#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৪ (২য় খণ্ড)
প্রায় একঘণ্টা ধরেই চুপ নীরব এবং নিশ্চেষ্ট অভিরূপ। গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে বলে অনেকক্ষণ আগে ঘরের দরজা আঁটকে দিয়েছিল ঠিকই তবে এখনো মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেনি সে। রূপা এবার তার চুপ থাকাটাকে নিতে পারছে না। উশখুশ করে বলেছে মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে। এবার তাকে বিস্ময়ে ফে/লে দিয়ে থমথমে সুরে অভিরূপ প্রশ্ন করে,
“কিছু বলতে চাও?”
রূপা অতি সল্প সময় চুপ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমি তো কিছু বলতে চাইনি। আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন।”
“ওহ হ্যাঁ। বাট কীভাবে বলব?”
অন্যদিকে ফিরে বসে অভিরূপ। মাথা নিচু করে নিজের অযত্নে বড়ো হওয়া চুলগুলোকে চেপে ধরে দুহাতে। এই শখের চুল নিয়ে আগে সারাদিন পড়ে থাকত অভিরূপ। হালকা বড়ো বড়ো এই চুলে সামান্য ডার্ক কালার করার ফলে যেই ঝিলিক দেখা যেত তা সময়ের সাথে মুছে গিয়েছে। তার মুখচ্ছবিতে যেই সুন্দর জৌলুসে মেতে থাকতে পছন্দ করত তার অনুরাগীরা সেই জৌলুস কোথাও যেন নিখোঁজ হয়েছে। রূপা মানুষটিকে অবলোকন করে দেখতে পেল স্পষ্ট পরিবর্তন। এমন আচরণে কিছুটা উদ্বিগ্ন নিয়ে রূপা বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
“হু। পালিয়ে যাবে?”
অভিরূপের ভেজা কণ্ঠে এমন কথায় বাকহারা হলো রূপাঞ্জনা। গলায় কণ্ঠস্বর যেন মিইয়ে পড়েছে তখনই। কাঁপা কাঁপা সুরে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“কী বলছেন?”
অভিরূপ এবার উঠে দাঁড়াল। রূপার সংলগ্নে গেল ধীর পায়ে। রূপার এবার ভয় ভয় করছে। হাজার হোক তার নারী মন! দুরুদুরু বুকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হতেই তার সামনাসামনি এলোমেলো হয়ে দুই হাঁটু গেঁড়েই ফ্লোরে বসে গেল অভিরূপ। নিজের দুহাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল,
“আমি আর পারছি না রূপা। সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। নয়ত আমি এভাবে ধীরে ধীরে তীব্র য/ন্ত্ণায় মৃ/ত্যু পানে লুটিয়ে পড়ব। অনেক ভেবেছি। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছি। নিজেকে বুঝিয়েছি। আশ্বস্ত করেছি নিজেকে এই বলে যে, তুমি ব্যতীত আমার সামনে আরো ভালো কিছু আছে। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝলাম আমার এত ভালো কিছু চাই না। এই বহুরূপীকেই চাই। তার নকল চেহারা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে পারলেই সবথেকে ভালো থাকব।”
রূপা এবার বিস্ময়ের সর্ব সীমানায় পৌঁছায়। মাথাটা ভনভন করতে থাকে। সামনের এই মানুষটির কথাগুলো তীব্র আকারে জলোচ্ছ্বাসের রূপ নিয়ে ভিজিয়ে দেয় সেই র/ক্তা’ক্ত হৃদয়। রুক্ষ ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে। বিভ্রান্ত হয়ে শুধাতে চাইল,
“আপনি আমাকে… ”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি রূপা। সেই প্রথম দিন থেকে। ওই সাহসী রূপটাকে আমি ভীষণ ভালোবেসেছি। সবসময় চেয়েছি। রাগিনীকে কখনোই ভালোবাসিনি। কোনোকালেই নয়।”
একটু থামল অভিরূপ। ঢক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,
“আমি সব শুনেছি তোমার আর রাগিনীর কথোপকথন। তুমি পালিয়ে এসেছ। তুমিও বাঁচতে চাও। আমিও বাঁচতে চাই। চলো না পালিয়ে যায়! দরকার নেই আমার বিলাসিতা। আমার তোমায় নিজের সবচেয়ে বড়ো বিলাসিতা বানাতে চাই রূপাঞ্জনা!”
রূপা বাকরুদ্ধ। মূর্তির ন্যায় বসে রইল বিছানায়। নড়াচড়া বন্ধ হলো তার। সামনের মানুষটার এই প্রতিক্রিয়া তার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। ভাবনাচিন্তা ব্যতীত সে বলল,
“আমি একা পালাতে চেয়েছি। আপনি কেন পালাবেন আমার সঙ্গে? আপনার পরিবার আছে, ক্যারিয়ার আছে। আপনাকে এসব মানায় না।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
“বাট আই কেয়ার। আমি একবারও বলিনি আপনার সঙ্গে পালাব।”
অভিরূপ এবার মাথা উঠিয়ে তাকায় রূপার চোখের দিকে। শীতল গলায় প্রশ্ন করে,
“আমায় ভালোবাসতে পারবে না?”
“ভালোবাসা কী আমি জানি না। এই শব্দটা আমি বুঝিনা। আমার জটিল লাগে। আমি ভালোবাসতে পারি না।”
রূপার স্পষ্ট উত্তর। অভিরূপের মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খপ করে রূপার হাত ধরে বসল।
“আমি শিখিয়ে দেব। ভালোবাসা সরল অংকের মতো। যেটা বাহিরে থেকে ভীষণ জটিল লাগে। কিন্তু একবার বুঝে উঠতে পারলে তার চেয়ে সহজ এবং সুখকর জিনিস আর একটাও পাওয়া যায় না।”
রূপাঞ্জনা মৃদু কেঁপে উঠল। এই স্পর্শে তার প্রতিটা লোম শিউরে তোলে। লোমহর্ষক নয়, এ যেন মাতিয়ে তোলা এক প্রয়াসমূলক ছোঁয়া!
