রাজপুত্র পর্ব -০১

#রাজপুত্র : পর্ব – ১ #

আমরা দুই ভাইবোন…আমি স্বপন – বড় আর আমার অতি আদরের ছোট বোন – কানন। আমাদের বাবা নেই… তিন বছর আগে ক‍্যানসারে ভুগে মারা গেছেন। তিনি সরকারি ব‍্যাঙ্কের ম‍্যানেজার ছিলেন। আমাদের কোনো অভাব অনটন ছিলো না, নিজেদের পাঁচ তালা বাড়ি, গাড়ি সবই ছিলো কিন্তু বাবার চিকিৎসায় বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নেই…ঘাতক ব‍্যাধিতে প্রচুর খরচ হয়েছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি হয়নি, তবু বাবাকে বাঁচানো যায়নি।

মা বাড়িটাও বেঁচে দিতে চেয়েছিলেন। বাবার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, মাকে দিশেহারা করে ফেলেছিল – যে কোনো মূল‍্যে স্বামীকে বাঁচানোর প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবেননি তিনি। বাড়ি বিক্রির কথায় বাবা মাকে বলেছিলেন… সবই তো শেষ করলে, বুঝতেই পারছো, আমার আর কোনো আশা নেই, বাড়িটা থাক, ছেলেমেয়ে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাইটুকু রাখো, নিজস্ব একটা আশ্রয় অন্তত তোমাদের রইলো…এই সান্ত্বনা, শান্তি নিয়ে আমাকে যেতে দাও, আজ যদি স্বপন….
আর কিছু তিনি বলতে পারেননি.. কান্নায় তাঁর কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ।

কানন কলেজে পড়ে – প্রথম বর্ষ। বাড়ি ভাড়ার টাকায় আমাদের জীবন চলে, গাড়িটা প্রথমেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো, তারপর আর কেনা সম্ভব হয়নি, তাই বাসেই কানন কলেজে যাতায়াত করে। আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বাসস্ট্যান্ড। বোনের শত মানা সত্ত্বেও রোজ ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসি আবার ফেরার সময় হলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকি।
বাস থেকে নেমেই কানন ‘ ভাইয়া ‘ বলে ডেকে, কাছে এসে আমার হাতটা ধরে…আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বোনটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই — যেখানে আমাদের মা অধীর উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করে থাকেন।
সন্তানরা বাড়ি ফিরলে তবেই তাঁর শান্তি, আমরা মা’র দুই নয়নের দুটি মনিই তো তাঁর এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

অনেক সময় ভীড়ের জন্য বাস আসতে দেরী করে, অস্থির লাগলেও, চুপচাপ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি। ফুটপাতে চায়ের দোকান আছে, সেখানে চা খেতে লোকজন আসে, নানারকম কথা বলে তারা, সেসব শুনে ভুলে থাকি।
একদিন, অপেক্ষা করছি কাননের জন্য, আজো ওর দেরি হচ্ছে…যথারীতি উদ্বেগে আমার মন অস্থির…এমন সময় শুনতে পেলাম মিষ্টি একটা কন্ঠ…
— ছেলেটা কি ভীষন বেহায়া, রোজ ঠিক সময় মত দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের জন্য ।
অন্য আর একটা মেয়ে, এর গলার স্বর ও সুন্দর, তবে নরম, প্রথমটার মত রাগ ও ক্ষোভে ভরা নয়, বললো…
–তোর যেমন কথা, আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে কেন, নিশ্চয়ই তার কোনো কাজ আছে।
— কাজ না কচু, বলতে চাস ঐ বুড়ো চাওয়ালাটাকে দেখবার জন্য আসে রোজ? কবে থেকে দেখছি, একদিন ও ভুল হয় না সময় মত আসতে, অভদ্র কোথাকার।
— তোর মত রূপসীকে দেখে যার মুন্ডু ঘুরবে না, সে কি পুরুষ? তবে যাই বলিস, ছেলেটা কিন্তু দারুন হ‍্যান্ডসাম, লেডি কিলার… একদম রাজপুত্রের মত দেখতে…

আরও কি কথা বললো শুনতে পেলাম না, দুরে চলে গেছে ওরা। মনে মনে হাসলাম — বেদনার,কষ্টের হাসি। এরপর রোজই মেয়ে দুটি আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নানারকম মন্তব্য করে আমাকে নিয়ে, বলাইবাহুল‍্য, সেসব শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগে না, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করার উপায়ও যে আমার নেই।
ওদের কথায় জানতে পারলাম কাছাকাছি কোথাও কোচিং করতে যায় দুই বান্ধবী। তাদের নামও জানা হয়ে গেছে.. আমার ওপর যে অসন্তষ্ট.. তার নাম মিষ্টি, বেশ নাম — উদাস হয়ে ভাবলাম, তাতে আমার কি? অন‍্য মেয়েটি নীলা, সংযত কথাবার্তা, মিষ্টির মত রাগি নয় মোটেও , আবারও ভাবলাম আমার কি তাতে।

