হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -৩৩+৩৪

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৩
ঘুমন্ত আরাবীর মুখপানে তাকিয়ে জায়ান।আরাবীর মলিন মুখশ্রীটা ক্রমশ জায়ানের হৃদয়টা ক্ষ’তবিক্ষ’ত হচ্ছে।আরাবীর সমগ্র মুখশ্রী জুড়ে যেন মায়ার ছড়াছড়ি।কেউ কি করে পারে এমন মায়াবী মুখশ্রীর অধিকারি মেয়েটাকে কষ্ট দিতে। আর যাই হোক জায়ান আর কখনও কাউকে আরাবীকে কষ্ট পেতে দিবে নাহ।জায়ান আগে যা ভালোবাসতো।তার থেকেও দ্বিগুন ভালোবাসা দিবে আরাবীকে।আরাবীকে কোনদিন ভালোবাসার কমতি অনুভব করতে দিবে না ও। জায়ান ঝুঁকে আসে আরাবীর কাছে।তারপর গলার কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,
-‘ আমার রানি।তোমায় আমি ঠিক কতোটা ভালোবাসি তা হয়তো বলে বুঝাতে পারবো না আমি।কিন্তু তোমাকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করাবো আমার এই তীব্র ভালোবাসা।তুমি আমার অতি যত্নের এক কাঠগোলাপ ফুল।যেই ফুলকে অতি যত্নে আমি আমার হৃদয়ের কুঠিরে আজীবন আগলে রাখবো। কথা দিলাম।’

জায়ান সমস্ত ভালোবাসাটুক উজাড় করে উষ্ণ স্পর্শ দিলো আরাবীর কপালে।ঘুমের ঘোরেই কেঁপে উঠলো আরাবী।নডেচডে উঠলো ও।ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে ওর।আস্তে আস্তে চোখ মেলেই নিজের ভালোবাসার মানুষটার সুদর্শন মুখশ্রী নজরে আসতেই হাসে আরাবী।লোকটা এতো সুন্দর কেন?এইযে আরাবী একবার তাকালে আর দৃষ্টি সরাতে পারে না।নজর যেন আটকে যায় লোকটার সেই কালো চোখের গভীরে।যেই চোখে আরাবী দেখতে পায় তার জন্যে অসীম ভালোবাসা।কেউ কাউকে কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে ভাবে আরাবী।তার মাঝে কি এমন আছে?জায়ান যেই পরিমান সুদর্শন।তার কাছে আরাবী মনে করে ও কিছুই নাহ।তার উপর আবার ওর নেই কোন নিজ পরিচয়।নেই বাবা মায়ের ঠিকানা।ও এতিম এটা জানার পরেও লোকটার চোখে নিজের জন্যে একফোটোও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখেনি।বরং যেন আরো আবিষ্কার করতে পেরেছে তার প্রতি লোকটার সমুদ্র সমান ভালোবাসা।যেই ভালোবাসার নেই কোন কূল কিনারা যেই কোন পরিমাণ।আরাবীকে এইভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়ান ধীরে স্বরে বলে উঠে,
-‘ কি দেখছো এইভাবে?’

আরাবী চোখের পলক ঝাপ্টায় পরপর কয়েকবার।অতঃপর বলে,
-‘ দেখি আপনায়।’
-‘ সেটাই তো কি দেখো?’
-‘ আপনি যখন আমায় দেখেন আমি কি জিজ্ঞেস করি আপনি আমায় এতো কি দেখেন?’

জায়ান হেসে ফেলে আরাবীর কথায়।তারপর হাসি থেমে আসতেই বলে,
-‘ তোমার দিকে আমি কেন এতো তাকিয়ে থাকি আমি নিজেও জানি না।তোমার দিকে তাকালে আমার চোখ ফিরাতে ইচ্ছে করে না।মনে হয় চেয়েই থাকি তোমার দিকে।পলক ফেললেও যেন মনে হয় এই তো এক সেকেন্ড নষ্ট হয়ে গেলো তোমাকে দেখতে না পেরে।’