আশেপাশে চোরের মতো তাকিয়ে দ্রুত টিফিনবক্সে খাবার তুলল সৈয়দ। চোখ তুলে বাহিরের হলরুমে উঁকি মে/রে দেখল আরেকবার। কেউ না থাকায় বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো বড়ো ধাপ ফেলে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো সদর দরজার কাছে। দরজা খুলে বাহিরে পা রাখতেই উপস্থিত হলেন স্বয়ং রাশেদ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে উঠল সৈয়দ। অস্ফুটস্বরে বলল,
“স্যার আপনি!”
রাশেদ সাহেব আগে পরখ করে নিলেন সৈয়দকে। এই বিকেলবেলা বাড়ির বাহিরে টিফিনবক্স সহিত সৈয়দকে দেখে খটকা লাগতে শুরু করল উনার। সন্দিহান হয়ে বললেন,
“ভয় পেলে নাকি?”
“না, স্যার। ভয় পাব ক্যান? আপনার সাথে আমার ভয় পাওয়ার সম্পর্ক? আপনি তো রাতের আগে বাসায় আসেন না তাই একটু চমকাইছিলাম।”
“অভিরূপের বাবা নাদিম ফোন করে ডাকল আমায়। কী যেন কাজ আছে দেশে। ফিরতে হবে তাদের। তাই চলে এলাম। তুমি কোথায় যাচ্ছো এভাবে হাতে টিফিন বক্স নিয়ে?”
সৈয়দ আমতাআমতা করতে শুরু করে এবার। মিহি সুরে বলে,
“আমার মাইয়াডা একটু বিরিয়ানি খাইতে চাইছিল স্যার। আমার তো বিরিয়ানি চাল কেনার টাকাপয়সা থাকে না সবসময়। আজকে তো এখানে বিরিয়ানি রান্না হইছিল ওখান থেকে একটু বেঁচে গেছিল। তাই ভাবলাম…”
শেষ কথাগুলোতে বোঝা গেল দুঃখের রেশ। রাশেদ সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন,
“ব্যাপার না। কিন্তু তুমি যদি একটু টিফিনবক্স খুলে দেখাতে!”
ফ্যালফ্যাল করে এবার চেয়ে রইল সৈয়দ। প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো পরক্ষণেই। বিগত কয়েকদিন যাবত রাশেদ সাহেব অতিরিক্ত সন্দেহ করা শুরু করেছেন। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সৈয়দ ভেতরে এলো। পিছুপিছু রাশেদ সাহেব ঢুকলে হলরুমের টেবিলে টিফিনবক্স খুলে দেখাল সৈয়দ। সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তি পেলে রাশেদ সাহেব। সৈয়দের কাঁধে হাত রেখে নম্র গলায় বললেন,
“কিছু মনে করো না। আমি জানি তুমি সবচেয়ে পুরোনো সদস্য এই বাড়ির। তবুও মনটা অস্থির অস্থির করে। এমনিতে আমার মেয়েটার উপর বি/পদ ঝুলছে বোঝোই তো!”
“আপনার বিশ্বাস কোনোদিনও ভাঙবে না স্যার। ভরসা রাইখেন।”
“ভরসা আছে বলেই সব জানো তুমি। তাড়াতাড়ি যাও। আর… ”
পুরো কথাটা না বলে নিজের মানিব্যাগ বের করে পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে সেটা সৈয়দের হাতে ধরিয়ে বলে,
“তোমার মেয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে।”
সৈয়দ নিতে চাইল না। কিন্তু সফল হলো না। রাশেদ সাহেব তাকে টাকা ধরিয়ে ছাড়লেন। খুশিমনে বাড়ি থেকে বের হলো সে।
সদ্য রিওকে গোসল করিয়ো তাকে টাওয়ালে জড়িয়ে নিয়ে পেরিয়ে গার্ডেনে যাচ্ছিল রাগিনী। রিও গোসল করে গায়ের লোমগুলো চুপসে ফেলেছে। অবশ্য সে গোসল করতে চায়না। গরম পানিতেও বেশ জোর করেই গোসল করাতে হয় তাকে। রাগিনী যেন একটা যু/দ্ধ জয় করে ফেলেছে গোসল করিয়ে। এখন গার্ডেনে যাচ্ছে তাকে নিয়ে খেলতে। এতে রোদে গা শুকিয়ে যাবে। এই অসময় গোসল করানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। তবে রিও দু/ষ্টুমি করে বিছানার নিচে গিয়ে শরীর ময়লা করে ফেলেছে। রাগিনী বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে নিতে বলে,
“আজকাল তুমি প্রচন্ড দু/ষ্টু হয়েছ রিও। কোহিনূর ঠিকই বলে তুমি দেখতে ইনোসেন্ট হলেও একটু মিটমিটে দু/ষ্টু।”
রিও যেন বুঝেই নিলো রাগিনীর কথা। জোরে জোরে মিও করে ডেকে উঠল। রাগিনী একগাল হেঁসে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতেই দরজার ওপাশে কেউ জোরে জোরে কলিংবেল বাজাল। হকচকিয়ে উঠলেও নিজের অভিব্যক্তি সামলে একহাতে দরজা খুলে দিলো রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গেই হতবাক হলো সে। পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া পুরো টিমকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হলো পরক্ষণেই। দুজন মহিলা কনস্টেবল আর দুজন পুরুষ কনস্টেবল রয়েছে। সামনে রয়েছে ইন্সপেক্টর রায়ান। গলা শুঁকিয়ে এলো রাগিনীর। ক্ষীণ সুরে বলে উঠল,
“আপনারা?”
“রাগিনী তাজরীন?”
