#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৯
‘ ফুপা ওরফে রাশেদুল শামিম শেখই হলো আরাবীর জন্মদাতা পিতা।’
জায়ানের ঠান্ডা কণ্ঠে বলা এই এক বাক্যের শব্দটা যেন পুরো সাখাওয়াত বাড়িতে বজ্রপাত ঘটাল।প্রচন্ডরকম ছটকা খেলেন সবাই।এযে মোটেও আশা করেননি কেউ।আরাবী মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে।জায়ানের বলা বাক্যটি তার বুকে তীব্র ঝড় তুলে দিচ্ছে।এই লোকটা কিভাবে ওর বাবা হতে পারে?কিভাবে?আরাবী কাঁপা কণ্ঠে বলে,’ এ..এসব আপনি কি বলছেন জায়ান? উনি আমার…মানে আমার বা..বাবা কিভাবে?’
জায়ান শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’ এই সত্যিটাই তোমাকে মানতে হবে আরাবী।কষ্ট হলেও মানতে হবে।এই জঘ’ন্য নিকৃষ্টতম মানুষটাই হলো তোমার আসল জন্মদাতা।’
নিহান সাহেব বলেন,’ কিন্তু শামিম কিভাবে আরাবীর বাবা হবে? শামিম তো আমেরিকায় থাকে।মানে কিভাবে কি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।তুমি সবাইকে সবটা পরিষ্কারভাবে বলো জায়ান।’
মিথিলা চেঁচিয়ে উঠলেন আকষ্মিক,’ থামো তোমরা।কি শুরু করলে তোমরা হ্যা? এই জায়ান যা বলছে সব মিথ্যে।সব মিথ্যে।সব এই মেয়েটার ষড়যন্ত্র।’
শেষ কথাটা আরাবীকে উদ্দেশ্য করে বলল মিথিলা।জায়ান মিথিলার কথায় তাচ্ছিল্যভরা হাসল।তারপর একটা কাগজ বের করে সবার সামনে তুলে ধরে বলে,’ এই হলো ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। যা ফুপা দেশের আসার পরের দিনই আমি খুব সাবধানে করিয়ে নিয়েছি।কি বলেন তো প্রমান ছাড়া তো আবার কেউ কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না।’
আরাবী হাত এগিয়ে দিল ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টটা চাইলো।জায়ান আরাবীকে সেটা দিল।আরাবী পুরো রিপোর্টটা ভালোভাবে পরল।যেখানে স্পষ্ট তার আর শামিমের ডিএনএ মেচ হয়েছে লিখা আছে।’
রিপোর্টটা পরে আরাবী জায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,’এই লোকটা আবার বাবা হলে।আমার মা কোথায় জায়ান?’
‘ মা আর এই দুনিয়াতে নেই আরাবী।’
কথাটা শুনে দুকদম পিছিয়ে গেল আরাবী।বহু কষ্টে বলে,’ কি..কিভাবে হলো এসব?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জায়ান।আর হোয়ালি না করে একে একে অতীতের সবকিছু খুলে বলল সবাইকে।সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পরল আরাবী।আলিফা আরাবীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল।ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীর কাছে গিয়ে অপরাধি কণ্ঠে বলে,’ আমায় ক্ষমা করে দিও আরাবী।আমি কিভাবে যেন এই পাপ কাজটা করে ফেললাম।আমায় মাফ করে দিও।’
আরাবী চোখ বন্ধ করে বড় নিশ্বাস নিলো।তারপর দৃষ্টি তাক করল ডা.রোজির দিকে।শান্ত গলায় বলে,’ নিজেকে আর দোষারোপ করবেন না আন্টি।এই দুনিয়ায় সবাই টাকার পাগল।টাকার বিনিময়ে মানুষ মানুষ’কে মে’রে ফেলে।তাতে ওদের বিন্দুমাত্র আফসোস হয় না।আর আপনি তো তাও নিজের পাপ বুঝতে পেরেছেন।অনুশোচনায় ভুগেছেন।আমি বেঁচে আছি জেনেও ওই নি’কৃষ্ট লোকটাকে কিছু জানান নি।নাহলে যে ওই লোকটা আমাকেও মেরে ফেলত।আমি তো আরও আপনার কাছে ঋণি হয়ে গেলাম।’
আরাবী এইবার জায়ানকে বলে,’ ওই লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন জায়ান।এই লোকটা কেন করল এসব আমার মায়ের সাথে?কেন আমাকে ম’রার জন্যে ফেলে এসেছিল ময়লার আবর্জনার স্তুপে?’
