#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৬
ভেজা চুল শুঁকিয়ে মাথার ওপর ঝুঁটি করল হৈমী। গায়ে ওড়না জড়িয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। উল্টো হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। কোমর অবধি কম্বলে ঢাকা। ধবধবে ফর্সা, পেশিবহুল পিঠ দৃশ্যমান। সাদা চামড়ায় থেকে থেকে লালচে দাগগুলো আচমকা খেয়াল হলো। লজ্জায় বুকটা ধক করে ওঠল নিমিষেই। গালদ্বয়ে রক্তিম আভা ভেসে ওঠল। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এসে কম্বল টেনে পিঠ ঢেকে দিল সে। ঢোক গিলে নিজের দু-হাত সম্মুখে রাখল। নখ গুলোতো ঠিকি আছে। কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো। পরোক্ষণেই মনে পড়ল গতকাল নখ কেটেছে সে। ফলশ্রুতিতে নখগুলো ধারালো ছিল! ইস ভীষণ মায়া হলো তার। নিজেকে অপরাধী লাগল খুব। কিন্তু তারই বা কী করার ছিল? মুখটা ছোটো হয়ে গেল খুব। মাথা নিচু করে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সময় গড়িয়েছে অনেক৷ সকাল দশটা ছুঁই ছুঁই। সূচনা এসে দু’বার ডেকে গেছে। তাদের ঘুম ছাড়তে দেরি হওয়াতে দরজা খুলতে পারেনি। লজ্জা দ্বিধা নিয়ে চটজলদি নিচে নামল সে। ছোটো কাকি টিভি দেখছিলেন৷ তাকে দেখে সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” ঘুম ভাঙল? বাব্বাহ নতুন বউ কোথায় সাতসকালে ওঠবে তা না। বেলা দশটায় ঘুম থেকে ওঠছ! তাও যদি রুদ্রটা সুস্থ থাকত। তাকে তো ঠিক সময় খাবার ওষুধ দিতে হবে। তুমি তো দেখি ভালো মন্দ কিছুই বোঝো না। ”
আমতা আমতা করতে লাগল হৈমী। ঠিক কী উত্তর দেবে খুঁজে পেল না। আশপাশে নজর ঘোরাতে লাগল। সূচনাকে খুঁজতে। কিন্তু নাহ সে নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ছোটো কাকিকে বলে গেল,
-” গত দু’দিন ঠিকভাবে ঘুম হয়নি তো তাই আজ ঘুম ছাড়ছিল না৷ কাল থেকে তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করব। ”
ছোটো চাচি রিনা মুখ ভেঙচি দিয়ে টিভির সাউন্ড বাড়াল। হৈমী রুদ্রর জন্য খাবার বাড়ল। কিন্তু সেগুলো একা কীভাবে নিয়ে যাবে? তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ বাড়ির কাজের মহিলাটা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। নতুন কাজের লোক এখন পর্যন্ত আনা হয়নি। চিন্তান্বিত হয়ে ডাইনিং থেকে বেরিয়ে ছোটো কাকিকে জিজ্ঞেস করল,
-” কাকি ভাবি কোথায়? ”
-” কেন? ”
বিব্রতবোধ করল হৈমী। কিছু না বলে পুনরায় চলে গেল ডাইনিংয়ে। সিদ্ধান্ত নিল একবারে না পারুক দু বার বা তিন বারে নিয়ে যাবে। এক হাতে ভাতের প্লেট অন্য হাতে জগ নিয়ে বের হতেই ছোটো কাকি ক্রোধের স্বরে বলল,
-” তুমি তো খুব বেয়াদব মেয়ে! বড়োরা প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় জানো না? ”
হতভম্ব হয়ে গেল হৈমী। ভিতর ঘর থেকে দাদিন বেরিয়ে এলো। চোখমুখ কুঁচকে বড়ো গলায় বলল,
-” ছোটো বউ আস্তে কথা বলো। তোমার তো দেখি ষাঁড়ের গলা এখনো কমল না। ”
শাশুড়ির কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল রিনা৷ চোখ কটমট করে বলল,
-” কী বললেন আমার ষাঁড়ের গলা! ভাতিজা বউয়ের সামনে এভাবে অপমান করলেন। আমি এক্ষুনি আপনার ছেলেকে ফোন করছি। ”
বলতে বলতে নিজে ঘরে চলে গেল রিনা। হৈমী দাদিনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। দাদিন বলল,
-” শোন ওর কথা ধরবি না। ওর স্বভাব একটু খারাপ আছে। আমার ছেলেটা কোন পাপে এমন খাস ঝগরাটে বউ পাইছে উপরওয়ালা জানে। ভাসুরের ছেলের বউয়ের সাথেই কাল থেকে যা শুরু করছে। নিজের দুই ছেলের বউয়ের সাথে যে এই মেয়ে কী করবে ভাবতেই আমার প্রেশার বাড়ছে। ”
আচমকা ঠোঁট টিপে হাসল হৈমী। বলল,
-” আমি রাগ করিনি দাদিন। আমি একটু চিন্তায় আছি তোমার নাতিকে নিয়ে। কাকির কথা ধরতে হলে তাকে নিয়ে ভাবতে হবে৷ কিন্তু আমার তো এখন তাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। ”
মাথা দুলিয়ে হাসল দাদিন। বলল,
-” বাহ। খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে কথা বললি তো। ”
হৈমী কিছুটা ঝুঁকে এলো দাদিনের দিকে। চুপিচুপি বলল,
-” আমার মাথায় যে বুদ্ধি আছে এই কথা কি তুমিও বিশ্বাস করো না? ”
শব্দ করে হেসে ওঠল দাদিন। হৈমীর চিবুক ছুঁয়ে বলল,
-” আমার দাদু ভাইয়ের চোখে কি যে সে সোনা ধরা দিছে নাকি? আমি জানি তুই খাঁটি সোনা। ”
প্রশংসা পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে গেল হৈমী। বলল,
-” আচ্ছা যাই আমি উনাকে আবার ওষুধ দিতে হবে।”
______________
সোহান, রোশানের সঙ্গে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় রেকেট খেলছিল সূচনা। হঠাৎ শাশুড়ির ফোন পেয়ে খেলা থেকে বিরতি নিল। হামিদা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে বলল,
-” আমাদের পাশের বাড়িতে এক ভাবি আছে। উনার মেয়ের গতমাসে ছেলে হয়েছে। শুনেছি বাচ্চা ধরছিল না। অনেক চিকিৎসা করার পর অবশেষে ধরেছে। শেষ যে ডাক্তার দেখিয়েছে সেই ডাক্তারের ঠিকানা নিয়েছি। মাহেরের কাছে দিয়ে দিব। তুমি নিয়ে একদিন যেও ডাক্তারের কাছে। ”
হামিদা থেকে এমন কথা শুনে আশ্চর্য হলো সূচনা। তীব্র রাগে শরীর কাঁপতে শুরু করল। এ মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে হামিদা খুব নিচু মনের একজন মানুষ। পরোক্ষণেই সে মাহেরের মা এটুকু মনে করে শান্ত হলো। ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-” আমার তো কোনো সমস্যা নেই মা। আমার বিয়ের বয়সও বেশি নয়। তাহলে কেন এসব করব। ”
-” সমস্যা না থাকলে দুই দুই বার ফলাফল শূন্য হতো? আমি যা বলছি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। ডাক্তার দেখাও। ”
সূচনা নিজেকে সংযত করে কোনোরকমে বলল,
-” আচ্ছা। ”
-” মনে করে যেও আগামী কয়েক মাসে যেন সুখবর পাই আমি। আর হৈমীকে ফোন করলাম ধরল না। ওকে বলো আমাকে ফোন দিতে। ”
