#মেঘের আড়ালে চাঁদ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ চুয়াল্লিশ
বাগানে নানা রকমের ফুল ফুটে রয়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ডানদিকে তাকালে ফুলগুলো দেখতে পাওয়া যায়। তুলতুল বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক ধরনের গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলি, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যামেলিয়া, নয়নতারা, জবা, নীলমনিলতা ফুল ছাড়াও ছোট বড় আরো অনেক ফুল বাগানে আছে। কিন্তু তুলতুলের দৃষ্টি হলুদ গোলাপের ওপর আবদ্ধ। হলুদ গোলাপ তার অতটাও ভালো লাগতো না আগে কিন্তু এখন লাগে। রাফসানের রুমে সে হলুদ গোলাপ সবসময়ই দেখতো। বিছানার পাশের টেবিলের ফ্লাওয়ার বাসে সবসময় তাজা ফুল থাকতো। প্রিয় ফুল হয়তো সেজন্যই প্রতিদিন তাজা ফুল রাখে। তুলতুলের সবসময়ই সাদা রঙের সব ফুল পছন্দ। কিন্তু ইদানীং হলুদ গোলাপগুলো কে দেখতে দেখতে সেটাও তার পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে। তুলতুল সেদিক থেকে নজর সরিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। নাহ লোকটি তাকে ফোন করেনি। বিয়ে করেই সে নাই হয়ে গেছে। ফাজিল লোক। দুইদিন হলো বিয়ে হয়েছে এরভেতর না দিয়েছে দেখা আর না দিয়েছে ফোন। অবশ্য যদিও সে বলেছিল বর ছাড়া থাকতে। কিন্তু তুলতুল তা মাথায় ঢুকাতে পারছে না। হয়তো তার ওপর অনেক অভিমান করেছে রাফসান। বিয়ে করে বাড়ি আসার পরে তিয়াস অনেক রাগারাগি করে। তুলতুলের বাড়ির বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ। তারপরও যদি সে থামতো কিন্তু তুলতুলের সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে। সবার সাথে খুব কম কথা বলে। তুলতুল এতে কষ্ট পায়। সে কথা বলতে গেলেও বলে না তিয়াস। এতে তার বাবা বলেছে একটু রাগ হয়েছে কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। তারপর তুলতুলকে তার বাবা রাফসানের ব্যাপারে আবার বুঝিয়েছে ভালো করে। এতে তুলতুলের ভেতর রাফসানকে নিয়ে সব সংশয় দূর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই লোকের দেখাই নেই।
“তোমার দেখা নাইগো বন্ধু
তোমার দেখা নাই ”
তাওহী চিল্লাতে চিল্লাতে রুমে ঢোকে। মাত্রই গানটা টিভিতে শুনে এসেছে তাই কিছুক্ষন নিজে নিজে একাই চিল্লাবে এটা বলে। তুলতুল শুনে হাসলো।
-” কি হয়েছে? কার দেখা লাগবে?” তুলতুল মুচকি হেসে তাওহীকে জিজ্ঞেস করে। তাওহী এগিয়ে এসে তুলতুলের জামা টেনে ধরে বলে
-” আপু বাইরে যাবো চলো। এখানের কিছুই চিনতে পারছি না।”
-” কিন্তু আমার তো বাইরে যাওয়া মানা। কিভাবে যাবো? তুই ভাইয়াকে নিয়ে ঘুরে আয়।” তাওহী মুখ বাঁকিয়ে বলে
-” ভাইয়া মদন সেজেছে। আমাকে নিয়ে যাবে না। উল্টো ধমক দিবে। তুমি চলো।” তাওহীর জেদের কাছে তুলতুল হার মেনে রুম থেকে বের হলো ওর হাত ধরে। কিন্তু বের হয়ে দেখে বাবা আর ভাইয়া ড্রয়িং রুমেই আছে। কিন্তু কেউ তার দিকে তাকায় নি। তুলতুল একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে চোরের মতো পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু তিয়াসের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করায় থেমে গেলো।
