#অতঃপর_সন্ধি (অন্তিম পর্ব)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
মাস ছয়েক হবে অফিস থেকে পাওয়া ফ্ল্যাটে মা বাবা আর বৃষ্টি নিয়ে উঠেছে মায়ান। বাবার সকল ঋণ সে পরিশোধ করেছে একটু একটু করে। ঋণ শোধ হতে বাবা মাকে আর গ্রামে রাখেনি সে। নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। বৃষ্টির ইউনিভার্সিটিতে যেতেও যেন কোনো অসুবিধা না হয়।
অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসেছে মায়ান। বসার ঘরে হইচই দেখে সেখানে পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। আফিয়া আর শিমুল এসেছে। মায়ানকে দেখে হইচই কমে থমথমে হয়ে গেলো পরিবেশ। জুতো জোড়া খুলে হাসিমুখে আফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তোমরা কখন এলে?’
মুখ ঘুরিয়ে নিলো আফিয়া। জবাব দিলো না।
ব্যপারটাকে গায়ে মাখলো না মায়ান। এসব আর সে তোয়াক্কা করে না। তার দায়িত্ব কেবল একজন ভালো ভাইয়ের আর একজন আদর্শ সন্তানের। সে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে।
অফিসের পোশাক ছেড়ে হাত পা ধুয়ে এলো মায়ান। বৃষ্টিকে ডেকে বলল,
‘আমাকে খেতে দে বৃষ্টি। খিদে পেয়েছে।’
‘বিয়ে করে বউ আনলে তো বৃষ্টি কে খাবার দেওয়ার কথা বলতে হয় না।’ কাট কাট গলায় বলল আফিয়া।
জবাব না দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো সে।
জবাব না পেয়ে তেতে উঠলো আফিয়া।
‘তোর কি মায়ের কষ্ট চোখে পড়ে না?’
আফিয়া রেগে যাচ্ছে দেখে শিমুল তার হাতটা ধরে শান্ত করার জন্য।
‘কেন মায়ের কি শরীর খারাপ করেছে?’
‘একদম না বুঝার ভান করবি না।’
মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন দিলারা বানু। বৃষ্টি ভাতের প্লেট সামনে দিতেই দূরে সরিয়ে রাখলো মায়ান। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আফিয়ার সামনে গেলো।
‘না চোখে পড়ে না। আমার দুচোখ দায়িত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ।’
নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েও ফিরে এলো সে। আজ কিছু কথা বলে হালকা হওয়া প্রয়োজন। মানসিক চাপ সে আর নিতে পারছে না।
বোনের সামনে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলল,
‘কয়েক বছর আগে আমিও আমার মায়ের পা জড়িয়ে অবুঝ শিশুদের মতো কান্না করেছিলাম। শুধু ওই মেয়েটাকে নিজের বউ করবো বলে। আমার মায়ের মন গলেনি। আমি সামান্য হাত কাটলে যে মা অস্থির হয়ে যেতো। আমার চোখের পানি দেখেও সেই মায়ের মন গলেনি। আমার সেই মা বুঝেনি তার একটা কথার জন্য আমি কতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম এবং আছি। আমার সহজ সরল মা কঠিন হয়েছিলেন। কারন তিনি তার ভাইকে কথা দিয়েছেন। কথার খেলাফ হলে তিনি মুনাফিক হবেন। তার সেই ভাইঝি যখন আমি দেশে ফিরার আগেই তার প্রেমিক নিয়ে পালিয়ে গেলো তখন আমার মামু মুনাফিক হয়নি। তার কথার খেলাফ হয়নি। এখন তো আমার মায়ের প্রতিশ্রুতি রাখার কোনো দায়বদ্ধতা নেই তাহলে এখন বিয়ের কথা আসছে কেন? মানুষের কত রকমের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে। আমার কাঁধে এসে পড়েছিল আমার মায়ের প্রতিশ্রুতি রাখার দায়িত্ব।’
‘মা জানতো নাকি সুইটির প্রমিক ছিলো?’
