#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
রুহুলের দোকানের বেচাকেনা চলছে তুমুল। তার আচার-আচরণ এবং ব্যবহারেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাবা-মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলে না। বোনদের নিয়ে খুব সিরিয়াস। বাজে বন্ধুদের সাথেও মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত না হলেও সে নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করছে। অর্ষা অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলে না। আস্তে আস্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও ঠিকমতো পড়তে পারবে বলে তার বিশ্বাস। রুহুলের এমন পরিবর্তন শুধু বাড়ির মানুষ-ই নয় বরং এলাকার সবারই চোখে পড়েছে। তারাও এখন রুহুলের প্রসংশায় পঞ্চমুখ। আগে ওমর রহমান চায়ের দোকানে গেলে মানুষের মুখে রুহুলকে নিয়ে হাপিত্যেশ শুনতেন। আর এখন শোনেন প্রসংশা। গর্বে বুক ফুলে যায় তার। মহান আল্লাহর প্রতি তিনি সর্বদাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আল্লাহ্ তাকে নিরাশ করেননি। সুখী পরিবারটি সে পূণরায় ফিরে পেয়েছেন।
রাতে অর্ষা আর সকাল খেতে বসেছে। রুহুলের আসতে আসতে রাত ১০/১১টা বাজবে। ততক্ষণে দু’বোনে ঘুমিয়ে পড়ে বিধায় বাকিদের আগেই খেয়ে নেয়। ওমর রহমান পাশেই চেয়ারে বসে ছিলেন। সেলিনা বেগম দু’মেয়েকে ভাত, তরকারি এগিয়ে দিচ্ছেন। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,
“রমিজ মিয়ার কথা মনে আছে তোমার?”
ওমর রহমান ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করেন,
“কোন রমিজ মিয়া?”
“ঐযে বাজারে পান বেঁচত। মনে নাই? ছোটো মেয়েটা যে পানিতে পড়ে ম-র-ল?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। কেন কী হলো হঠাৎ?”
“কিছু হয় নাই। গতকাল তার বড়ো মেয়েটারে দেখলাম।”
অর্ষা বলল,
“রমিজ চাচারা না গ্রামে চলে গেছিল?”
“হুম। গ্রামে সংসার চলে না। তাই আবার চলে আসছে।” বললেন সেলিনা বেগম।
সকালও অতি উৎসাহ নিয়ে বলল,
“খুশি আপুর কথা বলতেছ না মা? আমিও তো আপুরে প্রায়ই দেখি। আপু কিন্তু অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”
“হঠাৎ ওর কথা বলতেছ কেন?” জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
“খুশিরে রুহুলের বউ করে আনলে কেমন হয়?”
“খোঁজ-খবর নাও। ভাইয়াকেও জানাও। তারপর নয় হয় সবদিক ভেবে আগানো যাবে।”
ওমর রহমান সায় দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ। এটাই ভালো হবে।”
“তুমি তাহলে রমিজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখো তারা মেয়ে বিয়ে দেবে নাকি।” বললেন সেলিনা বেগম।
“তুমি ওর বাসা চেনো?”
“চিনি। যাবে কাল?”
“চলো যাই। যদি মেয়ে বিয়ে দিতে চায় তাহলে কালই রুহুলের কথা বলব।”
“ঠিক আছে।”
অর্ষা আর সকাল খাওয়া-দাওয়া করে নিজেদের রুমে চলে আসে। প্যাটিস ঘুমায়নি। চেঁচাচ্ছে। সকাল সুন্দর করে গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“প্যাটিস রে এভাবে চেঁচাস না। আপু রেগে গেলে কিন্তু তোর সাথে আমাকেও ঘর থেকে বের করে দেবে।”
প্যাটিস সকালের কথা বুঝল কিনা কে জানে। তবে শান্ত হয়ে গেল। সকাল ওকে বাক্সের মধ্যে ওর বিছানায় রেখে অর্ষার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। গায়ের ওপর হাত রেখে বলে,
“ভাইয়ার বিয়ে হলে খুব মজা হবে তাই না আপু? আমরা একটা ভাবি পেয়ে যাব।”
“তোর এত মজা করা লাগবে না। ভাইয়ের পরে তোর বিয়েটাও দিয়ে দেবো।”
“ইশ! আমি তো ছোটো। আমি পরে বিয়ে করব। ভাইয়ার পরে তোর বিয়ে হবে। আহনাফ ভাইয়াকে আর কত অপেক্ষা করাবি?”