-” মা, মায়ায়া! তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো এই দুপুর বেলা কোথায় যায়। ওর না ঘর থেকে বের হওয়া মানা? একটা কথাও তো শুনে না এটাও কি শুনবে না?” তিয়াসের কথায় তুলতুল আঁড়চোখে তার দিকে তাকালো। কষ্ট পাওয়ার বদলে তার হাসি পেল তিয়াসের চিৎকারে। কিন্তু হাসলো না, মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল। তাওহী একবার তিয়াসের দিকে তো আরেকবার তুলতুলের দিকে তাকায়। কেউ আর কিছু বলে না দেখে সে বিরক্ত হয়ে বললো
-” উফফ! আমি বাইরে যাবো। কিছু চিনতে পারছি না এখানের। আর গোসল করেছি শীত লাগছে, তাই রোদে যাবো। আর আপুর চুল ভেজা সেও যাবে। তোমরা এমন করছো যেনো আমরা চুরি করে ভাগছি।”
-” একটা দিবো এখন তোমাকে! দুপুর বেলা এখন তুমি কি চিনতে যাবা? আর শীত লাগছে ছাঁদে যেতে পারছো না?” তিয়াস চোখ রাঙিয়ে বললো। আর তাওহী ভেংচি কাটে। আফসা বেগম কিচেন থেকে হাত মুছতে মুছতে বের হয় বলে
-” দুইজন যেতে চাইছে যখন যেতে দে। কত সময় আর রুমে থাকবে? তারপর আবার নতুন জায়গা ঘুরে আসুক বাইরে থেকে। তাছাড়া তুলতুল তো একা যাচ্ছে না তাওহীও যাচ্ছে।” আফসা বেগম তিয়াসকে বললো।
-” যা ভালো মনে হয় করো। বাবা আমি কিছুক্ষণ পরে বের হবো তুমি কি যাবে?” তিয়াস সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো। তফিজ আহমেদ ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার পেপারের দিকে তাকিয়ে বলে
-” যাবো! যাওয়ার আগে আমাকে ডাক দিস।” তিয়াস মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। আর আফসা বেগম তুলতুল আর তাওহীকে বললো
-” তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু দুজনে বাড়িতে।” তুলতুল আর তাওহী খুশি হয়ে বের হয়ে গেলো। দুজন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। তুলতুল তাওহীর হাত ধরে আছে। হঠাৎ করে তাওহী বলে
-” আমাদের আগের বাসা বেশি ভালো ছিল তাইনা আপু?” তুলতুল তার দিকে তাকিয়ে বললো
-” কেন এটা ভালো লাগে না?”
-” এটা সুন্দর কিন্তু অপরিচিত! আর আগেরটা এমন বেশি সুন্দর না হলেও ওটা ভালো। এখানকার কিছুই চিনি না। আর ওটার আশেপাশের সব চিনি। ভালো লাগছে না এখানে।” তাওহী মুখ ফুলিয়ে বলে। তুলতুলেরও অবশ্য একটু কেমন কেমন লাগছিল। যতই পরিচিত হোকনা কেন বাড়িটায় অনেক দিন না থাকার কারনে এখন অপরিচিত লাগে। আগের বাড়িটার কথা মনে পড়ে খুব। থাকতে থাকতে একটা মায়া পড়ে গেছে। আর প্রশান্তিও লাগে পরিচিত জায়গায় থাকতে। তারপরও তুলতুল এসব কিছু বললো না তাওহীকে। শুধু বললো
-” তাহলে তোকে সেখানে রেখে আসার জন্য বলি?”
-” না আমি একা যাবো না। তোমরা সবাই না গেলে আমি তো একা ভয় পাবো।” এরকম নানা ধরনের টুকটাক কথা বলতে বলতে ভাই বোন এগিয়ে চললো। হঠাৎ কারো ডাকে সে পাশে তাকালো। আবির! সে এখানে কি করছে? তুলতুলের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবির বললো
-” এই তেলুতেলু গাড়িতে উঠো। দাদী তোমাকে ডেকেছে।”
-” আমার নাম তেলুতেলু না! আর একবার এই নামে ডাকলে মাথা ফাটিয়ে দেবো।” তুলতুল রেগে গিয়ে বললো।
-“আচ্ছা, আচ্ছা তেলুতেলু ডাকবো না। এবার চলো।”
-” কিন্তু আমি তো যেতে পারবো না। বাসায় বলিনি কাউকে চিন্তা করবে।”
-” না করবে না। দাদী তোমার বাবা মানে আঙ্কেল কে বলেছে।”
-” সত্যি?”