“জি, হ্যাঁ।”
“বাড়িতে আর কে কে আছে?”
রায়ানের সোজাসাপটা প্রশ্নে ভড়কাল রাগিনী। ধীর পায়ে তখনই ঠিক সময়ে নেমে এলেন রাশেদ সাহেব। সিঁড়ি থেকেই জোর গলায় রাগিনীকে ডেকে বললেন,
“কে এসেছে রাগিনী?”
রাগিনী কিছু বলার সুযোগই পেল না। রাশেদ সাহেব চলে এলেন দরজার কাছে। পুলিশ দেখে অবাক হলেন তিনিও। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলার আগেই রায়ান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলো,
“স্যার, আমাদের কাছে এভিডেন্স আছে যে আপনার বাড়িতে এখনকার সবচেয়ে বড়ো ক্রি/মিনা/ল আপনার মেয়ের মতোই দেখতে সেই বহুরূপী মেয়েটি অবস্থান করছে। একারণেই আমরা সার্চ করেছি। অ্যান্ড সি, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্টও আছে।”
রায়ান নিজের হাতে থাকা ওয়ারেন্ট দেখিয়ে আবারও বলে,
“আশা করছি আপনারা এই বিষয়ে কোওপারেট করবেন।”
রাশেদ সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। কিছু বলার সুযোগ বা ভাষা কিছুই পেলেন না। যেন উনার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যখন উনি উপলব্ধি করলেন ততক্ষণে রায়ান সহ সমস্ত কনস্টেবল বাড়িতে প্রবেশ করে ফেলেছে। রাগিনীর হাত থেকেও যেন অল্প সময়েই সবটা বেরিয়ে গিয়েছে। কোনো কিছু বলে আটকানোর সময় বিন্দুমাত্র পেল না। তার মাথায় শুধু ঘুরতে থাকল এই বিষয়টা পুলিশ কী করে জানল? কার মাধ্যমে জানল? বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অবিন্যস্তভাবে সোফার কাছে গিয়ে বি;ক্ষিপ্তভাবে বসে পড়লেন রাশেদ সাহেব। টেবিলে হাতের কনুই রেখে কপালে হাত দিয়ে আফসোসের সঙ্গে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“এটা কী হচ্ছে আমার বাড়িতে?”
রাগিনী নিশ্চুপ। এই হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সে দরদর করে ঘেমে চলেছে। কী হতে চলেছে পরবর্তী অবস্থা তা ভেবেই অন্তরটা শুঁকিয়ে কাঠ। রিওকে নামিয়ে দিতেই নোমান বেশ বিরক্ত হয়ে উপস্থিত হলো। জিজ্ঞেস করল,
“কী হচ্ছে? বাড়িতে পুলিশ কেন আঙ্কেল?”
রাশেদ সাহেব কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। রাগিনী কোনদিকটা সামলাবে বুঝে উঠতে পারল না। সে নোমানের কথার জবাব না দিয়ে একপ্রকার ছুটেই গেল অভিরূপের ঘরের দিকে। কাঙ্ক্ষিত ঘরে দ্রুত ছুটে যাবার পর ভিড়িয়ে রাখা দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই দুটো মহিলা কনস্টেবলকে চোখে পড়ল তার। স্থির হয়ে দাঁড়াল সে। তবে অস্থির লোচন দুটো একাধারে খুঁজে বেড়ালো তার মতোই দেখতে হুবহু সেই মেয়েটিকে। পেল না কোথাও! আরেক দফা চমক খেল। কোনোভাবে, কোনোখানে কি মেয়েটি লুকিয়ে রয়েছে কোথাও? এসব ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দিলো এক কনস্টেবলের প্রশ্ন।
“ম্যাম, কিছু বলতে চান?”
থতমত খেলো রাগিনী। হালকা কেশে নিজের অসঙ্কোচ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় বলল,
“না মানে দেখতে এসেছিলাম একটু।”
রাগিনী আঁড়চোখে তাকাল ওয়াশরুমের দিকে। অন্য কনস্টেবল সেদিকেই গিয়েছে চেক করতে। সর্বাঙ্গে তড়িৎ খেলে গেল রাগিনীর। কী বলে আটকাবে সেটা খুঁজে পেতে না পেতেই ততক্ষণে কনস্টেবল ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে। এই যেন মেয়েটা ধরা পড়ে যায়! কিন্তু রাগিনী ভুল প্রমাণিত হলো। ঘটল বিপরীতটা ঘটনা। ওয়াশরুম থেকেই সেই মহিলা জোরে বলল,
“আরে! ওয়াশরুমের উপরে থাকা কাঁচ তো ভাঙা। মনে হচ্ছে এদিক দিয়েই কেউ পালিয়েছে।”
আরেকজন কনস্টেবলও গিয়ে দেখল তা। নিশ্চিত হয়ে তারা দুজনেই ছুটল রায়ানের কাছে। রাগিনী ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইল। বড়ো বড়ো কয়েকবার শ্বাস নিয়ে সেও দেখতে গেল আসলেই ব্যাপারটা সত্যি কিনা! ওয়াশরুমে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ভাঙা সেই ছোট্ট জানালার মতো অংশ। সেখান থেকে একটু উঁচু হয়ে উঁকি দিলে দেখা যাচ্ছে নিচে সমস্ত কাঁচ পড়ে রয়েছে। তবে কি রূপাঞ্জনা পালিয়ে গিয়েছে? এই ওয়াশরুম থেকেই পালিয়েছে? অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, তারা অনেককিছুই করার ক্ষমতা রাখে। যদি সে পালিয়ে গিয়ে থাকে অখুশি হবেনা রাগিনী।