ফোন কেটে দিয়ে রুদ্ধ শ্বাস ছাড়ল সূচনা। ভাইদের বলে চলে এলো বাড়ির ভিতরে৷ নিজের রুমে গিয়ে ফোনটা ছুঁড়ে মারল বিছানায়। ঘর্মাক্ত কপাল দু’হাতে মুছে ধীরস্থিরে বসল বিছানার একপাশে। এরপর ফোন নিয়ে কল করল মাহেরকে। ফোন রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল,
-” আপনি কোথায় মাহের? ”
-” কলেজে কেন এনি প্রবলেম? ”
-” একটু আসতে পারবেন? ”
-” কী হয়েছে কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? ”
-” ডাক্তার দেখাতে যাব। আসার সময় মায়ের থেকে ডাক্তারের ঠিকানা নিয়ে আসবেন। ”
-” মানে! কীসের ডক্টর কী হয়েছে শরীর খারাপ লাগছে? ”
-” মায়ের থেকে শুনে নেবেন। রাখছি। ”
ফোন কেটে দিল সূচনা। কিছু সময় পর মন শান্ত হলো তার। সহসা মনে হলো মাহেরকে এভাবে ফোন করে সে ঠিক করেনি। কিন্তু কী করবে সে? আচমকা নিজেকে পাগল পাগল লাগল তার। বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়নি তার আগেই তাকে বাচ্চা কেন হচ্ছে না? নিজের কোনো সমস্যা আছে কিনা সেজন্য ডক্টর দেখাতে হবে! এটাকে কী হিসেবে নেবে? অপমান নাকি তার ব্যর্থতা।
______________
রুদ্রকে নিজহাতে খাইয়ে দিল হৈমী। রুদ্র পুরো সময়টাই নির্নিমেষে হৈমীর দিকে তাকিয়ে ছিল। হৈমীর মন কিঞ্চিৎ খারাপ কারণ রুদ্রর মনের ভেতর কী চলছে? সে ঠিক কি নিয়ে চিন্তিত? এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি সে। রুদ্র তাকে হয়তো বলবে এমন আভাস পাচ্ছে। কিন্তু কখন বলবে? সে যে আর ধৈর্য্য ধরতে পারছে না। সে কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে। অথচ রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে শুধু মিটিমিটি হাসছে।
গতরাতের কথা স্মরণ করে মনে মনে হাসছে রুদ্র। প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে হৈমী আবারো জব্দ করেছে তাকে। বাধ্য হয়ে বশে এসেছে সেও৷ স্ত্রীকে কথা দিয়েছে সে আর কখনো নেশা করবে না৷ শুধু মাঝেমধ্যে তার অনুমতি নিয়ে দু চারটে সিগারেট খাবে। সে যেমন হৈমীর বশ্যতা স্বীকার করেছে। হৈমীও তার বশ্যতা মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভুল তো হয়ে গেল! হৈমী বা সে কোনো প্রকার সুরক্ষা ছাড়াই ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সহসা বিছানা ছাড়ল রুদ্র। হৈমী ততক্ষণে নিচে চলে গেছে। সকালের খাবার খায়নি মেয়েটা৷ এখন নিশ্চয়ই খাবার খাবে? আর কিছু না ভেবে ধীরেধীরে পোশাক পরিবর্তন করল সে। অসুস্থতার জন্য বা হাতে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তবুও সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আগে হৈমীর খোঁজ করল। ডাইনিং রুমে তখন হৈমী সবে খেতে বসেছে। ছোটো চাচি রোশানের জন্য পাস্তা বানাচ্ছে। রান্না ঘর আর ডাইনিং পাশাপাশি। কোনো দেয়াল নেই এই দু ঘরের মধ্যিখানে। রান্নার পাশাপাশি মুখটা ভালোই চলছে রিনার।
-” কাল থেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠবে বুঝেছ? বাড়ির বউরা এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার বিষয়টা খুব খারাপ। ”
হৈমী মাথা নাড়িয়ে খেতে মনোযোগ দিল। এই ছোটো চাচিকে মোটেই পছন্দ হচ্ছে না তার৷ রুদ্র অসুস্থ, তাদের সম্পর্কটাও অনেকটা নড়বড়ে। রুদ্রর অসুস্থতায় একটা জিনিস সে খুব ভালো করে অনুভব করেছে। তা হলো সে রুদ্রকে খুব ভালোবাসে। দু’টো দিন তার বুকের ভিতর কী চলেছে একমাত্র সেই জানে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সেই করুণ মুখ মনে পড়েছে বারবার। মস্তিষ্কে চাপ এসেছে খুব। মনে সব সময় একটি কথাই ঘুরপাক খেয়েছে। তার বাবা চলে যাবার পর মা তাকে আর ভাইকে আঁকড়ে বেঁচেছে। কিন্তু রুদ্রর কিছু হলে সে কী আঁকড়ে বাঁচবে? তার ছোট্ট হৃদয়ে তো শুধু ঐ মানুষটারই বিচরণ। তার শরীর, মন জুড়ে রুদ্র ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সে খুব আবেগি মেয়ে। ভালোবাসার মানুষ ছাড়া বেঁচে থাকা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যার অসুস্থতাতেই তার বুকে খুব ব্যথা হয়েছে। তাকে হারানোর যন্ত্রণা কতখানি ভয়ানক হতে পারে! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে হৈমীর। কথায় বলে মানুষ ঠেকে শেখে। রুদ্রর হঠাৎ অসুস্থতাও তাকে গড়ে পিঠে নিল। আজ এ বাড়িতে যে যা খুশি বলুক কিচ্ছু গায়ে লাগছে না। তার কেবল রুদ্রকেই চাই৷ সে রুদ্রর সঙ্গে থাকতে পারছে, রুদ্রকে ভালোবাসতে পারছে, রুদ্রর ভালোবাসা দেহে, মনে জড়াচ্ছে এতসুখে ছোটো চাচির কিছু তিক্ত কথা গায়ে মাখানোর মতো ভুল সে কেন করবে? এই ভুল সে করব না। উনি যা খুশি বলুক। এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কানে বের করে দেবে।
রিনা একা একাই বকবক করে গেল। হৈমী কিছু বলছে না বলে বিরক্তও হলো। মেয়েটা কি এতই ছোটো, অবুঝ যে তার কথায় একটুও কষ্ট পাচ্ছে না? কষ্ট না পাক চাচি শাশুড়ির ওপর রাগ তো করতেই পারে। রিনা আচমকা কেশে ওঠল। বলল,
-” হৈমী এক গ্লাস পানি দাও তো। ”
রিনা কাশছে! এই দেখে ত্বরিত গ্লাসে পানি ভরে নিয়ে এলো হৈমী। কিন্তু রিনা তার থেকে গ্লাস না নিয়ে সহসা গর্জন ছাড়ল,
-” এই তোমার শিক্ষা। আমি তোমার চেয়ে বয়সে কত বড়ো জানো? বাম হাতে পানি দিচ্ছ ছিঃ ছিঃ। কী ধরনের বেয়াদব তুমি। তোমার মা কি তোমাকে কিছু শিখিয়ে শশুর বাড়ি পাঠায়নি? ওওও শিখিয়ে পাঠাবে কীভাবে তার আগেই তো ভেগেছ! ইঁচড়েপাকা মেয়ে কোথাকার! ”
হৈমীর হাতটা কেঁপে ওঠল। দু-চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রুও গড়াল। ডাইনিং রুমের দরজার বাইরে শক্ত মুখে দাঁড়ানো রুদ্র। আচমকা সে ডাকল,
-” হৈমী। ”
চমকে ওঠল হৈমী৷ চমকাল রিনাও। চপল পায়ে রুদ্রর সামনে এসে দুঃখী মুখে বলল,
-” ও বাবা তুমি ওঠে এলে কেন? কিছু লাগবে আমি পাঠাচ্ছি কী লাগবে বলো? ”
ভ্রু কুঁচকে ছোটো কাকির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রুদ্র। কয়েক পল পর গম্ভীর হয়ে, হৈমীকে ইশারায় দেখিয়ে বলল,
-” ওকে কী যেন বলছিলেন? ”
-” আর বলো না এই হৈমী কিছুই বুঝে না। জানো কী করেছে? বা হাতে পানি খেতে দিয়েছে আমাকে। বুঝো কী বেয়াদবি কাণ্ড! এমন কেউ করে। আজ যদি আমার জায়গায় বাইরের কেউ থাকত কী অপমানটাই হতো বলো। তাই একটু শাসন করলাম।”
