#রাজপুত্র : শেষ র্পব *
হ্যাঁ, আমি অন্ধ — যখন আমি মাধ্যমিক দেবার জন্য প্রস্তত হচ্ছিলাম, সেই সময় আমার টাইফয়েড হয়, পরবর্তীতে সুস্থ হলেও, চোখের জ্যোতি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তাররা কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি , শুধু বলেছিলেন..চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হচ্ছে, হয়তো ভবিষ্যতে আমি দৃষ্টি ফিরে পেতে পারি কিন্তু সেটা কবে তা জানিনা, ডাক্তাররাও বলতে পারেননি…. আমি হতাশ হইনি….. এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আমি আবার দুই নয়ন ভরে দেখতে চাই আমি আশা নিয়েই প্রহর কাটাই।
বাবা আমার চিন্তায় সারাক্ষণ মানসিক চাপে থাকেন, আর মা? আমার আড়ালে কাঁদেন, আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া চান….. আমার নিষ্পাপ ছেলেকে তুমি দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও, কানন ও আমাকে লুকিয়ে কাঁদে….. আমার সামনে সবাই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে কিন্তু আমি সবই টের পাই।
আমার পরিবারের আন্তরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা সব ভুলিয়ে দেয়…. আমাকে ওরা মন খারাপ করার কোনো সুযোগ দেয় না।
……………….
কাননের হাহাকারে চারপাশের শোরগোল নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। মিষ্টি স্তম্ভিত, বেদনায় মুখ বির্বণ। নীলা ব্যথিত সুরে আস্তে আস্তে বলে… ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছি আমরা…না জেনে কত কিছু বলেছি…এত সুন্দর চোখ দুটো… অথচ…
আর কিছু বলতে পারলো না, নির্বাক দুই বান্ধবী চেয়ে রইলো স্বপনের দিকে।
সানগ্লাসটা তুলে ভাইকে পরিয়ে দিয়ে বিমর্ষ কানন বললো… চল ভাইয়া বাসায় যাই। বোনের হাত শক্ত করে ধরে আমি হাঁটতে লাগলাম…বুকে অবর্নণীয় কষ্ট দলা বেঁধে আছে।
আমি বুঝতে পারছি, কানন কাঁদছে কিন্তু কোনো সান্ত্বনার কথা ওকে বলতে পারলাম না, মিষ্টিকে নিয়ে দেখা দুদিনের সুখস্বপ্ন আমার তাসের ঘরের মত ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
মিষ্টির চোখ দিয়ে অনুতাপের অশ্রু ঝরে পড়ছে। নিজেদের অজান্তেই স্বপনদের সাথে যেতে লাগলো ওরা। স্বপনদের গেট পযর্ন্ত এলো কিন্ত ভেতরে ঢুকলো না, কানন দেখলো ওদের, সে কিছু না বলে ভাইকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলো।
মা আমাদের চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন, কিছু হয়েছে, উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যাপার কি জানতে চাইলেন। মা’র কাছে ঘটনা গোপন করতে মন চাইলো না। সবই খুলে বললাম। শুনে মা তখনই জায়নামাজে বসে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন… আল্লাহ্ আমার নির্দোষ ছেলেটাকে তুমি আর কষ্ট দিও না, ওকে তুমি শান্তি দাও…..
অব্যক্ত বেদনায় মা’র হ্নদয় দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। সন্তানের জন্য মা’র দোয়া কবুল হয়…মিষ্টির বাবা পরদিনই আমাদের বাড়ি এলেন, মিষ্টির সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মা প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারলেন না তারপর বিষন্ন কন্ঠে বললেন… শুনেছি আপনার মেয়ে খুব সুন্দরী, আমার অন্ধ ছেলের সাথে ওর বিয়ে দেবেন?
দৃঢ় কন্ঠে দ্বিধাহীন ভাবে ভদ্রলোক বললেন…হ্যাঁ, দেবো, কারণ, মিষ্টি আমার একমাত্র সন্তান, আজ পযর্ন্ত ওর কোনো আবদার অপূর্ণ রাখিনি, যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, মিষ্টি খুব জেদী… আমাকে শাসিয়েছে, এই বিয়ে না হলে ও আর কখনো বিয়ে করবে না এবং যে কোনো মূল্যে স্বপনের চোখ ভালো করে দিতে হবে।
হাসতে হাসতে মিষ্টির বাবা আরো বলতে লাগলেন…
— পাগলী মেয়ে আমার কাল থেকে না খেয়ে আছে, আমি ওকে কথা দিয়ে এসেছি, এই বিয়ে হবেই, আমি সানন্দে রাজী, আপনি ও আর অমত করবেন না।
***************
কখনো কখনো স্বপ্নও তাহলে সত্যি হয়!! আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি, মিষ্টির চড়ের দাগ নিশ্চয়ই এখনো আমার গালে আছে, কেন – কিভাবে ইত্যাদি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো মনে, কাউকেই কিছুই বলতে পারলাম না আমি,কেবল রূপকথার রাজ্যে উড়ে বেড়াচ্ছি…. সত্যিই মিষ্টি আমার হবে!!
