#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ১৩
বিন্নীরা গ্রাম ছেড়েছে আজ পুরো একদিন হলো। প্রকৃতিতে তখন বিরহের সুর। দুঃখী, দুঃখী মেঘ যেন আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতিও যে মানুষ হারিয়ে অসহায় হয়েছে। পত্র আজ আর স্কুল যায় নি। রান্নাঘরের বাসি থালাবাসন নিয়ে সে পুকুর পাড়ে চলে গেলো। পুষ্প শুয়ে আছে নিজের ঘরে। ছায়া তৈরী হচ্ছেন সদরে যাওয়া উদ্দেশ্যে। গতকাল যাওয়ার কথা থাকলেও বিন্নীদের অনাকাঙ্খিত প্রস্থানের জন্য আর যাওয়া হয় নি। তাই দ্রুত তৈরী হয়ে নিচ্ছেন সে।
পুকুরপাড়ের নিরবতা ঠেলে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। পত্র এক মনে থালাবাসন ধুচ্ছে। হুট করেই অনুভব করলো সে- তার পিছনে কেউ উপস্থিত। পত্র ঘুরে তাকালো না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারলো কে এসেছে। পিছনের পদচারণের শব্দ থেমে গেলো। তারপর কেটে গেলো মিনিট দুই। চারপাশের নিরবতা তখন ঘন হয়ে এলো। পত্র এবার পেছন ফিরে তাকালো কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটাকে না দেখে তার কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে এলো। সে আবার ঘুরে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। সেকেন্ড ঘুরতেই উপস্থিত ব্যাক্তি মুখ খুললো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমায় কিছু বলতে চাই পত্রলেখা।”
পত্র একমনে থালাবাসন ধুয়ে উঠে এলো। মুখ চোখ গম্ভীর করে বললো,
“কী বলতে চান?”
সামনে দারুণ সুদর্শন পুরুষের আজ চোখ মুখে আগের মতন উৎফুল্ল ভাবটা নেই। সে আজ বেশ গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুমি হয়তো এটা শুনে আমাকে ঘৃণা করবে জানি কিন্তু আমি নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে পারছি না। তাই তোমাকেই সব বলে যেতে চাই।”
আতসের হেয়ালি কথায় ভ্রু কুঁচকালো পত্র। লোকটাকে আজ বেশ উসকোখুসকো দেখাচ্ছে। পত্র মনযোগ দিলো আতসের সারা অঙ্গে। লোকটার ভেতর কেমন এলোমেলো ভাব! পত্র ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ বলুন।”
আতস কথা বলতে গিয়েও কেমন যেন বার বার থেমে যাচ্ছে। অস্বস্তি বোধ করছে। পত্র সময় দিলো আতসকে। ছেলেটা নিজেকে সামলে নিলো অনেকটা সময় নিয়ে। হুট করেই আচমকা বলে উঠলো,
“পত্র, প্রথম দেখায় তোমার চুল ভীষণ ভালো লেগেছিল। সাথে তোমার ভীতু ভীতু ভাবটাও। চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে তোমার। কিন্তু সত্যি বলতে তোমাকে আমার ভালো লেগেছে কেবল। বন্ধু হিসেবে তুমি দারুণ মানুষ হবে। সেই হিসেবেই হয়তো আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার প্রকাম ভঙ্গী ছিলো অন্যরকম। সে যাই হোক, কেন জানি তোমাকে আমার ভীষণ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, আর সেই ভীষণ বিশ্বাস থেকেই আজ একটা কথা বলতে এসেছি। আমি খুব শীগ্রই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো। আমার বন্ধু-বান্ধব কাউকে জানাই নি আমি। তোমাকেই জানালাম।”
পত্র আতসের কথায় চরম বিস্মিত হলো যা তার চোখ-মুখে প্রকাশ পেলো। কিছুক্ষণের জন্য কী বলতে হবে তা-ই যেন সে ভুলে গেলো। বিস্মিত হয়ে বললো,
“তার মানে! আপনি শহরে চলে যাবেন মানে? আর কাউকে জানাবেনই না কেন?”
“পত্র, আমি বিন্নীকে ভালোবাসি, অনেক বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু বিন্নী তা জানেনা। সে মনে প্রাণে মানে তুমি আমাকে পছন্দ করো। সে হিসেবেই সে আমার সাথে কথা বলতো। তাই আমিও তাকে বলতে পারি নি আমার মনের কথা। কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না। বিন্নীকে ছাড়া এ গ্রামে আমার ভালো লাগছে না। আমি চলে যাবো শহরে। আমিও ঢাকা থাকি, যেখানে বিন্নী গিয়েছে। আমি পারবো না ঐ মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে। তাই আমাকে যেতে হবে। আমি চলে যাবো পত্র। তুমি বন্ধু হিসেবে থেকো। খুব বিশ্বাস করেছি আমি। রেখো আমার বিশ্বাস টুকু।”
পত্র চমকালো। বিশ্বাস! সে আদৌও বিশ্বাস রাখতে পারবে! কারো বিশ্বাস সে রাখে নি। রাখতে পারে নি। সে আদৌও পারবে রাখতে বিশ্বাস! আতস ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ফেললো নাতো!