ভ্রু উঁচিয়ে রুদ্র বলল,
-” ওও আচ্ছা। ”
এরপর হৈমীকে শক্ত কণ্ঠে ডাকল,
-” হৈমী। ”
কেঁপে ওঠল হৈমী। রিনা ভীষণ খুশি হলো। রুদ্র যেই ছেলে নিশ্চিত এই বেয়াদবির জন্য হৈমীকে বকবে। তার কাছে সরিও বলতে বলবে। মনে মনে এসব কল্পনা করতে করতে হৈমী এসে তার পাশে দাঁড়াল। আর রুদ্রর সামনে। হৈমীর টলমল চোখ দুটোতে কঠিন চোখে দেখে নিল রুদ্র। এরপর চোখ নামাল হৈমীর হাতের দিকে। ডান হাত এঁটো, বা’হাতে পানির গ্লাস। এ দৃশ্য দেখে তার চোয়ালদ্বয় শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করল,
-” আর কখনো এঁটো হাতে কাউকে কিছু দেবে? ”
আচমকা হৈমীর চোখ বেয়ে আরো দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। রুদ্রর রাগ আরো তীব্র হলো। সে পুনরায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” যাও খেতে বসো। ”
কিছু বলতে উদ্যত হয়েও চুপ করে গেল হৈমী। আজ দু’দিন হলো সে প্রাণখুলে কথা বলে না। বলতে পারে না। এখনো বলতে ইচ্ছে করল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেল খেতে। রুদ্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। রিনার হাসিহাসি মুখে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিঞ্চিৎ দমে গেল রিনা। বলল,
-” আমি যাই পাস্তা বানাচ্ছি রোশানের জন্য। ”
রুদ্র সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে কিছু মনে করার ভঙ্গি করল। তর্জনী দিয়ে কপাল চুলকে বলল,
-” কী যেন বলছিলেন? আমার বউ বেয়াদব। ইঁচড়েপাকা। ”
হকচকিয়ে গেল রিনা৷ চমকে তাকাল হৈমী। রুদ্র বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
-” আমার বউ সত্যি ইঁচড়েপাকা। ঠিক এজন্যই আপনার অসুবিধার কথা ভেবে সে নিজের আধখাওয়া খাবার রেখে, এঁটো হাতেই আপনাকে পানি দিয়ে উপকার করতে চেয়েছে। সে যদি ইঁচড়েপাকা না হতো তাহলে এটা না করে নিজে পেটপুরে খেতে ব্যস্ত থাকত। কারণ সামান্য কাশিতে মানুষ নিজেই পানি ভরে খেতে পারে। এটা আহামরি সমস্যা না। ”
দমে গেল রিনা৷ হৈমীর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনাপানির ধারা। রুদ্র এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। তাই আরো কঠিন হয়ে রিনাকে বলল,
-” আমার বউ যদি বেয়াদব হতো ছোটো কাকি, তাহলে আপনি ক্ষানিক পূর্বে যেসব কথা বললেন। তার যোগ্য জবাব দিত। কারণ সে কারো সঙ্গে ভেগে যায়নি। আমি তাকে বাধ্য করেছি আমার বউ হতে। ”
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রিনা৷ ঢোক গিলল ঘনঘন। মনে মনে তীব্র বিদ্বেষে ফেটে পড়ল সে। রুদ্র খোঁচা দিয়ে আবারো বলল,
-” ভাগ্যিস দাদিনের মতো কপাল আপনাদের হয়নি। তার ছোটো ছেলের বউয়ের মতো আমার বউটা বেয়াদব হলে আপনাদের কপাল পুড়তো। ”
চোখ দু’টো বড়ো করে ফেলল রিনা। চাপা আর্তনাদে বলল,
-” রুদ্র! ”
বাঁকা হেসে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হৈমীর দিকে তাকাল রুদ্র। বলল,
-” দশমিনিট এর জন্য বেরুচ্ছি। ”
রুদ্র চলে যেতে উদ্যত হলো। দু পা বাড়িয়েও পিছন ফিরে তাকাল। হৈমীর উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-” প্রয়োজনেই যাচ্ছি। ” #বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৭
আচ্ছন্ন মনে রুমে বসে হৈমী। দু-চোখ জুড়ে ভাসছে রুদ্রর মুখাবয়ব। একটা মানুষের কত রূপ হয়? মস্তিষ্ক জুড়ে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এই নিয়ে রুদ্রর ক’টা রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটল তার? হিসেব কষতে ইচ্ছে করল না। শুধু হৃদয় জুড়ে দুলুনি অনুভব করল। এ মুহুর্তে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী স্ত্রী। শশুর বাড়ির ঝুটঝামেলা সম্পর্কে আগে শুনেছে। চোখের সামনে এ প্রথম দেখল। পাশাপাশি নিজের স্বামী নামক মানুষটার আরো একটি রূপের পরিচয়ও পেল। রুদ্র তার সঙ্গে যাই করুক না কেন। সেসব তার হৃদয়ে কতটুকু নেড়েছে জানে না। তবে আজকের ঘটনাটি তার সমস্ত হৃদয় নাড়িয়ে এক রুদ্রর বশীভূত হয়ে গেল। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মেয়েই বোধহয় চায়, তার জীবনসঙ্গী এভাবেই পাশে থাকুক। পারিবারিক যাবতীয় সমস্যায় পাশে থেকে এভাবেই মোকাবিলা করুক। শশুর বাড়িতে একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে বড়ো সাপোর্ট আর কিছুই হতে পারে না। হৈমীকে আচ্ছন্ন রূপে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল রুদ্র। মৃদু কেশে এগিয়ে এসে বলল,
-” কী ব্যাপার কোথায় ভাসছ? এই নাও এখান থেকে একটা খেয়ে নাও দ্রুত। ”
চমকে ওঠল হৈমী। পিটপিট করে তাকাল রুদ্রর গম্ভীর মুখটায়। রুদ্র ইশারায় তার হাতের দিকে তাকাতে বলল। সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল হৈমী। বিতৃষ্ণা জাগল খুব। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। রুদ্র নিঃশব্দে তার পাশে বসল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” শরীরটা ভালো লাগছে না। এটা খেয়ে এসে আমার পাশে কিছুক্ষণ বসো। ”
নড়েচড়ে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। রুদ্রর শরীর খারাপ লাগছে? আর কিছু ভাবতে পারল না। বিচলিত ভঙ্গিতে একটি কন্ট্রাসেপটিভ পিল নিয়ে ছুটে গেল নিচে। রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল হৈমী ফিরে আসার।
চঞ্চলিত পায়ে, প্রায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ডাইনিং রুমে যাচ্ছিল হৈমী। আচমকা ছোটো কাকির কাঁধের সঙ্গে ধাক্কা খেলে ছোট্ট দেহটা টনটন করে ওঠল। দু-চোখ উপচে বেরিয়ে এলো নোনাপানির ধারা। ছোটো চাচিও আচমকা ধাক্কা খাওয়াতে কাঁধে বেশ ব্যথা পেল। চ্যাঁচিয়ে ওঠল হিংস্র ভাবে। বলল,
-” এই মেয়ে এই চোখের মাথা খেয়েছ নাকি। ও মা গো আমার কাঁধটা বুঝি আর নেই। সর্বনাশা মেয়ে আমার কী সর্বনাশটাই করল। ”
