#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer:মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ছয়
তুলতুল চোখ পিটপিট করে তাকায়। সে চোখে ঝাপসা দেখছে। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো কোথায় আছে ও। তাকিয়ে যা বুঝতে পারলো তাহলো সে এখন হসপিটালে আছে। বাম হাতে স্যালাইন লাগানো। কোমরের কাছে ব্যাথা হচ্ছে। ডান হাত দিয়ে সেদিকের কাপড় সরিয়ে দেখলো মোটা পুরু ব্যান্ডেজ করা। তার ওপরে হালকা হালকা রক্তের ছাপ স্পষ্ট। মাথা ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকালো। দেখে তার মা চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কোলে তাওহীও ঘুম। হঠাৎ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখে তিয়াস। তিয়াস এসে তুলতুলের মাথার পাশে বসে বললো-
—তুই ঠিক আছিস? এখন কেমন লাগছে?
—ভালো। তুলতুল আস্তে জবাব দিল।
—তুলু কি হয়েছিল তোর? আমি বাড়ি এসে শুনি তুই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরিস নি। খোঁজ করেও পাইনি তোকে, সন্ধ্যার সময় এক লোক ফোন করে বললো তুই হাসপাতালে। আমরা এসে দেখি লোকটা তোকে ভর্তি করেছে। সে বললো রাফসান রা আজ যেখানে দাঙ্গা করেছিল সেখানে তোকে অচেতন অবস্থায় পেয়েছে। পরে হাসপাতালে নিয়ে আসে। তুই বাড়ি না এসে ওই রাস্তায় গিয়েছিলি কেন? এতোক্ষণে তুলতুলের মা ও জেগে গিয়েছে।
তুলতুল কোনো উত্তর দিল না৷ চুপ করে ভাবতে লাগলো কি হয়ে ছিল। তুলতুল গাড়িতে বসে ছিল। আবির রাফসানকে ডাক দিলে রাফসান গাড়ি থেকে নেমে যায়। কিছুক্ষন পড়ে আবির এসে আস্তে করে বলে-
—চুপচাপ বসে থাকবে যদি বাঁচতে চাও। ভয় পাবে না মাথা নিচু করে রাখ যাতে কেউ দেখতে না পায়। ঠিকাছে?
—আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর আসবো না আপনাদের সামনে।
—চুপ! এখন কোথাও যেতে পারবে না। তোমাকে পরে ছেড়ে দেওয়া হবে কথা শুনলে। এখন চুপচাপ বসে থাকো। আবির চাপা ধমক দিয়ে বললো।
তুলতুল মাথা নাড়লো মানে সে চুপচাপ থাকবে। আবির চলে গেলো। তুলতুল কিছুক্ষন এভাবেই বসে রইলো। তার এখন বিরক্তি লাগছে। একা একা একভাবে এতোক্ষণ বসে আছে। সে ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে খেতে লাগলো। যা সবসময়ই তার ব্যাগে থাকে। হঠাৎ করে বিকট একটা শব্দ হলো। এতে তুলতুল চমকে ওঠে। তার হাত থেকে চকলেট পড়ে যায়। বুকের ভিতর ধুকপুক করছে ভয়ে। এটা নিশ্চয়ই গুলির শব্দ। বাইরে কি আবারও রাফসানের লোকজানের সাথে কারো ঝামেলা লেগেছে? তুলতুল ঝিম মেরে বসে আছে। পরপর অনেক গুলো শব্দ শুনা গেলো গুলির। অনেকের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে তুলতুল। তার ভয় লাগছে খুব। একটু পর হয়তো তাকেও মেরে ফেলা হবে। ভয়ে হাত পা জমে যাচ্ছে। মাথা থেকে সব আউট হয়ে যাচ্ছে । যা ভয় পেলে সচারাচর হয় তুলতুলের।
সে একটু উকি দিয়ে দেখতে চাইলো বাইরে কি হচ্ছে। গাড়ি থেকে মাথা উচু করে সামনে তাকালো। দেখে চারপাশে ধোয়া। কিছু লোকের হাতে লাঠি তো আবার আরো কাছে পিস্তল, চাকু। হাত রক্তাক্ত। সে থমকে সবকিছু দেখতে লাগলো। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ তুলতুলের দিকে তাকালো। তখন তার হুঁশ ফিরলো তাড়াতাড়ি করে মাথা নিচু করে লুকিয়ে পড়লো। এভাবে কিছু সময় পাড় হওয়ার পড়ে হুট করে গাড়ির দরজা খুলে গেল। তাকিয়ে দেখে একজন চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে চাকু।
তুলতুল ভয় পেয়ে পিছতে গেলে লোকটি তুলতুলকে টেনে নামায় গাড়ি থেকে। গলায় পেছন থেকে চাকু ধরে বলে-
—একদম নড়বি না মেরে ফেলবো। বলে লোকটি ওভাবে টেনে নিয়ে কোথাও দাঁড় করায়। আর বলে
—এই রাফসাইন্না পিছে ফের। আর কিছু করবি তো এটাকে শেষ করে দেব।
রাফসান পিছে ফিরে দেখে মেয়েটার গলায় চাকু ধরে আছে। ও ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো।
—তুই যে গাড়িতে মাইয়া নিয়ে মিটিং করতে আসবি তা তো জানতাম না। তা এটা তোর গার্লফ্রেন্ড নাকিরে কুত্তা। লোকে তো বলে তোর কোনো দূর্বলতা নাই। তাইলে এটাকে লুকিয়ে রাখছিলি কেন? চুপচাপ হাত থেকে পিস্তল ফেল নাহলে মেরে দিব একে।
—মেরে ফেল। রাফসান উত্তর দিল।
—হ্যায়..?
