#My_First_Crush
#পর্ব-১২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আজকের দিনটি খুব সুন্দর। আবহাওয়া নরম, উঞ্চ। রোদ উঠেছে, কিন্তু রোদের তাপমাত্রা মানানসই। জামা কাপড়ের একটা বড় লাগেজ টেনে টেনে বারান্দায় নিয়ে এলো হৃদি। কবাটে জায়গা না হওয়ায় কম প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র এটাতে রেখে দিয়েছিল সে। লাগেজের চেইন খুলে ভেতরের জিনিসপত্রগুলো হৃদি নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো। এমন সময় একটা পত্রিকা হাতে রাইয়ান এলো সেখানে। হৃদিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কি করছো এগুলো?’
হৃদি মাথা তুলে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই ব্যাগের উপর পানি পড়ে গেছে। কিছু ভিজে গেলো কিনা দেখছি। তাহলে রোদে শুকাতে দেবো।’
‘পানি পড়লো কিভাবে?’
‘মিঁয়ো কেবিনেটের উপর রাখা কাঁচের জগ এটার উপর ফেলে দিয়েছে।’
রাইয়ান বলল, ‘তোমার মিঁয়ো আজকাল খুব বেশি ছোটাছুটি করে।’
হৃদি ঠোঁট ফুলিয়ে কাজের মাঝে বলল, ‘হুম।’
তারপর হঠাৎ কিছু মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মিঁয়োকে পথে আনার জন্য আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে?’
রাইয়ান উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
হৃদি বাঁকা হেসে বলল, ‘আজকে লাঞ্চে মিঁয়োকে ভেজিটেবল সালাদ খেতে দেবো। আর আমরা ওঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে মুরগীর রান খাবো।’
রাইয়ান মাথা নেড়ে মুখের ভাষা হারানোর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। হৃদি হাসতে লাগলো। হৃদির মাথায় হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে রাইয়ান বলল,
‘তুমি অনেক ফানি।’
চাঁপা হাসির সাথে লাগেজের ভেতর চোখ পড়তেই রাইয়ানের নজর আটকে গেলো। কাপড় চোপরের মধ্যে থেকে মাঝারি সাইজের সেই পান্ডা সফট টয়টা বের করলো রাইয়ান। অবাকের সাথে প্রশ্ন করলো,
‘এটা এখানে আসলো কিভাবে?’
হৃদি মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘আমি নিয়ে এসেছি। দাদীমা আমাকে বলেছিল তুমি ছোট থাকতে সবসময় এটা ধরে ঘুমাতে। বড় হওয়ার পরও তুমি এটাকে ফেলে দাওনি। তাই নিয়ে এলাম। তুমি খুশি হওনি?’
রাইয়ান মিথ্যে হেসে কথা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় অন্যমনষ্কে হাতটা নাড়াতেই তার হাত থেকে পুতুলটা নিচে পড়ে গেলো। হৃদি তাড়াতাড়ি রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে দেখলো ওটা একদম গিয়ে পড়েছে রাস্তার মাঝ বরাবর। নিঃশ্বাস না ফেলেই যেন হৃদি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলো। হৃদির এমন অবস্থা দেখে রাইয়ানও ছুটলো তার পেছন পেছন। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে হৃদি রাস্তায় চলে এলো। হঠাৎ হৃদি দেখলো একটা বড় গাড়ি আসছে পুতুলটির দিকে। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো সে। হৃদিকে থামাতে রাইয়ানও পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো। বারবার ডাকতে লাগলো, ‘হৃদি, হৃদি!’
গাড়ি অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো। পুতুলটা বুকে জড়িয়ে সেখানেই চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো হৃদি। রাইয়ান স্তব্ধ হয়ে পড়লো। যখন দেখলো গাড়িটা সময়মতো থেমে গেছে, তখন ক্লান্ত মুখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো রাইয়ান।
হৃদি বসে আছে সোফার উপর। তার শরীর ঘেঁষেই পাশে কিউট দেখতে পান্ডাটা রাখা। বা হাত খানিকটা উঁচু করে আছে সে। সেখানে কনুইয়ের দিকে চামড়া ছিলে গেছে। একটা ফার্স্ট এইড বক্স টেবিলের উপর রেখে হৃদির পাশে বসলো রাইয়ান। সিরিয়াস মুখে একবার হৃদির দিকে তাকিয়ে ওর বা হাত টেনে নিজের দিকে নিলো। তুলোতে মেডিসিন নিয়ে হৃদির হাতে লাগিয়ে দিতে লাগলো সে। হৃদি মুখে মৃদু শব্দ করলো। আড়চোখে একবার তাকালো রাইয়ান। মেডিসিন লাগানো শেষ হলে কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, ‘তোমার কি মাথা খারাপ? তুমি জানো, তুমি আজকে মরে যেতেও পারতে! এটা কি এমন জিনিস যে এর জন্য তোমাকে রাস্তার মাঝখানে গাড়ির মধ্যে এভাবে দৌড়ে যেতে হবে?’