‘না মা জানতো না।’ চিৎকার করে উঠলো মায়ান।
ভাইয়ের চিৎকারে কেঁপে উঠল শিমুল। সে এমনিতেও একটু ভীতু।
‘না মা জানতো না। তবে মা এটা জানতো আমি একজনকে পছন্দ করি। একজনকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি মায়ের কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলাম। যেন একটু অনুমতি দেয়। দেয়নি। চেয়েছিলাম আম্মা যেন আমার ভালোবাসাকে সাদরে গ্রহণ করে। আমার চাওয়ার কোনো মূল্যই দিলো না। সুইটি ও নিজের ভালোবাসার মানুষ পেলো। আমার মাও মুনাফিক হলো না। মাঝখান থেকে আমি হারিয়ে ফেললাম সব।’
‘ওই মেয়েটা ছাড়া দেশে আর কোনো মেয়ে নেই?’
‘না নেই। আমার জন্য নেই। ওই মেয়েটার মতো করে কেউ আমাকে ভালোবাসবে না। সামান্য অসুস্থতায় কেউ উৎকন্ঠিত হবে না। গলা শুনে চট করে বুঝে ফেলবে না আমার পকেটে নাই বলে খেতে পারিনি। হুটহাট মেসের নিচে এসেও কেউ বলবে না, নিচে নামুন।আমি খাবার নিয়ে এসেছি। দু’টো জামা হাতে দিয়ে বলবে না, এগুলো আপনার বোনদের জন্য। বলবেন আপনি কিনেছেন।’
‘তাহলে সুইটি কে বিয়ে করতে কেন রাজি হয়েছিলি?’
‘মায়ের কথার খেলাফ যেন না হয়।’
‘এভাবে জীবন চলে না মায়ান? কতদিন তুই একা একা থাকবি? মা বাবার ইচ্ছে করে না।ছেলের বউ দেখার? নাতি নাতনির মুখ দেখার?’
‘তোমাদের ছেলেমেয়ে তো আছে। আলাদা করে আমার ছেলেমেয়ের প্রয়োজন দেখছি না।’
‘আপনি আপনার ছেলেকে কিছু বলছেন না কেন আব্বা?’
‘আমি হেইদিনও বোবা আছিলাম আইজও বোবা। আমার টেকা পয়সা থাকলে না তোর মামুর তে টেকা হাওলাত আনতাম আর হেই বেডা সুযোগে তোর মা র তে কতা লইতো। আর না আইজ আমার পোলা কষ্ট পাইতো।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন খায়রুল আলম।
একটু বাদে বাদে নাক টেনে চোখ মুছছেন দিলারা বেগম। সেইদিনের সেই সিদ্ধান্তের জন্য আজ বেশ আফসোস হচ্ছে তার।
‘কতবার মাকে বললাম মামুকে বুঝিয়ে বললে তিনি মেনে নিবেন।’ ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে।অসহায় গলায় পুনরায় বলল,
‘শুনলোই না আমার কথা। আজ বড্ড আফসোস-আক্ষেপ হয়। সেদিন বৃষ্টির কথা শুনে যদি পুষ্পিতাকে বউ করে সোজা মায়ের সামনে আসতাম হয়তো মা কয়েকদিন রেগে থাকতো। পরে ঠিক মেনে নিতো। আমি বোকা পারলামই না। বসে ছিলাম মায়ের অনুমতির জন্য।’
দিলারা বেগমের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো মায়ান।
‘গলায় দ’ড়ি দেওয়ার কথা বলে আমায় আটকে দিয়েছিলে আম্মা। অথচ তুমি যদি তোমার ছেলের ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত ভেতরটা দেখতে গলায় দ’ড়ি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। এমনিতেই ম’রে যেতে। জাপানে থাকা কালীন, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ইকুয়েশন সমাধান করার পর যখন আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম? আমার না ভীষণ ইচ্ছে করতো মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য। ভীষন ইচ্ছে করতো মেয়েটাকে দেখতে। আমার ক্লান্তি নিবারনের কারন ছিলো সে। না আমি মেয়েটাকে দেখতে পেতাম আর না তার গলার আওয়াজ শুনতে পেতাম। কতগুলো দিন আমি মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনি না। কত রাত আমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছি শুধু আমি জানি। আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখলে দড়ির প্রয়োজন তোমার পড়তো না আম্মা। আমার এইখানটায় জ্বলে আম্মা। এইখানটায় পুড়ে।’ বুকের দিকে ইশারা করে।