জায়ান রাগি গলায় শামিমকে বলে,’ শুনেছেন? ও কি বলল?কেন করেছিলেন এসব? আর হ্যা? অবশ্যই মিথ্যা কথা বলবেন নাহ।সবাই এখন আপনার আসল রূপ দেখে নিয়েছে।’
শামিম চুপ করে আছে।আহানার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নিজের বাবার এমন জ’ঘন্য রূপ যে এভাবে ও জানতে পারবে ভাবেনি কোনদিন।আহানা একপা একপা করে শামিম সাহেবের কাছে যায়।শামিম ওকে দেখেই আঁতকে উঠেন।মেয়ের চোখের অশ্রু যে উনি দেখতে পারেন না।শামিম অস্থির হয়ে বলেন,’ মা তুই কাঁদছিস কেন?’
‘ এখনও বলবে আমি কাঁদছি কেন?আমার বাবা যে এতো বড় একজন অপরাধি এসব জেনেও কি আমায় কষ্ট পেতে তুমি বারণ করছ?’
‘ ওরা মিথ্যে বলছে মা।তুই তো জানি…’
শামিমকে থামিয়ে দিল আহানা।ধরা গলায় বলে,’ আর মিথ্যে বলো না বাবা।দয়া করে সবাইকে সবটা বলে দেও। কেন তুমি এমন করেছ?কেন এইভাবে একজন মানুষের জীবনটা ধ্বং’স করে দিলে?’
শামিম মেয়ের চোখে জল দেখে আর কোন কথা বাড়ালেন না।সোফায় বসে পরলেন।বাইশ বছর পর যেহেতু অতীত সবার সামনে এসে পরেছে তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই।শামিন বলতে শুরু করলেন,’ তখন আহানা সবে জন্ম নিয়েছে।মিথিলা আর আমার সংসার বেশ সুখেরই ছিল।হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে ফোন আসে বাবা না-কি খুব অসুস্থ।আমায় দেখতে চান।আহানা যেহেতু ছোটো আর মিথিলাও অসুস্থ তাই ওদের ছাড়া আমি একাই বাংলাদেশে আসলাম।বাংলাদেশে এসে বাবাকে সুস্থ্য করার জন্যে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগলাম।এভাবে একজন হার্ট সার্জনের সাথে দেখা হলো আমার।সে আর কেউ না আরাবীর মা মানে ইরা ছিল।বাবার চিকিৎসা সূত্রে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবে জমে গেল।একসময় বেশ গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপরেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।এদিকে মিথিলার সাথে যোগাযোগ হলেই সে জিজ্ঞেস করত আমি কবে ফিরব।আমি ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কারন দিয়ে দিতাম।মিথিলার জন্যে আমার খারাপ লাগত।হাজার হোক ওকে ভালোবাসি তো।কিন্তু আরেকদিকে ইরার বাবার বিশাল সম্পত্তির লোভটাও সামলাতে পারেনি।ইরা ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।ওকে বিয়ে করলেই ওই সব সম্পত্তির মালিক আমি হবো।এর মাঝে বাবা সুস্থ্য হলো বাবাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম।বাবা বলল ছেলে মানুষ তিন চারটা বিয়ে করলেই বা সমস্যা কোথায়?যেই ভাবা সেই কাজ আমি বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গেলাম ইরার বাসায়।কিন্তু ওর বাবা সম্পর্কটায় মত দিলেন না সাথে সাথে।তিনি কিছুদিন সময় চাইলেন। অনেক রাগ লাগছিল আমার।কিন্তু ইরার জন্যে আমায় ভালো সাজার অভিনয় সাজিয়ে যেতে হলো।কিন্তু কে জানত এইটাই আমার জন্যে কাল হবে?ইরার বাবা লোক লাগিয়ে আমার খোজখবর নিয়ে জানতে পারলেন আমি বিবাহিত।ইরা সেসব শুনে অনেক ভেঙে পরেছিল।আমি আবারও ওকে মিথ্যে বললাম।বললাম ওর বাবা আমায় পছন্দ করেননা।ওর বিয়ে যাতে আমার সাথে না হয় এই জন্যেই তিনি ওকে এসব মিথ্যে কথা বলেছে।আরও অনেক মিথ্যে অজুহাত দিলাম।ইরা আমার প্রেমে এতোই অন্ধ ছিলো যে আমার এইসব মিথ্যেকে বিশ্বাস করে নিলো।ওকে বললাম চলো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।