হৃদি স্মিত হেসে বলল, ‘কারণ এটা তোমাকে তোমার বাবা দিয়েছিল। তুমি প্রকাশ না করলেও আমি জানি, এটা তোমার জন্য অনেক স্পেশাল। এভাবে কিভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি!’
রাইয়ান থমকে গেলো। আঘাত লাগা জায়গাটিতে মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিতে লাগলো হৃদি। রাইয়ান হৃদির মুখপানে তাকিয়ে রইলো।
___________________________________________________
অ্যালেন জিশানকে নিয়ে রাইয়ানের জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিলো। এই মুহুর্তে তারা আছে রাইয়ানের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নিচে। খানিক বাদে বাদামী রঙের শার্ট আর ব্লু জিন্স গায়ে নিচে এলো রাইয়ান। ড্রাইভিং সিটে অ্যালেন বসা। জিশান বসে আছে পেছনে। রাইয়ান গিয়ে বসলো অ্যালেনের পাশের সিটে। বসে থাকার কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরও রাইয়ান খেয়াল করলো অ্যালেন গাড়ি স্টার্ট করছে না। রাইয়ান হাত দিয়ে ইশারা করলো। অ্যালেন গাড়ি স্টার্ট করতে নিলো। তখনই উপর থেকে হৃদি এলো নেমে। রাইয়ানের বন্ধু সহ সবাইকে গাড়িতে দেখে থমকে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই একটা সৌজন্যতামূলক হাসি দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাই বলল সবাইকে। অ্যালেন জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি বাইরে যাবে এখন?’
হৃদি আস্তের উপর বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘গাড়িতে উঠো, আমরা তোমাকে নামিয়ে দেই।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো অ্যালেনের দিকে। হৃদি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বলল, ‘কিন্তু আমার রাস্তা তো বিপরীত দিকে পরবে।’
‘সমস্যা নেই। আমাদের অতো তাড়া নেই।’
অ্যালেন গাড়ি থেকে নেমে হৃদির সামনে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। হৃদি বুঝতে পারলো না কি করবে। রাইয়ানের বন্ধু বলে কথা! রাইয়ানের দিকে একপলক তাকিয়ে ইতস্তত করতে করতে হৃদি উঠলো গাড়িতে। অ্যালেন হৃদির দরজা লাগিয়ে দিয়ে রাইয়ানের কাছে এসে তাকে গাড়ি ড্রাইভ করতে বলল। রাইয়ান কিঞ্চিৎ অবাক হলেও বসলো ড্রাইভিং সিটে। অ্যালেন বসলো রাইয়ানের জায়গায়। গাড়ি চলতে শুরু করলো। অ্যালেন গাড়ির আয়নায় হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি ব্রেকফাস্ট করেছো?’
হৃদি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে তার আগেই অ্যালেন বলল, ‘তুমি না করে থাকলে আমরা কোন রেস্তোরাঁর সামনে আগে গাড়িটা থামিয়ে নিতে পারি।’
হৃদি বলল, ‘না না, আমি ব্রেকফাস্ট করেই বের হয়েছি।’
অ্যালেন বলল, ‘তোমার কফিশপের কফি খুবই ভালো। আমার তো একবার খেয়েই খুবই ভালো লেগেছে।’
হৃদি মৃদু হেসে বলল, ‘থ্যাংকস।’
রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই গিয়েছিলি ওর কফিশপে?’