একদিন মিষ্টি ব‍্যঙ্গ করে বললো…ঢং করে আবার রোজ সানগ্লাস পরা হয়, মেয়েদের দেখতে খুব সুবিধা, তাই না। নীলা হাসতে হাসতে বলে… তোর সমস্যাটা কি, এত রূপবান একজন পুরুষ যদি রোজ আসে, অসুবিধা কোথায়?
এমনি সব কথা শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
কি আর করা, নীরবে হজম করে যাই, আমার বেদনা ভরা অন্তর নিঃশব্দে কাঁদে…. যে কান্না কেউ শুনতে পায় না।

আমার মন খারাপ হয় ঠিকই কিন্তু আবার কান পেতে কথাগুলো শুনিও। যেমন নীলা আজকে বলছিলো…
— এমন নিষ্ঠাবান পুরুষ যদি রোজ তোর জন্য আসে, তোর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ক্ষতি কি, প্রেম তো এভাবেই হয়।
— এরকম ফালতু প্রেমে আমার আপত্তি আছে, বখাটের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাভাতের মত তাকিয়ে থাকা, ছি, আর আমার জন্য কেন, তুই কি গায়েব হয়ে থাকিস, তোকে দেখে না?
–ঈস, আমি কি তোর মত সুন্দরী, ভদ্রলোক তোর জন্যই আসে… তাছাড়া সে তো দেখি চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকে, আমাদের সাথে আলাপ করার কোন আগ্রহ বা চেষ্টা তো দেখি না, আমরা যা বলি, ওর কানে কি আর যায় না? কিছুই তো বলে না।
— বেশ, একদম গুড বয় তাই না, তা তোর দেখি খুব দরদ, কি ব‍্যাপার?
লজ্জা পেয়ে লাজুক হাসে নীলা …যাঃ কি যে বলিস।

ওরা বোধহয় আশেপাশেই কোথাও থাকে। মাত্র কিছু দিন হলো এদের কথাবার্তা শুনছি, তাই ধারণা করলাম, এই এলাকায় নতুন এসেছে।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবি… আমার সম্বন্ধে কত ভুল ধারণা মিষ্টির, কাননকে দেখেনি নাকি, বোনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি এতদিনেও বোঝেনি, অবশ‍্য কানন যে আমার বোন সেটা ওরা জানবে কিভাবে।
যাকগে, কে কি ভাবলো না ভাবলো সেটা নিয়ে আমার কিসের মাথা ব‍্যথা।
দিন যায়, বেশ বুঝতে পারছি, মিষ্টির বিরূপ কথা সত্ত্বেও ওর প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি, জানি আমার এই অসম্ভব ইচ্ছা কখনো পূরণ হবার নয়।

মিষ্টিকে নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি, অন্তরে একরাশ যন্ত্রনা নিয়ে।

সেদিন…বাস থেকে নেমে কানন ডেকে উঠলো…..
— ভাইয়া ‘
ওর ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে এগোতে যেয়ে ধাক্কা লাগলো কারও সাথে… সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড এক চড় খেলাম গালে, সাথে মিষ্টির আগুন ঝরা কন্ঠের বুলি…
— ইতর, বদমাশ, চোখে দেখতে পাও না? ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে এতদিনের মনের কুৎসিত ইচ্ছে পূরণ করলে, তাই না?
ধাক্কা লেগে সানগ্লাসটা পড়ে গিয়েছিল, তুলতে পারলাম না, অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলাম… আমার যে কোনো উপায় নেই।
কানন পুরো ঘটনা দেখেছে, সে চিৎকার করে উঠলো…
–এই মেয়ে, দাঁড়াও ওখানে, মজা দেখাচ্ছি।

দৌড়ে এসে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে চেচিয়ে উঠলো কানন…তোমার এত বড় সাহস, আমার ভাইকে মারলে?
— মেরেছি বেশ করেছি, এইসব বদমাশদের এভাবেই শায়েস্তা করতে হয়, ধাক্কা দিলো কেন আমাকে, কানা নাকি?
বিস্মিত সুরে নীলা বললো..উনি তোমার ভাই? তোমার জন্যই রোজ দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে?
এই কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো কানন, রূদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলো…
— আমার ভাই বদমাশ নয়,তার মত ভালো মানুষ কমই আছে, ভাইয়া ইচ্ছে করে তোমাকে ধাক্কা দেয়নি, আমার ডাক শুনে এগিয়ে আসছিলো, তোমাকে দেখতে পায়নি, পাওয়ার কথাও নয়… আমার ভাই…আমার ভাই চোখে দেখতে পায় না… অন্ধ।।

# চলবে #

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here