু আমি ভালো করেই জানতাম যে ছোঁয়ার কিছু হলে শুভ্রকে আর পাওয়া হবেনা আমার, শুভ্র ছোঁয়ার শোকে শেষ হয়ে যাবে, আমি জেনে গিয়েছিলাম যে শুভ্র ছোঁয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি ধন সম্পদের লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ক্ষমা করে দিন সবাই আমায় প্লিজ। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং তাকে আমি খুব ভালোবাসি। শুধুমাত্র ধন সম্পদের লোভেই আমি শুভ্র কে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম এবং মানুষ খু’ন করতেও পিছুপা করিনি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি ক্ষমা করে দিন সবাই আমায়। আমি কথা দিচ্ছি আমি সব ছেড়ে চলে যাবো অনেক দূরে।”
ন্যাকা কান্না করতে করতে কথাগুলো বলে টিয়া। টিয়ার মা বাবা ভীষণ অবাক। তাদের মেয়ে যে সত্যি সত্যি এমন একটা কাজ করে বসবে এটা তারা ভাবতেও পারেনি।
ছোঁয়ার মনে পরলো সেদিন ছোঁয়া লিলির সাথে দেখা করেই নিজের রুমে ফিরছিলো। ছোঁয়া এবার শক্ত হয়ে টিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে ঠা’স ঠা’স দুটো থা’প্প’ড় লাগিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠে “তুই ক্ষমা চাইলেই কী আমার মা ফিরে আসবে আবার? পারবি আমার মাকে ফিরিয়ে দিতে তুই? পারবি আমাদের সংসার টা পূর্ণ করে দিতে তুই? পারবি আমার মায়ের আদর স্নেহ ফিরিয়ে দিতে? যদি পারিস তবেই ক্ষমা পাবি তার আগে নয়। ”
কথাগুলো বলেই আবারও কান্নায় ভে’ঙে পরে ছোঁয়া। শুভ্র এগিয়ে গিয়ে এক হাত দিয়ে ছোঁয়ার বাহু জরিয়ে টিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে “কিভাবে মা’র’লি তুই মেজু আম্মুকে যে আমরা কেউ একটুও বুঝতে পারিনি?”
“বালিস চেপে। সবাই যখন নাস্তা করতে বসেছিলো তখন আমি আন্টির রুমে গিয়েছিলাম। আন্টি আমাকে দেখে বসতে বললেন। আমি বসলাম আন্টি শুয়ে ছিলেন। বলছিলেন শরীর নাকি কিছুটা অসুস্থ তাই। আমিও এই সুযোগে আমার কাজ সেরে চুপচাপ এসে নাস্তা করতে বসে গিয়েছিলাম।”
“তুই বল এখন তোকে কি করা উচিত?”
“প্লিজ শুভ্র ক্ষমা করে দাও আমায়?”
“লজ্জা করছেনা তোর? কোন মাটি দিয়ে তৈরি রে তুই? তোকে এখন নিজের মামাতো বোন ভাবতে ঘৃ’ণা হচ্ছে আমার।
শুভ্র ভাই তুমি কিভাবে জানলে টিয়া মেজু আম্মুকে মে’রে’ছে?”