-” হুম”
তুলতুল এবার তাওহীর দিকে তাকালো। তাওহী কি যাবে! তার কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তাওহী বলে আবিরকে
-” আপুর শশুর বাড়ি নিয়ে যাবে তুমি?”
-” নিবো তো তুমি যাবে?” আবিরের কথায় তাওহী দাঁত কেলিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুলের যা বোঝার বুঝে গেছে। সে তাওহীকে নিয়ে গাড়িতে বসে।
.
রাফসান গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে। এ দুইদিন সে শহরের বাইরে ছিল। কাজ ছিল তার তাই সেদিন বিকালে বেড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে আর তুলতুলের খোঁজ নেওয়া হয়নি। ইচ্ছা করেই নেয়নি। সেও একটু বুঝুক কেমন লাগে এতদিন তো সে বুঝেছে। রাফসান তার রুমের দিকে যাওয়ার জন্য এগোয় কিন্তু একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর কিছু একটা শুনে তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। শরীর কাঁপছে রাগের চোটে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে। তারপর মুচকি হেসে নিজের রুমে যায়। সব হিসাব সে নেবে কিন্তু সুযোগ বুঝে। সে ফ্রেশ হয়ে দাদীর রুমে যায়। দেখে দাদী রকিং চেয়ারে বসে আছে। দাদীর কাছে গিয়ে জোরে বলে
-” দাদীইই আমি বিয়ে করেছি।”
-” ওরে আকাইম্মা! এত জোরে চিল্লানোর কি দরকার আছিল? বেয়াদব। আমি জানি না তুই বিয়া করছস! বিয়া কইরা একদম স্বর্গে চইলা গেছোস। তো বিয়া যে করছিস বউয়ের খবর কয়বার নিছিস?” রোমানা চৌধুরী রাফসানের কান টেনে ধরে বলে।
-” আরে কি যে বলো না দাদী। খবর নেবো না কেন? সে সারাদিন আমার কাছে থাকে। পাশে থাকলে তার খোঁজ নিতে হয় নাকি আর?”
-” ওই ও তোর পাশে কেমনে থাকে? আমারে পাগল পাইছস? পাঁচ টা মিনিটের জন্যও তুই দেখা করা দূরের কথা ফোনও করোস নাই। মাইয়াটা কেমন আছে সেই খোঁজ নিবি না?” রাফসান কান থেকে দাদীর হাত সরিয়ে বলে
-” তুমি আমার দাদী নাকি আমার বউয়ের? খালি বউয়ের সাইড নাও। এতদিন আমি কষ্ট পেয়েছি কই তখন তো কিছু বললে না তাই এখন সে একটু পাক পড়ে মানিয়ে নেব। সে সবসময়ই আমার মনের ভেতর থাকে বুঝলে? আর সে তার বাবার বাসায় ভালো আছে। হুহ্! আমি গেলাম। থাকবো না তোমার কাছে। খালি নাতবউের তদারকি।” রাফসান আঁড়চোখে দাদীর দিকে তাকিয়ে যেমন হনহন করে এসেছিল তেমন করেই বেরিয়ে গেলো। রোমানা চৌধুরী কি হলো বুঝতে না পেরে হা হয়ে গেলো। এমন ভাবে চলে গেলো কেন?”