পত্রকে চুপ থাকতে দেখে আতসই বললো,
“ভালো থেকো পত্রলেখা। ভালো থাকুক তোমার চা বাগান। সুস্থ হয়ে উঠুক তোমার চা বাগান। আমি আসছি।”
পত্র কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। সব কেমন গোলমেলে লাগলো তার। ভীষণ গোলমেলে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আতস ছেলেটা যেতে যেতেও ফিরে তাকালো, কেমন অদ্ভুত স্বরে বললো,
“ভালোবাসার অভিনয়ে তুমি দারুণভাবে জিতেছো। তুমি আমায় কখনোই ভালোবাসো নি পত্র, তা দেখে অবশ্য আজ স্বস্তি মিললো। তোমার চোখের কোথাও আমাকে হারানোর ভয় ছিলো না। তুমি ভালোবাসায় হয় বড্ড জয়ী নাহয় একদম কাঁচা।”
পত্র নিরুত্তর চেয়ে রইলো। তার অনেক কিছু বলার থেকেও যেন কিছু বলার রইলো না। সত্যিই কি সে ভালোবাসায় বড্ড কাঁচা! অথচ ভালোবাসার জন্য ই তো আজ কতো বলিদান!
_
থালাবাসন গুলো রান্নাঘরে রাখতেই ছায়ার মুখোমুখি হলো পত্র। ছায়া একদম তৈরী হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে। পত্রকে দেখে সে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“শহরের ঐ ছেলেটার সাথে কিসের এত কথা বললে, পত্র?”
মায়ের প্রশ্ন মুহূর্তেই ভয় জাগালো পত্রের মনে। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সে। আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো,
“ঐ তো মা, উনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। কেমন আছে বাবা এসব।”
ছায়া পত্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পত্র তার বিনিময়ে কেবল মাথাটা নিচু করে রাখলো। ছায়া আর কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে খাবারের বাক্সটা নিয়ে নিলেন বড়ো ব্যাগটাতে। ঘরের দিকে তাকিয়ে পুষ্পকে ডেকে বললো,
“আমি গেলাম পুষ্প। সাবধানে থেকো দুজনেই। আর হ্যাঁ, আজ কেউ বাড়ি থেকে বের হইও না।”
মায়ের কণ্ঠ পেয়ে খাট ছেড়ে উঠে এলো পুষ্প। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“সাবধানে যেও।”
ছায়া ঘাড় কাঁত করে তাকালো পত্রের দিকে, আগের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুমিও বের হইও না। দু’বোন সুন্দর মতন থাকবে। আমি সন্ধ্যা হতে হতে ফিরে আসবো।”
পত্র নিঃশব্দে ঘাঁড় নাড়াতেই ছায়া বিদায় নিলো। মা বেরুতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো পত্র। আচমকাই তার মনে হলো, মা কীভাবে জানলো পুকুর পাড়ে আতসের সাথে যে সে কথা বলেছে! মা তো বাড়িতেই ছিলো! এই প্রশ্নটা বার বার ঘুরপাক খেলো পত্রের মাথায়। তন্মধ্যেই পুষ্প ছুটে গিয়ে ঘর থেকে একটা লাল টকটকে শাড়ি আনলো। বাড়িয়ে দিলো পত্রের দিকে, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“পত্র, এটা বিন্নী তোকে দিতে বলেছিল।”
পত্র এমন লাল টকটকে শাড়ি দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
“বিন্নী! কখন দিলো!”
“এই তো তিন চারদিন আগে। ওদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় লুকিয়ে দিলো একটা ব্যাগে করে। আর বলেছিল, তোর যখন উদাস লাগবে চারপাশ, তখন যেন এটা খুলে দেখিস।”
পুষ্পের কথায় ভ্রু কুঁচকালো পত্র। কপালে তিন ভাঁজ ফেলে শাড়িটা হাতে নিতে নিতে বললো,
“নতুন শাড়ি! এই শাড়ি দিলো কী জন্য! নাকি চলে যাবে বলেই দিয়ে গেলো!”
“কি জানি।”
ছোট্টো জবাব দিয়ে পুষ্প আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে পত্রের ডাক ভেসে এলো। ভাবুক স্বরে বললো,
“এটা আপাতত রাখ তোর কাছে। আমি স্নান করে আসি পুকুর থেকে।”
বোনের কথা অনুযায়ী শাড়িটা নিলো পুষ্প। আবার নিঃশব্দে চলে গেলো সেখান থেকে। পত্রের পেটে তখন হাজারও রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমন আধা আধা, ঝাপসা ঝাপসা লাগছে রহস্যের এই বেরি বাঁধ।
_
চা বাগানে আরেকটি বিভৎস সকাল হলো। চারপাশের চঞ্চল মানুষ ছুটে গেলো সেই বিভৎসতা দেখতে। পুকুর পাড়ের বিরাট ছায়া দেওয়া উপকারী বটগাছটা কিছুদিনের বিবর্তনেই হয়ে উঠলো মানুষ খেকো। আজও গিলে নিলো তাজা এক প্রাণ। গতকালকের জীবিত যুবকটা আজ কেবল নিথর দেহ হয়ে ঝু/লে আছে গাছের সাথে। সবার ছুটোছুটি দেখে পত্র, ছায়া, পুষ্পও এলো কৌতূহল মেটানোর জন্য সে দেহখানা দেখতে। কিন্তু দেহটা দেখার পর তারা জমে বরফ হয়ে গেলো। পত্র কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আতস!”
#চলবে