লজ্জা পায় আরাবী ভীষণভাবে।লোকটার এইসব কথা শুনলে আরাবীর এতো লজ্জা লাগে যে ও জায়ানের দিকে তাকাতেই পারে না। লজ্জায় গালদুটোতে লালাভ আভা ছড়িয়ে পরলো।শ্যামলা মুখশ্রীতে লজ্জামিশ্রিত আভায় আরাবীকে কি যে সুন্দর লাগছে জায়ানের চোখে।জায়ান নেশালো কণ্ঠে বলল,
-‘ লজ্জা পেলে আরো ভয়ং’কর সুন্দর লাগে।তখন কিছু ভুল টুল করতে ইচ্ছে করে ভীষণভাবে।কিন্তু তুমি এখন অসুস্থ।তাই বলছি এইভাবে লজ্জা পেয়ে আমার মনের জ্বালা বাড়িও না।মনটাকে এইভাবে বেষামাল করো না।’

আরাবী ঠোঁট কামড়ে লজ্জামিশ্রিত মুঁচকি হাসে।জায়ান মুগ্ধ হয়ে দেখে সেই হাসি।তার কাছে পৃথিবীতে এক অমূল্য রত্ন হলো আরাবীর ঠোঁটের এই হাসিটুক।
^^^^^
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলিফা।সে এখন যাবে হাসপাতালে।আরাবীকে দেখতে যাবে।মেয়েটাকে যেইযে গতকাল দেখেছিলো।আর যাওয়াও হয়নি,কথাও হয়নি।এখন গিয়ে আরাবীর সাথে একটু সময় কাটিয়ে আসবে।তাই বের হয়েছে আলিফা।কিন্তু বলে না সময় খারাপ হলে যা হয় আরকি।এইযে কতোক্ষন হয়ে গেলো সে এখানে দাঁড়িয়ে। অথচ একট রিকশা অথবা সিএনজি কিছুই পাচ্ছে না।মেজাজ প্রচন্ড রকম খারাপ হয়ে আছে আলিফার।শেষে না পেরে আলিফা সিদ্ধান্ত নিলো মেইনরোড পর্যন্ত হেটেই যাবে ও।সেখানে গেলেই কিছু একটা পেয়ে যাবে।আলিফা বিরক্তিকর মুড নিয়ে হাটা ধরলো।কিন্তু বেশি দূর যাওয়া হলো না মেয়েটার।তার আগেই বাইক নিয়ে এসে আলিফার সামনে ব্রেক কষে ইফতি।ভয় পেয়ে দুকদম পিছিয়ে যায় আলিফা।দ্রুত বুকে হাত দিয়ে জোড়েজোড়ে শ্বাস নিতে থাকে মেয়েটা।ঘটনা পুরোটা ঠাওর করতেই প্রচন্ড রেগে যায় আলিফা।এদিকে আলিফার এমন অবস্থা দেখে যেন মজা পেয়েছে ইফতি। ও আলিফার দিকে তাকিয়ে হাসছে।আলিফা রেগে তেড়েমেড়ে যাহ ইফতির দিকে।রাগি আওয়াজে বলে,
-‘ আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?হ্যা?এইভাবে কেউ বাইক চালায়?আর একটু হলেই তো আমাকে মেরে ফেলতেন।অস’ভ্য লোক।কি পেয়েছেন কি আপনি?’

ইফতি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
-‘ পেয়েছেই তো।আলুর মতো গোলগাল নাদুস-নুদুস আমার আলিফাকে পেয়েছি।’

আলিফা হা হয়ে গেলো ইফতির কথায়।লোকটা কি তাকে আলুর সাথে তুলনা করলো? মানছে সে একটু খাটো।তাই বলে আলু বলবে লোকটা?আলিফার মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো।ঝাঝালো গলায় বলে উঠে,
-‘ এই এই এই আপনি আমায় আলু বললেন কেন?আমায় কোনদিক থেকে আলুর মতো দেখা যায়?আপনি একটা চরম খারাপ লোক।’
-‘ যেমনই হই না কেন।আমি তো তোমারই ডার্লিং।’
-‘ ডার্লিং মাই ফুট।’
-‘ বাট ইউ আর মাই হার্ট।’
-‘ ঘোড়ার ডিম।’
-‘ কি?তুমি খেয়ে এসেছো?’
-‘ উফফফফ!অসহ্য।’
-‘ এই অসহ্যকেই সহ্য করতে হবে ডার্লিং।’
-‘ এই একদম এইসব আজেবাজে নামে ডাকবেন না আমায়।’
-‘বাট আই লাভ টু কল ইউ বাই দিছ নেইম।’