‘আমার ভীষণ কষ্ট হয় আম্মা। তোমার ওই একটা ‘না’ এ আমি পুড়েছি। আজও পুড়ছি। যতদিন থাকবো পুড়বো না পাওয়ার যন্ত্রণায়। আমার চারপাশের বাতাসে শুধু বিষাদ, বিচ্ছেদের গন্ধ। আমি ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে পারিনা আম্মা। আমার দম আটকে আসে। কি বিশ্রি গন্ধ বিচ্ছেদের। তুমি যদি একটু মামুর সাথে কথা বলতে আজ আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম।’
দিলারা বানুর কোলে মাথা রাখলো মায়ান। ছেলের মাথায় হাত রাখতে গিয়ে রাখলেন না তিনি। অনুশোচনা হচ্ছে ভীষণ।
‘আমার বিচ্ছেদের গল্প যারা শুনে তারা আমায় উপহাস করে। ব্যঙ্গ করে বলে, এতো ছোটো কারনে কেউ ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দেয়? মা বাবা ওমন বলেই।’ ওরা তো জানে না আম্মা আমি সোনার চামচ মুখে নিয়া জন্মাই নাই। আমি জন্মেছি এক নিম্নবৃত্ত পরিবারে। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা মানুষকে লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। একবেলা খাবার খেয়ে চিন্তা করতে হয় পরের বেলা কি খাবো। ওই পরিবারে আমার আম্মা সারাদিন পরিশ্রম করে নিজে না খেয়ে আমার রেখে দিয়েছে। যেন আমি পেটপুরে খেতে পারি। সেই মায়ের মৃ’ত্যু’র
কারণ আমি হবো? আমার মতো কুলাঙ্গার যে আর নাই আম্মা। আমি না ওই মেয়েটাকে ছেড়ে আসার কারন বলতে পারিনি। বলতে পারিনি আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো দাম নেই আমার বাবা মায়ের কাছে। কথার বানে জর্জরিত করে কেবল দূরে সরিয়েছি। এক নারীর আদর্শ সন্তান হতে গিয়ে আরেক নারীর কাছে হয়েছি কাপুরষ আর বিশ্বাস’ঘা’ত’ক।’
বসা থেকে উঠে নিজের চোখ মুছে নিলো সে।
‘আমি সেসব সাহসী পুরুষদের মতো নই আম্মা যারা প্রেমিকার হাত ধরে বাড়িতে উঠে। আমি ভীতু ভীষণ ভীতু। তাই তো তোমার মিথ্যে হুমকিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন তোমার মুনাফিক হওয়ার সুযোগ নাই আম্মা। আমিও দায়মুক্ত। আমারে দয়া করে বিয়ের জন্য জোর করবা না।আমি কিন্তু আম্মা সত্যি সত্যি গলায় দ’ড়ি দিবো। আমারে এবার শান্তিতে একটু বাঁচতে দেও।’
এবারে মুখ খুলেন দিলারা বানু। ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
‘আমার ভুল হইছে আব্বা। আমারে মাফ কইরে দেও। নিজেরে কষ্ট দিও না।’
‘ওমন কথা বলো আম্মা। মা কখনো সন্তানের কাছে মাফ চায় না। এটাকে আমি আমার নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছি। আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। বক্ষঃস্থলে আর ভালোবাসা নেই। সেখানে শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্যের আনাগোনা।’
নিজের রুমের দিকে পা বাড়ানোর আগে শুনতে পেল আফিয়া তার মাকে শাসাচ্ছে।
‘সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। কার কাছে জিজ্ঞেস করে মামুরে কথা দিছিলা? মানুষের পছন্দ অপছন্দ থাকে না,,,,,,,’