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মিষ্টির সাথে মহা ধুমধাম করে আমার বিয়ে হয়ে গেলো… স্বপনের জীবন মিষ্টি হলো।
বাসর রাত… মিষ্টি দেখতে এমনিতেই সুন্দর, আর আজ নববধূর সাজে অপ্সরীর মত লাগছে ওকে। আমি কেমন করে জানলাম? চোখে দেখতে পাই না ঠিকই কিন্তু আমার অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর, তাছাড়া বাসর ঘরে ঢোকার আগে শীলা চুপিচুপি বললো — — দুলাভাই আপনি তো রাজপুত্র… আমার বান্ধবীও কম নয়, নববধূর সাজে ওকে অপ্সরীর মত লাগছে। শীলার রসিকতায় হেসে বললাম — আর তোমাকে কেমন লাগছে, সেটা তো বললে না, ও বুঝেছি… তোমার রাজপুত্র যখন আসবে তখন আমিও সেই ভাগ্যবানের কানেকানে বলে দেবো… আপনার জন্য রাজকন্যা শীলা অপেক্ষা করছে বধূবেশে — শীলা আমার হাতে আলতো চড় দিয়ে বললো — কি দুষ্টু, অসভ্যরে বাবা… বলেই হাসতে হাসতে পালিয়ে গেলো।
প্রিয়তমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি আমি, এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে স্বপ্ন নয়, মিষ্টিকে আমি একান্ত আপন করে পেয়েছি… হ্নদয়ে অনাস্বাদিত পুলক, কি ভালো যে লাগছে, বলে বোঝানো যাবে না।
বধূর হাতটা বুকে চেপে বললাম…. শেষ পযর্ন্ত একটা ইতর, বদমাশকে বিয়ে করলে!
মিষ্টি আমাকে আঁকড়ে ধরে বললো… আমাকে মাফ করে দাও স্বপন, না জেনে তোমাকে অনেক ব্যথা দিয়েছি।
–করুনা করেছো আমাকে, একজন অন্ধকে দয়া করে বিয়ে করেছো।
আমাকে আরো নিবিড় বাহুমূলে জড়িয়ে নিয়ে মিষ্টি বললো…না গো, করুণা নয়, ভালোবেসেছি তোমায়, সেই ভালোবাসার আলোয় তোমার জীবনের সব অন্ধকার দুর করে দেবো…আমার রাজপুত্র অন্ধ হতে পারে না, আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখবে তুমি, তোমাকে ভালোবেসেছি, আমার ভালোবাসার আলো তোমার নয়নে ছড়িয়ে যাবে ….ভালোবাসার রঙিন আলো।
আমরা আসলেই রূপকথার দেশে হারিয়ে গেলাম।
রাত গভীর হচ্ছে, ফুলশয্যার ফুলের সুগন্ধে বাতাস আমোদিত, চাঁদ তারা ঝলমল করে নবদম্পতিকে স্বাগত জানায়…স্বপন – মিষ্টির বাসর মধুময় হয়ে উঠলো।
স্বপ্নের মত দিনগুলো কেটে যেতে লাগলো, কানন প্রথম প্রথম মিষ্টির সাথে সহজ হতে পারেনি কিন্তু সবার প্রতি ওর আন্তরিক ব্যবহার, ভালোবাসা দেখে মনে কোনো ক্ষোভ রাখেনি…. বিশেষ করে আমাকে যেভাবে মিষ্টি আগলে রাখে, সেটার জন্যও বোন আমার সব ভুলে ভাবীর ভক্ত হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যেই শ্বশুর আব্বা আমাকে চোখের সেরা ডাক্তার দেখিয়েছেন…. সিঙ্গাপুর বা ইংল্যান্ডে নেওয়ার চিন্তাও উনি করেছিলেন কিন্তু আমি মিষ্টিকে বলেছিলাম…. যা করার আমার নিজের দেশেই করতে চাই, সার্মথ্য থাকলেই যে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবে, এতে আমি রাজী নই।
অতএব আমার ইচ্ছে মতই সব ব্যবস্থা হলো নিজ দেশেই।
আজ আমি দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি….. মা, কাননকে জান ভরে দেখছি, আর দেখছি অপরূপ আমার জন্মভূমিকে….. আর আমার মিষ্টি বৌটা?
দেখে দেখে আশ আর মেটে না, কাননের ঠাট্টার চোটে মিষ্টি আমার কাছে সহজে আসতে চায় না….
দিনের বেলা দুর থেকেই ওর লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে সন্তষ্ট থাকতে হয়….. রাতে? আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে….. শিহরিত স্বপনের বাঁধ ভাঙা প্রেমের জোয়ারে ভেসে স্বর্গীয় আনন্দ সুখে মিষ্টি নিজেকে সপে দেয় প্রিয়তমের বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে।।
# সমাপ্ত #