#বাসর
#৮ম_পর্ব
‘
‘
নীলা আজ চলে যাবে বাপের বাড়ি। সকাল বেলা তার বাবা ফয়জুর সাহেব এসেছেন। বাবাকে কতদিন পরে দেখেছে নীলা! ফয়জুর রহমান ঘরের দোরে এসেই যখন নীলাকে মা বলে ডাকলেন তখন নীলার খুব অভিমান হলো।তার বাবা অনেক অনেক দিন ধরে তাকে দেখতে আসেন না। এই জন্য সে মনে মনে ঠিক করেছে আজ বাবার কাছেই যাবে না। লুকিয়ে থাকবে।কষ্ট পেয়ে বাবা বুঝুক আপন মানুষদের অবহেলার কী যন্ত্রনা!
কিন্তু নীলা কী কষ্ট দিবে তার বাবাকে! ফয়জুর রহমান যখন দ্বিতীয় বার মা বলে ডাকলেন তাকে তখন ঘরের দরজা এক টানে খুলে সে পাগলের মত দৌড়ে বেরিয়ে গেল তার বাবার কাছে। তারপর বাবার বুকে জলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।এ যে কত অভিমানের কান্না,কত ভালোবাসার কান্না তা কী সহজ করে দু বাক্যে প্রকাশ করা যায়!
ফয়জুর সাহেবের বুকে নীলা ছোট ছোট কিল বসিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলছে,’আব্বা, তুমি আমায় ভুলে গেছো।তোমরা সবাই আমায় ভুলে গেছো! আমি অপয়া হয়ে গেছি না আব্বা?’
ফয়জুর সাহেবের দু চোখ জলে ভরে গেছে।তার জল তেষ্টায় শুকনো গলায় কান্না জমেছে অনেক।তার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সেই ছোট্ট নীলার কথা। তিনি তখন ঢাকায় থাকেন।একটা ফার্মে চাকরী করেন।বাড়ি ফিরেন অনেক দিন পর পর। সেই অনেক দিন পর ফেরার কারণে নীলা প্রথম প্রথম অভিমান করে থাকতো। কিন্তু এক দু বার মায়াভরে ডাকলে আর গা ধরে থাকতে পারতো না তখন। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো বুকের উপর। তারপর তার বুকের উপর ছোট্ট গোল গোল হাতের কিল বসিয়ে বলতো,’আরো কোনদিন দেরি করে আসবা তুমি? আরো কোনদিন দেরি করে আসবা? যদি আরেকবার দেরি করে আসো তবে কিন্তু মেরে ফেলবো তোমায়!’
ফয়জুর রহমানের চোখ থেকে জল নেমে পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। তিনি হঠাৎ কেঁদে উঠলেন শব্দ করে।এ এক অপার্থিব দৃশ্য।বাবা আর মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে এমন দৃশ্য বড় মায়াময়। সালমা বেগম এই দৃশ্য দেখে আবেগপ্রবণ হলেন। অনেক কষ্টে নিজের কান্না আড়াল করে বললেন,’বেয়াই,বাপ মেয়ে কান্দনের অনেক সময় পাইবেন।এহন ঘরে আসেন। অনেক দিন পর আপনারে পাইছি। এই সময়টা আপনার সাথে আনন্দে কাটাইতে চাই!’
ফয়জুর রহমান বড় কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন। তারপর নীলাকে শান্ত করে তার একটা হাত ধরে ঘরে গেলেন।
নীলা তার বাবার সাথে খাটের উপর বসতে বসতে বললো,’খালিদ কেমন আছে আব্বা?’
‘ভালো আছে। আমার সাথে আসতে চাইছিলো।আনি নাই আমি।’
‘আনলে না কেন বাবা?’
বড় অভিমানী গলায় কথাটা বললো নীলা।
ফয়জুর রহমান বললেন,’আজ তো তুই আমার সাথে যাবিই।আনলে আর লাভ কী? ছোট মানুষ। শুধু কষ্ট করে হেঁটে আসবে!’
এই সময় ঘরে এলো সেলিম।সে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ফয়জুর রহমানকে। নীলা তখন ওখান থেকে উঠে চলে যেতে যেতে বলল,’তোমরা কথা বলো আব্বা,আমি শরবত নিয়ে আসি।’
নীলা উঠে যেতেই শরবত নিয়ে এলেন সালমা বেগম। তিনি এসে শরবত দিয়ে আবার চলে গেলেন। ফয়জুর রহমান শরবত খেয়ে ট্রের উপর শূন্য গ্লাসটা রাখতে রাখতে বললেন,’জমিনে ধানের সাজ কেমন গো বাবা? পোকা টোকা তো ধরে নাই?’