হৃদি এবার তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে। সে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল।’
জিশান বুঝতে পারলো না কি চলছে। ওঁ একবার রাইয়ানের দিকে একবার অ্যালেনের দিকে তাকাতে লাগলো। দেখতে দেখতে হৃদি যেখানে যেতে চাইছিলো সেখানটায় চলে এলো। হৃদি গাড়ি থামাতে বলে নিচে নামলো। হাসিমুখে হৃদিকে বাই জানালো অ্যালেন। রাইয়ান বিভ্রান্ত মুখে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে রইলো। হৃদি চলে গেলো। রাইয়ান গাড়ি ঘুরিয়ে নিজেদের গন্তব্যে নিয়ে এলো। জিশান গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘অ্যালেন, তুই তো একটা লম্বা ট্রিপ থেকে ফিরে এসেই এক্সিডেন্ট করলি। তারপর পড়ে রইলি হসপিটালের বেডে। আমরা এখন পর্যন্ত কোন ইনজয়ও করতে পারলাম না। চল, আজকে তিন বন্ধু মিলে পুরো ফাটিয়ে দিবো।’
রাইয়ান ও অ্যালেন নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। জিশান গাড়ির দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই দেখলো হৃদি যেখানে বসে ছিল সেই সিটে একটা ফোন রাখা। জিশান সেটা বের করে দেখিয়ে বলল,
‘হৃদি মনে হয় ভুলে ফোন রেখে গেছে।’
অ্যালেন বলে উঠলো, ‘এখন কি হবে?’
রাইয়ান বলল, ‘সমস্যা নেই, আমার কাছে দে। আমি ওঁকে পরে দিয়ে দেবো।’
অ্যালেন বলল, ‘না হয় তোরা ভেতরে যা। আমি ওঁকে ফোনটা দিয়ে আসি। বেশি সময় লাগবে না।’
রাইয়ান আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, ‘হেই, তুই ওঁর এতো কেয়ার করছিস কেনো?’
অ্যালেন মৃদু হাসলো। খানিক সময় নিয়ে এরপর বলল,
‘আমার মনে হয় হৃদি খুবই প্রীটি একটা মেয়ে। আমার ওঁকে খুব ভালো লেগেছে।’
রাইয়ানের মুখ হা হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে বলল,
‘এই, তুই বোধহয় জানিস না হৃদি আমার……’
অ্যালেন রাইয়ানকে থামিয়ে বলল,
‘তোর স্ত্রী তাই তো! আমি জানি। কিন্তু তুই না হৃদিকে পছন্দ করে বিয়ে করিসনি! তোদের বিয়ে না নরমাল না?’
অ্যালেনের মুখে এই কথা শুনে রাইয়ান অবাক বিস্মিত মুখে তাকালো জিশানের দিকে। অ্যালেনের পেছন থেকে জিশান কানে হাত দিয়ে নিঃশব্দে সরি বলল। ইশারায় বোঝালো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে তার। রাইয়ান আবারো অ্যালেনের দিকে তাকালো। অ্যালেন বলতে লাগলো, ‘তাহলে তোদের ডিভোর্সের পর আমার হাতে তো চান্স আছেই তাই না! তাহলে আর সমস্যা কি?’
রাইয়ান কিছু না বলে গটগট করে ভেতরে চলে গেলো।
___________________________________________________
মিঁয়োকে কোলে নিয়ে সোফার উপরে বসে আছে হৃদি। রাত বাজে সবে সাড়ে আটটা। রাইয়ান বলেছিল তার আজ অফিসে একটা মিটিং আছে। আসতে দেরি হতে পারে। কিন্তু রাইয়ান যখন সময়ের আগেই চলে এলো, হৃদি খানিক অবাক হলো। ঘরে ঢুকে কোন কথা না বলেই সোজা রুমে চলে গেলো রাইয়ান। গা থেকে ফর্মাল শার্ট প্যান্ট খুলে একটা উলের পাতলা সোয়াটারের মতো পোশাক পড়ে নিলো। তারপর চলে গেলো স্টাডি রুমে। হৃদি বুঝতে পারলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। রাইয়ানের মন মেজাজ খুব একটা সুবিধের নেই আজ। প্রায় অনেকক্ষণ পর এক গ্লাস পানি নিয়ে সে আস্তে আস্তে গেলো রাইয়ানের কাছে।
রাইয়ান ল্যাপটপ খুলে মুখ শক্ত করে বসে ছিল। হৃদি ওঁর সামনে গ্লাস রেখে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। অনেকক্ষণ কিছুই বললো না। দেখলো রাইয়ানের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। তাই আস্তে আস্তে ডেকে বলল, ‘রাইয়ান, খেতে চলো।’
রাইয়ান না তাকিয়েই বলল, ‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
হৃদি বলল, ‘কেনো?’