কারন বাবা যেমনই হোক সন্তানকে তো আর ফেলে দিতে পারেননা।তাই বিয়ে একবার করে নিলে আজ হোক বা কাল মেনে নিবেনই।ইরাও আমার কথায় সম্মতি দিয়ে পালিয়ে গেল আমার সাথে।বিয়ে করে নিলাম আমরা।তারপর যখন ইরার বাবার কাছে গেলাম।তিনি ইরাকে ত্যাজ্য সন্তান করে দিলেন তাড়িয়ে দিলেন ওকে।এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন।অনেক প্ল্যান সাজাতে লাগলাম কিভাবে ইরার বাবাকে হাত করব।এর মাধ্যেই ইরা একদিন আমায় জানাল ও মা হতে চলেছে।এটা আমি চাইনি সন্তানটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।তবে বাবা আমায় বুদ্ধি দিল এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে না।মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি হওয়ার সংবাদ পেলে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।আমিও তাই সেই কথা শুনে ইরাকে নিয়ে ওর বাবার কাছে গেলাম।স্বভাবমতো তাই হলো মেয়েকে দেখে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি।সময় ভালোই কাটছিল কিন্তু ইরার বাবা তখনও আমায় পছন্দ করতেন না।শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতেন।একদিন মিথিলার সাথে কথা হয় আমার।আহানার অবস্থা নাকি অনেক খারাপ।আই সি ইউ তে ভর্তি।মেয়ের আমার এই অবস্থার কথা শুনে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।ইরাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাই আমেরিকা।এইটাই সর্বনাশ হয়ে দাঁড়াল আমার জন্যে।আমার অনুপস্থিতিতে ইরার বাবা আমার সকল বিরুদ্ধে সকল প্রমান একসাথে করে ইরাকে সব বলে দেয়।আহানা সুস্থ্য হতেই আমি আবার দেশে ফিরে আসি।তখন ইরার গর্ভাবস্থার শেষ মাস চলছিল।আমি আসতেই আমার সাথে ওর তুখোর ঝগড়া লাগল।আমি এতোসব সহ্য করতে না পেরে ওর গায়ে হাতও তুললাম।মারধোর করলাম ওকে।তারপর বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেলাম।ইরার বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না।ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন।সেদিনই ইরার পেইন উঠে বাড়ির কাজের মেয়েটা ইরাকে নিয়ে হস্পিটাল যায়।আমি বাড়ি এসে সেটা জানতে পারি।আর তখনই হাসপাতাল পৌছাই।হাসপাতালে এসেই রোজির সাথে আমার দেখা হয়।ওর থেকে জানতে পারি ইরা আর নেই।আর এদিকে ইরার বাবাও ইরাকে সম্মত্তি লিখে দেয়নি তখনও।তাই আমিও সম্মত্তি পেতাম নাহ।তাই রোজিকে টাকা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ রাখতে বললাম বাচ্চাটা সন্তান বেঁচে আছে।বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলতে বলে আমি চলে যাই ইরার লাশ নিয়ে।বাড়িতে ইরার লাশ নিয়ে যাই সাথে একটা ম’রা বাচ্চার ব্যবস্থা করে নিয়ে যাই।ইরার বাবাকে জানানো হয়।তিনি দ্রুত ছুটে আসেন।ইরাকে দাফন করা হয়।ইরার বাবা সম্পূর্ণ দোষ চাপালেন আমার উপর। আমি নাকি ইরাকে মেরেছি।পুলিশ কেইস ও করেন।কিন্তু উপযুক্ত প্রমান না পাওয়ায় ওরা আমার কিছুই করতে পারেন নাহ।আমারও ফিরার সময় হয়ে যাচ্ছিল।এখানে থেকেই বা কি লাভ?কিছুই তো পায়নি। এর কয়েকদিন পরেই আমি আমেরিকা চলে যাই।পরে বহুদিন পর জানতে পারি ইরার মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কয়েকদিন পরেই নাকি মারা যান।ইরার বাবাও একা হয়ে পরেন।তার বছর খানিক পর তিনিও মারা যান।আমি আবার ফিরে আসি সম্পত্তির জন্যে। কিন্তু সেবারও আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়।