আলিফা বুঝলো এই লোকটার সাথে কথা বলে লাভ নেই। এই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এই পাগলের সাথে কথা বলাই মানে ঝগরা করা।সে নাকি আবার ওকে ভালোবাসে।আরে গাধার বাচ্চা ভালোবাসলে যে ভালোবাসার দুটো কথা বলতে হয় সেটাও কি ওকে শিখিয়ে দিতে হবে?মনে মনে ইফতিকে ব’কে টকে ওর গুষ্টি উদ্ধার করে দিলো আলিফা।তারপর হনহন করে সামনে দিকে হাটা ধরলো। আলিফাকে চলে যেতে দেখে জিভ কাটলো ইফতি।তার গোলআলুটাকে বোধহয় আজ একটু বেশিই জ্বালিয়ে ফেলেছে ও।ইফতি দৌড়ে যায় আলিফার কাছে।তারপর আলিফার হাত ধরে থামিয়ে দেয়।বাধা পাওয়ায় বিরক্ত হয়ে তাকায় আলিফা।নাক মুখ কুচকে পিছনে তাকিয়ে বলে,
-‘ উফ,কি শুরু করলেন বলুন তো?আমার লেইট হচ্ছে।হাসপাতালে যাবো আমি।’

ইফতি এইবার শান্ত স্বরে বলে,
-‘ আমিও সেখানেই যাবো।আমার বাইকে উঠ চলো।একসাথে যাবো।’
-‘ আমি যাবো না আপনার সাথে।’
-‘ আলিফা দেখো অনেক হয়েছে। আর সিনক্রিয়েট করো নাহ।তোমারও লেইট হবে আমারও।তুমি এখানে গাড়ি পাবে না একটাও।তাই ভালোভাবে বলছি চলো।’

আলিফা ইফতির যুক্তি খুজে পেলো।ও এমনিতেও যেতো ইফতির সাথে।আর যাই হোক ভালোবাসার মানুষটার সাথে সময় কাটাতে কেইবা না চায়।আর এখন তো কোন বাধা বিপত্তিও নেই।ফিহার সাথে যে ইফতির বিয়ে হবে না তা তো গতকাল ও জেনেছেই।এটা তো একটু বাজিয়ে দেখছিলো ইফতিকে।আলিফা টু শব্দ না করে সোজা গিয়ে উঠে বসল ইফতির বাইকে।ইফতি মুঁচকি হেসে গিয়ে বাইকে উঠে বসে। বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে,
-‘ আমাকে ধরো বোসো।নাহলে পরে গিয়ে তো আলুরভর্তা হয়ে যাবে।’
-‘ আবারও আপনি আমায় আলু বলছেন।’

এটা বলেই আলিফা ইফতির বাহুতে ঘু’শি মেরে বসে।ইফতি শরীর দুলিয়ে হেসে দেয়।ইফতিকে হাসতে দেখে আলিফাও হাসে।তারপর পিছন থেকে নিবীড়ভাবে জড়িয়ে ধরে ইফতিকে।ইফতিকে মুঁচকি হেসে বাইক টান দেয়।আলিফা মাথা এলিয়ে দেয় ইফতির পিঠে। আর কোন ধরাবাধা নেই।আর কোন ভয় নেই।এইবার মন খুলে দুজন দুজনাকে ভালোবাসবে।ভালোবাসার রঙে রেঙে উঠবে দুজন।
____
মানুষ মাত্রই ভুল।পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ পাবেন না যে ভুল করেননি। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে মানুষ ভুল করে। সে ভুল অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করে বা অন্যের প্রতি অবিচার করে। অন্যায় বা ভুলের ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় পাপবোধ বা অনুশোচনা। পাপবোধ বা অনুশোচনায় সাড়া দিয়ে একজন মানুষ যখন নিজের ভুল, ক্ষ’তিকর, আক্র’মণাত্মক বি’দ্বেষাত্মক ও ধ্বং’সাত্মক আচরণকে সংশোধন করে তখন এই পাপবোধই আত্ম উন্নয়নের সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাই নিজের প্রতি বা মানুষের প্রতি কোনো ভুল বা অন্যায় করলে অবশ্যই অনুশোচনা করা উচিত। অনুশোচনাই মন্দকে ভালোয় রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে।কোনো অপরাধ বা পাপ করে ফেললে আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করুন। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করুন। তওবা করুন। আপনার পাপ মোচনের জন্যে করুণাময়ের সাহায্য চান। আপনি তো জানেন স্রষ্টা ক্ষমাশীল। ক্ষমা হচ্ছে স্রষ্টার সবচেয়ে বড় গুণ। আপনার যে কোনো পাপকে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন। তাই আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করুন। তওবা আপনাকে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ ও সম্ভাবনাময় করে তুলবে।