“তোদের সবার দেখি তার জন্য খুব দরদ। আর আমার বেলাতেই কিছু না।”
“আমরা তো তোকেও ভালোবাসি আপা!”
“ছাই ভালোবাসিস।”
“হ্যাঁ, ছাই-ই ভালোবাসি। এখন আমাকে ঘুমাতে দে। সকালে ক্লাস আছে আমার।” বলে শক্ত করে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরল।
.
সকালে অর্ষার ঘুম ভাঙে বাজে একটা খবর শুনে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওকে এত ব্যস্ত হতে দেখে সকাল জিজ্ঞেস করে,
“আপু! এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”
অর্ষা কোনো কথা বলতে পারছে না। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। সকাল মরিয়া হয়ে ওঠে। বারবার জিজ্ঞেস করে,
“ও আপু? কে ফোন করেছিল? কী হয়েছে আমায় বল।”
অর্ষা ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,
“আহিল ফোন করেছিল। ওর বাবা মা-রা গেছে।”
সকালে মুখে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার দু’চোখেও জমাট বেঁধেছে রঙহীন অশ্রু। সে ক্রন্দনরত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“তুই কি এখন তার বাসায় যাচ্ছিস?”
অর্ষা মাথা ঝাঁকায়।
“আমিও যাব।” বলে সকাল কলেজ ড্রেস পড়েই অর্ষার সঙ্গে বেরিয়ে যায়
যাওয়ার পূর্বে শুধু মাকে বলে যায় ঘটনাটি।
অর্ষা আর সকাল যখন আহিলের বাসায় পৌঁছায় ততক্ষণে গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকিরা চলে এসেছিল। আহিল আশিক আর দিদারকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে আহিল। বাকিরা পাশে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। অর্ষার বুকটা হুহু করে ওঠে। নিজেকে সে সামলেই রাখতে পারছে না। বাবা-মাকে চিরদিনের মতো হারানোর কষ্ট থেকে আর কী বড়ো হতে পারে কোনো সন্তানের কাছে? নিজের বাবার কথা ভেবেই অর্ষা যেন আরও বেসামাল হয়ে পড়ে। সকাল বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। হঠাৎ দেখলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে কার বাবা ইন্তেকাল করেছে ভেবে। অন্যপাশে বসে বিলাপ করে কাঁদছে আহিলের সৎ মা শিমলা বেগম।
আস্তে আস্তে বাড়িটিতে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা এসেছেন। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে মুন, আদিব, আহনাফ এবং হাসিব। সকালে মায়ের থেকে ঘটনাটি শুনে অর্ষাকে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে রুহুলও চলে এসেছে। সকালকে এভাবে কাঁদতে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করে সে। আহনাফ এগিয়ে যায় আহিলের কাছে। দু’হাতে আহিলকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। কাঁদতে বারণ করে না। বারণ করলেও কি চোখ, মন সেই বারণ কখনও শুনবে?