আর কিছু হয়তো বলেছিলো তবে সে আর শুনেনি। মনের ভিতরের জমানো কথাগুলো কিছু বলতে পেরে একটু হালকা লাগছে। পুষ্পিতার মুখোমুখি হতে পারলে হয়তো আরো একটু হালকা হয়ে যেতো। তবে মেয়েটার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্র সাহস তার নেই।
__________________
কপালে হাত ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে মায়ান। কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠল সে। হাত সরিয়ে বৃষ্টিকে দেখতে পেলো। একমাত্র বৃষ্টির সাথেই সে ঠিকঠাক কথা বলে।
‘বেড়ে রাখা ভাত ফেলে আসতে নেই। খাবে চলো।’
অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘খাবো না। খিদে নেই।’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো বৃষ্টি। ভাইয়ের পাশে বসে একটা হাত আঁকড়ে ধরলো।
‘এভাবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছো ভাইয়া? এভাবে জীবন চলে বলো?’
এতোক্ষণ নিজেকে কঠিন করে রেখেছিলো। এখন আর পারলো না। কষ্ট নিবারনের জন্য বোনকে আঁকড়ে ধরলো।
‘খুব ইচ্ছে করে ওই মেয়েটার সাথে ছোট্ট একটা সংসার পাতবার। একটাবার যদি আবার সুযোগ পেতাম, বিশ্বাস কর হাতছাড়া করতাম না। ওই মেয়েটাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন একটু মানসিক শান্তির জন্য। আমার বুকের ভেতরটা কেবল হাহাকার করে। সেদিন আম্মা রাজি হলে হয়তো আমার সংসার আজ পূর্ণ থাকতো। ধারণা ছিল পুষ্পিতার পরিবার মেনে নিবে না।আমার সহজ সরল মাই যে প্রথম বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারিনি।’
‘সেদিন আমার কথা শুনলে হয়তো এভাবে তোমাকে তিলে তিলে ম’র’তে হতো না। ছোট বলে আমার কথাটা পাত্তাই দিলে না।’
‘তুই আমার কত বছরের ছোট জানিস?’
সম্মতিতে মাথা দুলায় বৃষ্টি। ‘আট বছর।’
‘কম সময় না। তুই এতোটা অভাব না দেখলেও আমি দেখেছিলাম। তোর বয়স হয়তো দুই কি তিন বছর। ওই অভাবের দিনে আম্মা কি নিয়ে যেন আব্বার সাথে জেদ করলেন। আব্বার পকেটে নাই। সেজন্য আব্বা নিষেধ করলেন। আম্মা জেদ করে টানা তিনদিন ভাত খেলেন না। পানিও স্পর্শ করলেন না। আমার সেদিন আম্মার জেদের কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল। যদি সত্যি সত্যি আম্মা,,,,,’
‘এখন কষ্ট কে ভোগ করছে? আমি? তখনকার জেদ আর এখনকার জেদ সমান না। চাইলেই মানুষ ম’র’তে পারে না।’
‘যদি করে ফেলতো? আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি।’
তেতে উঠলো বৃষ্টি। মেজাজ আসমান ছুলো তার। তিরিক্ষি মেজাজে রুষ্ট হয়ে বলল,
‘যদি, যদি, যদি। যদির কোনো অর্থ নেই। যদি এটা হতো, যদি ওটা হতো। হয়নি, হতোও না। কারন মা জানে শত কষ্ট হলেও তুমি মায়ের উপর দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না। এই যদি যদি করতে করতে আজ এই অবস্থা।’
রাগে হিস হিস শব্দ করছে বৃষ্টি। এক পর্যায়ে কেঁদে দিলো সে। চোখের পানি চিবুক স্পর্শ করলো তার।
‘বড় আপা মেজ আপা তোমার কষ্ট দেখে নাই ভাইয়া। আমি দেখেছি। আমি তোমাকে কাঁদতে দেখেছি। আমি রোজ তোমার হাহাকার দেখি। তোমার জন্য আমার কষ্ট হয় ভাইয়া। শেষ কবে হেসেছিলে ভাইয়া?’