হাসপাতালে এসে আরাবীর কেভিনের সামনে দাড়িয়ে লিপি বেগম।চেহারায় তার মলিনতার ছাপ।কাল রাত একফোটা ঘুমাননি তিনি।তার ভীতরে অপরাধবোধ যেন তীব্রভাবে জেগে উঠেছে।মেয়েটাকে ছোটো থেকে পেলে বড় করেছে ও তার নিজ দুইহাত দিয়ে।আর সেই মেয়েকে কি করে এতোট কষ্ট দিয়ে ফেললেন উনি। কি করে পারলেন এমন করতে তিনি এমন করতে?অনুশোচনায় আজ দ’গ্ধ হয়ে ভীতরটা তার পু’ড়ে যাচ্ছে।কিভাবে ক্ষমা চাইবেন তিনি আরাবীর কাছে তাই ভাবছেন। তিনি যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত।তখন আরাবীর কেভিন থেকে বের হয়ে আসে জায়ান।ভীতরে আলিফা,নূর আছে আরাবীর কাছে।তাই জায়ান একটু নিচে যাচ্ছিলো।এমন সময় লিপি বেগমকে দেখে জায়ান থমকে দাঁড়ায়।পরমুহূর্তেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে জায়ানের।সেদিন কিছু বলতে না পারলেও আজ আবার তাকে দেখে কিছুতেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ও।জায়ান শক্ত কণ্ঠে বলে,
-‘ কি চাই?কেন এসেছেন এখানে?’

জায়ানের এমন কণ্ঠে কেঁপে উঠলেন লিপি বেগম।থেমে থেমে বলেন,
-‘ আ..আরাবী কেমন আছে বাবা?’
-‘ সেটা জেনে আপনি কি করবেন?’

লিপি বেগম কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলেন,
-‘ আমি তো ওর মা….’

জায়ান লিপি বেগমকে থামিয়ে দিলো সাথে সাথে।রাগে হিসহিস করে বলে,
-‘ থামুন।আর একবার নিজেকে আমার আরাবীর মা বলবেন নাহ।আপনি যদি ওর মা-ই হতেন। তাহলে আজ আমার আরাবীর এই অবস্থা হতো না।আমি সেদিন চুপ ছিলাম।কারন বাবা ছিলেন।আর তিনিই যা করার করেছেন।আর বডদের উপরে কথা বলা আমার বাবা মা আমায় শিক্ষা দেননি।কিন্তু আজ আর আমি চুপ করে থাকবো না।আপনি আমার আরাবীর ধারে কাছেও আসার চেষ্টা করেন।ভুলে যাবো আপনি বয়সে আমার বড়।তাই বলছি চলে যান এখান থেকে।’

লিপি বেগমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে।এমন সময় আসল ফাহিম আর ইফতি।ওরা কিছু খাবার আনতে গিয়েছিলো নিচে।ফাহিম ওর মাকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়।পরক্ষণে ও নিজেও রেগে যায়।লিপি বেগমের কাছে গিয়ে রাগি গলায় বলে,
-‘ কি চাই এখানে?কেন এসেছো তুমি?আর কতো কষ্ট দিতে চাও আমার বোনটাকে?এইবার ক্ষান্ত হও।আর নিচে নেমো না মা।নাহলে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার মা।চলে যাও এখান থেকে।আরাবীর আশেপাশে তুমি আর তোমার মেয়েকে যেন আমি না দেখি।চলে যাও।’

শেষের কথা বেশ ধমকের স্বরে বলল ফাহিম।লিপি বেগম কেঁপে উঠলেন।তারপর কোন কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আসে।তার চোখের জল আজ বাধা মানছে।তার পাপের শাস্তি পাচ্ছেন তিনি।আজ নিজের করা পাপের জন্যে সব খুইয়েছেন।স্বামি,সন্তান সব।আজ কেউ নেই তার পাশে।তিনি একা। বড্ড একা।এই একাকিত্বে অনুশোচনাবোধ যেন তাকে আরো গিলে গিলে খেয়ে নিচ্ছে। মানুষ ভুল করে।কিন্তু তিনি এতো বছর ধরে যা করে এসেছেন তা ছিলো আরাবীর প্রতি তার করা অন্যায়।এখন কি আর কোনদিন সে ক্ষমা পাবে না তার এই অন্যায়ের?
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৪
-‘ আম্মু এসেছিলো?’