হলরুমে রাগিনী ফিরে দেখল রাশেদ সাহেব একই ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। নোমানও বেজার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একইভাবে। অভিরূপকে দেখে উৎসুক চোখে তাকায় সে। সদ্য শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে লোকটা। তাদের দুজনের চোখাচোখি হতেই রাগিনী মাথা ঝাঁকিয়ে না জানাল। অভিরূপ তার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকায়। রাগিনী আর সেদিকে খেয়াল করে না। ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে। কাঁচের জগ থেকে পানি গ্লাসে নিয়ে এগিয়ে দেয় রাশেদ সাহেবের দিকে। মৃদু গলায় বলে,
“বাবা, টেনশন করো না প্লিজ! শরীর খারাপ করবে তোমার।”
“আমি তো বুঝতেই না পারছি না কোথা থেকে কী হচ্ছে।”
চিন্তিত হয়ে কথাটি বলে দিলেন রাশেদ সাহেব। হাতে গ্লাস নিতেও হাত কাঁপছে উনার। রাগিনী না পেরে পানি পান করিয়ে দিলো উনাকে। বেশি পানিও পান করতে পারলেন না উনি। যেন গলায় পানিও আঁটকে যাচ্ছে। কর্ণকুহরে কারোর পায়ের তীব্র শব্দে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকা রাগিনীর ধ্যান ফিরলে দরজার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। নিজের বাড়ির সদর দরজাটিকে কালো রঙের কোট পরিহিত নিজের প্রিয় মুখটি দেখে যেন অঙ্গ, মস্তিষ্ক সকল কার্যক্রম বন্ধ করে। সবেই স্বাভাবিক হতে থাকা হৃৎস্পন্দনের বেগ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।
কোহিনূর একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা সময় রাগিনীকে পরখ করে। মেয়েটার দিকে তার প্রশ্ন ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না তার এই নির্মলতায় ভরা চেহারায় বিষাদ দেখতে। কিন্তু পরিস্থিতির সামনে সে ব্যর্থ। সে আসতে চায়নি। তার আসার কথা নয়। সে শুধুমাত্র এসেছে রাগিনীকে নিজে প্রশ্ন করবে বলে! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভেতরে এলো কোহিনূর। পিছু পিছু ঢুকল মেহরাজ। রাগিনীর সামনাসামনি দাঁড়াল সে। মেয়েটির মুখটা তখন কৌতূহলে পরিপূর্ণ। সে কিছু একটা বলতেও যাচ্ছিল তার আগেই কোহিনূর প্রশ্ন করে বসল,
“তুমি নিজে জেনেশুনে একটা ক্রি/মি/নালকে আশ্রয় দিয়েছিলে?”
ভাবলেশহীন হলো রাগিনী। এই লোকটিও তবে সবকিছুই জেনে গিয়েছে। কিন্তু অন্যের কাছ থেকে। সেকারণেই তার প্রতিক্রিয়া আজ এমন ভ/য়ানক হবে হয়ত! রাগিনী হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে খুঁজে পেল না। মাথা নিচু হলো সাথে সাথেই। কোহিনূর গাম্ভীর্যের সাথে ফের বলল,
“যা বলার সত্যি সত্যি বলবে!”
রাশেদ সাহেব কোহিনূরকে এমন জেরা করতে দেখে ক্ষি;প্ত হলেন এইবার। দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন,
“আশ্চর্য! আমার মেয়েকে কেন দো/ষারোপ করা হচ্ছে।”
“স্যার, আপনার মেয়ে সেটা খুব ভালো করে জানে। আমি কেন ওকে প্রশ্ন করছি।”
রাগিনী এবার বুকে সাহস নিয়ে মিনমিন করে বলে দিলো,
“হ্যাঁ। রূপা মানে আমার মতো দেখতে ওই মেয়েটার বাড়ি থাকায় সম্পূর্ণ সম্মতি আমার ছিল। আমি পুরো বিষয়টা জানতাম। আমি লুকিয়ে গিয়েছি।”
রায়ান উপস্থিত ছিল সেখানে। তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করল তবে সে নীরবই রইল কারণ সে জানে এটা কোহিনূর এবং রাগিনীর মাঝখানের কথাবার্তা। তার মাঝে কথা বলাটা ভালো দেখায় না। অপরদিকে রাগিনী অনেক ভেবে বের করে ফেলেছে এই খবরটা দেওয়ার একমাত্র বাহক ছিল নয়নতাঁরা। রাশেদ সাহেব যেন বিস্ময়ের সর্ব সীমানায়। তার মেয়ে এসবকিছু এই বাড়িতে থেকে করছে তিনি জানতেও পারলেন না। নিঃশ্বাস নিতে ক/ষ্ট হলো এবার। রাগিনী কোহিনূরের দৃষ্টি দেখে ভড়কালো এবার। এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বুঝিয়ে দিলো সে কত বড়ো অ/ন্যায় করে ফেলেছে। সে আগ বাড়িয়ে বলতে চাইল,
“কিন্তু তার পেছনেও কারণ আছে আমি…”
“তুমি কি জানো? একজন ক্রি/মিনালকে সাহায্য করার কারণে তোমায় এই মূহুর্তে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমরা পুলিশ কাস্টারিতে রাখতে পারি?”
ঢক গিলল রাগিনী। কোহিনূর এসব কথা বলবে তার ভাবনাতেও আসেনি কখনো। মুখটা বিবর্ণ হয়েছে তার। চোখ ফে/টে কান্না আসতে চাইছে। তবুও সে মুখ তুলছে না। মাথা নুইয়ে রয়েছে। অভিরূপ এবার চুপ থাকতে পারল না। তার কারণে রাগিনীর এত কথা শোনা মানতে পারল না। ফট করেই বলে দিলো,
“সি ইজ ইনোসেন্ট। আমি ওকে জোর করেছিলাম বিষয়টা কাউকে না জানাতে। সে বাধ্য হয়ে গোপন রেখেছে।”
কোহিনূর এবার নিজের দৃঢ় নজর রাখল অভিরূপের দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
“আই নো দ্যাট। আপনাকে আলাদা করে জানাতে হবে না। আপনারা চরম ভুল করেছেন। আপনাকে এসব মানায় না মি. অভিরূপ!”