বৃষ্টি মায়ানের গাল স্পর্শ করলো।
‘আমি আমার ভাইকে কতদিন হাসতে দেখি না।’
‘হাসার পথ বন্ধ। তাই হাসি না।’
ত্বরিত গতিতে গাল হতে হাত সরিয়ে নিলো বৃষ্টি।
‘তুমি নিজে বন্ধ করেছো।’
নিশ্চুপ রইলো মায়ান। ভাইয়ের নিরবতা আবারও গর্জে উঠলো বৃষ্টি।
‘এতোই যখন মায়ের বাধ্য ছেলে তাহলে কেন বিয়ে করছো না? এখনও তো মা তোমার বিয়ের কথা বলছে। এখন তোমার সহজ সরল মাকে শান্ত করো বিয়ে করে।’
‘এখন তো আর মা কাউকে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আমার ভেতরেও ভালোবাসার মতো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। আমি শূন্য। আমার নিয়তি একা থাকার।’
দাঁতে দাঁত পিষে বৃষ্টি। ভেজা নেত্রপল্লব। তবে চোখ দু’টো দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে।
‘নিয়তিকে একদম দোষ দিবে না। তোমার সমস্ত কষ্টের জন্য তুমি নিজে দায়ী। নিয়তিকে দোষ দেওয়া অজুহাত মাত্র। সেদিন একটু সাহস করলে আজ অন্যরকম দিন পার করতে। তুমি ওই আপুটাকে আসলেই কোনোদিন ভালোবাসোনি। ভালোবাসলে একটু সাহস করতে কাছে টানার। একটু স্রোতের বিপরীতে যেতে। তাহলে একটা সুখের সংসার করতো। মায়ের পা ধরে কেঁদেছিলাম। মার মন গলেনি। হেনতন বলা বন্ধ করো। এর বাইরে চেষ্টা করেছিলে তুমি? কাঁদলেই শেষ? তুমি আসলে একটা কাপুরষ।’
দরজা সজোরে লাথি মে’রে প্রস্থান করলো সে।
বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবারও আগের মতো হাত ঠেকালো কপালে।
‘আসলেই কাপুরুষ আমি। টাইম এন্ড টাইড,ওয়েট ফর নান। একটু যদি প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে পাওয়ার চেষ্টা করতাম। তাহলে হয়তো বলতে পারতাম চেষ্টা করেছিলাম। সময় ফুরিয়ে বুঝলাম। এখন আফসোস ছাড়া কিছু করার নেই। আমি আপনাকে আসলেই ভালোবাসতাম? হয়তো হ্যা,নয়তো বা না। ভালোবাসলে এভাবে ছেড়ে দিতে পারতাম?
_______________________________
স্নায়ুযুদ্ধ চলছে পুষ্পিতা আর তানজিফের মাঝে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে দু’দিন ধরে। কিন্তু কি নিয়ে চলছে এই ঠান্ডা লড়াই এর কারন স্পষ্ট নয়।
শো-রুম থেকে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো তানজিফের। ততক্ষণে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে আর কলিংবেল চাপলো না। মেসেজ করলো পুষ্পিতা কে।
‘কেউ যদি দরজাটা একটু খুলে দিতো বেশ উপকার হতো আমার। অনেক ক্লান্ত আমি।’
মেসেজ সেন্ট করার মিনিটের মাথায় দরজা খুলে গেলো। হয়তো তানজিফের আসার অপেক্ষায় ছিলো পুষ্পিতা।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কপাল কুঁচকে গেল তানজিফের। আয়নার সামনে বসে সাজুগুজু করছে পুষ্পিতা। চুলে আর্টিফিসিয়াল গাজরাটা লাগলোর অব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। বড্ড আবেদনময়ী লাগছে পুষ্পিতাকে। ফাঁকা ঢুক গিলে তানজিফ। পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে কন্ট্রোল করার প্রয়াস চালালো। আদৌও পারলো কী?’
