#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৬|
ঝিরঝিরে বৃষ্টি শেষ হয়েছে প্রায় অনেকক্ষণ। আকাশে মেঘের দলা ছিন্নভিন্ন করে উঁকি দিয়েছে কমলা রঙের সূর্য। সোনারঙা রোদে গা মাখামাখি। ভেজা মাটির গন্ধ আচ্ছন্ন চারপাশ। মাহতিম প্রিয়ন্তিকে ক্যাম্পাসের একটি নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এল। প্রিয়ন্তি গায়ের চাদর শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ যা বলার দ্রুত বলো। দু মিনিট সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ‘
মাহতিম ভ্রূ কুঁচকে এখনো চেয়ে আছে প্রিয়ন্তির গালের আঁচড়ের দিকে। মস্তিষ্কের মধ্যে ভোঁতা রাগ মাথাচাড়া দিতে চাইছে। তবে এই রাগকে এই মুহূর্তে প্রশ্রয় দিতে চাইছে না মাহতিম। প্রিয়ন্তির অবস্থা আগে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রিয়ন্তি ঠিক নেই! বড় কিছু অঘটন ঘটেছে তার সঙ্গে, মাহতিম বুঝে সেটা। তাই সে বড্ড নাছোড়বান্দার ন্যায় বলল,
‘ গাল ছাড়া আর কোথাও আঘাত পেয়েছ? ‘
প্রিয়ন্তির ইচ্ছে করল, দু চার কটু কথা শুনিয়ে দিতে মাহতিমকে। কিন্তু মাহতিমের অসহায়-টলমলে চোখে চোখ রেখে বলার সাহস রইল না। প্রিয়ন্তি জানে মাহতিমের একমাত্র দুর্বলতা প্রিয়ন্তি নিজে। প্রিয়ন্তির গায়ে একটা ফুলের টোকা সে সহ্য করতে পারে না। দুনিয়া এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলে। তাই আজকে এইসব কথা বলাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। প্রিয়ন্তি গলার কাছে চাঁদর তুলে সহসা তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে। জরুরি কথা বলা শেষ? আমার যেতে হবে। ‘
মাহতিম প্রিয়ন্তির কথা শুনে চোখ উল্টে মাথার চুল খামচে ধরল। দুবার এদিক ওদিক পায়চারি করে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। মাহতিম এগিয়ে আসল দ্রুতপদে। প্রিয়ন্তির দুবাহু নিজের পুরু হাতে খামচে ধরে বলল,
‘ একটা কুকুরের সঙ্গেও বোধহয় কেউ এমন ব্যবহার করে না, যতটা খারাপ ব্যবহার তুমি আমার সঙ্গে করো! কি দোষ আমার? অপরাধটা কি? তোমাকে ভালোবাসি বলে সহ্য করতে পারো না? বিশ্বাস করো আমি হেল্পলেস। আমি ছাড়তে পারব না কখনো। না তোমার হাজার কটু কথা শুনে নিজের পাগলামি ছাড়তে পারব। আমাকে রাগিও না, প্রিয়ন্তিকা। সুন্দর করে বলো, তোমাকে কে আঘাত করেছে? আর কোথায় আঘাত পেয়েছ? জাস্ট টেল মি। ‘
প্রিয়ন্তির মন এতেও গলে না এটুকু। পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী এ নারী চোখে চোখ রেখে বলে,
‘ তোমার ভালোবাসা আমার গলায় কাটার ন্যায় আটকে আছে। আমি না পারছি গিলতে আর না পারছি উগলাতে। কেন পরে আছো এখনো? খারাপ ব্যবহার করছি তো ছেড়ে যেতে পারছ না? অতিষ্ট হয়ে গেছি আমি তোমার পাগলামির ধকল সহ্য করতে করতে। ‘
মাহতিম রেগে হাতের বাধন শক্ত করল। প্রিয়ন্তি হাতের ব্যথায় কুচকে ফেলল মুখ। মৃদু স্বরে বলল,
‘ তুমি ব্যথা দিচ্ছ আমায়, মাহতিম। ‘
সঙ্গেসঙ্গে মাহতিম ছেড়ে দিল প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তির চাদরের উপর ওর হাতে নিজের হাত পরপর ঘষে বলল,
‘ ইশ! বেশি ব্যাথা পেয়েছ? সরি, সরি। মাফ করে দাও। আর করব না এমন। সরি, সরি। ‘
প্রিয়ন্তি ভীষন অবাক হল। কে বলবে একটু আগে প্রিয়ন্তি নিজের খারাপ কথার ত”লোয়ার দ্বারা এই ছেলেটার বুকের ভেতর ক্ষতবিক্ষত করেছে। যখন মাহতিম টলমলে চোখে অসহায় হয়ে চেয়ে চিল প্রিয়ন্তির মুখের দিকে, প্রিয়ন্তি সে চোখের ভাষা পড়ে নি, পড়তে চায়নি। কেন চায়নি? জানে না। ভালোবাসা জোড় করে হয় না। দু পক্ষের ইচ্ছেতে হয়। মাহতিম একা ভালোবেসে যাচ্ছে প্রিয়ন্তিকে। একবিন্দু আশা রাখেনি যে প্রিয়ন্তিও তাকে ভালোবাসুক। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে। কিন্তু এত ভালোবাসা পাওয়া সত্ত্বেও প্রিয়ন্তির মনে মাহতিমের জন্যে কোনো অনুভূতি নেই। প্রিয়ন্তী চাইলেও অনুভূতি তৈরি করতে পারছে না। এ কথা মাহতিমকে অনেকবার বুঝিয়েছে প্রিয়ন্তি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দার ন্যায় প্রিয়ন্তির পিছনে পরে আছে। একের পর এক পাগলামি করছে। প্রিয়ন্তি এসব আর কত সহ্য করবে? পাগলকেও বুঝিয়ে বললে বুঝে। অথচ মাহতিম? একদম বুঝতে চায় না। যা মন চায় তাই করছে। এতে আজকের মত প্রিয়ন্তি অনেকবার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে অথচ মাহতিমকে এসব কে বুঝাবে? বুঝতে চায় আদৌ? না!