“পানিশমেন্ট দিলে দিতে পারেন।”
অভিরূপের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি! কোহিনূর মাথা ঝাঁকাল। রাগিনীর দিকে তাকাল। মেয়েটা কী করে বসল সেটাই সে ভেবে উঠতে পারছে না। এতক্ষণ সে বারবার এই ভেবে রাগিনীকে প্রশ্ন করছিল যে সে কোহিনূরকে ভুল প্রমাণ করবে। কিন্তু হলো না। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় জন্ম নিলো তার। তবে শক্ত গলায় কিছু বলে ওঠার সাহসও জুগিয়ে উঠতে পারল না সে। তবুও বুকে যেন ভারি পাথর রেখে বলল,
“আই ডিড নট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ।”
রাগিনী ছলছল নয়নে তাকাল এবার। অশ্রুসিক্ত তার মায়াবী মুখখানা স্পর্শ করেও যেন ভেদ করে চলে গেল কোহিনূরের হৃদয়। কোহিনূর সত্যিই তার প্রেয়সীর এই বোকামী আশা করেনি। দৃঢ় শ্বাস নিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল সে আর বলল,
“দিস ইজ মাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এমনটা যদি পরবর্তীতে হয় আমি এর বিরুদ্ধে যেতে দুইবারও ভাববো না।”
আর বিলম্ব করল না কোহিনূর। দরজার দিকে ফিরে মেহরাজকে বলল,
“চলে এসো মেহরাজ।”#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫ (২য় খণ্ড)
পরদিনও নোমান গিয়ে হসপিটালে উপস্থিত হলো। কিছুটা তাড়াহুড়োর মাঝেই উর্মিলার কেবিনে ভুলবশত অনুমতি না নিয়েই প্রবেশ করল সে। তখন উর্মিলা তবে নিজের অগোছালো চুলটা নার্সের হাতে বেঁধে নিচ্ছিল। এমন হুট করে এই মানবটির আগমনে সে চমকালেও আজ রে/গে গেল না। কেমন যেন ম্লান মুখে তাকাল। আশেপাশে তাকিয়ে উর্মিলার মাকে দেখতে না পেয়ে নোমান জিজ্ঞেস করল,
“আন্টি নেই কেন আজ?”
উর্মিলার ত্যাড়া উত্তর শোনা গেল এবার।
“কেন মাকে দিয়ে কী করবেন? আবার আমার বিয়েশাদি নিয়ে আলাপ করবেন?”
নোমান তার এমন বাঁকা জবাবে মোটেও রাগ করল না বা উত্তেজিত হলো না। বরং হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ। উনার সঙ্গেই তো দেখা করতে এলাম। তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার এত শখ নেই আমার।”
“তাহলে আমাদের বাড়িতে যান ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। দেখা করে আসুন গিয়ে। মা কিছু কাপড় আর ফ্রেশ হতে বাড়ি গিয়েছে।”
“অন্যকেউ নেই তোমার সাথে?”
উর্মিলার সুর এবার নরম হলো খানিকটা।
“খালামনি ছিল। তো উনার ছেলের স্কুল ছুটি দিয়েছে তাই নিতে গেল।”
নার্সটি চুল বেঁধে দিয়ে এবার তাদের কথার মাঝে বলল,
“ম্যাম, আপনার চুল বাঁধা শেষ। এখন কিন্তু হাঁটার প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি অন্য কেবিন থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি। আপনাকে হাঁটতে সাহায্য করব।”
কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র সারা শরীরে কাঁপুনি উঠল উর্মিলার। নার্স চলে যেতে না যেতেই সে হাত উঠিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে নোমানকে কাছে ডাকল। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে নিকটে এলো নোমান। ওমনি তার হাতের বাহু খপ করে ধরে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলল,
“শুনুন না! ওই নার্সটাকে বলে দিন আমি এখনি হাঁটব না। আমার পায়ে অনেক ব্য/থা।”
নোমান এবার কাছে থাকা টুলে বসল। মেয়েটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো একবার। আসলেই তার মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আ/তঙ্কে আছে। তার ভয় কমাতে আশ্বস্ত করে বলল,
“যেহেতু নার্স বলেছে সেহেতু নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তোমার ভালোর জন্যই বলেছে। একটু হাঁটাহাঁটি তো করতেই হবে।”
“ওসব ভালোর আমার দরকার নেই আপনি জাস্ট বলে দিন আমাকে এখন হাঁটানোর দরকার নেই।”
নোমান এবার কিছুটা ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি কেন বলব?”
“আজব! আপনারই তো বলা উচিত। আপনার জন্য আমি ম্যানহোলে প/ড়ে গেলাম। আপনার তো এটা দায়িত্ব আমার ভালোমন্দের দিকে খেয়াল রাখা।”
নোমান তৎক্ষনাৎ সাফ জানিয়ে দেয়,
“পারব এসব বলতে আমি।”
উর্মিলার ভারি রা/গ হয়। দম ছেড়ে দিয়ে তেতে উঠে বলে,
“অকৃতজ্ঞ লোক একটা!”
কিছু সময়ের ব্যবধানে নার্স এসে উপস্থিত হলো। উর্মিলাকে হাঁটানোর জন্য জোরাজুরি করা শুরু হলো। উর্মিলাও হাঁটবে না বলে পণ করল। দুজনের কান্ড একজায়গায় বসেই ভাবলেশহীন হয়ে দেখতে থাকল। উর্মিলা মেয়েটা তো হাত-পা ছুঁ/ড়ে কাঁদতে বসে যাবে এমন ভাবসাব। গলাটা দুর্বল করেই ফেলেছে ইতিমধ্যে। অবশেষে নোমান নিজের জবান খুলল,
“ডক্টর তোমায় ডেইলি চেকআপ করে। চেকআপ করে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে তুমি হাঁটতে পারবে। কোনো সমস্যা হবেনা একবার ট্রাই করতে ক্ষ;তি কী?”