খুব রা’গ নিয়ে কথাগুলো বলে লিলি। শুভ্র একটু গলা খাখারি দিয়ে বলে “যখন সবাই আহাজারি করছিলো মেজু আম্মুর মৃত্যুতে তখন আমিও খুব ভে’ঙে পরছিলাম আর ছোঁয়ার অবস্থা দেখে ওর কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলাম না তাই দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ তখন আমার চোখ যায় টিয়ার দিকে। টিয়ার ঠোঁটে অদ্ভুত রহস্যময় হাসি দেখে আর আগের রাতের কথাগুলো শুনে কেনো যেনো ওর উপরে সন্দেহ হলো কারণ আমাদের মেজু আম্মুর তো তেমন কোনো রোগ ছিলোনা যে এভাবে হঠাৎ মৃত্যু হবে তাই আমি সবার আঁড়ালে মেজু আম্মুর রুমে যায় তখনই এবং ওখানে গিয়ে অনেক খুঁজাখুঁজির পর একটা বালিসের সাথে পেলাম নীল রংয়ের একটা নক। আর আমাদের বাসায় এমন রংয়ের আলাদা কেনা নক টিয়া ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করেনা তারপর দেখলাম ভাগ্যক্রমে আমি ওই রুম থেকে আসার পরেও ওই নক গুলো টিয়ার নকে লাগানো ছিলো শুধু একটা নক বাদে।
বাই দ্যা রাস্তা এতক্ষণ টিয়া নিজের মুখে যা স্বীকারোক্তি করেছে সব রেকর্ড করা হয়েছে তাই ওর বাঁচার আর কোনো উপায় নেই।”
সবাই স্তব্ধ। থমথমে পরিবেশ। ছোঁয়ার গাল বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। টিয়া খুব মিনতি করে বলছে ওকে ক্ষমা করার জন্য। এবার বেলাল মির্জাও মুখ ফিরিয়ে নিলেন টিয়ার থেকে। নাজমা বেগম খুব অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। টিয়া যে তার ভাইয়ের মেয়ে। শুভ্র যদি এই বিষয়ের জন্য উনার থেকে আরো দূরে চলে যান এটার জন্যই উনার ভয় হচ্ছে বেশি।
নীরবতা ভে’ঙে টিয়া বললো ও ঢাকা চলে যাবে। সাথে সাথেই শুভ্র পুলিশ ডাকে। এবার টিয়া সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। মহিলা পুলিশ এসে টিয়ার হাতে হাত খরা পড়ালো। টিয়া চিৎকার করছে কিন্তু আজ টিয়ার চিৎকারে কেউ কান দিচ্ছেনা শুধু ওর বাবা মা ছাড়া।
দেখতে দেখতে টিয়া সবার চোখের আঁড়ালে চলে গেলো। এবার কাজি সাহেব মুখ খুললেন। নরম কণ্ঠে বললেন “যা বুঝলাম বিয়ে তো আর হবেনা এবার আমি চলি তবে।”
এটা বলেই কাজি চলে যেতে নিলে শুভ্র আঁটকায় উনাকে। সবাই আবারও অবাক হয় কারণ শুভ্র বলে বিয়ে এখনই হবে শুভ্র ছোঁয়ার। কথাটা শুনতেই বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন রেগেমেগে কয়েকটি কথা শুনিয়ে দেন শুভ্রকে। শুভ্র তবুও বলে সে ছোঁয়াকে বিয়ে করবে এবং আজই করবে। ছোঁয়া এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলো, এখন সে মাথা উঁচু করে শুভ্রর দিকে তাকিয়েছে কারণ এই প্রথম শুভ্র ছোঁয়ার জন্য বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুনের সাথে তর্ক করছে। জীবন মির্জা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেননি কারণ উনার কথা বলার মতো যে মুখ নেই। মান্নান মির্জা কিছু বলেছেননা আজ কারণ মান্নান মির্জার জায়গায় আজ শুভ্র দাঁড়ানো, শুভ্র আজ ছোঁয়ার পাশে আছে তাই মান্নান মির্জা নিজের জায়গায় বসে দেখছে যা হচ্ছে। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি এখন আর নিজের মধ্যে নেই। লিলি ওর বাবা আর দাদির উপর বেশ অসন্তুষ্ট তবে শুভ্রর প্রতি ভীষণ সন্তুষ্ট আজ।
লিলি মনে মনে ভাবছে এভাবে যদি সে আলিফ কে পেয়ে যায় তবে আর কোনো চাওয়া থাকবেনা ওর কিন্তু আলিফের মধ্যে যে অন্য রহস্যের বাসা তা লিলি ঠিকই টের পেয়েছে শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছে সে।