দেখলো রাইয়ান কোন জবাব দিচ্ছে না। তারপর আবার কিছু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে রাইয়ান?’
রাইয়ান সাথে সাথেই কিছু বলছে না দেখে হৃদি ভাবলো রাইয়ানের বুঝি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হৃদি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠার কথা ভাবতেই হঠাৎ রাইয়ান অভিযোগের সুরে বলতে লাগলো,
‘আমাদের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার মি. অ্যাডাম নিজেকে কি ভাবে কে জানে! নিজে লেট করে আসায় ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং ক্যান্সেল হয়ে গেলো আর সে কিনা আমাকে বলে আমার গাফিলতির জন্যই ক্যান্সেল হয়েছে। আমি নাকি ক্লায়েন্টকে ধরে রাখতে জানি না। নিজে কখনো কোন কাজ ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারে না আর সে কিনা আমাকে কথা শোনায়। নেহাৎ কোম্পানির একজন শেয়ারহোল্ডার বলে তাকে কিছু বলতে পারছি না। এখন কিছু বলতেও পারছি না আবার নিজেকে শান্ত করতেও পারছি না। আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে।’
হৃদি মৃদু হাসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে রাইয়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা সাদা কাগজ আর কলম রাইয়ানের সামনে রেখে বলল, ‘তাহলে বাঁচাও মাথা ফাটা থেকে।’
রাইয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো হৃদির দিকে। বলল,
‘মানে?’
হৃদি মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘তুমিই না বললে তুমি কিছু বলতে পারছো না বলে নিজেকে শান্ত করতেও পারছে না। তাই এখানে বলে দাও। নিজের মনের এমন যত কথা যেগুলো তোমাকে বিচলিত করে, জ্বালাতন করে, শান্তি দেয় না সেসব তুমি লেখে ফেলো। দরকার হলে লিখে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দাও। তবুও লিখবে। তাহলেই দেখবে মনটা হালকা হয়ে যাবে। মনের মধ্যকার চাপটাও একটু কমবে।’
রাইয়ান হেসে উড়িয়ে বলল,
‘সিরিয়াসলি?’
হৃদি জোর দিয়ে বলল, ‘হুম, আমিও এমনটাই করি। এন্ড ট্রাস্ট মি, এটা খুবই এফেক্টিভ। মাঝে মধ্যে মনের কথা মন থেকে বের হওয়া দরকার। সেটা যদি কাউকে বলা না যায় তাহলে লিখে করলাম। নয়তো এমনটাই লাগবে ‘মাথা ফেটে যাচ্ছে!’
হৃদি কাগজের মাঝখানে কলম দিয়ে শিং গজানো একটা মাথামোটা কার্টুনের মতো আর্ট করলে। এরপর উপর লিখে দিলো মি. অ্যাডাম। এরপর ওটার মুখের উপর কলম দিয়ে ক্রসের মতো কেটে দিলো। এরপর রাইয়ানের দিকে বাড়িয়ে ধরলো কলম। রাইয়ান প্রথমে কলমের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর আস্তে আস্তে কলমটা ধরলো সে। হৃদির দিকে তাকালো। হৃদি ভ্রু উঁচিয়ে করতে ইশারা করলো। এরপর রাইয়ানও গাঢ় করে কার্টুনটার মুখের উপর কেটে দিলো। পরপর আরেকবারও এমন করলো। এরপর বেশ কয়েকবারই এমনটা করে শেষমেশ আনমনে মৃদু হেসে ফেললো রাইয়ান। হৃদিও হাসলো, এরপর বলল,
‘এবার তো খেতে চলো।’
রাইয়ান বলল, ‘না হৃদি, সিরিয়াসলি আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি খাবো না। আমার অনেক কাজ আছে। সেগুলো করতে হবে।’
এরপর আর কি করার হৃদিকে চলে আসতে হলো। ল্যাপটপ অন করে কাজ শুরু করলো রাইয়ান। হৃদি পুরোপুরি চলে গেলে আবারো কার্টুন আঁকা কাগজটার উপর একটা কলম নিয়ে রাইয়ান সেখানে লিখলো, ‘তুমি একটা স্টুপিড,’ ‘ইডিয়ট।’ ‘তোমার পাগলাগারদে যাওয়া উচিত মাথা মোটা।’ এরপর কাগজটা দলামোচরা করে দূরে রাখা ডাস্টবিনের দিকে নিশানা ছুড়লো। কাগজটা নিশানা বরাবর ডাস্টবিনে গিয়ে পড়লে তবেই শান্তি পেলো সে।
এরপর রাইয়ান পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার কাজ নিয়ে। গভীর রাত পর্যন্ত একটানা কাজই করে গেলো সে। ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা, বারোটা এরপর ধীরে ধীরে দুইটার ঘরে গিয়ে ঠেকলো। অবশেষে সব কাজ শেষ করলো রাইয়ান। ল্যাপটপ বন্ধ করে, ফাইলপত্র গুছিয়ে রেখে স্টাডি রুম থেকে বের হয়ে এলো। লিভিং এরিয়ার লাইট বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ হাত থমকে গেলো তার। দেখলো সুইচের পাশে একটা হলুদ রঙের ছোট্ট চিরকুট আটকানো। সেখানে লেখা,
‘আমাকে বন্ধ করার আগে পেছনে ঘুরে মাত্র সাত কদম আগাও আর ফ্রিজের দরজাটা একটু খুলো প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!’