“প্রশ্নই আসেনা। আমি উঠে বসলেই পায়ে লাগছে। হাঁটতে গেলে ম/রেই যাব।”
এসব শুনে নার্স আরো কিছু বলার জন্য উদ্যত হলেন তবে নোমান ইশারায় থামাল তাকে। নিজে উর্মিলার হাত ধরে বলল,
“আচ্ছা আমি তোমায় হেল্প করি?”
“না। আমি হাঁটব না।”
উর্মিলার স্পষ্ট নাকচ পছন্দ হলো না নোমানের। সে তবুও জোর করে বলল,
‘আরে বাবা! আমায় অনেক তো অবিশ্বাস করলে একবার বিশ্বাস করে দেখো। ঠকবে না।”
উর্মিলা তবুও মানল না। এবার নোমান অনেক ভাবনাচিন্তা করে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। তার এমন চলে যাওয়ায় বোকাবনে গেল উর্মিলা। তার এমন জে/দে কি রাগ করল লোকটি? এই ভাবনাকেও ভুল প্রমাণ করে নোমান কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো। হাতে একটা ঔষধের পাতা দেখিয়ে বলল,
“নাও এটা খেলে হাঁটতে আর ব্যথা করবে না। ডক্টরের কাছ থেকে নিয়ে আসলাম।”
ভ্রু কুঁচকায় উর্মিলা এবার। চশমার কাছে নেমে আসে ভ্রুকুটি। যেন তার বিশ্বাস হয়নি। নার্স নিজেও হতভম্ব নোমানের এমন কথায়। এমন কোন ঔষধ আছে যেটা খেলে ব্যথা সাথে সাথেই গায়েব হবে? এতদিন নার্সিং পড়ে শিখলটা কী? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল নোমানের দিকে। উর্মিলা সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সত্যি?”
“খেয়েই দেখো একটা। তারপর হেঁটে দেখো যদি ব্য/থা না কমে তাহলে আমার নাম পাল্টে রেখো?”
অনেক ভেবে উর্মিলা এবার আশ্বস্ত হলো। এরই মাঝে ইশারায় কিছু কথোপকথন হলো নার্সের সঙ্গে নোমানের। নার্স ঔষধের পাতা দেখে বুঝল এটা শুধুমাত্র একটা ভিটামিন ট্যাবলেট ছাড়া কিছুই নয়। শুধুমাত্র মেয়েটাকে যেন হাঁটানো যায় সেকারণে এই পরিকল্পনা করেছে লোকটি। নার্সের বেশ ভালো লাগল বিষয়টা। উর্মিলা ঔষধ খেয়ে আস্তে করে নোমানের হাত টেনে ধরেই অল্প অল্প করে হাঁটল। হালকা ব্য/থা পেল অতঃপর সেই পায়ে চাপ কম দেওয়ায় তেমন সমস্যা হলো না। নোমান তাকে ধরে রেখে বলল,
“বলেছিলাম না? ব্য/থা করছে?”
উর্মিলা প্রফুল্লতার সাথে বলল,
“হালকা করছিল। ব্যাপার না এটা।”
“হুমম। যেমন মাচা তেমনই নাচা।”
নোমানের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল না উর্মিলা। তখনি বলল,
“কী বললেন?”
কথাটা নিজে ঘুরে বলতে গিয়ে পায়ে বেশি চাপ লেগে নিজেকে সামাল দিতে পারল না উর্মিলা। প/ড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে সে দ্রুত নোমানের বুকের শার্টের অংশ জড়িয়ে নিলো। অনুভব করা গেল মানুষটির ভেতরে থাকা সেই ধুকপুক সুন্দর এক আন্দোলিত আবৃত্তি। নোমান নরম সুরে বলল,
“বললাম যে আজ হয়ত আমাদের লাস্ট দেখা।”
পরক্ষণেই চোখমুখ অন্ধকার হলো উর্মিলার। তার বুকের হৃদস্পন্দনের গতিও তড়তড়িয়ে বেড়ে গেল অকারণেই। শুকনো গলায় শুধাল,
“মানে?”
“কাল বাড়ি থেকে কল এসেছিল। আমার ফুপিমণি মা/রা গিয়েছেন। আমাকে যেতে হবে। রাগিনীর মতো আমারও মা নেই। তাই উনি আমায় কোলেপিঠে করে মানুষ করলেন। সেই মানুষটাকে দেখতে হয়ত পাব না। তবে শেষকাজে অংশগ্রহণ করতে চাই আমি।”
“আর এই দেশে ফিরবেন না?”
নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না।”
উর্মিলার কিছুক্ষণ আগেই উৎফুল্ল হওয়া মনটা আস্তে আস্তে মিইয়ে গেল। ভারী হলো নিঃশ্বাস।
গত রাত থেকে বেশ কয়েকবার কোহিনূরকে কল করেছে রাগিনী। তার মাঝে একবারও কোহিনূর কলটা রিসিভ করেনি। সময়ে সময়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছে নিজের। বিষয়গুলো রাগিনীকে এবার বেশ দুঃখ দিচ্ছে। অভিমান জমাচ্ছে। একবারও কি পুরো ব্যাপারটা শোনা উচিত ছিল না? এমন উটকো ব্যবহার রাগিনীকে এবার ক্লান্ত করল। সে জানে কোহিনূর নিজের জায়গা থেকে ঠিক। তবে রাগিনীও মন্তব্যও তার শোনা উচিত! কিন্তু এই মানুষটা আগে থেকে এতোটা ঘাড়ত্যা/ড়া সেটা জানা ছিল না রাগিনীর। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ফের কল লাগাল রাগিনী। ফলাফল শূন্য। তবে দুই-তিন বার কল করাতে অবশেষে যেন প্রতীক্ষার শেষ হলো। কল রিসিভ হতেই দ্রুত রাগিনী বলে উঠল,
“কী সমস্যা আপনার? কাল রাত থেকে কল করে যাচ্ছি। খেয়াল আছে?”