আজ সেরে নিয়ে কেভিনে প্রবেশ করতেই আরাবীর শান্ত কণ্ঠ শুনে থমকে যায় জায়ান।তারপর জোড়ে নিশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
-‘হুম এসেছিলেন তিনি।’
-‘ ভাই আর আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন তাই নাহ?’

ভ্রু-কুচকে জায়ান বলে,
-‘ তো?তুমি কি চাইছিলে?’
-‘ কিছুই নাহ।শুধু এমনিতেই বললাম।’

জায়ান এইবার আলিফাকে বলে,
-‘ ওকে খাইয়েছো?’
-‘ কোথায় খেলো ভাইয়া?অর্ধেকখানি স্যুপ খেয়ে বলে আর খাবে না।’

আলিফার মুখে সন্তোষজনক কথা না শুনতে পেয়েই রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জায়ান আরাবীর দিকে।আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
-‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?’
-‘ এটা কি শুনছি আমি?’
-‘ এখন খেতে না পারলে আমি কি করব?’
-‘ না পারলেও খেতে তোমাকে হবেই।’
-‘ এটা কেমন কথা?’
-‘ এটা আমার কথা।’

আরাবী মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো।এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে তর্ক করে লাভ নেই।সে জানে এখন জোড় করে এক বাটি স্যুপ গেলাবে জায়ান।তারপর এক ডজন মেডিসিন তো আছেই।এদিকে কেভিন থেকে নূর আর আলিফা বের হয়ে গেলো।জায়ান এইবার আরাবীর পাশে গিয়ে বসল।তারপর স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে বলে,
-‘ দেখি মুখ এদিকে ঘোরাও।এইটা পুরো শেষ কর‍তে হবে।’

আরাবী কোন কিছু না বলে চুপচাপ জায়ানের হাতে স্যুপটুক খেয়ে নিলো।খাওয়া শেষে জায়ান যত্নসহকারে আরাবীর মুখ মুছিয়ে দিলো তারপর মেডিসিন ও খাইয়ে দিলো।আরাবী মুগ্ধ চোখে জায়ানকে দেখছে।লোকটার এই ছোটো ছোটো কেয়ারিংগুলো যে আরাবীর মনে ঠিক কতোটা প্রশান্তি দেয় তা ও বলে বুঝাতে পারবে না।আরাবী মুগ্ধ গলায় বলে,
-‘ আপনি এতো ভালো কেন?’

মেডিসিন গুলো গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিলো জায়ান।আরাবীর কথা শুনে মুঁচকি হাসে ও।তারপর আরাবীর দিকে ফিরে ওর দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো।আরাবী চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করলো।জায়ান সরে এসে মোলায়েম গলায় বলে,
-‘ তুমি মানুষটাই এমন যে তোমার সাথে আমি শক্ত হতে পারি না।তোমাকে রাগ দেখাবো কেন?তোমাকে দেখলেই আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়।মন চায় আদরে আদরে তোমায় ভরিয়ে ফেলি।’

লজ্জায় লাল হলো আরাবী।শ্বাস হয়ে আসল ভারি।আরাবীর কষ্ট হলেও ও এগিয়ে গিয়ে মাথা গুজল জায়ানের বুকে।একহাতে জায়ানের গায়ের শার্টটা খামছে ধরে বলে,
-‘ আমি তো আপনারই।’
-‘ আমি জানি তুমি আমার।আর আজীবন আমারই থাকবে।’
-‘ জায়ান?’
-‘ হু!’
-‘ শুনছেন?’
-‘ হু! বলো।’
-‘ ভালোবাসি।’