জানাজার নামাজ পড়ে আহিলসহ বাকিরা বাসায় আসে। শিমলা বেগম কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন আহিলকে। তার ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, আহিলকে বাড়ি থেকে চলে যেতে। আহনাফ অবাক হয়ে যায়। এখানে আহিলের দোষটা কোথায়? অর্ষা বাদে বাকি বন্ধুরা আহিলের বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে পূর্বে অবগত ছিল না। তাই তাদেরও বিস্ময়ের সীমা নেই। বাবার শোক, মায়ের গালমন্দ সবকিছু আহিলকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। তবুও সে চুপ করে আছে। কিচ্ছু বলছে না। তার মাথা নত করা। আহনাফ আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে এগিয়ে গিয়ে শিমলা বেগমকে বলল,
“আহিলকে নিয়ে যখন আপনার এতই সমস্যা, তখন ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। এখন থেকে আহিল আমার ভাই। ও আমার সাথে আমার বাসায় থাকবে।”
শিমলা বেগম এ কথার প্রত্যুত্তর করলেন না। তিনি কাঁদছেন। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও কেউ মুখ খুলল না। আহনাফ আর সেখানে অপেক্ষা না করেই আহিলকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসে। আশিককে ফোন দিয়ে জানায়, ওরাও যেন আহিলকে সঙ্গে দেওয়ার জন্য ওর বাসায় চলে যায় সন্ধ্যায়।
অর্ষা রুহুলের সাথে সকালকে পাঠিয়ে দিয়ে আহনাফের বাসায় গেল। রেণুকে জিজ্ঞেস করল,
“উনি কোথায়?”
রেণু বলল,
“খালাম্মার রুমে।”
অর্ষা ঐ রুমে গেল। আমেনা বেগমের কোলের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে আহিল। আমেনা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছেন,
“আহারে বাচ্চা! কাঁদে না। কাঁদতে বারণ করেছি। কাঁদবে না। খবরদার!”
আহনাফ আর হাসিব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। দরজায় অর্ষাকে দেখে আহনাফ এগিয়ে গেল। অর্ষাকে নিয়ে চলে এলো ছাদে।
অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে অর্ষা বলল,
“খুব কষ্ট হচ্ছে আমার!”
আহনাফ অর্ষার দু’গালে হাত রেখে বলল,
“সব কষ্ট তোমার আনন্দে পূর্ণতা দেবো দেখে নিও। আহিলকে আজ কাঁদতে দাও। এত সহজে তো আর সবটা ঠিক হয়ে যাবে না। তবে আমি কথা দিচ্ছি, সব ঠিক করে দেবো। আজ থেকে আমরা আহিলের নতুন পরিবার।”
অর্ষা কেঁদে ফেলে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
“আপনি কি আমার সম্পর্কে সব জানেন?”
আহনাফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অর্ষা বলে,
“আমি আর ভাইয়া কিন্তু এতিম! আমাদের আপন বাবা-মা….”
এতটুকু বলতে গিয়েই প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে অর্ষা। আহনাফ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“চুপ! আমি সব জানি। আঙ্কেল-আন্টিই তোমার আপন বাবা-মা। আমি এটাকেই ধ্রুব সত্যি মানি। শুধু জন্ম দিলেই বুঝি বাবা-মা হওয়া যায়? যারা আদর-যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তারা আপন হয় না?”
অর্ষা ফোঁপাচ্ছে। আহনাফ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“আর কখনও বলবে না তুমি এতিম। তোমার কত সুন্দর একটা পরিবার রয়েছে। বাবা-মা, ভাই, বোন সবাই আছে তোমার। আমি আছি তোমার। আহিলও একা নয় আর। ওর-ও এখন থেকে বাবা-মা আর একটা বড়ো ভাই আছে। যাওয়ার আগে সুন্দর করে ওকে সব বুঝিয়ে বলে যাবে। ও যদি এখানে থাকতে না চায় তাহলে কিন্তু বড়ো ভাই হিসেবে ওর পা পি-টি-য়ে ভে-ঙে ফেলব আমি হুহ। তখন কিন্তু বন্ধুর সাপোর্ট নিতে পারবে না বলে দিলাম।”
অর্ষা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলে। আহিলের জন্য যেমন সে কষ্টে কাতর হচ্ছিল; এখন একরাশ ভালোলাগায় মন আনন্দিতও হচ্ছে। আহিল এত সুন্দর একটা পরিবার পাচ্ছে এটা কি বন্ধু হিসেবে অর্ষার জন্য আনন্দের খবর নয়? নিশ্চয়ই আনন্দের খবর। একটা কথা আজ সত্যিই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, প্রকৃতি যেমন কেড়ে নেয়, তেমন আবার ফিরিয়েও দেয়। এইতো যেমন অর্ষাকে দিয়েছিল আর এখন আহিলকে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]