—বললাম মেরে ফেল। তুই না মারলেও আমি মেরে ফেলতাম। আস্ত ঝামেলা একটা। তুই কি ভাবিস রাসান, এর গলায় চাকু ধরে আমাকে কাবু করবি। আমার কোনো দূর্বলতা নাই রে শুনে রাখ। আর তোর সাহস কত তুই আমাকে গালি দিস আজকে বাচবিনা তুই। বলে রাফসান পিস্তল তাক করলো ওদের দিকে।
—এই এই একদম এটা করবি না বলছি। মেরে ফেলবো একে। তুই বললেই বিশ্বাস করবো যে মেয়েটা তোর কেউ না? কখনো না। রাসান ভয়ে ভয়ে বললো
—তাহলে করিস না। আজকের পর আর তুই থাকবি না, তোর বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে কি করবো। হা হা হা
—আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। দেখ…আ..
তুলতুল হা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। গলায় খানিক কেটে যাওয়ায় ওখান থেকে রক্ত পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। পেছনে তাকিয়ে দেখে লোকটির উরুর উপর গুলি লেগেছে। তাতে হাত চেপে ধরে আছে। তুলতুল নিজের দিকে তাকায় এবার। কোমরের উপর হালকা হাত রেখে সামনে এনে দেখে হাতো রক্ত। তারমানে তার কোমরের কাছ দিয়ে গুলি গিয়ে ওই লোকটির উরুতে লেগেছে। এতে সেও জখম হয়েছে। কলেজ ড্রেস রক্তে ভিজে উঠেছে। হুট করে আরেকটা শব্দ হয়। তাকিয়ে দেখে পিছনের লোকটির মাথা ভেদ করে গুলি বেরিয়ে গেছে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। কি বিভৎস দৃশ্য। সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তুলতুল এবার রাফসানের দিকে তাকালো। এখনো পিস্তল তাক করে রেখেছে।
কি ভয়ংকর নিষ্ঠুর লোক। এখন বুঝতে পারছে লোকে কেনো ভয়ংকর বলে এই মানুষটিকে। নাহ এ মানুষ না অমানুষ। একজনকে খুন করতেও হাত কাপে না। চেহারায় সামান্য অপরাধবোধ নেই। তুলতুল আর ভাবতে পারছে না। তার মাথা ঘুরছে এসব দেখে। রক্তের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। ঝাপসা চোখ মেলে রাফসানের দিকে তাকায়। তুলতুল শুনলো রাফসান বলছে
—রাফসান কাউকে ক্ষমা করে না। এজন্য মানুষ রাফসানের সামনে আসতে একবার নয় দশবার ভাবে।
এরপর কিছুক্ষন সামনে আগুন ধরা তেলের ট্রাংকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাফসান। দৃষ্টি আগুনের শিখার ওপর। আগুনের আলো তার মুখে এসে লালচে কমলা রং তৈরি করেছে। চারপাশের অন্ধকার হয়ে আসছে। রাফসানের মুখে হিংস্রতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে-
— সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দে আবির এখানে যেন একফোঁটা রক্তের দাগও না থাকে।
আর কিছু মনে নেই তুলতুলের। তার দৃষ্টি ক্রমশই ঝাপসা হতে হতে বন্ধ হয়ে যায়।
চলবে….