কারন ইরার বাবা তার সকল সম্মতি বিক্রি করে স্কুল, হাসপাতাল,এতিমখানা তৈরি করে গিয়েছে ইরার নামে।বাদ বাকি টাকা অন্যান্য এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন।সেবারও আমার হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।কিছুই করতে পারিনি।ভেবেছিলাম এইসব অতীতের সত্য কোনদিন কেউ জানতে পারবে না।কিন্তু…কিন্তু জায়ান তুই?তুই তা হতে দিলি না।দিলিনা আর লুকায়িত অতীতকে লুকিয়ে রাখতে।আমায় অন্ধকার গর্তের থেকে টেনেটুনে বের করেই আনলি।
#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।আজকের পর্বটা কেমন হয়েছে অনুভুতি জানাবেন সবার।#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৫০
পিনপতন নিরবতার মাঝে হঠাৎ তীব্র চ’ড়ের শব্দে মুখোরিত হয়ে গেল চারপাশ।শামিম অবাক হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।আজ এতো বছরের সংসার জীবনে মিথিলা আর তার কোনদিন ঝগড়া হয়নি।মিথিলা খুবই স্বামিভক্ত একজন মহিলা।শামিম যা বলতেন তিনি তাই করতেন।আজ সেই মিথিলা নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামির গায়ের হাত তুলেছেন।তাও এতোগুলো মানুষের সামনে।শামিম সাহেব অবাক কণ্ঠে বলেন,’ এটা তুমি কি করলে মিথু?’
মিথিলার চোখে মুখে তীব্র রাগের আভা ছড়িয়ে পরেছে।ক্রোধে ফেটে পরছেন তিনি।শামিমের কথা শুনে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন,’ চুপ একদম চুপ।কোন কথা বলবি না তুই।’
শামিমের আত্মা কেঁপে উঠল মিথিলার এমন ক্রোধান্বিত কণ্ঠ শুনে।এই মিথিলাকে তিনি চেনেন না।শামিম কাঁপা গলায় বলে,’ মিথু তুমি….’
মিথিলা রাগে থরথর করে কাঁপছেন।তিনি বলেন,’ আমায় আর কিছু বলবি না তুই।তোর মতো মানুষের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।লজ্জা করছে না তোর?একটুও কি লজ্জা করছে নাহ?আরে তোর এই জঘন্য কির্তীকালাপ শুনে তো ঘৃ’নায় আমার নিজেরই ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।আরে সবাই ভাবে আমি নাকি একজন খারাপ মানুষ।কিন্তু তুই তো আমার থেকেও নিকৃষ্ট রে।এতোদিন ভালো সাজার এতো নিখুঁত অভিনয় করে গিয়েছিস আমাদের সাথে।আজ তোর এই মুখোশের আড়ালে এমন জঘন্য রূপ আছে তা জায়ান আমাদের না জানালে তো আমরা জানতেই পারতাম নাহ।কি করে পারলি রে তুই?ইরা মেয়েটা নাহয় পরের মেয়ে।তাকে শুধু স্বার্থের লোভে বিয়ে করেছিস।কিন্তু আরাবী তো তোর নিজের জন্মের সন্তান।তোর রক্ত ও?কিভাবে ওর সাথে এমন করতে পারলি? তোর আহানা তোর মেয়ে হলে তো আরাবীও তো তোর মেয়ে।তাহলে কিভাবে পেরেছিলি ওই সদ্য জন্মানো বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলার কথা বলতে?বুক কাঁপেনি তোর একবারও?এতোটা পাষাণ তোর হৃদয়।আমার তো নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছে।যে তোর মতো জা*নোয়ারকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।’
মিথিলা বেগম শেষের কথাটুক বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। কষ্টে তার বুকে চি’রে যাচ্ছে।সাথি আর মিলি বেগম গিয়ে উনাকে ধরলেন।মিলি বেগম বলে উঠেন,’ আপা শান্ত হন।কাঁদবেন না আপা।’
‘ ভাবি…ভাবি ও কি করে পারল এমন করতে।আমার কষ্ট হচ্ছে ভাবি।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমি সহ্য করতে পারছি না ভাবি।’