জায়ান তৃপ্তির হাসি হাসলো।তারপর প্রেমময়ী কণ্ঠে বলে,
-‘ আমিও ভালোবাসি। প্রচন্ড,অতিরিক্ত,সীমাহিন।’

~~~~
হাসপাতালের করিডোরে মন খারাপ করে বসে আছে ফাহিম।সেটা লক্ষ করে নূর গিয়ে বসল ওর পাশে।তারপর বলে উঠে,
-‘ মন খারাপ?’

আচমকা নূরের গলার স্বরে একটুখানি চমকাল ফাহিম।অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে উদাস গলায় বলে,
-‘ নাহ মন খারাপ কেন হবে?’
-‘ আমি যে দেখছি আর অনুভব ও করছি আপনার মন ভীষণভাবে, বা’জেভাবে খারাপ।’

হাসল ফাহিম বলে,
-‘ তা কেন?’
-‘ এইযে আপনার চোখ দুটোই তো বলে দিচ্ছে।’
-‘ তুমি যে মানুষের চোখ পড়তে জানো আগে তো জানতাম নাহ।’

নূর আনমনা হয়ে বলে,
-‘ আমি যে গোটা আপনিটাকেই পড়তে জানি সেটাও তো জানেন নাহ। আপনায় যে আমি পছন্দ করি সেটাও তো জানেন নাহ।’

আধো আধো কথা শুনে পুরো কথার ঠাওর করতে পারলো না ফাহিম।প্রশ্ন করল,
-‘ কিছু বললে?কে কি জানে নাহ?’

থতমত খেয়ে গেলো নূর।প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে আমতা আমতা করে বলে,
-‘ ও কিছু না।আপনি বলুন নাহ মন খারাপ কেন?’

ফাহিম উদাস হয়ে গেলো।নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলে,
-‘ মন খারাপ নাহ।শুধু কিছু সময়ের জন্যে আমার মস্তিষ্কটা এলোমেলো হয়ে আছে।কি হচ্ছে?কি করবো?কিচ্ছু বুঝতে পারছি নাহ।আজ মা এসেছিলো আরাবীর সাথে দেখা করতে।আমি তাকে ধমকে ধামকে অনেক কটু কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছি।কিন্তু এখন মন মানছে না।আমি উনার চোখে মুখে স্পষ্ট অনুশোচনা দেখতে পেয়েছি।কিন্তু আমি কি করতাম?এছাড়া উপায় নেই।আমি যদি এখন মায়ের পক্ষ নেই।আরাবী আমায় ভুল বুঝবে।ও হয়তো ভাববে মা এতো অন্যায় করার পরেও আমি উনার পক্ষ নিচ্ছি।মানে আমি ওর সাথেও অন্যায় করছি। আমি আমি বুঝতে পারছি না আমি কি করবো।আমার ঠিক কি করা উচিত। ‘

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে ফাহিম।নূর এইবার নরম গলায় বলে,
-‘ কিছুই করতে হবে না।কোন প্রকার স্ট্রেস নিবেন নাহ।শুধু নিজেকে সময় দিন।একটু একান্তে নিজের সাথে নিজেই সময় কাটান।মন ফ্রেস করুন।তারপর আস্তে ধীরে সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি চান।আর যেহেতু আপনি বলছেন আন্টি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।তার অনুশোচনা হচ্ছে।তাহলে অবশ্যই তাকে আর একবার সুযোগ দেওয়া যায়।আর রইলো ভাবির কথা।আমি এই কয়দিনে যেটুকু বুঝেছি ভাবি এতোটা পাথর মনের না।আন্টি মন থেকে ভাবির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি নিশ্চয় আন্টিকে ক্ষমা করে দিবেন।আপনি এতো চিন্তা করবেন না।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ফাহিমের মনে নূরের কথাগুলো বেশ গাঢ দাগ কাটল।মেয়েটা তাকে এতোটা ভালোভাবে বুঝলো কিভাবে?কি করে ওর মনের ব্যাকুলতাগুলো অনায়াসে বুঝে ফেলল।ফাহিমের আচমকাই কেন যেন নূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করল।মেয়েটাকে কোনদিন ফাহিম একটু ভালোভাবে দেখেনি।ফাহিমকে এইভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূর লজ্জা পেলো।আঁখি পল্লব ঝাপ্টে মাথা নিচু করে নিলো। কাঁপা গলায় বলে,
-‘ আমি আসছি চা নিয়ে। আপনি এখানে বসুন।’