-” আরে ওই! আজকা মাইয়াটারে আমি ডাকছি বাড়ি থেইকা বের হইবি না একপাও!” তিনি জোরে বলে কিন্তু রাফসান এতোক্ষণে তার রুমে চলে গিয়েছে। সে তার কিছুই শুনে নি।
তুলতুল বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই তাওহী দৌড়ে ঢুকে পড়েছে। তুলতুল ডেকেও থামাতে পারেনি। সে তার বোনের বরকে দেখবে। তুলতুল ভেতরে গিয়ে দেখে তাওহী সোফায় বসে আছে। যাক কোন দিকে যায় নি। সে তাওহীর হাত ধরে উপরে যেতে চায় দাদীর রুমে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।
-” বেবি আমরা আজকে রেস্টুরেন্টে যাবো, সিনেমা দেখবো, রাইডে চড়বো। ঠিকাছে? কত মজা হবে তাইনা?” এলা আর রাফসান সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এলা রাফসানের হাত ধরে এসব বলতে বলতে নামছে আর রাফসান মুখে জোরপূর্বক হসি টানিয়ে রেখেছে। তুলতুলের তা দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠে। এজন্যই কি আজ দুইদিন রাফসানের খোঁজ নেই? তুলতুলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ করেই রাফসানের নজর তুলতুলের ওপর পড়ে। তার খাবি খাওয়ার মত অবস্থা। তুলতুল এখানে কি করছে? রাফসান তুলতুলের দিকে তাকিয়ে দেখে সে কান্না করছে। রাফসানের অস্থির লাগতে শুরু করলো। এতকিছুর পরে তুলতুল যাও বা তাকে মেনেছে এটার জন্য আবার ভুল বুঝবে নাতো? সে এলার থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু এলা ছাড়ার বদলে আরো টাইট করে ধরলো। রাফসান কোনরকমে এলাকে বলে
-” বেবি কি হয়েছে বলো তো? তোমার মেকাপ গুলো না কেমন মেস হয়ে গিয়েছে। এমন ভাবে গেলে তো লোকে পাগল বলবে। তুমি রুম থেকে এগুলো ঠিক করে আসো। সাথে শাড়ি পড়বে। ওকে?” এলা চোখ বড় বড় করে বলে
-” তাই নাকি? কিন্তু আমি তো দেখলাম ঠিক আছে। আচ্ছা তুমি যখন বলছো আমি যাচ্ছি বেবি।” এলা হাসি দিয়ে চলে গেলো। রাফসানের বিরক্ত লাগছিল এতক্ষণ এখন একটু রেহাই পেল কিন্তু তুলতুলকে এখন কি বলবে? তুলতুল পেছনে ফিরে চোখ মুছে সোফায় গিয়ে বসলো মুখ ফুলিয়ে। তার এত ঠেকা পড়ে নি এসব দেখার। সে দাদীর সাথে দেখা করে চলে যাবে সেই চিন্তা করেই বসলো। রাফসান তুলতুলের পাশের সোফায় বসলো। আর তাওহী তুলতুলের হাত ধরে বললো
-” ও আপু তোমার বর কই? বের হয়না কেন? আমি তাকে দেখবো।” তাওহীর কথা শুনে তুলতুল চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আর রাফসান মিচকে হেসে বললো
-” বাবু তোমার আপু বর এখানে।” এ কথায় তুলতুল চোখ মুখ কুঁচকে রইল আর তাওহী চোখ কপালে তুলে বললো
-” জিপার খোলা ভাইয়া? আপু তোমার বর এটা? তুমি এনাকে কিভাবে বিয়ে করেছো? এনার জিপার খোলা থাকে। সবাই সব দেখে ফেলেছে। আর এখানে ডাইনি বুড়িও আছে দেখি।” তাওহীর কথা শুনে রাফসানের হাসি মিলিয়ে গেলো। আর তুলতুলের হাসি পেল। তারপরও সে না হাসার জন্য এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কিন্তু আটকাতে পারছে না মিটমিট করে হাসতে লাগলো। রাফসান গম্ভীর হয়ে তাওহীর দিকে তাকালো। তার আগেই উচিত ছিল এখান থেকে কেটে পড়া। এ ছেলে যে তার মানসম্মানের ছিটেফোঁটাও রাখবে না। সে গম্ভীর ভাবেই তাওহীকে ডাকলো