পুষ্পিতার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। কিঞ্চিৎ নুয়ে পড়লো। থুতনি ঠেকলো কাঁধে। গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই পুষ্পিতার শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো। লিপস্টিক হাতে নিয়েছিলো মাত্র। হাত একদম স্থির হয়ে গেলো তার। তানজিফ ঠান্ডা হাতে
স্পর্শ করলো পুষ্পিতার উন্মুক্ত উদরে। কেঁপে উঠলো পুষ্পিতার শরীর। শীতল স্পর্শে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো কিয়ৎকাল।
তানজিফের হাত সরলো না। না সরলো সে। স্থির, অনড় রইলো। পুষ্পিতা বুঝতে পারলো তানজিফ মিটিমিটি হাসছে। তাকে নিঃশব্দে জ্বালিয়ে ভীষণ মজা পাচ্ছে সে। তাকেও চুপ করে থাকলে চলবে না। নাক ফুলিয়ে কিছু বলার আগেই তানজিফ চিরুনি নিয়ে ভেজা গুলো আঁচড়াতে লাগে। পুষ্পিতা রাগে হিস হিস শব্দ করতে লাগলো। আঙুল উঁচিয়ে বলল,
‘চিরুনি ঘুরে গিয়েও নেওয়া যেতো।’
পুষ্পিতার কথাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না তানজিফ। আড়মোড়া ভেঙে রগড় গলায় বলল,
‘আমার কাছে এটাই সোজা পথ মনে হয়েছে।’
দাঁত কিড়মিড় করলো পুষ্পিতা। কিন্তু কথা বাড়াল না।
কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল তানজিফ। মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগইন করলো। ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো আর একটু পর পর আড়চোখে পুষ্পিতার দিকে তাকাচ্ছে। পুষ্পিতা সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাহনি বেশ সূঁচালো। একটু পরেই তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মোবাইল রেখে পুষ্পিতার দিকে চাহনি নিবদ্ধ করে তানজিফ।
পুষ্পিতা তার দিকে ফিরে আঁচল ঠিক করতে ব্যস্ত। সে এমন একটা ভাব করলো যেন এতে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলোনা সেই ভাব। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো।
‘আয়না এইদিকে না ওইদিকে।’ আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল তানজিফ।
মুখ ভেঙচি দেয় পুষ্পিতা।
‘কোথায় লেখা আছে আয়নার সামনে গিয়ে আঁচল ঠিক করতে হবে? রুম আমার আমি যেখানে খুশি সেখানে আঁচল ঠিক করবো।’
‘এখানে আমাকে জোর পূর্বক সি’ডি’উস করা হচ্ছে।’
‘আমাকেও একটু আগে করা হয়েছিল।’
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেলো তানজিফের।
‘ফাজলামো বাদ দে। খেতে দে প্লিজ। খিদে পেয়েছে ভীষণ।’
পুষ্পিতা হেলতে দুলতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
‘কেউ যদি ভেবে থাকে আমি তার জন্য সেজেছি। তাহলে সে ভুল। সে যেমন সারাদিন সুন্দরী সেক্রেটারির সাথে থেকে বাসায় ফিরেছে আমিও সারাদিন বাসায় থেকে এখন আমার ড্যাশিং, স্মার্ট পার্সোনাল সেক্রেটারির সাথে সারারাত ঢাকা শহর ঘুরবো। সে যেন নিজে নিজে নিয়ে খেয়ে নেয়।’