“একচুয়ালি ম্যাম! আমি মেহরাজ।”
পরপর তিনটে ভাঁজ পড়ে রাগিনীর চুলে ঢাকা কপালে। এমনি মনমেজাজ ঠিক নেই। তার ওপর কোহিনূরের ফোনে মেহরাজের গলা। বিরক্ত হলো রাগিনী।
“আপনি কেন? আপনার স্যার কোথায়?”
“স…স্যার তো বিজি।”
রাগিনীর বুঝতে বাকি রইল না কোহিনূর মেহরাজের আশেপাশেই আছে। জোর গলায় বলল,
“ওই লোকটা আপনার পাশেই আছে বুঝতেই পারছি আমি। এখনি ফোনটা উনাকে দিন নয়ত আমি নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওই ফা/জিল লোকটাকে তো দুটো চ/ড় ক/ষিয়ে দেবই তার সঙ্গে আপনাকেও…”
পুরো কথাটা শোনার সাধ্য হলো না ফোনের ওপাশে থাকা মেহরাজের। তড়িঘড়ি করে কোহিনূর হাতে ফোন ধরিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“অন্যের বউয়ের হাতে চ/ড়-থা/প্পড় খাওয়ার শখ নেই স্যার। আপনিই খান। আমি বরং কাজে যাই।”
কোহিনূর চোখ গরম করে তাকিয়েও কাজের কাজ হলো না। মেহরাজ চলে গেল। অগত্যা ফোনটা কানে কাছে ধরল কোহিনূর। রসকষহীন কাঠখোট্টা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? ফোন করেছ কেন?”
“কী হয়েছে মানেটা কী? আমি কি আপনাকে কারণ ছাড়া কল করতে পারিনা?”
কোহিনূর আগের প্রতাপ নিয়েই জবাবে বলে ওঠে,
“কাজের সময় আমি ডিস্টার্ব করা পছন্দ করিনা রাগিনী। সেখানে তুমি একের পর এক কল করেই চলেছ।”
রাগিনীর কণ্ঠে এবার অভিমানের আভাস পাওয়া গেল,
“এখন আমি আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি? কাল রাত থেকে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তখনও কি কাজ ছিল?”
“এসব উল্টাপাল্টা কথা না বলে কী রিজনে কল করেছ সেটা বলো।”
রাগিনী বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল কিছুটা। কোহিনূরের সঙ্গে সে নিজেও চ/টে গেলে বিষয়টা আরো বিগড়ে যাবে। শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“আপনি আমায় ভুল বুঝছেন কোহিনূর। আমি আপনাকে কাল রূপার কথা জানাতে চেয়েছিলাম। অভিরূপ অনুরোধ করলেন। উনি নিজে বলেছেন রূপার সাথে পারসোনালি কথা বলে নিজে পু/লিশের হাতে তুলে দেবে। আমার তখন কিছু করার ছিল না!”
কোহিনূর কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“রূপা কে?”
“ওই আমার মতো দেখতে যেই মেয়েটা।”
এবার ওই বিষয়টা আসতেই রা/গটা আরো বাড়ল কোহিনূরের। তবুও রা/গ না দেখনোর চেষ্টায় বলল,
“ওইসব কথা বাদ দাও। আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাইনা। এসব শোনাতে কল করে থাকলে এখনি কল কাটো। আমার রা/গটা দেখলে তোমার নিজেরই ক/ষ্ট হবে।”
“এটা এক্সকিউজ নয় কোহিনূর। বোঝার চেষ্টা করুন।”
“লজিকলেস লজিক দিলে কী বুঝব আমি? আমাদের কাছে অপ/রাধীকে ধরাটা প্রয়োজন। সেখানে সেই অপ/রাধীকে নিয়ে তোমরা আবেগে ভেসে যাচ্ছো এবং পুরো বিষয়টা আমাদের থেকে লুকিয়েছ।”
রাগিনী চোয়াল শক্ত করে বলল,
“আবেগ কখন কার ওপর কাজ করে সেটা কি কেউ লিখে দিতে পারে? আপনি নিজেও তো আমাকে প্রথমে ক্রি/মি/নাল ভেবেছিলেন। আবার পুরো নিশ্চিত না হয়েই আমাকে ভালোবেসেছিলেন। তাহলে অন্যদের বেলায় ভিন্ন কেন?”