-” এই বিচ্ছু এদিকে আয়।তুই কখন দেখেছিস আমার জিপার খোলা? তুই নিজে ঢপ মেরেছিস। এখন আমাকে পার্সপত্র দেখার কথা বলে মানসম্মান ডুবাতে চাইছিস? এদিকে আয়। দেখি জিপার খোলা কাকে বলে তোকে আজকে শিখিয়ে দেই। এমনিতেও তুই ছোট শালা আমি না শেখালে আর কেই বা শেখাবে!” বলে রাফসান তাওহীর দিকে এগিয়ে যায়। আর তাওহী প্যান্টে হাত দিয়ে দৌড় দেয়। আর বলে
-” আমি কোথায় ঢপ মারলাম? আর আমি কিন্তু বাবু না। বেশি করলে সব ফাঁস করে দেবো।”
-” কি ফাঁস করবি?” রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাওহীর দিকে তাকায়। আবার কি বলে ফাঁসাতে চাইছে বিচ্ছুটা? এমন সময় আবির আসে। তাওহী আবির কে দেখে বলে সে ঘুরবে। আবির মুচকি হেসে তার হাত ধরে নিয়ে যায়। তাওহী যেতে যেতে পেছনে ফিরে চোখ টিপ দিয়ে বলে
-” অনেক কিছু” রাফসান চোখ মুখ কুঁচকে সোফায় গিয়ে বসে। তারপর তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুল হাসি চাপানোর চেষ্টা করছে। তা দেখে রাফসান গলা খাঁকারি দেয়। তুলতুল ঘাড় ঘুরিয়ে রাফসানের চোখের দিকে তাকায়। পলকহীন ভাবে কিছুক্ষণ তাকানোর পর কিছুক্ষণ আগের কথা মনে হয়। সে মুখ মলিন করে অন্যদিকে তাকায়। রাফসান বুঝতে পেরেছে তুলতুল কষ্ট পেয়েছে এলার সাথে তাকে দেখে। কিন্তু তারও কিছু করার নেই এখন। তাই তুলতুলের মন কিছুটা ভালো করতে গান ধরে।
-” কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি”
তুলতুল এই গান শুনে রাফসানের দিকে কটমট করে তাকালো। তা দেখে রাফসান ভ্রু কুঁচকায়। তুলতুল রাগ নিয়েই বসে থাকে। এই গান এই লোক গাইছে কেন? এটা তো এখন তার গাওয়া উচিৎ।
“কেন পিরিতি বাড়াইলি রে ব্যাটা
অন্য বেটির সাথে যাইবি যদি”
তুলতুল মুখ বাঁকিয়ে দাদীর কাছে যাওয়ার জন্য উঠে যায়। আর রাফসান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি এমন গাইলো যাতে এমন রেগে গেলো? সেও কিছু না ভেবে আর উঠে গেলো।
তাওহী লাফিয়ে লাফিয়ে করিডোর দিয়ে যাচ্ছে। আজ সে অনেক জায়গায় ঘুরছে। অবশ্য কাছেই ছিল। যেতে যেতে একটা রুমে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে গালে দুই হাত দিয়ে বলে
-” হাউউউ লোমান্তিখ!” তারপর দাঁত কেলিয়ে বলে
-” পিলিজ আপনারা থামবেন না। আমি দেখবো। কেউ আমাকে লোমান্টিখ কিছু দেখতে দেয় না।”
রুমের দুইজন মানুষ যেনো অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু এর ভেতর একজন যেন খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। রাফসান তাওহীর দিকে এগিয়ে এসে বললো
-” বাবু তুমি এখানে কি করছো?” যদিও সে এসময়ে তাওহীর আসায় অনেক খুশি হয়েছে। এলার থেকে বেঁচে গিয়েছে। সে কিছু চাইলেও করতে পারছিল না। আর পেছনে এলা রাগে ফুঁসছে। সে রাফসানের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে ছবি তুলতে চাইছিল। এতে তার কাজ কিছুটা সফল হয়ে যেতো। কিন্তু এই পুচকা এসে তার সমস্ত প্ল্যানে জল ঢেলে দিল। রাফসানের কাছে যেতেই এ চলে আসলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। মনে হচ্ছে এখনি যেয়ে থাপ্পড় মারে। কিন্তু রাফসান আছে দেখে কিছু বললো না। যদিও সে জানে না রাফসান আজ তার