রুম থেকে মেসেজ সেন্ট করে দাঁতে নখ কাটতে লাগলো পুষ্পিতা। তানজিফের আসার অপেক্ষা করছে। অযথা রাগ করে এখন নিজেরই আফসোস হচ্ছে। তানজিফের আসার আওয়াজ পেয়ে পুষ্পিতা তাড়াতাড়ি করে সদর দরজার কাছে গেলো। দরজার হাতলে হাত রাখার আগেই তানজিফ খপ করে হাত ধরে ফেলে। একটানে নিজের দিকে ফিরালো।রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘এতোরাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
‘ঘুরতে।’
মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো পুষ্পিতা।
‘কোথায় যাচ্ছিস আরেকবার উচ্চারণ কর।’
‘ঘুর,,,’ সম্পূর্ণ করার আগেই পুষ্পিতা কে কোলে তুলে নিলো তানজিফ।
হাত, পা ছুড়াছুড়ি করতে লাগলো পুষ্পিতা।
‘আমি কিন্তু এখন মামনী কে ডাকবো।’
‘ডাক তুই মিস্টার নওশাদ এবং তার ওয়াইফকে। তারাও দেখুক তাদের ছেলের রোমান্স।’
পুষ্পিতাকে কোলে করে রুমের দিকে পা বাড়াতেই তানজিফের গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে পুষ্পিতা। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘জ্বলে তাই না?’
ফিক করে হেসে দিলো তানজিফ।
‘খুউউউউব জ্বলে।’
রুমে এসে কোল থেকে নামিয়ে দিলো পুষ্পিতাকে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলিষ্ঠ হাতে। গলায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
‘কানে ধরলাম। বউয়ের সামনে কখনো কোনো মেয়ের প্রশংসা করবো না।’
‘তার মানে পিছনে করবি?’ ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলো পুষ্পিতা।
‘না, কারন আমার চোখ শ্রেষ্ঠ সুন্দরী আমার বউ। আমার জীবন্ত পুষ্প । যেই পুষ্পের উপর কেবল আমারই একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই পুষ্পকে কেবল আমিই ছুঁয়ে দেই নিবিড়ভাবে। আমার জীবন্ত পুষ্পের সর্বাঙ্গে কেবল আমারই বিচরণ।’
ভ্রু কুঞ্চিত করে পুনরায় বলল,
‘এখন বল তোর পার্সোনাল সেক্রেটারি কে?
মোড় ঘুরে তানজিফের কাঁধে হাত রাখে পুষ্পিতা। দু আঙুলের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে নিলো। নাকে নাক ঘষে কন্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলল,
‘ এই যে আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি। একেবারে সারা জীবনের জন্য যাকে নিজের কাজে নিয়োজিত রেখেছি।’
পুষ্পিতার কোমর চেপে আরো একটু সান্নিধ্যে নিয়ে এলো।যেটুকু দূরত্ব ছিলো সেটুকুও কমে গেলো মুহূর্তে। পুষ্পিতার অধর যুগল স্পর্শ করলো আলতো করে। পুষ্পিতার মাথাটা চেপে ধরলো বুকের সাথে। ফিসফিসয়ে বলল,
‘ দুজনের মাঝে অতঃপর ভালোবাসার সন্ধিটা হয়েই গেলো?’
__________________সমাপ্ত____________________
অবশেষে অতঃপর সন্ধির ইতি ঘটলো। অনেকে বলেছেন মায়ানকে গল্প আনার প্রয়োজন ছিলো না। আবার অনেকে বলেছেন মায়ানে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট তেমন জোড়ালো নয়। মায়ানের দ্বারা এটাই বুঝাতে চেয়েছি, দারিদ্রতার কাছে অনেক সময় ভালোবাসা হেরে যায়। কখনো মা বাবা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ভালোবাসার পথে। সব ছেলে মেয়ে কি মা বাবার অবাধ্য হয়? হয় না তো। যারা এই খাপছাড়া গল্পটা পড়েছেন শেষ পর্বে একটু মন্তব্য করবেন। আশায় থাকবো আপনাদের মন্তব্যের।