বেলাল মির্জার গর্জনে লিলির হুঁশ ফিরে।
“এই ছোঁয়া কে আমি কখনোই আমার ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারবোনা। এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি আর কিছু শুনতে চাইছিনা।”
“তাহলে তুমিও শুনে রাখো আমি ছোঁয়াকেই বিয়ে করবো তা আজকেই। ছোঁয়াকে নিয়ে আমি দূরে চলে যাবো এই পরিবার থেকে। অনেক দূরে চলে যাবো। যেভাবে ছোটবেলায় আমার মা আমাকে নিজের থেকে এই পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো সেভাবে এখন আমি নিজেই নিজেকে সবার থেকে আঁড়াল করে নিবো। শুধু পার্থক্য হবে সেবার আমি ছোট ছিলাম আর এখন আমি বড় হয়েছি এবং আমার সাথে আমার ভালোবাসার মানুষ থাকবে এবার।”
“দেখ শুভ্র তুই কিন্তু তোর মাকে এখনো ভুল বুঝে আছিস। হ্যাঁ আমি প্রথমে চাইনি তোকে বোডিং স্কুলে ভর্তি করতে কিন্তু পরে আমিও চেয়েছিলাম আর তাই তোর মা তোকে ভর্তি করতে পেরেছে। তোর ভালোর জন্যই তোর মা তোকে বোডিং স্কুলে ভর্তি করেছিলো। তুই ছোটবেলায় প্রচুর দু্ষ্টু ছিলি, রোজ মানুষে তোর নামে অভিযোগ নিয়ে আসতো বাসায় তাই বাধ্য হয়ে তোর মা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এবং আমরাও তাতে মতামত দিয়েছিলাম। শুধু শুধু এতোগুলো বছর ধরে তুই তোর মাকে ভুল বুঝে দূরে সরে আছিস তার থেকে। এখন আবার এসব বলে তুই তোর মাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছিস বুঝতে পারছিস তুই?”
“এতো বুঝাবুঝির দরকার নাই আমার। ছোঁয়াকে মেনে নিলে আছি আমি নয়তো চলে যাবো ওকে নিয়ে। এবার সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে। আমার নাহ আমার মায়ের ভাইয়ের মেয়ের মতো ধন সম্পদে এতো লোভ নাই আবার। আমি সাধারণ ভাবে চলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাই তো অন্য কোম্পানিতে উঁচু পদে জব করি নিজপর যোগ্যতায়।”
“দেখ দাদুভাই আমার জন্য তোরা সবাই সমান। তাই বলে বাড়ির মেয়েকে বাড়ির বউ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নাহ।”
“ওহ্ সিরিয়াসলি দাদিই? তোমরা ছোঁয়াকে এই পরিবারের একজন মানো? বিশ্বাস করো ছোঁয়া এই বংশের-ই মেয়ে?
আর এতো লুকালুকি করিও না প্লিজ। সব জেনে গিয়েছি আমি। ছোঁয়ার জন্ম পরিচয় জেনে গেছি আমি এবং এটাও জেনে গিয়েছি যে ছোঁয়া এই বংশের-ই মেয়ে এবার তোমরা বিশ্বাস করো বা না করো তাতে আমার কিছুই যাই আসেনা।”
ছোঁয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। আজ যেনো সে এক নতুন শুভ্রকে দেখছে।
ছোঁয়ার বুকটা হঠাৎ ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো। ওর জন্ম পরিচয় কি হতে পারে? কেনো সবাই ওর সাথে এমন আচরণ করে তা সে জানার জন্য অধীর আগ্রহে আছে।
সবাই আজ শুভ্রকে নতুন রুপে দেখছে যেনো এমনভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
এবার শুভ্র ওর মা নাজমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন “কি আপনিও কী রাজি নয় আমার আর ছোঁয়ার বিয়েতে। থাক কাউকেই রাজি থাকতে হবেনা। কাজি মোল্লা মামা বিয়া পড়ান।”
সবাইকে চমকে দিয়ে নাজমা বেগম বলে উঠলেন “এই বিয়ে হবেনা এভাবে। আমি হতে দিবোনা এই বিয়ে। আমার ছেলের বউ আমিই পছন্দ করবো। নিজ হাতে সাজাবো আমি আমার ছেলের বউকে। ছোঁয়ার মধ্যে আমি আমার ছেলের বউয়ের কোনো প্রতিচ্ছবিই পাচ্ছিনা।”
শুভ্র রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই_____
#চলবে_ইনশাআল্লাহ