সাথে কেন ভালো বিহেভ করছে। জানতেও চায় না কারন সে খুশি এতে। রাফসান তাওহীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” চলো আমরা বাইরে যাই।” তাওহীও এতে সায় দিল। রাফসানের হাত ধরে যাওয়ার সময় তার মুখে দুষ্ট হাসি লেগে ছিল। সে ওই ডায়নিকে দেখতে পারে না। আর সে দাঁড়িয়ে তখন দেখছিল এলা রাফসানের কলার ধরে তার কাছে মুখ এগিয়ে আনছিল জোর করে। আর তখনই সে কথাটা বলে উঠে। কারন সে জানে জিপার খোলা ভাইয়া এখন তার বোনের বর ওই ডায়নির সাথে কেন থাকবে? এতটুকু বুদ্ধি তার হয়েছে। তাই ইচ্ছে করে এমন করেছে। সে ছোট দেখে কেউ তাকে কার্টুন ছাড়া অন্য কিছু দেখতে দেয় না। বলেছে ছোটদের এগুলো ছাড়া অন্য কিছু দেখতে নেই। তাই সে ভেবেছে তার সামনে কিছু করতে পারবে না ডায়নিটা ছোট তো সে। অবশ্য সে গান দেখে দেখেও অনেক ট্যাটন হয়ে গেছে। নিজের কাজে নিজেই বাহবা দিল তাওহী তারপর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে রাফসানের সাথে যেতে লাগলো।
তুলতুল রোমানা চৌধুরীর রুমে এসেছে অনেকক্ষণ ধরে। এতক্ষণ গল্প করেছে। রাফসান তাকে কিভাবে বিয়ে করেছে বলেছে। আর এলার ব্যাপারেও বলেছে। কেন বলবে না। এই মেয়ে এসে রাফসান তাকে ভুলে গেছে। হুহ্। কষ্ট হয়েছে তার এলার সাথে রাফসানকে দেখে। রোমানা চৌধুরীও আশ্বাস দিল সে দেখবে। তাছাড়া তিয়াসার ব্যাপারেও বললো। অনেকক্ষণ ধরে তুলতুল চুপচাপ আছে। তার একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছে না। সে হাত কচলাতে লাগলো। এটা দেখে রোমানা চৌধুরী বললো
-” ও নাতবউ তুমি কি কিছু কইবা আমারে?” তুলতুল ইতস্তত করলো। তারপর একটা শ্বাস নিয়ে বললো
-” দাদী ওখানে যে ছবি আছে হয়তো সেটা ওনার মা বাবার। কিন্তু তারা কোথায় থাকে? মানে কখনো দেখিনি আর ওনাকেও বলতে শুনি নি।” তুলতুলের এ কথায় পূর্ণ দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকালো রোমানা চৌধুরী। তারপর গম্ভীর হয়ে তুলতুলকে বললো
-” তুমি জানতে চাও?” তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছেন না। মানে তিনি ব্যাপারটায় সিরিয়াস। তুলতুল মাথা নাড়লো। এতে রোমানা চৌধুরী নড়েচড়ে বসেন, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
-” যদিও এসব বলা বা মনে করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই কিন্তু তোমার জানার অধিকার আছে।” রোমানা চৌধুরী একটু দম নিয়ে বলে
-” রাফসান আর তার বাবা রসিদ চৌধুরীর কম শত্রু ছিল না। তাদের সবসময়ই প্রাণের ঝুঁকি ছিল। কিন্তু কখনো কেউ কিছু করতে পারে নি। কারন রাফসান আর রসিদ সবসময় এক থেকেছে। দুজনের শক্তি, পাওয়ার, সামর্থ্যের কাছে শত্রুরা বরাবর হেরে গিয়েছে। এই বিশাল সম্পত্তি, বাড়ি গাড়ি কোম্পানির ওপর সবারই শকুনের নজর ছিল। এমনকি আমার ছোট ছেলে মানে রাফসানের ছোট চাচারও ছিল। কিন্তু তারও জমি জমা প্রতিপত্তি কম ছিল না। তবুও বড় ভাইয়ের সম্পদের ওপর লোভ ছিল। রাফসান তা বুঝতে পেরে যায় আর চাচার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। কারন সব জেনে হয়তো পেছন থেকে আঘাত করবে। এভাবেই চলতে থাকে। পরিবারের ওপর কোন আচ আসার আগেই