কল কেটে গেল এবার। রাগিনী শুনতে পেল না কোহিনূরের জবাব। এভাবে হঠাৎ কল কেটে দেওয়ায় হতাশ হলো রাগিনী। মনে জমল ধূসর রঙের সেই অভিমানের স্তর। লোকটা কেন যে বুঝতে চাইছে না! আর রূপাঞ্জনাই বা কোথায়? গতকাল থেকে তার বাবাও ভয়ে, রাগিনীর উপর রে;গে বেশ অসুস্থ হয়েছেন। ডক্টর ঘুমের ঔষধ দিয়ে রেখেছেন বর্তমানে। মূহুর্তেই সব এলোমেলো হলো। রাগিনীর চোখের কোণে পানি জমল। সেই ছলছল দৃষ্টিতে বিছানার কাছের জানালার কাছে বসে বাহিরের আকাশের দিকে নিবদ্ধ করল দুটো চোখ। অনুভব করল রিও এসে গুটিশুটি হয়ে তার কাছে বসেছে। তার দিকে না তাকিয়ে একহাতে তার গায়ে হাত রাখল। অন্যহাত দিয়ে চোখের পানিটা গাল বেয়ে পড়ার আগেই মুছে নিলো তাড়াতাড়ি।
বিকেল হতে না হতেই নয়নতাঁরা বাঙালীয়ানার সাজে রায়ানের বাড়িতে পদার্পণ করল। আজ নীল রঙের জামদানী শাড়ি পড়েছে সে। হাতে নীল-সাদা রেশমি চুড়ি ঝনঝন করছে। বাঙালী মেয়েদের মতোই হালকা করে সেজেছে। তবে যেটা তার মনমতো হয়নি সেটা হচ্ছে চুল। বাঙালী নারীদের ন্যায় বড়ো বড়ো কোমর অবধি ঘন কেশ নেই তার। চুলগুলো শুধু কাঁধ ছেড়ে একটু বেড়েছে। তাও কোঁকড়ানো! কী জানি তাকে কেমন লাগছে! রায়ানের বাড়ির দরজায় কলিংবেলে চাপ দেওয়ার আগেই তার মনে হলো রায়ান তাকে জোকার ভেবে হাসাহাসি করবে না তো? অনেক ভাবনাচিন্তা করার পর সে সাহস নিয়ে কলিংবেল চাপে। কিছুক্ষণ পরই দরজা খোলে রায়ান। আজ তার ছুটিই ছিল। গতকাল সে শিশু পা/চারকারীদের ধরেছিল। তার ওপর জন্মদিন আজ তার। ফলে ছুটি উপভোগ করছে বাড়িতে ঘুমিয়েই। হঠাৎ নয়নের আগমনে বেশ চমকালো সে। তার উপর এমন সাজগোজে রায়ানের মস্তিষ্ক ফাঁকা হতে শুরু করল। কোথাও একটা মুগ্ধতা লেগেই গেল! অতঃপর চোখটা সরিয়ে নিজের মনকে বলল, ‘ছি রায়ান! ওকে তুই আন্ডাবাচ্চা থাকতে জামা ছাড়া ঘুরতেও দেখেছিস। তার দিকে এভাবে দেখিস না।’
নিজেকে ধাতস্থ করে রায়ান বলল,
“মিস. নয়নতাঁরা? তুমি?”
“হ্যাপি বার্থডে ইন্সপেক্টর!”
“থ্যাংক ইউ। বাট…”
রায়ানকে নয়ন থামিয়ে বলল,
“কিন্তু টিন্তু কিছু না। আমি এসেছি প্ল্যান সাকসেসফুল করতে।”
রায়ান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“মানে কীসের প্ল্যান?”
“উফফ…আপনি না বললেন আমার বিগ ব্রাদারকে আপনার জন্মদিনে উপস্থিত করলে খুশি হবেন সেটা!”
রায়ান আশেপাশে তাকাল। নির্জনকে দেখতে পেল না। কনফিউজড হয়ে বলল,
“কই সে? আসেনি তো।”
“ওহ হো! আমি বলেছি সে এখনি আসবে? তার আসার তো ব্যবস্থা করতে হবে নাকি?”
নয়নের প্রতিটা কথা যেন রায়ানের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সে প্রথমে সরে গিয়ে নয়নকে বাড়ি ঢুকতে দেয়। নয়নতাঁরাও স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়িতে প্রবেশ করে বলে,
“দেখুন, এমনিতে তো বিগ ব্রাদার আসবে না! এরজন্য পরিকল্পনা করতে হবে। বাড়ি সাজাতে হবে। বার্থডে পার্টির আয়োজন করতে হবে। তারপর তাকে ডাকতে হবে।”
রায়ান তবুও বুঝল না। বলল,
“করলেই যে সে আসবে সেটার নিশ্চয়তা কী?”
“আপনি ওতোসতো বুঝবেন না। এখন আমাকে আপনার এই পুরো ড্রয়িংরুম সাজাতে হেল্প করুন।”
এবার মাথা ঘুরছে রায়ানের। মেয়ের কী আশ্চর্য কথাবার্তা! নিজের জন্মদিনে নিজেই অবশেষে ঘর সাজাবে?
অনেকক্ষণ হলো। নয়নতাঁরা কাজে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুমের অনেকটা সাজিয়ে ফেলেছে সে। রায়ান নিজের ঘরে গিয়েছে কিছু কাজে। ব্যস্ততার মাঝে কলিংবেলটা বাজে। নয়নতাঁরা প্রথমে খানিকটা অসহ্য হলেও পরবর্তীতে ভাবে হয়ত কেক ডেলিভারি করতে এসেছে। সে কেকও অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। এই ভেবে সব কাজ ফেলে সে দরজার কাছে এগোয়। আপনমনে দরজা খুলতেই বাহিরে আবিষ্কৃত হয় এক বয়স্ক মহিলা। হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ। নয়ন মহিলাটিকে চিনতে পারল না।
রায়ানের মা বেশ কয়দিন ধরেই ভালো আছেন। ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দেশে আসার তোড়জোড় করছিলেন ছেলেকে না জানিয়েই। ভেবেছিলেন জন্মদিনের দিন বাড়িতে ফিরে একটা চমক দেবেন আদরের ছেলেকে। কিন্তু উনি নিজের বাড়িতে এমন সুন্দরী একটা যুবতী মেয়েকে দেখে নিজেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখে আসছে না কোনো কথা? তবে ছেলেটা কি না বলে কয়ে বিয়ে টিয়ে করে ফেলল? তিনি বারবার নয়নকে পরখ করলেন। পোশাকআশাক দেখে বুঝলেন মেয়েটি ভালো ঘরের। তখন আরো নিশ্চিত হলেন ছেলে নিশ্চয় বিয়ে করেছেন। দ্রুত নয়নকে ঠেলে হাহুতাশ করতে করতে কিছুটা জোরে জোরে বললেন,
“এই দিনটাই দেখা বাকি ছিল! ছেলেটা আমাকে পর করে দিয়েছে। আমায় না জানিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে মেয়ে এনে তুলেছে। আমি এসব দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম?”
চলবে…
[বি