বুকের বা পাশে হাত রেখে কাঁপতে লাগল হৈমী। কী ভয়াবহ আঘাত পেয়েছে শুধু মাত্র সেই জানে। উচ্চ শব্দে না কেঁদে শুধু ফুঁপাতে লাগল। ছোটো কাকি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে কিছুক্ষণ বকাবকি করে চলে গেল। হৈমীর মাথাটা ভনভন করছে। হঠাৎ খেয়াল করল তার হাতে থাকা ট্যাবলেটটা নেই! কোথায় পড়ল? আশপাশে উদ্ভ্রান্তের মতো খোঁজাখুঁজি করল কিছুক্ষণ। পেল না! বাম পাশের কাঁধ থেকে বুক পর্যন্ত ব্যথায় অসহ্য হয়ে ফিরে গেল রুমে। রুদ্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই হৈমী তার পাশে গিয়ে বসল। ডুকরে ওঠল আচমকা। রুদ্র হতভম্ব হয়ে পলক ফেলল। কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” কী হয়েছে? কাঁদছ কেন, কী হলো? ”
ঠোঁট উল্টে হৈমী ঘটনাটা বলল। রুদ্র সহসা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তোমাকে কতবার বলেছি ধীরেসুস্থে হাঁটবে। ধীরেসুস্থে কথা বলবে। ”
রুদ্রর এমন কথায় হৈমীর কান্নার বেগ বাড়ল। রুদ্র খেয়াল করল হৈমীর শরীর মৃদু কাঁপছে। একটি হাত বুকের বা পাশে নরম স্থান চেপে ধরেছে। শ্বাস রোধ হয়ে এলো রুদ্রর। ঢোক গিলে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” বেশি ব্যথা পেয়েছ? ”
হৈমী ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
-” মনে হচ্ছে লোহার সাথে বাড়ি খেয়েছি। হাতটাও নাড়াতে পারছি না। ”
ধীরেধীরে এগিয়ে এলো রুদ্র। থমথমে মুখে হাত বাড়িয়ে হৈমীর বা হাতটা ধরল। উপর নিচ হাতটা ওঠানামা করতে নিলে মৃদু আর্তনাদ করল হৈমী। রুদ্র সেসবে পাত্তা না দিয়ে বেশ কয়েকবার জোর পূর্ব হাতটা নাড়াচাড়া করল। বলল,
-” ঠিক আছে সেরে যাবে। এরপর যেন এত ছটফট ছটফট না করো। ধীরেসুস্থে হাঁটবে, ধীরেসুস্থে কথা বলবে। দেখবে অঘটন ঘটবে না। ”
হৈমী ক্ষেপে গিয়ে বলল,
-” আমি ঠিক ভাবেই গিয়েছিলাম। ”
-” ওকে ওকে কুল। ”
স্যারেন্ডারের ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হৈমীর দুগালের নোনাপানি মুছে দিল রুদ্র। হৈমী কিঞ্চিৎ শান্ত হলো। থমথমে সুরে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার কেমন লাগছে? ”
ভ্রু কুঁচকাল রুদ্র। বারকয়েক চোখের পলক ফেলে আচমকা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে মুখে ডান হাতটা হালকা চেপে ধরে বলল,
-” কেমন আর লাগবে দমফাটা হাসি আঁটকে ছিলাম। ছোটো কাকি আর তুমি মিলে যে কাণ্ডটা ঘটিয়েছ এরপর আমার আর কেমন লাগবে। ”
রুদ্রর আচমকা হাসি দেখে হৈমীর ব্যথাহত মনে আরো দ্বিগুণ ব্যথা লাগল। চোখ কটমট করে, রাগে ফুঁসতে লাগল সে। রুদ্র হাসি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে বলল,
– ” আমার বউয়ের যেমন শুঁকনো পথে আছাড় খাওয়ার অভ্যেস। ছোটো কাকার বউয়ের তেমন সোজা পথে হাঁটতে গেলে ঝগরা করার অভ্যেস। দু’জন ভিন্ন প্রজাতির পাগল একসাথে হলে এমন ঘটনা তো ঘটবেই! ”
চোখ বড়ো বড়ো করে মুখ হা করে ফেলল হৈমী। তার রক্ত লাল মুখটা যেন কাঁপছে। তিরতিরিয়ে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়ায় নজর পড়তেই রুদ্র কেশে ওঠল। আলগোছে বিছানা থেকে ওঠে গিয়ে দরজা আঁটকে দিল সে। নিঃশব্দে পুনরায় বিছানায় এসে হৈমীকে কাছে টেনে নিল। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” রাগছ বেশ ঠোঁট কাঁপাচ্ছ কেন ? ”
হৈমী নড়েচড়ে সরে যেতে চাইল। কিন্তু রুদ্রর বাঁধন থেকে সরে যাওয়া কি এতই সহজ? একদমই নয়। বেচারি সরতে পারল না বরং জব্দ হলো বলিষ্ঠ দেহের নিবিড় আলিঙ্গনে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়া সিক্ত হলো স্থূল ঠোঁটের উত্তাপে। দীর্ঘসময় নরম ঠোঁটে প্রণয় বর্ষণে ভিজল রুদ্র। বক্ষতলে ছটফটানো দেহের ভাঁজে শরীর ছেড়ে শান্তির শ্বাস নিল সে। ধীরেধীরে দু’হাতে আগলে ধরল হৈমী। টের পেয়ে তৃপ্তি ভরে হাসল রুদ্র। মাথা তুলে লাজুক মুখটা দেখে হাত বাড়িয়ে আদর করল। কপোল ছুঁয়ে উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল,
-” ভাগ্যিস তুমি ছিলে। ”
কাঁপা কাঁপা স্বরে হৈমী বলল,
-” ভাগ্যিস কেন? ”
নিজের বাঁধন থেকে হৈমীকে মুক্ত করে পাশের বালিশে মাথা রাখল রুদ্র। চোখ বুঁজে নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
-” ঐ দিনের পর একমাত্র তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি নিজেকে কিছু করিনি। এতকাল সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচেছি। সব সময় মনে হয়েছে আমার কিছু হলে ওর কী হবে? ওকে কে আগলে রাখবে। আজ ওকে আগলানোর জন্য আমি ছাড়াও সঠিক মানুষ রয়েছে। কিন্তু আমি নির্ভার হতে পারিনি। এই পৃথিবীটা খুবই নিষ্ঠুর। তার নিষ্ঠুরতা সহ্য আমাকে করতেই হবে। শুধু আফসোস রয়ে গেল কিছু মানুষকে শিক্ষা দিতে পারলাম না বলে। ”
অবাক চোখে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” কাকে শিক্ষা দিতে পারলেন না? ”
-” যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছে।
আঁতকে ওঠল হৈমী। ঢোক গিলে বলল,
-” কীভাবে? ”
-” নিজেকে শেষ করে। ”
আতঙ্কিত হয়ে হাত বাড়িয়ে রুদ্রর ঠোঁট চেপে ধরল হৈমী। রুদ্র সে হাতের তলায় সন্তর্পণে চুমু খেল। চোখ বুজে। কয়েক পল পর মুখ সরিয়ে বলল,
-” পারব না তো। এতদিন পারিনি বোনের জন্য। এখন পারব না বউয়ের জন্য। ”
হৈমীর চোখ দু’টো টলমল করছিল। সেই টলমল চোখে নির্নিমেষে তাকিয়ে রুদ্র বলল,
-” সেদিন রাতে হসপিটালে ঐ মহিলার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। বহু বছর পর! ”
ত্বরিত বেগে ওঠে বসল হৈমী। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বিচলিত মুখে তাকাল রুদ্রর দিকে। যেন আরো কিছু শুনতে চায়। আরো অনেক কিছু জানতে আগ্রহী সে। তার আগ্রহ বুঝল রুদ্র। টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজল নিবিড়ভাবে। হৈমী ঘনঘন চোখের পলক ফেলল। রুদ্র অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে নিজের সঙ্গিনীকে বলতে লাগল তার জীবনে সুপ্ত থাকা পীড়াদায়ক কথাগুলো,
– ” এই পৃথিবীতে আমরা সবাই কিছু না কিছু অবলম্বন করে বাঁচি। যার জীবনে অবলম্বন করার মতো কিছু না থাকে সেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়!”
হৈমীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রুদ্র সহসা শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়াল। দৃঢ় ভাবে পা ফেলে এগিয়ে গেল বুকশেলফের সামনে। অগণিত বইয়ের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট একটি বই বের করল সে। সেই বইয়ের ভাঁজে থাকা বহু পুরোনো দিনের একটি ছবি বের করল। থম মেরে দৃষ্টিপাত করল ছবিতে জ্বলজ্বল করা চারটে মুখকে। এরপর সন্তর্পণে বইটা রেখে হৈমীর পাশে এসে বসল। দু’হাতে ছবিটা ধরে পলকহীন তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল,
– ” জানো হৈমী, মানুষের জীবনে কিছু অতীত অভিশাপ হয়। ”
ভরাট কন্ঠস্বরের রুদ্রর সঙ্গে পরিচিত হলেও কাঁপা কণ্ঠের রুদ্রর সঙ্গে পরিচিত ছিল না হৈমী। ফলে রুদ্রর কম্পিত কণ্ঠে বুক কেঁপে ওঠল তার। ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল সে। রুদ্রর দৃষ্টি হাতে থাকা ফ্যামিলি ফটোতে স্থির। শ্বাসরোধ করা কণ্ঠে সে পুনরায় বলল,
-” আমরা কতটা সুখী ছিলাম এই ছবিটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ”
রুদ্রর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার ছবিটার দিকে তাকাল হৈমী। রুদ্রর বাবার সামনে চার, পাঁচ বছর বয়সি একটি ছেলে দাঁড়ানো। তার পাশে দাঁড়ানো হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত সুন্দরী এক নারী। সেই নারীটির কোলে ধবধবে ফর্সা, গুলুমুলু একটি বাচ্চা। পরনে হালকা গোলাপি রঙের ফ্রক। বোঝার বাকি নেই এরা কারা। হৈমীর এত ভাল লাগল যে খপ করে রুদ্রর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। এরপর চোখ ভরে দেখতে লাগল রুদ্রকে। অনেকটা সময় পর চারজনকেই মুগ্ধ চোখে পলকহীন দেখতেই থাকল। তার সে চাহনি দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল রুদ্র বলল,
-” এই সুখী পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেছে হৈমী। ধ্বংস করা হয়েছে শুধু এই পরিবারটাকে নয় আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎকেও। আমার জীবনের জঘন্য অতীত এই মহিলা, আমার জন্মদাত্রী। আর এই অতীতটাই আমার জন্য অভিশাপ। দিনশেষে এই অতীত স্মৃতি আমাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়। আমি সহ্য করতে পারি না, আমার ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে যায়। ”
ছলছল চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্রর করুণ মুখ তার বুকে আঘাত হানল। রুদ্র অসহনীয় স্বরে বলতে লাগল,
-” আমাদের পরিবারে সবকিছুই পরিপূর্ণ ছিল। কোনো কিছুর কমতি ছিল না। কিন্তু এত সুখ বাবার সহ্য হলো না। সে বরাবরই বিজনেস পাগল ছিল। হঠাৎ করেই একদিন আমরা জানতে পারি বিদেশের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাবা। এবার দেশে নয় বিদেশেও বিজনেস করবে তিনি। বাংলাদেশে বড়ো কাকা, ছোটো কাকা সামলাবে। আর সে বিদেশের এক নামকরা কোম্পানিতে যোগ দেবেন। ধীরেধীরে সেখানে স্থায়ী হওয়ারও চেষ্টা করবেন৷ আরো কত কী প্ল্যান। তখন আমি খুব ছোটো৷ শুধু মনে আছে এটা নিয়ে বাবার সঙ্গে এই মহিলার ঝগরা হয়েছিল। বাবা বিদেশে যাক সে চায়নি। কয়েক মাস পর একপ্রকার জোর করেই আমাদের রেখে বাবা চলে গেল। আর এই মহিলা রাগ করে আমাকে আর বোনকে নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। বাবার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধও করে দিল। একমাস পর বড়ো কাকা গেলেন আমাদের আনতে। আমার নানার জোরাজোরিতে উনি এলেন এ বাড়িতে। এরপর সময়গুলো কীভাবে গেছে আমার ঠিকঠাক মনে নেই৷ কিন্তু সাদমান যখন বড়ো কাকির গর্ভে এলো শেষ চারমাস বড়ো কাকি বাবার বাড়ি ছিল। সেই সময়গুলোর অনেক কিছুই মনে আছে, আজো মনে পড়ে। কখনো সকালে ঘুম ভাঙলে, কখনো মাঝরাত্রে। ”
এ পর্যন্ত বলে চোখ খিঁচিয়ে ফেলল রুদ্র। আচমকা তার একটি বাহু চেপে ধরল হৈমী। সেখানে মাথা ঠেকিয়ে বা’হাতে ছবিটা ধরে ঘনঘন শ্বাস ফেলল সে। বলল,
-” পুরোটা শেষ করুন প্লিজ। আমি জানতে চাই। আম্মু বলেছে মনের ভেতর খুব কষ্টের কিছু জমানো থাকলে সেগুলো যদি বিশ্বস্ত কাউকে শেয়ার করেন মন হালকা হয়। বুকের ওপর একশ মন বোঝা থাকলেও তার ওজন জিরো জিরো হয়ে যায়। ”
ঘনঘন শ্বাস ফেলল রুদ্রও। দু-হাত শক্ত মুঠোবন্দি করে চোখ বুজল। মনে পড়ে গেল সেইসব ঘৃণ্যতম দৃশ্য। হৈমী তার স্ত্রী। সেইসব দৃশ্য এতবছর কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনি। সেই ঘটনাগুলো কাউকে জানাতে পারেনি। বুকের ভিতর তীব্র ক্রোধ জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে। যা কোনোদিন ভাঙা সম্ভব না। ঘৃণার মাত্রা এতটাই বেশি যে ঐ দুজন মানুষের মৃত দেহ দেখতেও গা গুলিয়ে ওঠবে তার। যতটা ঘৃণা করলে জন্মদাত্রীর মুখে থুথু দেয়া যায় ঠিক ততোটাই ঘৃণা করে রুদ্র। সেই ঘৃণা থেকেই নিজের সঙ্গিনীকে বলল, তার জন্মদাত্রী আর বড়ো চাচার পরোকিয়ার গল্প। আশ্চর্য হলেও সত্যি ঐ ছোট্ট বয়সে রুদ্র ঠিক কী কী ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঐ দুজন মানুষ পরিবারের সকলের মুখে চুনকালি মেখে, চারটে সন্তানকে মা, বাবা ছাড়া করেছে। এসব ভাবতেই তীব্র ঘৃণা, ক্রোধে চোখ উপচে পানি বেরিয়ে এলো হৈমীর। রুদ্র, সূচনা, রাদিফ, সাদমান সবার জন্যই বুকটা হুহু করল তার। তার মনের অবস্থা টের পেয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিল রুদ্র। রুদ্রর বুকে মুখ গুঁজে সহসা ডুকরে ওঠল হৈমী। অজান্তে রুদ্রর চোখ বেয়েও দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। থমথমে কণ্ঠে সে বলল,
-” বাবা টাকার পেছনে দৌড়াল, আর উনি দৌড়ালেন যৌবনের উন্মেষ পেতে। এই দু’টোই কি মানবজীবনে সব? তাই যদি হয়ে মানুষ কেন বংশবৃদ্ধি করে? কী দরকার ছিল উনাদের আমাকে আর সূচনাকে পৃথিবীতে আনার? বাবার ওপর অভিমান কাজ করলেও কখনো ঘৃণা কাজ করে না। কারণ বাবা পাপ করেনি। আর উনি পাপ করেছে মস্তবড়ো পাপ। যার ক্ষমা ইহকাল, পরোকাল কোনো কালেই নেই। ”
ক্ষণকাল থেমে আবারো বলল,
-” ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে নিজেকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন৷ বাবার ভালোবাসা আমি বুঝতে পারি না। সে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি রাখেনি৷ কিন্তু ভালোবাসায় বিরাট ত্রুটি রেখেছে। যিনি জন্ম দিলেন তিনি তো ছুঁড়েই ফেললেন। দাদিন ভালোবাসে আমায় কিন্তু সেই ভালোবাসা আমার পর্যাপ্ত লাগে না। কারণ তিমি আজো আমার, আমাদের চেয়ে বড়ো কাকাকে বেশি ভালোবাসেন। দাদিন বেস্ট মা হৈমী। ছেলে এতবড়ো অপরাধ করার পরও সুযোগ পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলের খোঁজ নেন। ”