মিথিলা বেগম লুটিয়ে পরলেন সাথি বেগমের বুকে।সাথি আর মিলি দুজনে তাকে ধরে সোফায় নিয়ে বসালেন।আহানা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শামিমের কাছে।শামিম ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।যতো যাই হয়ে যাক না কেন?তিনি যতোই খারাপ হোক না কেন? তবে একটা চিরন্তন সত্য যে তিনি মিথিলা আর আহানাকে অনেক ভালোবাসেন।আজ সেই প্রিয়তমা স্ত্রী আর নিজের সন্তানের চোখে নিজের জন্যে এতো ঘৃনা তিনি সহ্য করতে পারছেন না।বুকে ব্যথা করছে তার।মাথাটা ভণভণ করছে।আহানার চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে।ও কান্নারত কণ্ঠে বলে,’ আগে আমি সবাইকে গর্ভে বুক ফুলিয়ে বলতাম আমার বাবা পৃথিবীর বেস্ট বাবা।শতো কোটিবার তোমার বুকে মাথা রেখে বলেছি,আই লাভ ইউ বাবা। ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।কিন্তু আজ তোমার সম্পর্কে জেনে আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।আসলে তোমার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বিধছে। আজ শুধু এটুকুই বললাম আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ বাবা।ইউ আর দ্যা ওয়ার্স্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’
আহানা দৌড়ে চলে গেল।আহানা প্রতিটি বাক্য ধা’রাল ছু’ড়ির ন্যায় আ’ঘাত করেছে।তার মেয়ে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা বলে গেল।তিনি সত্যিই তো পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা।তিনি যা করেছেন একজন বাবা তা কোনদিন করতে পারেন না।শামিম সাহেব তাকালেন আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।তবে সেই দৃষ্টিতে যে এক সমুদ্র ঘৃ’না মিশে আছে তা খুব ভালোভাবে জানেন তিনি।আরাবীর মুখশ্রীটা ভালোভাবে দেখলেন তিনি।ওই ছোট্ট মুখখানটায় কি প্রগাঢ় মায়া।মেয়েটা তার দেখতে একদম ইরার মতোই হয়েছে।ইরার চেহারাটাও এমন মায়ায় পরিপূর্ণ ছিল।সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটা তার রক্ত।তার সন্তান।এই সন্তানকেই কিনা তিনি বলেছিলেন মে’রে ফেলতে।কিভাবে নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে পেরেছিলেন?আজ তার বুকটা বড্ড হাহাকার করছে।আরাবীর মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু তা যে অসম্ভব। শামিম সাহেবের বুকে ব্যথাটা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে।এতো এতো মানুষের ঘৃনিত দৃষ্টি তিনি নিতে পারছেন নাহ।পারছেন না তিনি।
_____________
জায়ান তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তমা স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে জায়ান।আরাবীর কাছে গিয়ে ওর নরম গালজোড়া স্পর্শ করল।আরাবী নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল।ওই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই কলিজাটা ধ্বক করে উঠল জায়ান।আরাবীকে এই অবস্থায় কোনোদিন দেখেনি জায়ান।এতো নির্বিঘ্ন, অনুভুতিশূন্য আর নিষ্প্রাণ হয়ে থাকার মতো মেয়ে তো আরাবী না।তবে আজ কেন ও এইভাবে আছে?মেয়েটা কি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেল?কিন্তু জায়ান তো চায় আরাবী কাঁদুক।কেঁদে কেঁদে ওর বুক ভাসিয়ে দিক।কেঁদে নিলে মনটা হালকা হয়।কিন্তু এমন নিষ্প্রাণ হয়ে থাকলে তো মেয়েটা ভীতরে ভীতরে গুমরে ম’রে যাবে।জায়ান শুকনো ঢোক গিলল।নরম গলায় বলে,’ কি হয়েছে আরাবী?’