সেলিম বললো,’না তালই সাব। আলহামদুলিল্লাহ ধানের সাজ ভালো। এখন একটু বৃষ্টি হলেই অনেক ভালো ধান হবে।’
ফয়জুর রহমান হাসলেন। হেসে বললেন,’আজ তো নীলাকে নিয়ে চলেই যাবো। তুমি মাঝেমধ্যে বেয়াইন সাবকে নিয়ে বেড়াবা আমাদের বাড়িতে।’
ফয়জুর রহমানের কথাটা শুনে সেলিমের কেন জানি হঠাৎ কষ্ট অনুভব হলো। এই এতো দিন ধরে নীলা এখানে থাকায় সে তো তাদের ঘরেরই একজন হয়ে উঠেছিল।আর এখন চলে যাবে এই কথা ভেবেই তার কষ্ট হচ্ছে।তার এখন মনে হচ্ছে পৃথীবিটা কী ভীষণ অদ্ভুত এক জায়গা। এবং মানুষের জীবনটা আরো বড় অদ্ভুত।আজ যদি তার ভাই বেঁচে থাকতো তবে নীলা এখানেই থাকতো। কোনদিন চলে যেতো না।তার ভাইয়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়ে হতো। সেই ছেলে মেয়েরা তার হাত ধরে ঘুটি ঘুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাকতো,কাকা,কাকা বলে।
আহারে! এমন কেন হলো তবে?
তারপর সেলিম ফয়জুর রহমানকে নিয়ে গেল নাঈমের কবরের কাছে। কবরটা কেমন এখন পুরনো দেখাচ্ছে। কবরের ভেতর শ্যাওলা জমেছে।লতা পাতাও বেড়ে উঠেছে কিছু।
সেলিম কবরের বেড়ায় হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ফয়জুর রহমান তাকে জড়িয়ে ধরলেন।ধরে ভেজা গলায় বললেন,’কাইন্দো না বাপ। ভাইয়ের আত্মায় কষ্ট পাইবো!’
‘
সালমা বেগম চুপ হয়ে আছেন। একটা কথাও বলছেন না।তার চোখ টলমল করছে জলে। নীলা অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার শাশুড়ির কাছে। সে কাপড় চোপড় পরে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সালমা বেগম অনুমতি দিলেই ঘর থেকে বের হয়ে স্বামীর কবর হয়ে একেবারে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু শাশুড়ির অনুমতি মিলছে না। তিনি কথাই বলছেন না।
নীলা তার পায়ের কাছে বসে বললো,’আম্মা, আপনি গিয়ে কদিন পর পর আমায় দেখে আসবেন। আপনাকে না দেখে আমি থাকতে পারবো না।’
সালমা বেগম কেঁদে উঠলেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তিনি এবার জড়িয়ে ধরে ফেললেন নীলাকে। তারপর বললেন,’তুমি আমার বউ না মা, তুমি আমার মাইয়া। আমার লক্ষ্মী মাইয়া।মাগো,তোমারে ছাড়া আমি থাকবাম কেমনে? আমার ঘর দোর আন্ধাইর হইয়া যাইবো গো মা!’
নীলাও কাঁদছে।তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
তারপর তারা গেল বাড়ির পেছনে নাঈমের কবরের কাছে একসাথে কাঁদতে কাঁদতে।
গিয়ে নীলা কবরের ভেতর থেকে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে গুঁড়ো করে সারা গায়ে মেখে নিলো তার। তারপর বললো,’আপনাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি এখন থেকে সব সময় আমার সাথেই থাকবেন।’
এই দৃশ্যটা দেখে সালমা বেগম চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।যেন পৃথিবীতে এমন ব্যাদনার দৃশ্য আরেকটিও নাই।
‘
নীলা চলে যাওয়ার সময় সালমা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। সালমা বেগম তাকে টেনে নিলেন বুকে। বুকে নিয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’মারে ভুইলা যাইবা তুমি না?’
নীলা ভেজা গলায় বললো,’কোনদিন না আম্মা। আমি ভুলতে পারবো না।’
বলে কেঁদে ফেললো। এবং কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ির পথ ধরলো নীলা।
———————————————————————
নীলা বাড়ি ফেরার তিন দিন পরেই তার শাশুড়ি চলে এলেন তাদের বাড়িতে। ফয়জুর রহমান তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। নীলা এসেছে মাত্র তিনদিন হয়েছে এর মধ্যেই তিনি হঠাৎ চলে এলেন কেন?
‘
‘
#চলবে__
#অনন্য_শফিক