বিস্ময়ে শরীর শিউরে ওঠল হৈমী। রুদ্র বাহু আরো শক্ত করে চেপে ধরল। রুদ্র বাঁকা হেসে বলল,
-” এই বাড়ির কানায় কানায় কী ঘটে সব আমি জানি হৈমী। এ বাড়ির মানুষ গুলোর মন বইয়ের পাতার মতোন পড়তে পারি। একটা সময় আমি সবার কাছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না। সূচনাকে আগলে মানুষ করতে যেয়ে নিজেকে আগলানোর মানুষ খুঁজতাম। বড্ড দিশাহীন লাগত তখন। সপ্তাহে একবার বাবা ফোন করে খোঁজ নিতেন৷ দাদিন তিনবেলা খেয়েছি কিনা, ঠিক সময় স্কুলে গিয়েছি কিনা খোঁজ নিতেন। সূচনাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে গিয়ে আমাকে পিঠে রাখতেন। আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে, বাচ্চামো ভাবনা জাগতো একটা মানুষের দুটো বুক কেন থাকে না? দাদিনের দু’টো বুক থাকলে সূচনার মতোন আমিও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতাম। ”
থরথর করে কাঁপতে লাগল হৈমী। বুক ফেটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইল তার। অসহনীয় হয়ে হাঁটু ভর করে রুদ্রর গাল দু’টো কাঁপা হাতে স্পর্শ করল৷ এরপর চট করে রুদ্রর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। হতভম্ব হয়ে গেল রুদ্র। দু’হাতে হৈমীর পিঠ জড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” অ্যাঁই মেয়ে , এভাবে কাঁদছ কেন। চুপ চুপ। আরে বাবা আমি সূচনার জন্য এটুকু সেক্রিফাইস করেছি৷ ও তো খুব ছোটো ছিল এইটুকুন দুধের শিশু। ”
হৈমীর কান্না থামার নাম নেই। রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ছোট্ট শরীরটা গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল,
-” আমার কষ্টে যার চোখে এত পানি ঝড়ে সে নিশ্চয়ই নিঃস্বার্থ ভাবে আমায় ভালোবাসে? ”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে হৈমী বলল,
-” আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, এরচেয়েও বেশি ভালোবাসবো। খুব আগলে রাখব আপনাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিব না কখনোই না। ”
-” আমি এটাই চাই হৈমী। তুমি আমাকে ভালোবাসো। এতটা ভালোবাসো যে আমি সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে এক তোমাতে বিভোর থাকি। তুমি শুধুমাত্র আমাকেই ভালোবাসো, শুধুমাত্র আমার জন্য বাঁচো। আমার আর তোমার মাঝখানে একটি পিঁপড়াকেও সহ্য করতে পারব না হৈমী। তুমি আমার শেষ অবলম্বন, তুমি পারবেনা আমাকে তোমার শেষ এবং একমাত্র অবলম্বন করে বাঁচতে? ”
উন্মাদের মতো মাথা নাড়াল হৈমী। বলল,
-” পারব, আমাকে পারতেই হবে। ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হৈমীর বুকে চুমু খেল রুদ্র। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। দিনশেষে তুমি আমার হাসির কারণ। আমি তোমাকে ঠিক কতটা… ”
সহসা থেমে গেল রুদ্র। হৈমী চমকে তার মুখের দিকে তাকাল। আকুতি করে বলল,
-” বলুন। ”
চোখের ভাসাতে পুরোটা বোঝালেও মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না রুদ্র হৈমীকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। বরং জগতের সকল গম্ভীরতা মুখে টেনে ভরাট স্বরে বলল,
-” এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনো। পিপাসা লেগেছে।
”
চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে রুদ্রর বুকের বা’পাশে হাত রাখল হৈমী। বলল,
-” বলুন না কতটা ভালোবাসেন আমায়? ”
হৈমীর হাতের ওপর সন্তর্পণে হাত চেপে রাখল রুদ্র। কিঞ্চিৎ মাথা নুইয়ে বলল,
-” বলতে পারি না, বোঝাতে পারি। ”
-” আমি তো বুঝি না বলে বোঝান। ”
-” ভালোবাসা বলার জিনিস নয় মিসেস। ”
-” আমি অনুভবও করি না । ”
বাঁকা হাসলো রুদ্র। বলল,
-” বোঝো কি বোঝো না তা তো সময়ই বলে দেয়।”
-” তবুও বলবেন না? ”
কপট রাগ দেখাল হৈমী। রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দুম করে শুয়ে পড়ল। আদেশ বাক্যে বলল,
-” আর কোনো কথা নয়। যা বলেছি চুপচাপ তাই করো। যাও। “#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৮
.
সূচনা মাহেরের বিবাহবার্ষিকী আজ। খান বাড়িতে ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে। একবছর বেডরেস্টে থাকার কথা রুদ্রর। অথচ সে সাতসকালে ঢাকায় গেছে। ফিরতে রাত হবে। এদিকে বোনের ম্যারেজ ডে! তাই শেখ বাড়ি থেকে হৈমী, সোহান, রোশান, আর সাদমান এসেছে। রুদ্র না আসাতে ভারী অভিমান করল সূচনা৷ সেই অভিমান ভাঙাতে হৈমী ভিডিয়ো কল করল রুদ্রকে। ভাই বোনকে ভিডিয়ো কলে তার জরুরি কাজের বিষয়ে অবগত করল। এতে বোঝে আসল সূচনা। সূচনার সঙ্গে কথা শেষে রুদ্র হৈমীকে বলল সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে। হৈমী আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বলল,
-” আম্মু আজ থেকে যেতে বলেছে। ”
রুদ্র দৃঢ় চোখে তাকিয়ে শুধুমাত্র একটি কথা বলে ফোন কেটে দিল।
-” আমার ফিরতে এগারোটা কি বারোটা বাজবে। তুমি যদি চাও বাকি ছ’ঘন্টার রাত একা পার করি তাহলে মায়ের কাছে থাকো। আমার কোনো সমস্যা নেই! ”
হৈমীর বুকের ভিতর টনটন করে ওঠল। একদিকে মাতৃস্নেহ অপরদিকে স্বামী ভক্তি। দোটানায় পড়ে শেষে মা’কে বুঝাল কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আসবে। থেকে যাবে দু’দিন। রুদ্রকে যদি মানাতে না পারে তাহলে জোর করে তাকে সহ নিয়ে এসে থাকবে। হামিদা আপত্তি করল না। বরং অবাক হলো তার মেয়ে, মেয়ের জামাইয়ের মধ্যকার গভীর টান দেখে! রুদ্র যে হৈমীকে চোখে হারায়, আর হৈমী রুদ্রকে খুবই সমীহ করে চলে। এ দু’টো জিনিস বুঝতে পেরে অহংকার হলো তার। খেয়াল করল, তার ছেলে মেয়ে দুজনই সংসার জীবনে খুব সুখী। এই সুখটা পরিপূর্ণ হবে যখন এদের সংসারে ছোট্ট শিশুর আগমন ঘটবে৷ হৈমীকে নিয়ে আপতত এসব চিন্তা নেই। সে নিজেই একটা শিশুর মতোন। অল্প বয়স। বছর, চারেক না গেলে মেয়ের ঘরের নাতি, নাতনির আশা করা যায় না। কিন্তু ছেলের ঘরের নাতি, নাতনির খুবই প্রয়োজন। এক বছর হয়ে এলো। এখনো ছেলে বউয়ের কোনো খবর নেই। ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন হামিদা। মনে মনে স্থির করলেন আগামীকাল আবারো সূচনার সঙ্গে কথা বলবে এ ব্যাপারে।
হৈমীরা চলে যাওয়ার পর নিজেদের রুমে এলো সূচনা। দেখল মাহের চুপচাপ বসে আছে। সে এগিয়ে এসে মাহেরের কাঁধে হাত রাখল। জিজ্ঞেস করল,
-” এখনো পোশাল ছাড়োনি যে? একি মুখটা শুঁকনো লাগছে কেন? ”
কপট রাগ দেখিয়ে মাহের বলল,
-” সারাদিনে পাঁচ মিনিট সময় তোমার হয় না সূচনা?”
বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল সূচনা। অবাক হওয়া কণ্ঠে বলল,
-” বাব্বাহ সামান্য বিষয়টা নিয়ে এত্তো রাগ? বাপের বাড়ির লোকজনকে সময় না দিয়ে দরজা আঁটকে তোমার সঙ্গে বসে থাকলে ব্যাপারটা ভালো দেখাতো? ”
মুখ ঘুরিয়ে মাহের বলল,
-” আমি সেটা বলিনি। ”
ত্বরিত মাহেরের কোলে চেপে বসল সূচনা। গলা জড়িয়ে বলল,
-” আমার বরটার দেখি খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। ”
আলগোছে সূচনার কোমর জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল মাহের। আলতো স্বরে বলল,
-” একটা বছর কাটিয়ে ফেললাম। বিয়ের প্রথম বছরে কী চাই তোমার বলো? ”
-” আমাদের সন্তানকে চাই। ”
-” এটা তো আল্লাহ তায়া’লার কাছে চাচ্ছিই। এছাড়া কী চাই। ”
-” এই যে তোমার এই ভালোবাসা আরো তীব্র করে চাই। ”
-” উহুম এমন বললে হবে না। কিছু তো চাইতেই হবে। ”
-” না চাইতে কম কী দিয়েছ। এই যে সারা দেহে যেসব পরে আছি সবই তো তোমার দেয়া। স্পেশাল ডে হিসেবে। ”
-” এগুলো নয় আরো স্পেশাল কিছু চাও। ”
-” না আমার আর কিছু চাই না। ”
জেদি স্বরে মাহের বলল,
-” চাইতেই হবে। ”
মহা মুশকিলে পড়ে গেল সূচনা। এরপর আচমকাই মনে পড়ল। মাহেরের কাছে আসলে তার কিছু চাওয়ার নেই। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের এই মানুষটা গত এক বছরে এতটা উজার করে দিয়েছে যে চাওয়ার মতো কিছু খুঁজেই পাচ্ছে না। সেদিনের সেই ঘটনার পর সত্যিই কি কিছু চাওয়ার আছে?
সেদিন শাশুড়ির ওপর তীব্র অভিমানে যখন সূচনা ডক্টরের কাছে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিল। মাহের তখন তার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিল,
-” সূচনা, মা’য়ের চিন্তা ধারা আমাদের চেয়ে আলাদা। সে আমাকে সুখে দেখতে চায়। সেই সুখ দেখার জন্যই বউ হিসেবে তোমাকে এনে দিয়েছে। এবার সে চায় আমাকে বাবা হওয়ার সুখে চোখ ভরে দেখতে। তার মাতৃ হৃদয় পুত্রকে সর্বসুখে দেখার জন্য এতটাই ব্যাকুল যে অবান্তর আবদারও করে বসে। আমি আমার মায়ের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ”
সূচনা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাহেরের হাত চেপে ধরে৷ মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” আমি দুঃখীত মাহের৷ মায়ের ওপর এভাবে রাগ, অভিমান করা উচিৎ হয়নি আমার। ”
মাহের বলে,
-” তোমার কোনো ভুল নেই। ভুল মায়েরও নেই। সমস্ত ভুল পরিস্থিতি আর আবেগের। আমার একটি কথা রাখবে তুমি? ”
-” কী? ”
-” মা যদি জিজ্ঞেস করে আমরা ডক্টর দেখিয়ে ছিলাম কিনা তুমি হ্যাঁ বলবে। আর বলবে ডক্টর বলেছেন আমাদের কারো কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ পাক চাইলে আমরা সন্তানের মুখ অবশ্যই দেখব। ”
সূচনার চোখ গলে অশ্রু ঝড়েছিল৷ মাহের তার ভেজা চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলেছিল,
-” মায়েদের খুশির জন্য এটুকু মিথ্যা বলাই যায়। ”
সূচনা বলেছিল,
-” তাহলে চলুন তার খুশির জন্য আমরা কাল ডক্টর দেখাই। ”
সহসা সূচনার ঠোঁটজোড়া একহাতে চেপে ধরেছিল মাহের। বলেছিল,
-” তাহলে যে আমার বউয়ের মা হবার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করা হবে। জানি না মহান আল্লাহ পাক কী চান। কিন্তু আমি কখনোই এর জন্য আপনাকে ডক্টর দেখাব না৷ আমি আমাকে সন্দেহ করতে পারি কিন্তু আপনাকে না। আপনি যেমন আছেন তেমনি যথেষ্ট। যদি কোনোদিন সন্তান সুখ নাও পাই আফসোস নেই। মনে রাখব এক আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপহার আল্লাহ পাক আমার জন্য রাখেননি। ”
নারী জীবন ধন্য হতে আর কী চাই? সূচনার জীবনে সত্যি কি না পাওয়া কিছু আছে? মাহের নামক মহান পুরুষটা যে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। সেদিনের কথাগুলো স্মৃতিচারণ করে সূচনার চোখ দু’টো ছলছলে হলো। আবেগান্বিত হয়ে সে মাহেরের জেদ খাটানো বুলিতে বলল,
-” আপনার অজস্র ভালোবাসা মাখানো সিক্ত চুমু চাই। ”
মাহের কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু সূচনার আকুতিভরা চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেল। নরম ঠোঁটজোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। সেই তৃষ্ণা মেটাতে কৃপণতা করার সাহস হলো না তার। সহসা উষ্ণ ঠোঁটে ভেজা চুমুতে মেতে ওঠল দুজনে।
__________________
বাড়িতে আসার পর পরই গলগল করে বমি হলো হৈমীর। রান্নাঘরের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বমিরত অবস্থায় হৈমীকে দেখে এগিয়ে এলো রিনা। আঁচলে মুখ ঢেকে গা ঘিনঘিন করে বলল,
-” বাপের বাড়ি গিয়ে কতই গিলছিলা গো। যা হজম করতে পারবা না তা গিলছ কোন দুঃখে। ”
চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো হৈমীর। মাথা ধরে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এরপর কুলি করে চোখে, মুখে পানি দিয়ে ছোটো কাকিকে বলল,
-” আপনি এমন মানুষ, সত্যি অবাক লাগছে। কোথায় কাছে এসে একটু ধরবেন তা না। খাবার নিয়ে খোঁটা দিচ্ছেন। বাপের বাড়ি গিয়ে ভাইয়ের কেনা খাবার ইচ্ছে মতো গিলেছি। সমস্যা আমার হয়েছে, আমিই বুঝব৷ সব সময় এত কথা শোনাবেন না। এমনিতেই শরীরটা ভালো লাগছে না। ”
শেষ কথাটা কাঁদো কাঁদো হয়েই বলল হৈমী।কথাগুলো একদমে বলে রান্নাঘর ছাড়তে উদ্যত হলো সে। ছোটো কাকি ঢোক গিলল। হৈমী যে পটর পটর কথা বলতে পারে এ ব্যাপারে সে অবগত৷ তাই খুব বেশি অবাক হলো না। শুধু তার আচরণ যেন রুদ্রর কান পর্যন্ত না পৌঁছায় তাই ভালো মানুষী দেখাল। কৌতূহলী মনে আচমকা প্রশ্ন করল,
-” এই শোনো হঠাৎ বমি করলা পেটে কিছু আসল না তো? ”
থমকে দাঁড়াল হৈমী। পিছন ঘুরে আশ্চর্য হয়ে বলল,
-” পেটে আবার কী আসবে? ”
ছোটো কাকি এগিয়ে এলো। হৈমীর চোখ মুখ তীক্ষ্ণ চোখে দৃষ্টিপাত করল। বলল,