-‘ নূর!’ ডেকে উঠে ফাহিম।থেমে যায় নূর।কি যেন ছিলো ওই ডাকটায়।নূরের সর্বাঙ যেন কেঁপে উঠেছে ওই একটা ডাকে।নূর পিছনে ফিরে তাকায় না।ফাহিম নিজে এসেই নূরের হাত ধরে ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।অবাক হলো নূর।ফাহিম সেদিকে না তাকিয়ে বলে,
-‘ তুমি বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।’

ফাহিম বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো।নূর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফাহিম তার হাত ধরেছে।তাও স্বইচ্ছায়।এই প্রথম ফাহিম নিজ ইচ্ছায় ওকে একটু হলেও স্পর্শ করেছে।নূর মুঁচকি হাসল।বিরবির করে বলে,
-‘ আপনাকে তো আমার প্রেমের জালে ধরা দিতে হবেই মি.ভদ্রলোক।তৈরি থাকুন আপনি।’

_____
জিহাদ সাহেবের সাথে হাসপাতালের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে এসেছে জায়ান।তারা দুজন মুখোমুখি হয়ে বসে।জায়ান দুটো কফি অর্ডার করল।নীরবতা ভেঙে জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ জরুরি কিছু বলবে বাবা?আরাবী ঠিক আছে তো?’
-‘ চিন্তা করবেন না আংকেল।আরাবী ঠিক আছে।’
-‘ তাহলে?’

জায়ান কিছুক্ষন চুপ থাকলো।মনের মাঝে চলা কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
-‘ আরাবীর বাবা আপনি।জন্মদাতা না হলেও আপনিই ওর বাবা।আমিও তাই মানি।রাগ করবেন না বাবা।তবে যাই হোক সেদিনের ঘটনা আরাবীর মনে ভীষণভাবে আঘাত করেছে।ও এখন প্রায় আমাকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করে।নিজেকে এতিম মনে করে ও। আমি নাকি ওকে ত্যাগ করবো।ওকে আমি অনেক বুঝিয়ে এটুকু বোঝাতে পেরেছি যে আমি ওকে কোনভাবেই ছাড়বো না।এটা মেনে নিলেও।আরাবী নিজেকে এতিম বলেই বার বার গন্য করছে।ও নাকি কারো নাজা’য়েজ সন্তান।কারো পাপের ফল ও।তাই তো ওকে নর্দ’মার মাঝে ফেলে দেওয়া হয়েছে।এসব বলছে বার বার।’

জিহাদ সাহেবের চোখ ভিজে উঠলো।মেয়ের এতো কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন নাহ।জায়ান উনার হাতে হাত রেখে বলে,
-‘ কাঁদবেন না বাবা।এখন কান্না করার সময় নয়।আমাদের আরাবীকে এই ভুল থেকে সরিয়ে আনতে হবে।যাতে ও এইভাবে নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে।’

জিহাদ সাহেব নিজেকে শান্ত করলেন।বলেন,
-‘ তো তুমি কি চাইছো?’
-‘ আমি আরাবীর আসল বাবা মাকে খুঁজে বের করতে চাইছি।জীবত হোক বা মৃ’ত। শুধু তাদের পরিচয় আর অস্তিত্বের সন্ধান করতে চাইছি।আরাবীকে তার পরিচয় মিলিয়ে দিতে চাইছি।এখন আমায় আপনার সাহায্য প্রয়োজন বাবা।’

জিহাদ সাহেব অবাক হলেও।সবটা বুঝে আসতেই নিজেকে সামলে নেন।মেয়ের ভালো যেটাতে হবে তিনি তাই করবেন।তিনি নরম নরম গলায় বলেন,
-‘ আমায় কি কি করতে হবে তুমি শুধু আমায় বলো।আমি আমার মেয়ের ভালোর জন্যে সব কর‍তে রাজি।’

জিহাদ সাহেবের সাপোর্ট পেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললো জায়ান।যাক এইবার আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না।আসল রহস্যের উন্মচন তো তাকে করতেই হবে।যা করেই হোক।আরাবীর জন্যে দুনিয়া এফো’ড় ওফোড় করে দিতেও রাজি জায়ান।শুধু তার কাঠগোলাপ ভালো থাকলেই হবে।

#চলবে__________

🥺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here