রাফসান ঢাল হয়ে দাঁড়াতো। নিজেদের সবকিছু রক্ষার্থে সে দলবল বাড়ায়। গ্যাংস্টার টাইপ হয়ে যায়। আর সেখান থেকে আরো শত্রু বাড়তে থাকে। কিন্তু যতদিন রাফসান ঠিক ছিল কেউ পরিবার বা সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে পারেনি। বাবার সাথে মিলে সে সব মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এক ঝড় সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। তিয়াসার মৃত্যুর পরে রাফসান কয়েকমাস হাসপাতালে থাকে। তারও গুলি লেগেছিল। রসিদ আর বৌমা তার চিন্তায় থাকতো। দিনের পর দিন হাসপাতালে পরে থাকতো। এই সুযোগ টা কাজে লাগায় আমার ছোট ছেলে। সবকিছু পরিচালনার দায়িত্ব সে নেয়। আস্তে আস্তে সবকিছু গ্রাস করতে থাকে। যাকে বলে সুযোগে সৎ ব্যবহার। ধীরে ধীরে রাফসানের শারীরিক উন্নতি হলেও সে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে অসুস্থ হয়ে যায়। সেটা রাফসানও বুঝতে পারে। তাই তার চিন্তা বাদ দিয়ে তার বাবা মা কে সবকিছু সামলাতে বলে। রসিদ ও বৌমা হাসপাতালেই থাকা আবার এদিকটা সামলানোও শুরু করে। কিন্তু যখন এদিক টায় দেখে তখন বুঝতে কোম্পানির টাকার অংকে বিরাট গড়মিল। কিছু জমি বিক্রিও হয়ে গেছে। শেয়ার, ডিল অনেককিছু হাতছাড়া হয়েছে। বরং সেটা আমার ছোট ছেলের জন্য হয়েছে। রসিদ তার কাছে স্বাভাবিক ভাবে এসব হিসেব চাইলে সে রেগে যায় এককথায় দুকথায় তর্কাতর্কি বিশাল আকার ধারণ করে। ছোট ছেলে কোন হিসাব না দিয়ে রেগেমেগে চলে যায়। এর দুইমাস পরে রাফসানের কাছে একটা ফোন আসে। তখন সে মোটামুটি সুস্থ। ফোন পেয়ে সে আবিরকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি চলে আসে। কিন্তু বাড়ি এসে দেখে সব শেষ। তার দুনিয়া পুরো উল্টে গিয়েছে। তার প্রিয় মানুষগুলো তাকে একা করে চলে গিয়েছে। বাড়িতে হামলা হয়েছিল। আর তার অবর্তমানে কাজটা সহজ ছিল। রসিদ আর বৌমাকে তারা মেরে ফেলে। রসিদকে গুলি করা হয় আর বৌমাকে গলা টিপে মেরেছিল। রাফসান সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিল বাবা মায়ের লাশ ধরে। আর আমি হতভাগিনী মা ছেলের লাশটাও দেখতে পাইনি। পাশে কেউ ছিল না তখন রাফসানের। আমিও ছিলাম না। আবির বলেছে আমায় সে তখন রাফসানের পাশেই ছিল। এরপর থেকে রাফসান পাথরের মতো হয়ে যায়। নেই কোন মায়া দয়া, কোন দূর্বলতা। এভাবেই কাটতো হিংস্রতার সাথে তার দিন কিন্তু রাত হলেও আপনজন হারিয়ে সে হাহাকার করতো। অসহায় হয়ে যেতো তখন। এমন কেউ ছিল না তার পাশে যে কাঁধে হাত দিয়ে একটু সান্ত্বনা দিবে। আমার সাথে ফোনে কথা বলতো। আমি আসতে চাইলে তখন মানা করতো। পারিনি সবসময় তার পাশে থাকতে।” বলে রোমানা চৌধুরী চোখের পানি মুছলো। তুলতুলের ও চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এত কষ্ট করেছে রাফসান! কষ্ট তো তারাও করেছে কিন্তু তারা সবাই একে অপরের পাশে ছিল। কিন্তু রাফসানের সাথে কে ছিল? কেউ না! সে একা লড়াই করেছে এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। তুলতুল কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো
-” কে এমন করেছিল? তাদের শাস্তি হয়নি?”