-” চোখ, মুখ তো সুবিধার লাগছে না। এখনি বাচ্চা টাচ্চা নিছ নাকি! ”
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল হৈমী। ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ত্বরিত বলল,
-” কী সব বলছেন ওসব কিছু না। ”
হাঁটু কাঁপতে লাগল হৈমীর। এক মাস আগেও সে চাইতো রুদ্রর সন্তানের মা হতে৷ অথচ আজ সময়ের সাথে সাথে তার মন কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। রুদ্রর মতো সেও চায়না তাদের মাঝখানে কেউ আসুক। মূলত রুদ্র চায় না বলেই সে চায় না। কথায় বলে না ভালোবাসার মানুষের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়? হৈমীও নিজের মাতৃসত্ত্বা ত্যাগ করতে চায় রুদ্রর জন্য। ঐ মানুষটা জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। ভিতরে ভিতরে একটু ভালোবাসা, একটু যত্নের কাঙাল সে৷ ধীরেধীরে হৈমী চিনতে পেরেছে রুদ্রর ভেতরের সত্ত্বাকে। ভালোবেসে লোকে কত কিছুই তো করল। রুদ্র যদি না চায় তারা বাবা, মা হোক তাহলে সে অযথা জেদ করে ঐ মানুষটাকে কেন কষ্ট দেবে? তার কেবল একটাই উদ্দেশ্য বাকিটা জীবন শুধু রুদ্রকে ভালোবেসে পাশে থাকা। রুদ্রর সেই কণ্ঠ এখনো তার হৃদয়ে বিঁধে,
-” তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো, শুধু আমার জন্য বাঁচো। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৈমী। ছোটো কাকি ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” কী সব বলছি মানে? ভুল কী বললাম। স্বাভাবিক কথাই তো বললাম। তোমার হাভভাব তো তাই বলে। একটা কথা বলোতো তোমার লাস্ট পিরিয়ড ডেট কবে ছিল? ”
বুকটা কেঁপে ওঠল হৈমীর৷ ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল,
-” গতমাসের বারো তারিখ। কেন কী হয়েছে? ”
-” আজ তো বাইশ তারিখ। এ মাসে হয়েছে? ”
টলমল চোখে হৈমী বলল,
-” না! ”
ছোটো কাকি প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল,
-” আরে মেয়ে ঘটনা তো ঘটে গেছে। তুমি রুমে যাও আমি আসতেছি। ”
সহসা ছোটো কাকির হাত টেনে ধরল হৈমী। বলল,
-” কী করবেন। ”
ছোটো কাকি ফিসফিস করে বলল,
-” আমার কাছে প্র্যাগনেন্সি কীট আছে পরীক্ষা করব।”
_______________
দরজা আঁটকে দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল হৈমী। ছোটো কাকি আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে গিয়ে ধমক দিল ওকে। বলল,
-” তুমি তো খুব অসভ্য। এমনভাবে কাঁদছ মনে হচ্ছে এটা তোমার অবৈধ সন্তান! ”
হৈমী পাগলের মতো ছটফট করতে করতে বলল,
-” উনি জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ”
-” কী বলছ! রুদ্র জানলে খুশি হবে সর্বনাশ হবে কেন। তুমি সত্যি করে বলো তো আসলে কী হয়েছে। ”
ছোটো কাকি সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল। উপায় না পেয়ে হৈমী তাকে দেয়া রুদ্রর শর্তের কথা বলে দিল কাকিকে। এছাড়াও রুদ্র কেন সন্তান চায় না। সে সম্পর্কেও জানালো। সব শুনে পুরো বিষয়টা বুঝতে পারল ছোটো কাকি। চোখ কটমট করে বলল,
-” তাহলে এই অঘটন ঘটল কী করে। এখানে তো স্পষ্ট দুই দাগ স্পষ্ট। তোমার গর্ভে রুদ্রর অংশ এসে গেছে। বাচ্চা যখন নিবাই না সতর্ক থাকলা না কেন? ”
হৈমী দিশেহারা হয়ে বলল,
-” আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কীভাবে কী হলো। এখন আমার কী হবে? আমার এখন কী হবে কাকি। উনি আমাকে ছেড়ে দেবেন, আমি কী করব এখন। কীভাবে বোঝান উনাকে। ”
পাগল পাগল হয়ে গেল হৈমী। ছোটো কাকি কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। এরপর বললেন,
-” অস্থির হইয়ো না। সমস্যা আছে সমাধানও আছে। ”
হৈমী আচমকা কাকির দু-হাত চেপে ধরল। আকুতি করে বলল,
-” প্লিজ এসব কাউকে বলবেন না। উনাকেও না। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। উনাকে আর কোনো আঘাত আমি পেতে দিব না। ”
-” তুমি পাগল! আকাশে চাঁদ ওঠলে সবাই দেখে তেমনি তোমার পেটে বাচ্চা আসছে এটাও সবাই জানবে। ”
কথাটা বলেই হঠাৎ থমকাল ছোটো কাকি। বলল,
-” অবশ্য একটা কাজ করলে কেউ জানতে পারবে না। ”
এ কথা শুনেই মরিয়া হয়ে হৈমী জানতে চাইল,
-” কী কাকি প্লিজ একটা উপায় বলুন। ”
-” অ্যাবর্শন! ”
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল হৈমীর। ভয়ে মিইয়ে গেল মুখটা। ছোটো কাকি বলল,
-” বেশি দিন হয়নি যদি করাও এখনি করাতে হবে। ”
হৈমী মেঝেতে থম মেরে বসে পড়ল। ভয়ে বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। ছোটো কাকি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
-” আমি এখন যাই। এই কথাটা চেপে রইলাম। যদি অ্যাবর্শন করাও আমাকে জানিয়ো সাহায্য করব। আর যদি না করাও নিজ দায়িত্বে সবাইকে জানিয়ে দিও। ”
ছোটো কাকি চলে গেলেন। হৈমীর দু’হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। দীর্ঘক্ষণ দুঃশ্চিন্তা, ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুর্বল হয়ে পড়ল সে। বার বার রুদ্রর বলা কথাগুলো স্মরণ হলো তার। সবশেষে ছোটো কাকির অ্যাবর্শন বলা শব্দটায় থামল সে। বিরবির করে বলল,
-” যা করলে উনি এসব জানবেন না। যা করলে উনি কষ্ট পাবেন না। যা করলে উনার আর আমার ভালোবাসায় ফাটল ধরবে না। সব করতে পারব আমি। হ্যাঁ অ্যাবর্শন করব আমি। ছোটো কাকি আমি অ্যাবর্শন করব! ”
অ্যাবর্শন ছোট্ট একটি কঠিন শব্দ। যার মর্মার্থ জানে না হৈমী। শুধু জানে অ্যাবর্শন করলে রুদ্র জানবে না সে গর্ভবতী হয়েছিল। যে বিষয়টা নিয়ে রুদ্রর এত বিতৃষ্ণা সে বিষয়টা নীরবেই শেষ করে দেবে সে। এতে তাদের সম্পর্কে, গভীর ভালোবাসায় কোনো আঁচ আসবে না। কিন্তু তার এই নির্বুদ্ধিতা যে সামনের দিনগুলোতে কাল হয়ে দাঁড়াবে একবারের জন্যও টের পেল না। রুদ্র সন্তান চায় না। এটুকুই বুঝল হৈমী। তার অল্প জ্ঞানে শুধু এটুকুই ধরল।
চলবে…