একটা কিউট অনুরোধ করা মুখের ইমুজিও আঁকা সেখানে। রাইয়ানের ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম কৌতূহলী হাসির রেশ ফুঠে উঠলো। ধীরে ধীরে ফ্রিজের কাছে গেলো সে। ফ্রিজের দরজা খুলে দেখলো সেখানে একটা প্লেটে বড় একটা চারকোণা সাইজের স্যান্ডউইচ রাখা। যার উপরে ঝিড়ি ঝিড়ি করা চিজ দিয়ে একটা সেড মুখের ইমুজি বানানো। পাশে নীল রঙের চিরকুটে লেখা,
‘মাইক্রোভেনের উঞ্চ তাপে আমার মন খারাপ ভাব গলিয়ে দাও! গলিয়ে দাও!’
তারপর একটা করুণ মুখের ইমুজি। রাইয়ানের ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো। ওভেনে স্যান্ডউইচের প্লেট রেখে ওভেন অন করে দিলো সে। চিজ গলে গিয়ে সেড ইমুজি পুরোপুরি মিশে গেলো। রাইয়ান বের করে আনলো প্লেট। সেই সময় তার পায়ের কাছে দুলতে দুলতে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো মিঁয়ো। রাইয়ান দেখলো মিঁয়োর গলার ফিতায় একটা গোলাপি রঙের চিরকুট আটকানো। যেখানে লেখা,
‘আমি আমার প্রিয় খাবার তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। এবার তা খেয়ে আমাকে আমার বড় মনের পরিচয় দিতে দাও। হুহ!’
নিচে একটা ফু দেওয়া মুখের ইমুজি। রাইয়ান এবার হেসেই ফেললো। চিরকুটের পেছনে উল্টে দেখলো বাম দিকে এরো চিহ্ন আঁকা। রাইয়ান বামে তাকালো। দেখলো একটা কাঁচের মিনি ফ্লাক্সে দুধ ভরা। রাইয়ান সেটা হাতে নিলো। দুধ আর স্যান্ডউইচ নিয়ে টেবিলে এসে বসলো। টেবিলের মাঝখানে একটা টমেটো সসের বোতল। তার গায়েও একটা সাদা রঙের চিরকুট। লেখা,
‘এমনিতে তো আমি খাবারে এক্সট্রা ফ্লেভার যোগ করার কাজ করি কিন্তু তুমি আমাকে স্মাইলি ভাব আনার জন্যও ব্যবহার করতেই পারো।’
নিচে একটা স্মাইলি ইমুজি। রাইয়ান মৃদু হেসে স্যান্ডউইচের উপর সস দিয়ে তেমনই একটা স্মাইলি ইমুজি আঁকলো। এরপর খাওয়া শুরু করলো।
সবশেষে রুমে ঢুকে দেখলো আয়নার গায়ে আরো একটা সবুজ রঙের চিরকুট লাগানো। সেখানে লেখা,
‘তোমারই প্রতীক্ষায় একদম পরিষ্কার, ঝকঝকে, তকতকে হয়ে আছি। এবার দেখো তো ভালোভাবে। হাসিমুখে যখন এতো ভালো লাগে তখন আবার মন খারাপ করো কেন? হুম?’
এরপর একটা বাঁকা চোখের চাহনি ইমুজি। রাইয়ান হেসে সোফার উপর ঘুমিয়ে থাকা হৃদির কাছে এলো। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা গায়ে ভালো করে টেনে দিলো। হাসিমুখে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘পাগল!’
চলবে,