-” আমার ছোট ছেলে আর কোম্পানির আরো কয়েকজন মিলে সব করেছে।আর রইল শাস্তির কথা! শাস্তি পেয়েছে তারা। ঘটনার কয়েকমাস পরেই তাদের লাশ পাওয়া যায়। গলা কাটা অবস্থায়, শরীর ক্ষতবিক্ষত, মাথার মগজ বের হয়ে গেছে, জিহবা কেটে ফেলেছে ভয়ানক অবস্থা ছিল। তাদের পরিবারের অবস্থাও এখন করুণ।”
-” খারাপ লাগেনি আপনার ছোট ছেলের জন্য?”
-” না, লাগেনি কোন কুলাঙ্গার সন্তানের জন্য আমার একফোঁটাও খারাপ লাগেনি।” রোমানা চৌধুরী চোখ মুখ শক্ত করে বলে। তারপর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে
-” নাতবউ অনেক কিছু শুনছো তোমার এখন মাইন্ড ফ্রেশ করা দরকার। নাহলে এগুলোই ঘুরবে মাথায়। যাও রাফু কোথায় আছে দেখো। তুলতুল মাথা নাড়লো। তার কান্না থামছে না এখনো। উঠে যাওয়ায় সময়ই হঠাৎ করে তুলতুল মাথা ঘুরে পড়ে যায়। রোমানা চৌধুরী চিৎকার করে উঠে তুলতুলের সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায়। সে আবিরকে ডাক দেয়। আবির এসে কোলে নিয়ে যায় রাফসানের রুমে, তাকে শুয়িয়ে ডাক্তারকে ফোন দেয়। রোমানা চৌধুরী রুমের ভেতর টেনশনে পায়চারি করে। এমন সময় তাওহী আসে। তাওহী এসে তুলতুলকে এমন ভাবে দেখে কান্না করে। কিছুক্ষণের ভেতর ডাক্তার এসে তুলতুলকে দেখে যায়। প্রেশার লো, অতিরিক্ত চিন্তা, না খাওয়ার ফলে সেন্সলেস হয়ে গেছে। তিনি কিছু ঔষধ আর তুলতুলকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে চলে যায়। রোমানা চৌধুরী তুলতুলের বাবাকে ফোন করে জানায় তিনি আসতে চাইলে তুলতুল ঠিক আছে বলে জানায়। আসতে মানা করে দেন। তিনি তুলতুলের গায়ে কম্বল ঠিক করে দেয়।
রাফসান অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে। রুমে ঢোকে দেখে ডিম লাইট জ্বালানো। সে আর লাইট অন না করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। হাত মুখ টাওয়াল দিয়ে মুছে সে বিছানার দিকে আগায়। কম্বল ভাজ হয়ে আছে। সে প্রায়ই কম্বল দলা করে তারওপর শুয়ে পড়ে। আজকে যেহুতু ওমন আছে তাই সে আর কিছু করলো না। কম্বলের ওপর উপুড় হয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। কম্বলটা কেন জানো আজ বেশি উঁচু লাগছে। তারপরও সে উঠলো না ওভাবেই শুয়ে থাকলো। আজকে অনেক পরিশ্রম হয়েছে তার। ক্লান্ত থাকার কারনে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেলো।
চলবে….