‘ কোথায় কি হয়েছে?’ আরাবীর শীতল কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠল জায়ানের।জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
‘ কিছু বলছ না কেন?’
‘ কিছু কি বলার ছিল আমার জায়ান?’
জায়ান অবাক হচ্ছে আরাবীর এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে।আরাবী ফের বলে,’ আমার ভালো লাগছে না জায়ান।আমি রুমে যাচ্ছি।এই তামাশা শেষ হলে আপনিও এসে পরুন জলদি। ‘
এই বলে আরাবী ধীরে কদম বাড়াল কক্ষের যাওয়ার জন্যে।সিড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় মাথা ঘুরে উঠল আরাবীর।তাও নিজেকে সামলে নিল।জায়ান আরাবীর টালমাটাল পরিস্থিতি দেখে দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।এদিকে আরাবী দু ধাপ সিড়ি না পেরোতেই আবারও ওর মাথা ঘুরে উঠল।এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না আরাবী।শরীরের ভাড় ছেড়ে দিতেই ঝুকে গিয়ে বারি খায় সিড়ির রেলিংয়ে।নিচে গড়িয়ে পরার আগেই জায়ান দ্রুত আরাবীকে টেনে নিজের বুকে আগলে নেয়।আরাবীকে বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরে সিড়িতেই বসে পরে জায়ান।তারপর আরাবীর গালে হালকা চর মেরে অনবরত ডেকে চলেছে সে,’ আরাবী?আরাবী কি হলো তোমার?চোখ খুলো আরাবী?’
ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীকে এমন অবস্থায় দেখে দ্রুত এগিয়ে যান।ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন,’ জায়ান। তুমি দ্রুত আরাবীকে রুমে নিয়ে চলো।আমি দেখছি ওর চেক-আপ করে।চলো বাবা।’
জায়ান ডা.রোজির কথা শুনে দ্রুত আরাবীকে কোলে তুলে নিল।ডা.রোজি আবার বলে,’ ইফতি তুই যা জায়ানের গাড়ি থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়।’
‘ হ্যা আন্টি যাচ্ছি।’
ইফতি ছুটে চলে গেল বাহিরে।জায়ান আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।আরাবীকে নিয়ে রুমে চলে গেল।রুমে এসেই বিছানায় সুইয়ে দিল আরাবীকে।ততক্ষনে ইফতি ব্যাগ নিয়ে এসেছে।ছেলেটা হাপাচ্ছে।যেই জোড়ে দৌড়ে গিয়েছে আর এসেছে।জায়ান আরাবীর হাত ধরে বসল বিছানার পাশে।চিন্তায় ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।অস্থির কণ্ঠে ও বলে উঠল,’ আন্টি?ও এইভাবে সেন্সল্যাস হলো কেন? কোন খারাপ কিছু হবে না-কি আন্টি?ওর মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে আন্টি। দ্রুত রক্ত থামান।’
ডা.রোজি জায়ানকে শান্ত হতে বললেন।তারপর ব্যস্ত হাতে আরাবীর মাথায় আঘাতের জায়গা পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।এরপর ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে আরাবীর চেক-আপ করতে লাগল। চেক-আপ শেষ হতেই জায়ান অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে আন্টি?খারাপ কিছু?ওর জ্ঞান ফিরছে না কেন?কিছু বলছেন না কেন আন্টি?’
ডা.রোজি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ প্রেসার লো আরাবীর।রক্তশূন্যতাও আছে।আর হঠাৎ করে মানষিকভাবে আঘাত পাওয়ার কারনেই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।’
জায়ানের চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেল।ডা.রোজির আবারও একটা কথায় যেন কলিজা শুকিয়ে আসল ওর।তিনি বলেন,’ এইগুলো ছোটো ছোটো কারন বললাম। এর থেকেও বড় কারন আছে।ওর এইভাবে অসুস্থ হওয়ার পিছনে।’
জায়ান কাঁপা গলায় বলে,’ কি হয়েছে আন্টি?কি এমন কারন?’
হঠাৎ ডা. হোসনে আরা রোজি মুঁচকি হাসলেন।হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ আরাবী মা হতে চলেছে জায়ান।আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় কারন।ইউ টু আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস।’
#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।