‘ গলার চাদর একটু সরাবে, প্রিয়ন্তিকা? ‘
প্রিয়ন্তি চমকে উঠল। গলার কাছে চাদর চেপে ধরে বলল,
‘ না, একদম না। ‘
মাহতিম আবার বলল,
‘ প্লিজ। জাস্ট ব্যথা পেয়েছ কি না দেখব। ‘
মাহতিমের ব্যাকুল করা অনুরোধ ফেলতে পারল না প্রিয়ন্তি। সে গলা থেকে চাদর হালকা সরাল। মাহতিম লক্ষ্য করল। গলার মধ্যখান থেকে এক লম্বা আঁচড় বুকের দিকে চলে গেছে। পুরো আঁচড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে না। চাদর দিকে ঢাকা। মাহতিমের রাগে তরতর করে কেপে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুজে বলল,
‘ চাদর ঠিক করে নাও। ‘
প্রিয়ন্তি চাদর ঠিক করল। ব্যাগ চেপে বলল,
‘ আমি যাচ্ছি। দু মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ‘
‘ না, যাবে না। ‘
মাহতিম চোখ খুলে দ্রুত বলল। প্রিয়ন্তির ভ্রু কুঁচকে এল। মাহতিম প্রিয়ন্তির হাত ধরে আলগোছে তাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিল। আঙ্গুল তুলে পাঁচমিনিট দেখিয়ে বলল,
‘ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। আমি যাব আর আসব। প্লিজ। ‘
প্রিয়ন্তি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ অসম্ভব। আর এক মিনিটও বসব না আমি। ‘
মাহতিম কাতর কন্ঠে বলল,
‘ জাস্ট পাঁচ মিনিট চাইছি। বিয়ে করতে তো বলছি না। অপেক্ষা করলে কি ক্ষতি হয়ে যাবে? ‘
প্রিয়ন্তি চোখ রাঙানি দিল। বলল,
‘ পাঁচ মিনিটের বেশি লেইট হলে আমি তোমার আসার অপেক্ষা না করে সোজা চলে যাব। ‘
‘ ঠিকাছে। চলে যেও। কিন্তু আপাতত অপেক্ষা করো। ‘
মাহতিম দৌঁড়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল দু মিনিটের মধ্যে। হাতে একটি প্যাকেট। মাহতিম এসে প্রিয়ন্তির পাশে বসল। প্যাকেট ছিঁড়ে একটা মলম আর ব্যথার ট্যাবলেট বের করে পাশে রাখল। মলম এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আঁচড়ের জায়গায় মলম লাগিয়ে নাও। জ্বালাপোড়া কমে যাবে। ”
প্রিয়ন্তি মলম নিল না। বলল,
‘ দরকার নেই, আমি কিনে নেব একটা। ‘
‘ কিনে নিল আমার কেনাটা নষ্ট হবে। খামোকা টাকা নষ্ট করবে কেন? এটা নিয়ে নাও। ‘
প্রিয়ন্তি মলম নিতে চাইল না। উঠে যেতে চাইল বেঞ্চ থেকে। বেপরোয়া মাহতিম তা হতে দিল না। পেছন থেকে মলম আর ব্যথার ঔষধ প্রিয়ন্তির ব্যাগে পুড়ে চেইন লাগিয়ে নিল। প্রিয়ন্তির রেগে গেল। ব্যাগ খুলে সেসব বের করতে চাইলে মাহতিম হাত আটকে নেয় তার। বলে,
‘ আমার দেওয়া জিনিস ফেরত দিলে এক্ষুনি তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলব। রাতে তোমার বাসার নিচে যেয়ে পাথর ছুঁড়ে ফেলব, ক্লাস করতে দেব না, বিরক্ত করব। ভেবে দেখো। ‘
প্রিয়ন্তি রেগেমেগে উঠল। বিড়বিড় করে মাহতিমকে গালাগালি করে হনহন করে চলে গেল। মাহতিম হেসে ফেলল। শব্দহীন, সুন্দর হাসি।
#চলবে
/